ফরিদুর রহমান : মার্কোস তার মাইক্রোবাস নিয়ে হাজির হলে হোটেলে চেক-আউট করে বেরিয়ে পড়লাম। এথেন্স শহরের গলিঘুঁচি নিশ্চয়ই মার্কোসের নখের ডগায়। অপ্রশস্ত পথে ডাইনে ঢুকে বাঁয়ে বেরিয়ে পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যেই সে বড় রাস্তায় একটা হোটেলের সামনে দাঁড়ালো। প্রধান সড়কে জনসমাগম বেড়েছে, কাজেই বেশিক্ষণ দাঁড়াবার উপায় ছিল না। তিনজন নতুন অতিথি তাদের ব্যাগ বোচকাসহ উঠে বসার পরপরই আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। তিন সহযাত্রীর মধ্যে সদালাপী হাস্যোজ্জ্বল বেশ লম্বা চওড়া জোসে প্লাজা তাঁর নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি কিন্তু আসলে ফিল্মমেকার নই, আমার স্ত্রী শিশু চলচ্চিত্র নির্মাতা লোলা ফার্নান্দাজের সঙ্গ দিতে এসেছি আর আমাদের তৃতীয় ব্যক্তি আলবার্তো একজন এ্যানিমেটর এবং স্পেশাল ইফেক্টের দক্ষ শিক্ষকও বটে! দুজনেই হেসে হসে ‘ওলা ওলা, কোমো এস্তা?’ সম্ভাষণ জানাবার ফলে ধারণা হলো এরা সকলেই স্প্যানিশ।

আমার সামান্য স্প্যানিশ বিদ্যা দিয়ে উত্তর দিলাম. ‘এস্তা মুই বিয়েন।’ স্প্যানিশে আমার ‘কেমন আছেন?’ ‘খুব ভালো আছি’ শুনে ওরা বোধহয় ধরেই নিয়েছিল আমি ওদের ভাষাটা মোটামুটি ভালোই জানি। জোসে প্লাজা জোশের সাথে স্প্যানিশে কথা শুরু করলে বলতেই হলো, ‘লো সিয়েন্তা। ইয়ো নো আবলো বিয়েন স্প্যানিয়োল। … দুঃখিত আমি ভালো স্প্যানিশ জানি না।’এবারে একটু ক্ষ্যান্ত দিয়ে জোসে বললো, ‘আমার ইংরেজির চেয়ে তোমার স্প্যানিশ ভালো।’ বললাম, ‘আমার স্প্যানিশ দু চার বাক্যের পরেই শেষ। কথা চালিয়ে যেতে হলে ইংরেজিই ভরসা।’ এরপরে নিজের নাম সংক্ষিপ্ত করে বললো, ‘আমাকে তুমি পেপে বলতে পারো।’ নাম শুনে প্রায় হেসে ফেলেছিলাম, তারপর হাসি চেপে বললাম, ‘আমাদের দেশে সবারই একটা ডাক নাম থাকে। তোমাদের সবারও কি এমন সংক্ষিপ্ত নাম আছে?’ বললো, ‘না। লোলা ইজ লোলা এবং আলবার্তো কেবলই আলবার্তো।’

আমাদের গন্তব্য আবার সেই এয়ারপোর্ট! এর আগে আরো কয়েকবার অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যোগ দেয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এরপর কী কী ঘটনা ঘটবে সে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে দিলো। ফিল্ম ডিরেক্টার, গেস্ট এবং বিদেশি জুরিসহ ফেস্টিভ্যালে যোগ দিতে আসা প্রায় সকলেই বিভিন্ন ফাইটে দুপুরের মধ্যে এথেন্সে নেমে পড়বেন। লিটো নামের একটি মেয়ে সবাইকে একত্রিত করে একটা বড় বাসে তুলে দিলে আমরা পিরগস রওনা দেবো।

এয়ারপোর্টে পৌঁছেই দেখা হলো লিটো থিওডিসিওর সাথে। লিটোকে দেখে তার বয়স অনুমান করা কঠিন। মনে হলো একটি অতি চঞ্চল কিশোরী এদিক থেকে ওদিকে ছুটে বেড়িয়ে অতিথি ব্যবস্থাপনার পুরো দায়িত্ব একাই সামলাচ্ছে। গ্রিক স্প্যানিশ এবং ইংরেজিতে যাকে যেমন প্রয়োজন সেই ভাষায় স্বাগত জানিয়ে কুশল বিনিময় করেই আবার পরবর্তী ফাইটের খোঁজ নিতে ছুটে যাচ্ছে। পেপে আমার সাথে লিটোর পরিচয় করিয়ে দিতেই বললো, ‘তুমিই বোধহয় সবচেয়ে দূরের দেশ থেকে এসেছে, নিশ্চয়ই খুব কান্ত! আর একটা ফাইট কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়লেই আমরা যাত্রা শুরু করবো, বাকি সবাই প্রায় এসে গেছে।’ বললাম, ‘আমার কোনো সমস্যা নেই। তোমার ব্যস্ত হতে হবে না।’

