ফরিদুর রহমান : ভূমধ্য সাগরের নীল জল ছুঁয়ে দক্ষিণ-পূর্ব সমুদ্র উপকূলে যে বন্দর নগরী, স্পেনের তৃতীয় বৃহত্তম শহর, সেই ভ্যালেনসিয়া থেকে নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। আমার মতো একজন অজ্ঞাত অখ্যাত প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ জানানোর কোনো কারণ ছিল না। কয়েকমাস আগে গ্রিসে অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ঊনিশতম আসরে পরিচয় হয়েছিল লোলা মায়েসো এবং তার সজ্জন স্বামী পেপে প্লাজার সাথে। আমার অশ্বারোহী তাসমিনাকে স্কুল ভিত্তিক শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাতা লোলা মায়েসোর এতো ভালো লেগেছিল, যে সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে দ্রুত সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ভ্যালেন্সিয়া থেকে অফিসিয়াল চিঠি পাঠিয়েছিল। ইংরেজিতে লেখা ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর জোসেফ আরবিয়লের পত্রপাঠ করে ভেবেছিলাম উৎসবের নাম ‘মাইস’, অর্থাৎ ইঁদুর। বাস্তবে দেখা গেল উৎসবের নাম ‘মিছে’ আর ফেস্টিভ্যাল লোগোসহ সবর্ত্র সগৌরবে ছড়িয়ে আছে ইঁদুর নয়, হাতি! তবে নাম মিছে হলেও আমরা সত্যি সত্যিই এক ফেব্রæয়ারি মাসের ১৬ তারিখে মাদ্রিদে এসে নেমে পড়লাম।

মাদ্রিদের বারায়াস বিমান বন্দর থেকে বাইরে বেরিয়েই বিশাল স্বচ্ছ নীল আকাশের নিচে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে হেনা বলে উঠলো এখানে বাতাস কী হালকা! সত্যিই ইওরোপের বেশিরভাগ দেশের বাতাসে এখনও তেমন বায়ু দুষণ নেই, শ্বাস নিতে কোনো কষ্ট করতে হয় হয় না। পরিবেশের মধ্যে নিজেকে ছেড়ে দিলে অনায়াসে বিশুদ্ধ বাতাস ফুসফুসে আসা যাওয়া করে। এয়ার পোর্টের বাইরে বেরিয়ে সামনেই চোখে পড়লো একটি কিম্ভুত কিমাকার ভাস্কর্য। ‘এল রাপতো দে ইউরোপা’ নামের এই ভাস্কর্যে একটি বিশালাকৃতি ষাঁড়ের পিঠে সওয়ার হয়ে আছেন এক নগ্নিকা। অদ্ভুত দর্শন হলেও এটি যখন মাদ্রিদের বারয়াস এয়ারপোর্টের সামনে স্থাপন করা হয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই এর একটা গুরুত্ব আছে ভেবে গোটা কয়েক ছবিও তোলা হলো। খোঁজ নিয়ে জেনেছি ইওরোপের খ্যাতিমান শিল্পী গয়া’র পেইটিং অনুসরণে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছেন একজন কলোম্বিায়ন ভাস্কর। ‘এল রাপতো দে ইওরোপা’র শব্দগত অর্থ ‘ইউরোপ ধর্ষণ’। এক ভাস্কর্য নিয়ে কী বিপদেই না পড়া গেল। আমরা এসেছি ইওরোপ দর্শন করতে, আর শুরু হলো ইওরোপ ধর্ষণ দিয়ে। এবারের ভ্রমণ যাত্রায় কী আছে কপালে কে জানে! তবে ভাস্কর যতই বিখ্যাত হোক এয়ারপোর্টের এক নম্বর টার্মিরানাল থেকে বেরিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয় করে তৈরি ইওরোপের এই বেইজ্জতি দেখতে রাজি নই।

