স্বপন কুমার সিকদার : (সকল বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এই লিখার মূল উদ্দেশ্য। এই লিখায় যদি কোনভাবে সেন্টিমেন্টে আঘাত লাগার মতো কিছু বুঝায়, তার জন্য ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি কামনা করছি।)

২০ শে জুন ‘বাবা দিবস’। পৃথিবীর সকল ধর্মেই বাবাকে বিশেষ গুরুত্ব ও সম্মান দেওয়া হয়েছে। পবিত্র ইসলাম ধর্মে মাতা-পিতাকে অতি উচ্চ অধিকার ও সম্মান দিয়েছে। পবিত্র ইসলামের বিধানমতে, আল্লাহ তাআলার পরেই মাতা-পিতার স্থান। এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে বলা হয়েছে, “তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে এবং মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে”। পবিত্র ইসলাম ধর্মে উল্লেখ আছে- “হে আমাদের পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম করুন; যেমনিভাবে তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন”। পবিত্র হাদিসে ঘোষণা করা হয়েছে- “বাবা-মা’র সন্তুষ্টিতেই রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর তাদের অসন্তুষ্টিতে রয়েছে আল্লাহর অসন্তুষ্টি”।
পবিত্র সনাতন ধর্মে বাবার একটি বিশেষ স্থান আছে। উপনিষদে যা বলা হয়েছে তার মর্মাথ করলে অনেকটা নিম্নরুপ দাঁড়ায় – ‘পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম এবং পিতা পরম তপস্যার। পিতা তুষ্ঠ হলে, সকল দেবতা তুষ্ঠ হন’। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- “পৃথিবীর চেয়ে ভারী হলো মাতা, স্বর্গের চেয়ে উঁচু হলো পিতা”।

বাবাকে নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ যা বলেছেন তা হলো-
“বাবার চেয়ে যদি কেউ বাসে বেশি ভালো, জেনো তা ধোঁকা
মায়ের চেয়ে যদি কাউকে লাগে বেশি আপন, তাহলে তুমি বোকা”।

পবিত্র খৃষ্টান ধর্মে শিক্ষা দেওয়া হয় ছেলে-মেয়েরা যেন পিতা-মাতার সাথে সম্মান জনক আচরণ করে। তারা যেন পিতা-মাতার বাধ্য হয় এবং উনাদের ইচ্ছা পূরণ করে। পবিত্র বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকে বলা হয়েছে “মাতাপিতার সেবা করাই সবচেয়ে উত্তম”।

পৃথিবীর সব চেয়ে বড় সুখ হলো মা-বাবার আদর। আর অমূল্য রতন হলো মা-বাবার ভালোবাসা। বাবা সন্তানের জন্য শ্রেষ্ঠ বন্ধু ও উত্তম পথপ্রদর্শক। বাবার অপরিসীম স্নেহ ও মায়া-মমতার কথা কবি গুরু প্রকাশ করেছেন এই ভাবে –
“মেলা বসবে গাজনতলার হাটে,
বাবার নৌকো কত দূরের থেকে
লাগবে এসে বাবুগঞ্জের ঘাটে।
বাবা মনে ভাববে সোজাসুজি,
খোকা তেমনি খোকাই আছে বুঝি,
ছোটো ছোটো রঙিন জামা জুতো
কিনে এনে বলবে আমায় “পরো”।- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রকৃতপক্ষে, বাবা-মা সন্তানের জন্য সেরা আশীর্বাদ। সন্তানের জন্মের পর থেকেই বাবা-মা তাদের বেড়ে ওঠতে সার্বিক দেখা-শুনা করে থাকেন। সন্তানদের উন্নত জীবনের জন্য এবং তাদেরকে সুস্থ, সুন্দর ও ভালো রাখতেই চলে বাবা-মার যত প্রচেষ্টা। বাবাকে নিয়ে এক ছড়াকারের অনুভূতি –

“বাবার কাছেই হাটতে শিখি, শিখি চলা-বলা
সারাটি দিন কাটতো আমার, জড়িয়ে তার গলা।
বাবার হাতেই হাতে খড়ি, প্রথম পড়া-লেখা
বিশ্বটাকে প্রথম আমার, বাবার চোখেই দেখা।
আজকে বাবার চুল পেকেছে, গ্রাস করেছে জ্বরা
তবু বুঝি বাবা থাকলেই, লাগে ভুবন ভরা”। সঞ্জয় সরকার
বাবাকে নিয়ে সন্তানের মনোমুগ্ধকর স্মৃতিচারণ –
“এখনো মনে পড়ে-
ছোট্ট বেলায় হাত ধরে রাতের নিস্তব্ধতায় নির্মেঘ আকাশের
দিকে তাকিয়ে বলেছিলে,
ওটা শুকতারা, ওটা ধ্রæবতারা, আর ঐযে ঐখানে
তারাদের গাঁথুনি দেয়া যেটা দেখতে পাচ্ছ ঐটাই “আদম সুরত কাল পুরুষ”- এইচ বি রিতা
বাবার তুলনাহীন মমত্ববোধ ও ভালোবাসা উঠে এসেছে নিন্মের কাব্য কথায়ও –
“বাবরের মতো পিতৃস্নেহে, কতরাত তুমি জেগেছ শিয়রে
দেখেছি তোমার উদ্বিগ্ন আঁখি, চোখ মেলে নির্ঘুম রাতে”। – সান্তনু পাল
সন্তানের প্রতি অপরিসীম ও অকৃত্রিম স্নেহ ও আদরের প্রকাশ কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় – “ভোর হলো দোর খোল, খুকুমণি ওঠো রে
ঐ ডাকে জুঁই শাঁখে, ফুল খুকি ছোট রে”।