আলবার্তো এবং লোলার মাঝে লিটো

ইতিমধ্যেই স্পেন থেকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক-উপস্থাপিকা, বুলগেরিয়া থেকে এক প্রামাণ্যচিত্র নির্মার্তা দম্পতি এবং বলকানের কয়েকটি দেশ থেকে কয়েকজন তরুণ ফিল্ম মেকার এসে পড়েছেন। তুরস্ক থেকে জুরিদের একজন এসে গেলেও আমরা সম্ভবত আরো একজন জুরির আগমনের অপেক্ষায় ছিলাম। এখানে অনেকেই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে রোদে দাঁড়িয়ে গল্প গুজবে মেতে উঠেছিল। বিশেষ করে তরুণ নির্মাতা এবং অনুষ্ঠানের উপস্থাপকদের অনেকেই পূর্ব পরিচিত বলে মনে হলো। অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল গত বছর কুড়ি ধরে চলছে। কাজেই এখানে অনেকেই একাধিবার এসেছেন। আমার স্প্যনিশ বন্ধুরাও দেখলাম বেশ কয়েকজনজন মিলে তুমুল আড্ডার অনিবার্য বহিপ্রকাশ হিসাবে মুহূর্মূহু উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠছেন। আমি কাছাকাছি থাকলেও ভাষা বিভ্রাটের কারণে এইসব আলোচনার আনন্দ কোলাহলের রস থেকে বঞ্চিত হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। পেপে সম্ভবত আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরে বললো, ‘চলো সামনে থেকে বরং একটু সামনে থেকে ঘুরে আসি।’ আমরা এয়ারপোর্টের বহিরাগমন লাউঞ্জের দিকে এগিয়ে যাবার কিছু পরেই লিটো সর্বশেষ অতিথি দুজনকে নিয়ে বেরিয়ে এলো।

কুড়ি বাইশজন যাত্রী নিয়ে বেশ বড় একটি বাস গ্রিসের এ-সেভেন হাইওয়ে ধরে ধরে ছুটে চললো। আমার দেখা ইউরোপের অনান্য দেশের থেকে গ্রিসের ভূপ্রকৃতি ভিন্ন। জার্মানির দীর্ঘ ফসলের মাঠ এবং বনাঞ্চলের সবুজ বিস্তার, নেদারল্যান্ডসের উইন্ডমিল বা ফুলের সমারোহ কিংবা ইতালির উঁচু নিচু ঢেউ খেলানো ভূখণ্ডে মাইলের পর মাইল সবুজ ঝোপঝাড় নেই। এখানে একপাশে রু² পাথুরে জমি বিস্তৃত হতে হতে দূরে এক সময় পাহাড়ে মিশেছে। স্তরে স্তরে সাজানো সেই পাহাড়গুলোও আবার মিশে গেছে আকাশে জমে থাকা মেঘের সাথে। রাস্তার এক পাশের প্রকৃতিতে পাহাড় এবং ঊষর পাথুরে মাটির দেখা পেলেও অন্য পাশে নীল সমুদ্র মাঝে মাঝেই দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়। কোথাও কোথাও দূর পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট শহর দেখা দেয় আবার কোথাও আমরাই ছোট বড় শহরের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাই।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক একটানা চলার পরে মেগালোপলিস শহরের কাছাকাছি হাইওয়ের পাশে বিরতির সময় হলে বিশাল বাসটা সুড়সুড় করে নিচের দিকে একটা বাধানো চত্বরে নেমে এলো। বেশ বড় চত্বর ঘিরে কান্ট্রি বার্গার, ট্রাভেল ব্রেক এবং গ্রিক নামের আরো গোটা দুয়েক রেস্টুরেন্ট। লিটোর নির্দেশনা অনুসারে আমরা যেখানে ঢুকলাম সেখানে চেয়ার টেবিলগুলো আমাদের অপেক্ষায় হাপিত্যেশ করে বসে ছিল। বিশাল রেস্টুরেন্টে আমরা ছাড়া আর কোনো জনপ্রাণি নেই। প্রায় প্রত্যেক টেবিলেই দু চারজন করে বা কমপক্ষে একজোড়া সিনেমার মানুষ থাকলেও আমি একা এককাপ কফি নিয়ে স্বচ্ছ কাচের দেয়ালের পাশে একটা টেবিলে বসলাম। বাইরেটা এখান থেকে বেশ দেখা যায়। দূরে পাহাড়ের মাথায় আকাশে মেঘ জমেছে, যে কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। আমরা অবশ্য মিনিট কুড়ির মধ্যেই বাসে উঠে পড়ালাম। এখান থেকে পিরগস আরও ঘণ্টা দেড়েকের পথ। এথেন্স থেকে পিরগসের দূরত্ব ২৯৩ কিলোমিটার, হিসাব অনুসারে তিন ঘণ্টায় অর্থাত বিকেল পাঁচটার মধ্যে পৌঁছে যাবার কথা। কিন্তু রেস্টুরেন্টে বিরতি দিয়ে ধিরে সুস্থে বেরিয়ে সাড়ে পাঁচটার আগে পৌঁছাতে পারবো মনে হলো না। সন্ধ্যা ছয়টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, কিন্তু পথের এই ধির গতির ব্যাপারে কারো মধ্যে কোনো তাড়াহুড়ো লক্ষ করা গেল না।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