পুয়ের্তা দেলসল

রাতে ঘুম হয়নি একটুও। সৌদি এ্যারাবিয়ান এয়ার লাইন্সের বিমান গভীর রাতে রিয়াদে পৌঁছে আবার ভোর সাড়ে পাঁচটায় ছেড়ে এসেছে। তারপরে আবার আট ঘণ্টা উড়ে মাদ্রিদে পৌঁছেছে দুপুর একটায়। স্বাভাবিকভাবেই যত শিগগিরই সম্ভব গন্তব্যে পৌছবার তাড়া ছিল। গৃহকর্ত্রী সেসেলিয়ার সাথে কয়েক দফা পত্র বিনিময়ের করে ফেব্রæয়ারি ১৬ থেকে ১৯ তারিখের তিন দিনের জন্য মাদ্রিদের প্রায় কেন্দ্রস্থলে কালে যেসাস দেল ভ্যালেতে এয়ার বিএনবি’র অতিথি শালা বুক করে রেখেছিলাম। একেবারে শেষ মুহূর্তে অর্থাৎ ১৫ তারিখ বিকেলে তিনি জানিয়েছেন জরুরি কাজে তাঁকে শহরের বাইরে যেতে হচ্ছে, তবে তাঁর বন্ধু লুনা আমাদের দেখাশোনা করবে। কিন্তু সমস্যা হলো লুনার ওয়ার্কিং-ডে হবার ফলে সে সাড়ে চারটার আগে আগে পৌঁছাতে পারবে না। সেসেলিয়া অবশ্য একটা সহজ সমাধান বাতলে দিয়েছে। আমরা যদি আগেভাগে পৌঁছে যাই, তাহলে তার বাসার উল্টোদিকের কফিশপে বসে দিব্যি সময় কাটাতে পারি।

সবচেয়ে কম খরচে গন্তব্যে পৌঁছবার জন্যে মেট্রো লাইন সম্পর্কে একটা ধারণা সেসেলিয়া দিয়ে দিয়েছিল। তবে সাথে লাগেজ থাকলে বাস ট্রামের ঝামেলায় না করে ট্যাক্সিই সুবিধাজনক মনে হয়। ট্যাক্সিওয়ালাদের সাথে কথা বলে সমস্যা দেখা দিল আমার হোস্টের ঠিকানা কালে যেসাস দেল ভ্যালে কেউই চেনে না। সাথে এয়ারবিএনবির পাঠানো মেইল-এর প্রিন্ট করা কপি ছিল সেটা দেখাতেই হাসি ফুটলো ক্যাব চালকের মুখে। বললো, ‘কাইয়ে ইয়াসুস দেল ভ্যালে?’ তারপার ইশারায় বললো উঠে পড়ো। যিশু খ্রিস্ট নাম বদলে বিদেশে যেসাস ক্রাইস্ট হবেন বলেই ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু স্পেনে তিনি যে ইয়াসুস হয়ে গেছেন তা বুঝতে পারিনি।

ফেদরিকো গার্সয়া লোরকা

এয়ারপোর্ট থেকে ধীরে সুস্থে বেরিয়েছিলাম, তারপরেও চারটার মধ্যেই যিশুখ্রিস্টের সড়কে আমাদের ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম। বাড়ির দরজার সামনে জিনিসপত্র নামিয়ে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে উল্টোদিকের কফিশপে ঢুকবো কি না ভাবতে ভাবতেই মিনটি দশেক পার। এরপর বাকি কুড়ি মিনিট জনবিরল গলিপথে মানুষের আসা যাওয়া দেখেই কেটে যাবে ভেবে শুরু হলো অপেক্ষার পালা। কিন্তু ঘড়িতে সাড়ে চারটা বেজে পার হয়ে যাওয়ার পরেও বিকল্প গৃহকর্ত্রীর দেখা নেই। মিনিট তিনেক পরে গলির মাথায় দেখা গেল প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছেন এক দীর্ঘাঙ্গী তরুণী। কাছে এসে পরিচয় দিয়ে দেরির জন্যে দুঃখ প্রকাশ করলেন বললেন, ‘আমি লুনা। তোমরা নিশ্চয়ই সেসেলিয়ার গেস্ট।’

নাম আগেই জেনেছিলাম। এবারে পরিচিতির সাথে সাথে দরজা খুলে গেল। আমাদের তিন দিনের শয়ন কক্ষ, রান্নাঘর, ড্রইং-ডাইনিং রুম দেখিয়ে দেবার সময় বারবারই নিজের দুর্বল ইংরেজির জন্যে দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমি শেষ পর্যন্ত বললাম, ‘লুনা তোমার ইংরেজি দুর্বল হলেও আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু আমি যদি স্প্যানিশ বলতে শুরু করি তাহলে তোমার বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে।’

