ফরিদুর রহমান : এথেন্স আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের একটা লম্বা চওড়া নাম আছে, এলফেথেরিওস ভেনিযেলোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। নামটা মনে রাখা কঠিন এবং তারচেয়ে বেশি কষ্টসাধ্য এর সঠিক উচ্চারণ। আবুধাবি থেকে স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে বারোটার দিকে এয়ারপোর্টে নেমে মনে হলো এতোটা বিস্তৃত এয়ারপোর্টের তুলনায় যাত্রী সংখ্যা নেহায়েতই কম। ট্রলিব্যাগ টেনে প্রায় নির্জন ইমিগ্রেশন কাউন্টারে পৌঁছে রীতিমতো ধাক্কা খেলাম। এখানে কি কোনো সিনেমা বা টিভি সিরিয়ালের শ্যুটিং চলছে! কিন্তু আশেপাশে কোথাও তো লাইট-ক্যামেরা-এ্যাকশন নেই। তাহলে ডেস্কে বসা ইমিগ্রেশন অফিসার, পোশাকধারী নারী পুলিশ, এমন কি যে মেয়েটি আমাকে কোন কাউন্টারে দাঁড়াতে হবে দেখিয়ে দেবার জন্যে এগিয়ে এলো, প্রত্যেকেই ইউনিফর্ম পরা সুশ্রী সুন্দরী এবং রীতিমতো মেকআপ করা। পাসপোর্ট এগিয়ে দিয়ে আমি যখন লিপস্টিক চর্চিত ঠোঁট আইব্রো টানা চোখ এবং গোলাপি গালের ভাবলেশহীন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার দিকে তাকিয়ে আছি, তখন তিনি যা জিজ্ঞেস করলেন তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘তোমাকে গ্রিসে টেনে এনেছে কে?’ বললাম, ‘আমাকে নিমন্ত্রণ করেছেন অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ডিরেক্টর দিমিট্রিস স্পাইরো। বলা যায় তিনিই আমাকে টেনে এনেছেন।’
‘ওহ! ইউ আর আ ফিল্ম মেকার!’ ভদ্র মহিলার চেহারায় হাসি ফুটে উঠলো। ‘তা বলতেই পারো। আমি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাই।’ আমার কথা শেষ হবার আগেই পাসপোর্টে এন্ট্রি সিল দিয়ে ছেড়ে দিলে আমি ধন্যবাদ জানিয়ে ঢুকে পড়লাম প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র এথেন্সে। জুলাইয়ের শেষ দিকে অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ফর ইয়ং পিপল-এর কোঅর্ডিনেটর মান্দি আরগিরোপৌলো ‘অশ্বারোহী তাসমিনা’র একটি কপি পাঠাবার অনুরোধ জানিয়েছিল। প্রিজনেস ইন্টারন্যাশনালের পুরস্কারের তালিকা দেখে প্রাথমিক নির্বাচনের জন্যে অলিম্পিয়ার পাঠানো ই-মেইল পাবার প্রায় সাথে সাথেই ভিমিওতে থাকা ছবির লিংক পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর অনেকদিন কোনো খবর নেই। অক্টোবরের মাঝামাঝি আবার মান্দির মেইল পেলাম, ‘তাসমিনা দ্য হর্স গার্ল’ প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়েছে, এবারে ছবির প্রোজেকশন কোয়ালিটি কপি এবং প্রেস মেটেরিয়াল ইত্যাদি পাঠাতে হবে।
চাহিদা মতো সবকিছু পাঠিয়ে দেবার কয়েক দিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানিয়ে মেইল পাঠালেন দিমিট্রিস স্পাইরো। পাশাপাশি ফেস্টিভ্যালের সহকারি সমন্বায়ক একটি মেইলে বিনীতভাবে দশদিনের লোকাল হসপিটালিটি ছাড়াও সামান্য পরিমাণে ইওরো নগদ দেবার প্রস্তাব পাঠালেন। হিসাব করে দেখলাম এই সামান্য ইওরো দিয়ে বিমানের একদিকের টিকেট হয়ে যাবে। এ ছাড়াও যদি কোনো টেলিভিশন চ্যানেল ডকুমেন্টারিটি দেখায় তাহলে প্রাপ্ত রয়েলটির সত্তুর শতাংশ আমাদের দেয়া হবে। এরপরে আর না যাবার প্রশ্নই ওঠে না। জানিয়ে দিলাম আমি আসছি। ঢাকায় গ্রিসের কোনো দূতাবাস নেই। ইতালির এ্যাম্বেসিতে আবেদন জমা দিয়ে যথাসময়ে ভিসা হাতে পাবার পরে পহেলা ডিসেম্বরে এক শীতের রাতে ইত্তেহাদ এয়ার লাইন্সের বিমানে উঠে উড়াল দিলাম।
এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে বেরোতেই চোখে পড়লো অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের পোস্টার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মার্কোস! নাম আগেই জেনেছিলাম, পরিচিতির পালা শেষ করে মাইক্রোবাসে উঠে পড়তেই চলতে শুরু করলো মার্কোসের বাহন। জিজ্ঞেস করে জানলাম এবেলা আমিই একমাত্র যাত্রী, বিকেলে এবং রাতে আরো বার দুয়েক তাকে আসতে হবে এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্ট থেকে নগর কেন্দ্র পঁয়ত্রিশ কিলোমিটারের মতো পথ। ইউরোপের অন্য অনেক দেশের মতোই গাড়ি চলছে রাস্তার ডান পাশের লেইন ধরে। তবে পথের মাঝখানে বিশাল রোড ডিভাইডার এবং দেয়ালের বাধা থাকায় উল্টো দিক থেকে আসা যানবাহন তেমন দেখা যায় না। আমরা বাঁ দিকের লেইন ধরে চলা মানুষ, তাই প্রথমবার দক্ষিণ কোরিয়ায় সউল বিমান বন্দর থেকে শহরে যাবার পথে প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিলো উল্টো দিক থেকে আসা রং-সাইডের গাড়িটা বোধহয় এক্ষুণি ধাক্কা দেবে।
শুক্রবার দিন ঢাকার রাস্তায় যানজট থাকে না, কিন্তু তাইবলে শুক্রবার দুপুরে এথেন্সের সড়কে তেমন যানবাহন নেই কেন বুঝলাম না। প্রশস্ত মসৃণ রাস্তা ধরে চলার পথে কিছু স্থাপনা এবং কিছু সবুজ গাছের সারি চোখে পড়ে, কিন্তু আমার দৃষ্টি চলে যায় দূরে। রাস্তা বরাবর সামনে তাকালে গাঢ় সবুজ, কালচে সবুজ, নীল এবং ধূসর রঙের কয়েক স্তরের পাহাড়ের সারি এগিয়ে আসতে থাকে। মার্কোস অভ্যস্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে অনায়াসে একশ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালাবার সাথে সাথে কথাবার্তাও চালিয়ে যায়। সে অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের স্টাফ নয়, তবে সিনেমার প্রতি আগ্রহের কারণে গত কয়েক বছর ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিচালক, প্রযোজক, কলাকুশলী এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে যাওয়া আসার দায়িত্ব পালন করে আসছে।
এথেন্সে এক রাত অবস্থানের জন্যে যে হোটেলে বুক করা ছিল তার নাম বেস্টওয়েস্টার্ন মিউজিয়াম। শুধু বেস্টওয়েস্টার্ন হলে কোনো ক্ষতি ছিল না, কিন্তু মিউজিয়াম কেন! হাজার তিনেক বছর আগের এই প্রত্নতাত্তি¡ক নগরীর সর্বত্রই তো ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের নানা যুগের বিভিন্ন নিদর্শন। জাদুঘর থেকে রূপান্তরিত তেমন কোনো ভুতুড়ে বাড়ির হোটেলে ঢুকিয়ে দেবে না তো? মার্কোসকে সে কথা জিজ্ঞেস করতেই হেসে বললো, ‘তোমার হোটেলটা বলা যায় এথেন্সের ন্যাশনাল আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়ামের গায়ে লাগানো। মিনিট তিনেক হেঁটেই তুমি মিউজিয়ামটা ঘুরে দেখে আসতে পারো।’