মেগালোপলিস নগরীতেও প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। আসলে পুরো দেশটাই প্রত্নতাত্তি¡ক নগরী বললে বোধহয় বাড়িয়ে বলা হয় না। তবে আমরা তো পর্যটক হিসাবে সফর করতে আসিনি। প্রত্যেকের মাথায় ঘুরছে ফিল্মের রিল, চোখের সামনে প্রতি মুহূর্তেই বদলে যাচ্ছে ফ্রেম এবং কম্পোজিশন। বাইরে ক্ষণে ক্ষণেই চোখে পড়ছে আলোর পরিবর্তন। হঠাত করেই ঢুকে পড়লাম পাহাড়ের ভেতরের টানেলে। অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে জ্বলছে হলুদ টাংস্টেন বাতি। পরপর এমনি কয়েকটা সুড়ঙ্গ পথ পেরিয়ে বাঁ দিকে বহু দূর পর্যন্ত সমুদ্র আমাদের সাথে সাথেই চললো। বৃষ্টি না এলেও আকাশের মন খারাপ করা ভাবটা থেকেই গেল। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে পিরগস শহরের একেবারে কেন্দ্রে এসে দাঁড়াল আমাদের বাস। সিটি সেন্টার বলতে যেমন বিশাল চত্বর, যান বাহনের ছোটাছুটি, অসংখ্য মানুষের চলাচলে ব্যস্ত ফুটপাথ, বিপনি বিতানে কেনাকাটার ভিড়, কোনোটাই নেই। হয়তো শনিবার বিকেল বলেই শহরটা ঝিম ধরে আছে।

বাস থেকে নামার পরে লিটো তালিকা মিলিয়ে বেশিরভাগ অতিথিকে বাঁ দিকে এবং অল্প কয়েকজনসহ আমাকে ডান দিকে হোটেল অলিম্পাসে পাঠিয়ে দিল। হয়তো একই হোটেলে সবার স্থান সঙ্কুলান হবে না বলেই এই ব্যবস্থা। চিরদিনের বামপন্থী আমি জনাতিনেক অপরিচিত চলচ্চিত্র প্রেমিকের সাথে অলিম্পাসে উঠে পড়লাম। ভাবলাম একদিক থেকে ভালোই হয়েছে, অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এসে অলিম্পাস হোটেলে থাকাটাই ঠিক। কিন্তু ছয়টার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাবো কেমন করে! লিটো কিছু একটা বলে দিয়েছিল নিশ্চয়ই কিন্তু তখন খেয়াল করে শুনিনি। আমার সহযাত্রীদের সবাই নতুন, কারোরই এ্যাপোলো থিয়েটার চেনা নেই। হোটেলে চেক-ইনের সময় কাউন্টারে জিজ্ঞেস করলাম। দেঁড়েল রিসেপশনিস্ট সোজা পথ দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘ভেরি ইজি, গো স্ট্রেইট!’ বললাম, ‘তোমার কাছে যেটা সোজা আমার কাছে সেটাই কঠিন। আমি পিরগসে তো দূরের কথা, আমার পূর্বপুরুদের কেউ গ্রিসের মাটিতে কখনো পা রাখেনি।’ সে বিরক্ত হলো না খুশি হলো বুঝলাম না। তবে এবারে সে কাউন্টার ছেড়ে বাইরে এসে সামনের রাস্তা দেখিয়ে দিল। ‘এই ফুটপাথ ধরে পাঁচ থেকে ছয় মিনিট হেঁটে বাঁয়ে ঘুরে গেলেই দেখবে এ্যাপেলো থিয়েটার। একটু সামনে রাস্তার ডাইনে অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের গেট। ইট উইল টেক ফাইভ টু সিক্স মিনিটস। আর যদি দশ মিনিটেও তুমি পৌঁছাতে না পারো, তাহলে ফিরে এসো, আমি একটা ট্যাক্সি ডেকে দেবো।’