বিশ্বের রপ্রাচীনতম রেস্তোরাঁ

বাসা ছেড়ে না গেলেও পরবর্তী তিন দিনের বেশিরভাগ সময় লুনা বাইরেই থেকেছে, আমাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ খুব একটা হয়নি। সেসেলিয়া তার বাড়ির পরিচিতি হিসাবে লিখেছে ‘হ্যাবিতেসিঁয় পিভিডা’ যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় নিজস্ব বাড়ি। ঘরে ঢুকতেই দেয়ালে ‘ওয়েলকাম হোম’ ছাড়াও হাউজ রুল হিসাবে বেশি কিছু নিয়ম নীতি লেখা ছিল। সে সব খুব জটিল কিছু নয়, অতএব আমরা এখানে থেকেছি নিজের বাড়ির মতোই। ঘরটা আগে থেকেই গোছানো ছিল। হোটেল বিজনেসের এ্যাসেনশিয়াল বা অত্যাবশ্যীয় জিনিসপত্র ছাড়াও বৈকালীন চা নাস্তার ব্যবস্থাও ছিল ঘরেই। কাজেই হালকা কিছু খেয়ে একটা ঘুম দেবো ভেবেছিলাম। কিন্তু ঘরের জানালা খুলতেই ঘুম ছুটে গেল। বিকেল বেলার নীল আকাশে জ্বলজ্বল করছে আধখানা চাঁদ। কৃষ্ণপক্ষ শুক্লপক্ষের হিসাব আমার প্রায়ই গোলমাল হয়ে যায়, চাঁদটা মাদ্রিদেরর আকাশে কোন দিকে উঠছে তাও জানি না। কিন্তু কিছুক্ষণ জানালায় দাঁড়িয়ে আবার কিছু সময় বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিকেল বেলার চাঁদ দেখলাম।

ভ্যালেনসিয়া যাবার পথে মাদ্রিদে তিন দিনের যাত্রা বিরতি নিয়েছিলাম। স্পেনের মাটিতে প্রথমবার পা রেখে রাজধানী শহরটা নিজের চোখে দেখে যাবার সুযোগটা ছাড়তে চাইনি। শুক্রবার দুপুরের দিকে মাদ্রিদে পৌঁছে সেদিন বিকেলেই ‘মাদ্রিদ ফ্রি ওয়াকিং ট্যুর’ বুক করে ফেলেছিলাম। আজকাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এ সব বিনামূল্যে শহর ঘুরিয়ে দেখাবার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এর আগে একবার কোপেন- হেগেনে এই বিনে পয়সার শহর পরিভ্রমণের সুযোগটা নিয়েছিলাম। তখনই মাথায় এসেছিল, কেন এই অতিথি সেবা? পায়ে হেঁটে শহর ঘুরিয়ে দেখাবার পরে অবশ্য গাইডকে যা যা খুশি টিপস দিতে পারেন, না দিলেও কারো কিছু বলার নেই। কিন্তু শুধু এই যৎসামান্য বখশিশের ওপর নির্ভর করে কেউ নিশ্চয়ই মাদ্রিদ মিউনিখ বা স্টকহোমের মতো শহরে জীবন যাপন করতে পারে না।

যাই হোক, ভেবে চিন্তে আমি নিজেই এর একটা কারণ খুঁজে বের করেছিলাম। প্রথমত দিনের প্রথমার্ধে ফ্রি-ওয়াকিং ট্যুর এর পরে বিকেল বেলা অথবা পরদিন প্রথম সফরের অদেখা কয়েকটি বিশেষ দর্শনীয় জায়গা যুক্ত করে প্যাকেজ ট্যুরের ব্যবস্থা আছে। একই সাথে থিয়েটার বা মিউজিক্যাল শো এবং বিশেষ কোনো রেস্টুরেন্টে খাবার ব্যবস্থাও এ সব প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া বিনামূল্যে বিচরণের বিরতিতে কেনাকাট বা রেস্তোরায় চা-কফি-আইসক্রিমের সাথেও হয়তো পথপ্রদর্শকদের জন্য কিছু কমিশন থাকতে পারে। ব্যাপারটা যাই হোক আইডয়াটা মন্দ নয়। আমরা নগর পরিদর্শন শেষে গাইডের টুপিতে পাঁচ দশ ইওরোর নোট আর নেহায়েত তাও সম্ভব না হলে দু চারটে কয়েন ফেলে দিলেও কেউ কিছু মনে করবে না। ডেনমার্কের রাজধানীতে প্রথম দিনের ট্যুর-এর প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে হঠাৎ করেই দেখলাম আমাদের প্রতিবেশি দেশের এক ভদ্রমহিলা এবং তাঁর কিশোরী কন্যা উধাও। বিষয়টা লক্ষ করলেও আমি চুপচাপই ছিলাম। কিন্তু ট্যুর গাইডের সাথে হ্যান্ডশেক করার মতো করে একটা পাঁচ ইওরোর নোট তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিদায় নেয়ার সময় আমার স্ত্রী বাংলায় বলে উঠলো, ‘দেখেছো, আমাদের দিদি কিন্তু ঠিক সময়ে কেটে পড়েছেন।’

