ফরিদুর রহমান : ‘অশ্বারোহী তাসমিনা’ দেখানো হবে আমলিয়াদার সিনে সেন্টারে রাত আটটায়। এদিকে সন্ধ্যা নামার আগেই কনকনে ঠাণ্ডার সাথে শুরু হলো টিপটিপ বৃষ্টি। স্বাভাবিকভাবেই এমন বৈরি আবহাওয়ায় অনভ্যস্ত বঙ্গ-সন্তানের জুবুথুবু অবস্থা। মান্দি আগেই জানিয়ে রেখেছিল সাড়ে ছয়টায় হোটেলের সামনে থেকে একটা মাইক্রোবাস আমাদের তুলে নিয়ে আমলিয়াদায় পৌঁছে দেবে। যথা সময়ে নিচে নেমে দেখলাম আমি ছাড়াও নির্মাতা, জুরি এবং ফেস্টিভ্যাল স্টাফসহ আমরা প্রায় সাত আটজন। জুরিদের একজন তুরস্কের থমাস বাকেনহল রসিকতা করে বললেন, ‘ফিল্মমেকার এবং জুরিদের কি একই গাড়িতে কোথাও যাওয়া উচিৎ!’ আমিও হাসতে হাসতেই বললাম, ‘পথে একেবারেই চুপচাপ থাকবো, জুরিদের সাথে কোনো কথা হবে না।’ জুরিদের আরেকজন চুল এবং গোঁফ মিলিয়ে যাকে দেখতে একেবারেই আইনস্টাইন ছোট ভাই বলে মনে হয়েছিল, তিনি তাঁর নিরপেক্ষতার নিময় রক্ষর্থেই কিনা জানি না, সারা পথে একটিও কথা বলেননি। অবশ্য ষোল কিলোমিটার দূরের আমলিয়াদায় কুড়ি বাইশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম।
সিনে সিনেমা নামের যে প্রেক্ষাগৃহকে ঘিরে অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ডকুমেন্টারিগুলোর প্রদর্শনী চলছে সেটি একটি পুরোনো সিনেমা হল। পুরোনো ধরনের ভবনের ভেতরটা সাজানো হয়েছে অকেজো ৩৫ মিলিমিটারের প্রজেক্টর এবং সাউন্ড সিস্টেমসহ বিভিন্ন পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে ফিল্মের স্পুল। এ ছাড়া উৎসবের দেশি বিদেশি ছবির পোস্টারের পাশাপাশি কিছু পুরোনো প্রোমোশনাল ম্যাটেরিয়ালও রয়েছে ডিসপ্লে বোর্ডে। আমার জন্যে সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় ছিল সিনেমা হলের লবিতে একটি ফায়ারপ্লেস। শুধু উপস্থিতি দিয়ে নয়, রীতিমতো কাঠ পুড়িয়ে উত্তাপ ছড়াচ্ছে এই অগ্নিকুণ্ড। সিনে সিনেমার সামনে বাহন থেকে নামার পর উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন লিনা গিয়ান্নোপউলু। ভেতরে প্রবেশের সাথে সাথেই কফি খাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন লিনা। জুরি কমিটির সদস্যদের এড়াবার জন্যে বললাম, ‘আমি বরং কিছুক্ষণ আগুনের পাশে বসি, পরে কফি খাওয়া যাবে।’
আমাদের সিনেমা হলগুলোর মতোই ভেতরে কফি কর্নার আছে। তবে এখানে কফি এবং শীতল পানীয় ছাড়া বিয়ারেরও ববস্থা আছে। আমি কিছুক্ষণ ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে অন্য ধরনের উষ্ণতা উপভোগ করে কফি কর্নারের সামনের লম্বা টুলে এসে বসলাম। জুরি মহোদয়েরা কোথায় উধাও হয়ে গেলেন বলতে পারবো না। লিনা এসে বলে গেলেন, ‘তুমি এখানেই বসো, আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমাকে ডেকে নেবো।’ লবিতে দেশি বিদেশি দর্শক, উৎসব সংশ্লিষ্ট লোকজন ছাড়াও একদল ছেলে মেয়েকে দেখলাম আনন্দের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি কফি শেষ করার বেশ কিছুক্ষণ পরে লিনা এসে হলের ভেতরে নিয়ে গেলেন। প্রেক্ষাগৃহের দৈর্ঘ্য প্রস্থ দেখে নিশ্চিত ভাবেই বোঝা যায় এটি একটি প্রাচীন থিয়েটার। দৈর্ঘ্যে অনেক বড় হলেও খুব বেশি চওড়া নয়, ঢুকবার এবং বেরোবার পথ একপাশে। তবে পাথরের দেয়াল, নতুন লাল রঙের সিট এবং উঁচু মঞ্চ দেখে এর আভিজাত্য সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
হলের বেশিরভাগ আসন পূর্ণ হয়ে গেলে আটটা বাজার সাথে সাথেই ইনসিগনিয়ার দিয়ে শুরু হলো এ্যানিমেশনে করা ফেস্টিভ্যাল লোগো। এর আগেও দুই একটা প্রদর্শনীর শুরুতে লোগো ফিল্মটা দেখেছি। কিন্তু বিশাল বড় পর্দা এবং চমৎকার সাউন্ড সিস্টেমের কারণে থিম মিউজিক, রঙের ব্যবহার এবং নির্মাণ শৈলী মিলিয়ে অসাধারণ মনে হলো। এর পরপরই পর্দায় ভেসে উঠলো ‘অশ্বারোহী তাসমিনা’। যে কোনো ছবির প্রদর্শনের ক্ষেত্রে প্রজেকশন যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম সিনে সিনেমার এই প্রদর্শনীতে। এতো বড় পর্দা জুড়ে প্রদর্শিত দৃশ্যের ছবি বা রঙের কোথাও সামান্যতম অস্পষ্টতা নেই। প্রকৃতির পাতা ঝরার শব্দ, পুকুরের জলের ঢেউ, মাঠে ঘাস কাটার শব্দ এবং হাঁস মুরগির ডাকসহ প্রতিটি অডিও এতোটা স্পষ্ট যে নির্মাতা হিসাবে আমি নিজেই বিস্মিত। পর্দার ইংরেজি সাবটাইটেলের নিচের দিকে বাড়তি অংশে বেশ বড় অক্ষরে ভেসে উঠছে গ্রিক ভাষায় সাবটাইটেল। আমি আরো একবার অনুধাবন করলাম, আমাদের সিনেমা হলগুলোই শুধু ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে যায়নি, কোনো কিছুর আধুনিকায়নেও আমরা আগ্রহী নই। কেবলই বাগাড়ম্বর দিয়ে আত্মসন্তুষ্টি লাভ করা যেতে পারে, কিন্তু আন্তর্জাতিক মান অর্জন করা সম্ভব নয়।