এরপরে আর কোনো কথা চলে না। আমি তিনতলায় নিজের ঘরে পৌঁছে যতোটা তাড়াতাড়ি সম্ভব তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলাম। ভেবেছিলাম উদ্বোধনী অনুষঠানে যাবার জন্য সঙ্গী সাথী কাউকে পাওয়া যাবে। এদিকে প্রায় ছয়টা বাজতে চলেছে। কাজেই আর কারো জন্যে অপেক্ষা না করে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। সত্যিই মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরে আর এ্যাপোলো থিয়েটার খুঁজে বের করতে হলো না। পোস্টার, ফেস্টুন এবং ব্যানারে সাজানো থিয়েটার প্রাঙ্গণের উত্সব উত্সব ভাব চোখে না পড়ে কোনো উপায় নেই। চারিদিকে তাকিয়ে পরিচিত কোনো মুখই দেখতে পাই না। বাইরে বিশাল বোর্ডে দুটি ভাস্কর্যের মাঝখানে ফেস্টিভ্যালের দিন তারিখ এবং নিচে কয়েক সারিতে স্পন্সরদের নাম শোভা পাচ্ছে। অনেকেই বাইরে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। ফেস্টিভ্যালের কর্মকর্তা এবং স্বেচ্ছাসেবকরা গলায় পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে ব্যস্ততার সাথে এদিক সেদিক ছুটছেন। ঠিক ছয়টায় আমি হলের ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

পিরগসের পথে

গ্রিসের একটি ছোট শহরের পুরোনো থিয়েটার হল যার নামই প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে সেটি কেমন হতে পারে! শেক্সপিয়র যুগের গ্লোব থিয়েটারে আদলে তৈরি এই নিওকাসিক ভবনের দোতলার তিন দিক ঘিরে ব্যালকনি দেখেই বোঝা যায় এখানে এক সময় নাটকের প্রদর্শনী হতো। হয়তো পরবর্তী সময়ে ব্যবহৃত হয়েছে সিনেমা হল হিসাবে আর এখন পিরগসের প্রায় সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র এ্যাপোলো থিয়েটার। পরে জেনেছি প্রথমবার ১৮৫০ সালে নির্মিত হলেও প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে পুরোটা সংস্কার করে বর্তমান রূপ দেয়া হয়েছে। হলের অভ্যন্তরে মঞ্চে ডিজিটাল ডিসপ্লে এবং আধুনিক এ্যাক্যুইস্টিকসহ সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা থাকলেও এর মঞ্চের সামনের অংশ, প্রবেশপথ এবং লাল রঙের আসনের সারি পুরোনো ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। সোয়া ছয়টা বেজে গেলেও অর্ধেকের বেশি আসন তখন পর্যন্ত খালি। এই ফেস্টিভ্যালে যেহেতু তরুণদের আধিক্য বেশি সেই কারণেই বোধহয় হলের পেছন দিকে পুরো সিটগুলো দখল করে বসে থাকা তরুণ তরুণীদের .কথাবার্তা, হৈচৈ এবং আনন্দ কোলাহল একটু বেশি। সামনের দিকের দু সারির আসন প্রায় পুরোটাই খালি। কিন্তু কোথাও বসার ব্যাপারে ঈসায়ি না হয়েও আমি যিশুখ্রিস্টের বাণী অনুসরণ করে চলি। যিশু বলেছেন, এমন কোথাও বসো না, যেখান থেকে তোমাকে উঠে যেতে হয়। অতএব আমি মঞ্চ থেকে দুই সারি পেছনে অর্থাত তৃতীয় সারির বাঁদিকের একটা কোনায় বসে ভেতরের প্রস্তুতি দেখতে থাকি। সাড়ে ছয়টার দিকে দীঘল কেশের এক গ্রিক তরুণী ডানদিকের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে প্রায় নিশ্চিত হয়েই আমার কাছে এগিয়ে আসে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘আমি মান্দি, মান্দি আরগিরোপৌলো। তুমি নিশ্চয়ই রহমান, বাংলাদেশ থেকে!’