পরদিন সকাল দশটায় পৌঁছবার কথা থাকলেও মিনিট কুড়ি আগেই পুয়ের্তা দেলসলে পৌঁছে দূরে থেকেই দেখা গেল রাজা তৃতীয় কার্লোসের চরণতলে সবুজ ছাতা ঘিরে বেশ কয়েকজন ভ্রমণবিলাসী মানুষের জটলা। কাছে এসে সবুজ টি-শার্ট পরা দীর্ঘঙ্গী নারী মূর্তিকে নিজের পরিচয় দিতেই সে তার হাতের তালিকা মিলিয়ে দেখে নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘আই এ্যাম তাতিয়ানা ফ্রম ওগো ট্যুরস।’ আমাদের পরিচয়ের পালা শেষ হতেই সে তার ‘ওগো’ ট্যুরস এবং বিনামূল্যে নগর পরিভ্রমণের কারণ ও তাৎপর্য ব্যাখা করছিল। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম কখন সে ‘ওগো- হ্যাঁ গো- এসো গো এবার বেড়াতে যাই’ বলে যাত্রা করবে তার অপেক্ষায়। তাতিয়ানা বেশ খানিকক্ষণ তাওয়া তাতিয়ে তারপরে পুয়ের্তা দেলসলের পরিচিতি দিয়ে শুরু করলো তার নগর পরিক্রমা।

ঘণ্টা তিনেক ধরে পায়ে হেঁটে প্লাজা মেয়র, সান মিগুয়েল মার্কেট, বিশ্বের প্রাচীনতম রেস্তোরা বোতিনসহ মাদ্রিদের বেশ কয়েকটি বিশেষ দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে নিয়ে এসে তাতিয়ানা তার সফর শেষ করলো আবার সেই পুয়ের্তা দেলসলে। আমি আশা করেছিলাম নগর চক্করের কোনো এক সময় লোরকার সাথে দেখা হয়ে যাবে। আগেই জেনেছিলাম স্পেনের ফ্যাসিবাদী সরকারে হাতে নিহত লোরকার ভাস্কর্য পুয়ের্তা দেলসল থেকে খুব একটা দূরে নয়। কিন্তু সফরের সমাপ্তি ঘোষণায় একটু মর্মাহত হলাম এবং তাতিয়ানাকে জিজ্ঞেস না করেই পারলাম না, ‘তোমার এই সফরে ফেদরিকো গার্সিয়া লোরকার একটা ভাস্কর্য দেখতে পাবো আশা করেছিলাম।’ তাতিয়ানা কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘তুমি লোরকার নাম জানো? কী করে সম্ভব?’ বললাম, ‘শুধু নামই জানি না, আমি তার দুটি নাটক ‘ইয়ারমা’ এবং ‘ব্লাড ওয়েডিং’এর টেলিভিশন প্রোডাকশন করেছি এবং তার হাউজ অফ বার্নাডা আলবা’ মঞ্চে দেখেছি।’