বাবা সব সময় সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন যা সন্তানেরও কামনা ও বিশ্বাস যা বিশ্ব কবির লেখনীতে আরও পরিস্ফুষ্ট হয়েছে- “শোনো শোনো পিতা
কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা”। – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমাদের বাবা স্বর্গীয় শচীন্দ্র সিকদার ছিলেন একজন সরকারি কর্মচারী। উনি এলাকায় শিক্ষার আলোক বর্তিকা জ্বেলেছিলেন বা শিক্ষার প্রসার ঘটায়ে ছিলেন বলে তখন আমাদের বয়সী সবার কছে উনি ছিলেন ‘মাষ্টারমামা’ এবং বাবার বয়সী সবার কাছে এক নামে পরিচিত ছিলেন ‘মাষ্টারদা’ হিসাবে। আমার শিক্ষায় বিশেষ করে ইংরেজির গোড়া পত্তন করেন বাবাই। উনার ছাত্র কেউ কেউ বিভিন্ন পর্যায়ে বা সরকারের উচ্চ পদে কর্মরত ছিলেন। বিগত স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করায়, অনেক মূল্যবান স্মৃতি নষ্ঠ হয়ে যায়। ফলে বাবার কোন ছবি উপস্থাপন করা গেল না। তবে বাবার মুখের আদলের সাথে কিছুটা মিলে বাবার মামা (একই গোষ্টি ভুক্ত) স্বর্গীয় স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজের যার ছবি সম্মানিত পাঠকের জন্য উপস্থাপন করা হলো। স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ একজন অদ্বৈতবাদী সাধক ছিলেন। রুপের মাঝে তিনি অরুপকে দেখেছিলেন। চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থল তুলসীধাম, নন্দন কাননে উনার বিরাট আশ্রম, মন্দির ও সমাধি আছে।
বাবার নামে গ্রামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামকরণ হয়েছে, স্কুলের সাথে সংযোগকারী রাস্তাটির নামও স্কুলের নামে হয়েছে, পুকুরে স্নানঘরসহ একটি আধুনিক পাকা ঘাট প্রধানতঃ আরসিসি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে যা বাবার নামে উৎসর্গীত ও সর্বসাধারনের ব্যবহারের জন্য নিবেদিত, মা ও বাবার নামে একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের নামকরণও হয়েছে যার ফলে মানুষ উপকৃত হচ্ছে।

স্বর্গীয় বাবার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্যে আমরা বাবার স্মৃতি সৌধও নির্মাণ করেছি।
বাবা-মা সন্তানের সুখের জন্য নিজের সুখকে বিসর্জন দেন। অথচ, কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায়, সন্তান বড় হয়ে বাবা-মার খোঁজ খবর রাখে না, তাদের মুখে হাসি ফোটাতে কোনো চেষ্টাই করে না বা মা-বাবার স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রমে। যে বাবা-মা তাদের যৌবনের সব সুখ-স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছেন সন্তানের অকৃত্রিম স্নেহ, মমতা ও প্রতিপালনে, আর সেই সন্তানেরই অনাদর-অবহেলায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয় অনেক বাবা-মাকে। বাবা-মা কখনো সন্তানের কাছে টাকা-পয়সা, বিলাসিতা কিংবা অসাধ্য বা দুষ্প্রাপ্য কোনো কিছুই চান না। উনারা যা চান তা হলো সন্তানের সঙ্গ, ভালোবাসা ও তত্ত্বাবধান। পৃথিবীর সব মানুষের প্রতি আহ্বান, যাদের বাবা-মা জীবিত আছেন, তাদের প্রতি যেন যথাযথ দায়িত্ব পালন করা হয় এবং যাদের বাবা মা পরলোক গমন করেছেন তাদের জন্য যেন সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা হয়। চলুন আমরা আমাদের সর্বোচ্চ শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে মা-বাবার সেবা করি ও পরম করুনাময়ের কাছে উনাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি। কোন মা-বাবার ঠিকানা যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয়। পৃথিবীর সব বাবার প্রতি রইল আমার অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। জয় ‘বাবা দিবস’। ধন্যবাদ।