‘তোমার ধারণা ঠিক। কিন্তু চিনলে কেমন করে?’ আমি উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম।
‘তোমার পাঠানো প্রেস মেটেরিয়ালে ছবি না দেখলেও তোমাকে চিনতে পারতাম। এশিয়ান চেহারার তো আর কেউ নেই।’ মান্দি এতো নরম গলায় এতাটা আন্তরিকভাবে কথা বলছিলো, যেন পুরোনো পরিচিত কারো সাথে অনেকদিন পরে দেখা হয়েছে।
মান্দির সাথে বাইরে বেরিয়ে এলাম। হলের বাইরে লোকজনের ভিড় বেড়েছে। অনেকের হাতেই কফির কাপ অথবা জুসের বোতল। গ্রিনরুমের প্রবেশের পথে টেবিলে সাজানো কমলার জুসের সারি থেকে একটা বোতল আমার হাতে তুলে দিয়ে বললো, ‘বিশিষ্ট অতিথিদের অনেকেই এখনো এসে পৌঁছায়নি, অনুষ্ঠান শুরু হতে একটু দেরি হবে।’
আমি বোতলটা হাতে নিয়ে দেখলাম, না এটা রাস্তা থেকে কুড়ানো কমলার জুস নয়, বোতলগুলো সিল করা। বাইরে ফেস্টিভ্যাল সংশ্লিষ্ট আরো কয়েকজনের সাথে মান্দি পরিচয় করিয়ে দিলেও দ্রুত তাদের নাম ভুলে গেলাম। কিছু পরে প্রধান অতিথি গ্রিসের পশ্চিমাঞ্চলীয় উপাধ্যক্ষ গিওরগস গিওরোগিওপুলাস, বিশেষ অতিথি শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী দিমিত্রিসপাবেন্ডা ভালাকিস এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব প্রত্নতত্ত¡বিদ মারিয়া ভন্ডাজাকিসহ গণ্যমাণ্য অতিথিদের আগমনের পরপরই সকলেই একে একে প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে পড়লেন। পুরো হলের সবগুলো আসন কানায় কানায় পূর্ণ হবার পরেও ফেস্টিভ্যালের সাথে যুক্ত স্থানীয় কর্মকর্তা এবং ভলান্টিয়ারদের অনেকেই দরজাগুলোর পাশে এবং দুপাশের চলাচলের পথে দাঁড়িয়ে গেল। নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা পরে সাতটার দিকে শুরু হলো অনুষ্ঠান। আমি একটু অবাক হলেও পরবর্তী সময়ে দেখেছি গ্রিকদের মধ্যে বাঙালিদের মতো একটু ঢিলেঢালা ভাব আছে।

ডিজিটাল ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে রঙিন আলোর বন্যা এবং অসাধারণ গ্রিক আবহ সঙ্গীতের সুর ছড়িয়ে মঞ্চে জায়গা করে নিলো আমাদের সাথে এথেন্স থেকে আসা দুই স্প্যানিশ প্রেজেন্টার ইনাকি লামুয়া এবং মেরিনা মুনেজ। ভাষা না বুঝলেও এরা দুজন যে স্প্যানিশে নয়, গ্রিকে কথা বলছেন তা বুঝতে পারছিলাম। অসাধারণ গতিময়তা, নাটকীয় উপস্থাপন এবং চমত্কার বাচনভঙ্গির কারণে না বুঝেও উপভোগ করছিলাম পুরো অনুষ্ঠান।

উপস্থিত দর্শকের প্রতিক্রিয়া দেখে ধরে নেয়া যায় ওদের কথায় হাস্যরসেরও কমতি ছিল না। স্থানীয় দুজন উপস্থাপক মাঝে মাঝে উপস্থিত হয়ে তরজমা করে বুঝতে সাহায্য করছিলেন। গানে গিটারে অপেরার পরিবেশনায় এবং ঘনঘন করতালিতে জমে উঠলো অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। (চলবে…)