ছবি শেষে শুরু হলো প্রশ্নোত্তরের পালা। লিনা গিয়ান্নোপউলু মঞ্চে ডেকে নিয়ে আমার সাথে দর্শকদের পরিচিয় করিয়ে দিলেন। প্রথমে ‘তাসমিনা দ্য হর্সগার্ল’ ছবির পটভূমি নিয়ে কিছু কথা। দর্শকদের মধ্যে ছোটদের প্রশ্নই ছিল বেশি। বাংলাদেশের মতো একটি প্রায় অজ্ঞাত অপরিচিত দেশ সম্পর্কে শিশু কিশোরদের কৌতূহলের অন্ত নেই। ‘বাংলাদেশে মেয়েরা ইচ্ছা করলেই ঘোড়ায় চড়তে পারে না কেন?’ ‘মেয়েরা ঘোড় দৌড়ে অংশ নিলে অন্য লোকের কী সমস্যা?’ ‘মেয়েরা স্কুলে স্কার্ফ গলায় না বেধে মাথায় পরে কেন?’ এইসব প্রশ্ন। একটি মেয়ে মন্তব্য করেছে, মেয়েটি পায়ে হেঁটে স্কুলে যায় কেন, সে তো ঘোড়ায় চড়েই স্কুলে যেতে পারে!’ সব শেষে একটি ছেলে প্রশ্ন করেছিল, ‘তাসমিনা যে একটা বড় ঘোড়ার জন্য বড়দের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে পারে না, তাকে সেই বড় ঘোড়াটি দেয়ার ব্যাপারে তোমরা কি কিছু করেছো?’ উত্তরে বললাম, ‘আমি এবং আমার বন্ধুরা মিলে একটা বড় ঘোড়া কেনার প্রয়োজনীয় টাকা তার বাবাকে দিয়েছি। এতো দিনে সে হয়তো নতুন একটা ঘোড়া কিনেও ফেলেছে এবং নতুন নতুন প্রতিযোগিতায় অংশও নিতে পারছে।’
সে রাতের পরবর্তী ছবি ‘রিচ ফর দ্য স্কাই’ দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে। প্রতি বছর নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার সারা দেশের হাইস্কুলে পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এক্সামে অংশ নেয়। ‘রিচ ফর দ্য স্কাই’ ছবিটি দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকটি হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রী, তাদের পরিবার এবং স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকার পরীক্ষার পূর্ব প্রস্তুতি, তাদের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং প্রার্থনার এক মিশ্র অনুভবের গল্প। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া অর্থ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগই নিশ্চিত করে না, বরং কোরিয়ার অভিজাত সমাজে উচ্চতর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা লাভেরও সুযোগ সুষ্টি করে। রিপাবলিক অফ কোরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করেও ‘রিচ ফর দ্য স্কাই’ খোদ কোরিয়াতেই কয়েকটি পুরস্কার লাভ করেছে। আমাদের দেশে এই ছবি যে সেন্সরের দরজা পেরিয়ে বের হয়ে আসতে পারতো না, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ছবি শেষে আমলিয়াদা থেকে বেশ রাতে আমরা কয়েকজন পিরগসে ফিরে এলাম। এবারে অবশ্য জুরিদের কেউই আমাদের সাথে ছিলেন না।
পরদিন সকাল সাড়ে নটার দিকেপিরগস কনফারেন্স হলে ফেস্টিভ্যালের অফিসে এসে জানতে পারলাম সকালে ক্যামেরা জিজানিওর কোনো প্রদর্শনী নেই। অনুষ্ঠান সূচি আগেই হাতে পেয়েছিলাম, কিন্তু তিন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্নপ্রদর্শনীর হিসাব রাখতে পারিনি। মূল এ্যাপোলো থিয়েটারে এ্যানিমেশন এবং কাহিনি ছবির প্রদর্শনী শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টায় আর আমলিয়াদার সিনে সিনেমায় প্রামাণ্যচিত্র শুরু হবে বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। কনফারেন্স হলের বাইরে অবশ্য ছোটদের ওয়ার্কশপ চলবে। বুঝলাম সকালটা পুরোপুরি ফ্রি। আগে খেয়াল করলে শহরের বাইরে কোথাও ঘুরে আসা যেতো। কাতাকোলো সমুদ্র সৈকত এখান থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে, বাসে আধা ঘণ্টার পথ। তিয়ানলিনকে বললে সেও হয়তো যেতে রাজি হয়ে যেতো। ফেস্টিভ্যালের অফিসে বসে যখন এইসব ভাবছি তখন মেঘ না চাইতেই জলের মতো মান্দি বললো, ‘তুমি বরং এলদোরার সাথে পোর্ট কিল্লিনি থেকে ঘুরে এসো।’
‘এলদোরা, মানে বুলগেরিয়ার এলদোরা ত্রায়কোভা?’