পুয়ের্তা দেলসলের ভালুক

তাতিয়ানা হঠাৎ করেই ‘ইউ মেড মাই ডে’ বলে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, ‘আমি বেশ কয়েক বছর ধরে ট্যুর গাইড হিসাবে কাজ করি। কিন্তু কেউ কখনো আমার কাছে লোরকার কথা জানতে চায়নি।’ আবেগ আপ্লুত হয়ে ফেদরিকো গারসিয়া লোরকা সম্পর্কে তার অনুভূতির কথা বলার পরে আমাদেরকে প্লাজা ডি সান্তা আনা যাবার পথ দেখিয়ে দিলো।
অপ্রশস্ত রাস্তা দিয়ে মিনিট সাতেক হেঁটে খুব সহজইে প্লাজা ডি সান্তা আনার খোলামেলা চত্বরে এসে পড়লাম। প্লাজার পশ্চিম প্রান্তে হোটেল মাদ্রিদ রেইনা ভিক্টোরিয়ার সামনে উঁচু বেদির উপরে বিশাল প্রস্তর মূর্তি দেখে স্বভাবতই ভেবেছিলাম কোনো রাজাধিরাজের ভাস্কর্যই হবে হয়তো। কিন্তু নাম ফলক দেখে ভুল ভাঙলো, এই মহারথী স্পেনের প্রধানতম কবি এবং নাট্যকার পেদ্রো কালদেরো দেলা বারকা। সপ্তদশ শতকের শুরুতে জন্ম নেয়া স্পেনের সোনালি অতীতের এই নাট্যকার তাঁর সময়ে জনপ্রিয় হলেও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক লিখে বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনেও স্থান করে নিয়েছেন। প্লাজার পূর্ব দিকে রয়েছে মাদ্রিদের প্রাচীনতম নাট্যশালা সপ্তদশ শতকের তিয়েত্রো স্পানিয়োল। প্রায় প্রতিদিন, বিশেষ করে শনি এবং রবিবারে লেখক কবি, শিল্প সাহিত্যিকদের মিলন মেলায় পরিণত হয় জনপ্রিয় এই চত্বর। কফি পার্লার, রেস্টুরেন্ট, সুভ্যেনিয়ার শপ ছাড়াও নানা ধরনের পণ্যের অস্থায়ী বেচাকেনার বাজার সারাদিনই সরগরম থাকে।

পেদ্রো কালদেরোর ভাস্কর্যের বিপরীতে খোলা চত্বরের প্রায় শেষ প্রান্তে মাদ্রিদের প্রাচীনতম নাট্যশালা তিয়েত্রো স্পানিয়োলের সামনে স্থাপিত হয়েছে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ও কবি ফেদরিকো গার্সিয়া লোরকার একটি ভাস্কর্য। ১৯৯৮ সালে কবির জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষে ব্রোঞ্জের তৈরি এই ভাস্কর্যে দুই হাতে ধরে শান্তির প্রতীক একটি কবুতর উড়িয়ে দিচ্ছেন কবি। একুশ বছর বয়সে গ্রানাডা থেকে মাদ্রিদে এস স্প্যনিশ আভাগার্দ বা শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্রের নবতরঙ্গের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন লোরকা। ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিলেন লুই বুনুয়েল এবং সালভেদর দালির মতো খ্যাতিমান শিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতার সাথে। খুব কম বয়সেই কাব্যগ্রন্থ ‘সনেটস অফ ডার্ক লাভ’ লিখে খ্যাতি এবং অখ্যাতি দুই কুড়িয়েছেন। ইয়ারমা, ব্লাড ওয়েডিং এবং হাউজ অফ বার্নাডা আলবা ছাড়াও তার ‘ফাইভ ইয়ারস’সহ তাঁর লেখা নাটকে স্পেনের সাধারণ মানুষের কাহিনি, বিশেষ করে শোষণ নিপিড়ন ও ধর্মীয় বাধা নিষেধের নিগড়ে আটকে থাকা নারীদের জীবন সংগ্রাম বিশেষভাবে চিত্রিত হয়েছে। স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তিনি গ্রানাডায় ফিরে যান। সেখানেই ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদী ন্যাশনালিস্ট সরকার লোরকাকে একজন বিপজ্জনক বুদ্ধিজীবী হিসাবে চিহ্নিত করে প্রথমে গ্রেফতার ও পরে ১৯৩৬ সালের ১ লা অগাস্ট দুজন সঙ্গীসহ গুলি করে হত্যা করে। গ্রানাডার কাছে সিয়েরা নেভাডা পর্বতমালার পাদদেশে ভিনার নামের একটি গ্রামের গণ কবরে লোরকাকে সমাহিত করা হয় বলে জানা যায়। তবে লোরকার দেহাবশেষ কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তাতিয়ানার সাথে- রিয়েল সিনেমার সামনে

লোরকার ভাস্কর্য ঘিরে আমাদের ছবি তুলতে দেখে কয়েকজন তরুণ তরুণী নিজেদের মধ্যেই সম্ভবত ইতালিয় ভাষায় কী যেনো বলাবলি করছিল। তাদেরই একজন শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এসে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করে, ‘দিস স্ট্যাচু মাস্ট বি অফ সাম ওয়ান ভেরি ইম্পর্ট্টে পারসন?’ বললাম, ‘আই থিংক হি ইজ ওয়ান অফ দ্য গ্রেটেস্ট পোয়েটস এ্যান্ড ড্রামাটিস্টস অফ স্পেন! ফেদরিকো গার্সিয়া লোরকা।’ আমারা যখন ফিরে আসছি, তরুণ তরুণীর দল তখন লোরকার ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। চলবে…