শুনে উৎসাহিত হলাম। গ্রিসে পা রাখতেই এ্যাক্রোপলিস না হোক, জাদুঘরে একটা চক্কর দিয়ে আসতে পারাটা কম কিছু নয়। হোটেলে চেক-ইন করেই বেরিয়ে পড়বো ভেবেছিলাম। কিš‘ বেস্টওয়েস্টার্ন মিউজিয়ামে পৌঁছালাম আড়াইটার দিকে। লাঞ্চের পরে রাতজাগার কান্তির সাথে যুক্ত হলো হোটেলের চমৎকার বিছানার আকর্ষণ। ভাবলাম একটু গড়িয়ে নিয়েই ঘুরে আসবো প্রত্নতাত্তি¡ক যাদুঘর। ঘুম ভাঙলো মিউজিয়ামের দরজা বন্ধ হবার আগেই। কিন্তু ভেবে দেখলাম অল্প সময়ের একটা চক্কর দিয়ে আসার চেয়ে সকালে ঘণ্টা তিনেক সময় হাতে নিয়ে যাওয়াই ভালো। তাতে ইওরো দিয়ে কেনা টিকেটের মূল্য কতোটা উসুল হবে জানি না, কিন্তু ধিরে সুস্থে দেখার সময় পাওয়া যাবে। তবে বেলা বারোটায় মার্কোস আমাকে তুলতে আসবে, তার আগেই জাদুঘর থেকে ফিরতে হবে। হোটেলে চেক-আউট করে সঙ্গী সাথীদের আরো কয়েকজনকে তুলে নিয়ে আবার যেতে হবে এয়ারপোর্টে। সকাল এবং দুপুরের ফাইটে আসা সকলকে একত্রিত করে বড় একটা বাসে যাত্রা শুরু হবে ফেস্টিভ্যালের শহর পিরগসের উদ্দেশ্যে।
অপরিচিত শহরে প্রথম দিন শেষ বিকেলে বেশি দূরে যাবো না ভেবেও হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর থেকে ঘুরে এলাম। ইউরোপের অন্য অনেক শহরের মতোই গলিপথে একসারিতে পার্ক করা গাড়ি। বাঁদিকের গলির মাথায় ফাস্টফুডের দোকান আর রাস্তার ওপারে কয়েকটা ব্রান্ডের কাপড়-চোপড়, জামা-জুতার দোকান, ছোটবড় রেস্টুরেন্ট। সবচেয়ে বেশি চোখে লাগে দেয়াল জোড়া নানা রঙের গ্রাফিতি। ভাষা বুঝতে পারি না, তবে মনে হয় সাহিত্য-সংস্কুতি থেকে শুরু করে রাজনীতি পর্যন্ত সবকিছুই প্রকাশ পেয়েছে এই অপরিচিত বর্ণমালায়। খানিকটা এগিয়ে ডাইনের বড় রাস্তায় ট্রাম চলছে। চওড়া ফুটপাথ ফুঁড়ে সবুজ গাছপালা শাখাপ্রাশাখা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে। সড়কদ্বীপে এবং পথের পাশের বসতবাড়ির দেয়াল ঘেষেও চোখে পড়ে সবুজের সমারোহ। সড়ক পথে অনেকটা হাঁটার পরে অনুমানে ডানদিকে ঘুরেই বিস্ময়ের শেষ থাকে না এবং একই সাথে একটা প্রশ্নেরও উত্তর মিলে যায়।
হোটেলের লবি এবং রেস্টুরেন্টের মাঝামাঝি যায়গায় স্ট্যান্ডের উপরে ফলের রস করার জুসারের মতো বড়সড় একটা যন্ত্র এবং পাশেই একটা ঝুড়ি ভরে কমলা রাখা। গ্রিক ভাষার লেখাটা বুঝতে না পারলেও ইংরেজি লেখাটার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘কমলা চিপে রস বের করুন এবং যতো খুশি পান করুন।’ হোটেলে এতো ঔদার্যের কারণ তখন বুঝতে না পারলেও সড়ক দ্বীপে একের পর এক কমলা ঝোপের নিচে সবুজ ঘাসের উপরে অসংখ্য কমলা ছড়িয়ে আছে দেখে মনে হলো, ‘… এই দেশেরই ধুলায় পড়ি কমলা যায় রে গড়াগড়ি…।’ তবে মিউজিয়াম হোটেল যে রোড ডিভাইডার থেকে কমলা কুড়িয়ে নিয়ে যায়নি, সে কথা নিশ্চিন্ত ভাবেই বলা যায়।
সকাল সাড়ে আটটায় মিউজিয়াম হোটেলে নাস্তা শেষ করেই মিউজিয়াম দেখতে বেরিয়ে গেলাম। দিনের শুরুতে একটা চমৎকার নাস্তার পরে প্রত্নতাত্তি¡ক জাদুঘরে পৌঁছে দেখা গেল এখানকার ব্যবস্থাপনা শুধু চমৎকার নয়, অসাধারণ। প্রথমত মিউজিযামে প্রবেশ মূল্য মাত্র পাঁচ ইউরো এবং তারচেয়ে বড় কথা ভেতরে ছবি তুলতে এমনকি ভিডিও ধারণেও কোনো মানা নেই। শুধু ক্যামেরারর ফাশ লাইট এবং কোনো ধরণের কৃত্রিম আলো জ্বালাবার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আছে। আমাদের দেশে এবং আমাদের দেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে কাছের সবচেয়ে ভ্রমণযোগ্য ভারতেও ছবি তোলার ব্যাপারে সর্বত্র নিষেধের সতর্কবাণী আঙুল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একবার মেট্রো স্টেশনে ক্যামেরা বের করে আমরা ঝামেলায় পড়েছিলাম, তাও আইন শৃঙ্খলার কোনো কর্তৃপক্ষ নয় দেশপ্রেমিক এক কমবয়েসী দাদা তেড়ে এসেছিল। ভারত বাংলাদেশের মিউজিয়ামগুলো তো মনে হয় সরকারের সিক্রেট ডকুমেন্টসের ভল্ট!
যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ছবি তুললে ধরেই নেয়া হয় সবাই মিসাইল হামলার প্রস্তুতি শুরু করেছে। মূর্খের দল এখনো জানে না, দৃশ্যমান পৃথিবীর কোনো কিছুই এখন আর গুগলের দৃষ্টির বাইরে নেই।
এথেন্সের এই দুশ বছরের পুরোনো জাদুঘর মাত্র তিন ঘণ্টায়দেখে শেষ করা যাবে না জেনেও বিস্মৃত অতীতের সমৃদ্ধ সংগ্রহের ভেতর দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও তিন থেকে সাড়ে ছয় হাজার বছর আগের প্রাগৈতিহাসিক নিওলিথিক যুগের এবং সতেরশ থেকে তিন হাজার বছর আগের ব্রোঞ্জ যুগের মৃৎপাত্র, টেরাকোটা এবং স্বর্ণালঙ্কারের সংগ্রহ দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই মুখোমুখি হই নতুন নতুন বিস্ময়ের। সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরোনো প্রাগৈতিহাসিক যুগের মোনালিসা নামে খ্যাত আগামেমননের সোনার তৈরি অন্তিম মুখোশের সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ভাবি এই সেই আগামেমনন যিনি ট্রয়ের যুদ্ধে গ্রিকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন, হোমারের ‘ইলিয়াড’, শেক্সপিয়ারের ‘ট্রয়লাস এ্যান্ড ক্রেসিডা’ অথবা মিলোশ ইয়ানশোর ‘ইলেক্ট্রা মাই লাভ’ এর আগামেমনন। স্পার্টায় আবিস্কৃত খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠঅব্দের ব্রোঞ্জের ক্রীড়াবিদ বালিকার দৌড়ের ভঙ্গিমা থেকে খৃষ্টঁ জন্মের শ দড়েক বছর অেেগর হেলেনিক বোঞ্জমূর্তি ‘জকি অফ আর্টেমিসন’ এর সামনে থমকে দাঁড়াই।
আমাদের অশ্বারোহী তাসমিনার বয়সের এক কিশোর ঘোড় সওয়ারের ওরবম বড় আকারের অশ্বমূর্তি!প্রায় চারিদিক ঘিরে থাকা দর্শকের ভিড় একটু হালকা হতেই আমি বিভিন্ন দিক থেকে বেশ কয়েকটি ছবি তুলে ফেললাম।
পরবর্তী ঘণ্টা দুয়েক ধরে দেখে যাই মিশ্র ধাতুর অলঙ্কার ও পাত্র, যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম এবং কীর্তিমানদের মুখাবয়ব। মিশরীয় এবং নিকট প্রাচ্যের ভাস্কর্য, অলঙ্কার ও তৈজসপত্র। সান্তোরিনি এবং থেরা দ্বীপ থেকে সংগৃহীত ফ্রেসকো ছাড়াও শিল্পকর্মের নানা নিদর্শন। বেশিরভাগ ফ্রেসকোর রঙ এখনো নতুনের মতো জ্বলজ্বল করছে। অন্তেষ্টিক্রিয়ায় ব্যবহার করা হতো এমন সব সোনার তৈরি অলঙ্কার এবং পাত্রসহ সমাধি থেকে সংগ্রহ করা অলঙ্কার, পাত্র এবং নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর সম্ভার মনে করিয়ে দেয় মৃতদের জন্যেও কী বিপুল আয়োজন কী অর্থহীন অপচয়! গ্রিসের দেব-দেবী, রাজন্যবর্গ এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষ, অর্থাৎ গ্রিক পুরাণে যাদের নাম উচ্চারিত হয়েছে, সম্ভবত তাদের সবারই প্রমাণ সাইজ, আবক্ষ মূর্তি, নানা ভাবভঙ্গির একক বা সমষ্টিগত, যুদ্ধরত এবং কিছু না হলেও শ্রী মুখের পাথর, ব্রোঞ্জ এবং মিশ্র ধাতুতে নির্মিত অসংখ্য ভাস্কর্য শোভা পাচ্ছে জাদুঘরের একের পর এক কক্ষে।
খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে নির্মিত ভাস্কর্যের অনুসরণে খ্রিষ্ট্রিয় দ্বিতীয় শতকে মার্বেল পাথরে তৈরি আফ্রোদিতির ভাস্কর্যের মতো আরও অনেক সংগ্রহের ব্যাপারে দর্শকের আগ্রহ একটু বেশি। একটি কক্ষে প্রাচীন নৌযান এবং গ্রিকদের সমুদ্র অভিযানের বিভিন্ন স্মারকের পাশাপাশি গ্রিক বীরত্বের সাফল্যগাথার অডিও ভিজ্যুয়ালে প্রদর্শনী চলছে। দৃশ্য এবং শব্দের কুশলী ব্যবহারের মাধ্যমে ভেসে যাচ্ছে বিশাল রণতরী আর সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে জাদুঘরের দেয়ালে।বিশাল পর্দায় গ্রিক মহাকাব্যগুলো থেকে উদ্ধৃতি ভেসে আসছে। একটি বাণীতে উপরে গ্রিক এবং নিচে ইংরেজিতে লেখা ‘…Gods and demons, heroic generation and legendary journeys.’ আমার মনে হয়, এথেন্সের আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম সম্পর্কে এরচেয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না।
মিউজিয়ামের মূল ভবন থেকে বেরিয়ে একটি সংলগ্ন ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্বের শিলালিপি সংগ্রহের সবচেয়ে বড় জাদুঘর এপিগ্রাফিক্যাল মিউজিয়াম। খৃষ্টপূর্ব ৪৮৫ অব্দে লেখা এ্যাক্রোপলিসের পবিত্র আইনসমূহ উৎকীর্ণ করা শিলাখণ্ডের মতো প্রাচীন গ্রিসের লিখিত ইতিহাসের অনেকটাই ধারণ করে আছে এই সংগ্রশালা। অবাক ব্যাপার শিলালিপির এই মিউজিয়াম প্রায় দর্শক শূন্য। বেশ বয়স্ক একজন তত্ত্বাবধায়ক আমাকে দেখে খুশি হলেন। প্রথমে তাঁর নিজর ভাষায় কথা শুরু করেছিলেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না দেখে ভাষা পরিবর্তন করে স্প্যানিশ এবং সব শেসে ভাঙা ইংরেজিতে যা বললেন তার অর্থ হলো, ‘মিউজিয়ামের এই অংশটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানেই লেখা আছে গ্রিসের কয়েকহাজার বছরের পুরোনো ইতিহিাস। কিন্তু সাধারণ ভিজিটাররা সেটা বোঝে না।’ আমার হাতে সময় কম, তবুও বেশ খানিকটা সময় নিয়ে বিভিন্ন আকারের নানা রঙের পাথরের গায়ে খোদাই করে রাখা ইতিহাসের পাতা ছুঁয়ে দেখলাম। আরো অনেক সময় নিয়ে দেখলেও আমার পক্ষে এর একটি বর্ণও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব নয়। কেয়ারটেকার বৃদ্ধের কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে তিনি নিজেই বললেন, ‘এসো এপিগ্রাফিক্যাল মিউজিয়ামে তোমার একটা ছবি তুলে দিই।’
একটি নয়, ক্যামেরা হাতে নিয়ে তিনি বেশ কায়দা করে কয়েকটি ছবি তুলে দিলেন। মানুষ হিসাবে নিঃসন্দেহে তিনি চমৎকার। তবে ছবি তোলা সম্পর্কে তাঁর পারদর্শিতা নিয়ে কোনো কথা না বলাই ভালো। (চলবে…)