‘ওর সাথে গাড়ি আছে, বলছিলো আর কেউ যদি যেতে চায় তাহলে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে। কিল্লিনি থেকে জাকিনথোস দ্বীপে যেতে চাইলে বেশ ভালো একটা ট্রিপ হয়ে যাবে।’
আমি মনের ভেতরে একটু দ্বিধা রেখে রাজি হয়ে যাই, কারণ বুলগেরিয়ানদের সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়। আমাদের কথা বার্তার মধ্যেই এলদোরা তার গৃহকর্তাসহ এসে হাজির। মান্দি যখন বললো, রহমানকে তোমাদের সাথে নিতে পারো, তখন সে মহা আনন্দে রাজি হয়ে বললো, ‘তাহলে তো খুবই ভালো হয়। ঘণ্টা খানেকের পথ বেশ কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে।’
পথে যেতে যেতেই এলদোরাকে বললাম, ‘তোমার ছবিটা আমি দেখতে পারিনি, আশাকরি অন্য কোনো সময় দেখে নেবো। ছবি তো বুলগেরিয়ার, নামটা কেন কেম্ব্রিজ?’ এলদোরা উত্তরে বললো, ‘উত্তর-পশ্চিম বুলগেরিয়ার একটা গ্রামের নাম দলনি-সিবার, এখন মিডিয়ার কল্যাণে গ্রামের নামই হয়ে গেছে কেম্ব্রিজ। এই অঞ্চলটা বুলগেরিয়ার সবচেয়ে দারিদ্রপীড়িত অঞ্চল, শুধু বুলগেরিয়ার নয়, বলা যায় পুরো ইওরোপিয় ইউনিয়নে এরচেয়ে গরীব গ্রামাঞ্চল আর নেই। কিš‘ লেখাপড়ার ব্যাপারে গ্রামবাসীর আগ্রহ এবং উৎসাহের কারণে গ্রামের নামই হয়ে গেছে ‘কেম্ব্রিজ’।’ এলদোরা জানালো বছরের বিভিন্ন সময়ে, বলা যায় পুরো এক বছর ধরে এই ছবির স্যুটিং করতে হয়েছে দলনি-সিবার গ্রামে এবং আরো কয়েকটি জায়গায়। এইসব প্রামাণ্যচিত্র তৈরির জন্য এদের সারা বছর স্যুটিং করার টাকা কোন ভূতে যোগায়, তা ভেবে পাই না।
পিরগস থেকে কিল্লিনির ৫০ কিলোমিটার রাস্তা তুলনামূলকভাবে অপ্রশস্ত। বেশিরভাগ সময় দুপাশে ঊষর তৃণভূমি, ছোট ছোট ঝোপঝাড় আর লতাগুল্মে ভরা মাঠ। কোথাও কোথাও অসমতল পাহাড়ি এলাকায় তালগাছের মতো দীর্ঘদেহী গাছের দেখা মেলে। এ ছাড়া উইলো এবং ফার গাছের ছোট ছোট দুই একটা বনও দেখা গেল। রাস্তায় যানবাহন চলাচলের তেমন ভিড় নেই। এলদোরার গৃহকর্তা ভদ্রলোক ধিরে সুস্থে চমৎকার চালিয়ে যা”িছলেন। অবশ্য গাড়ি চালাবার ব্যাপারে দুজনের কারোরই দক্ষতার অভাব নেই। তা না হলে সোফিয়া থেকে পিরগস পর্যন্ত এগার’শ কিলোমিটার পথ গাড়ি চালিয়ে আসার সাহস হতো না। ওরা নিজেদের মধ্যে টুকটাক দুই একটা কথা বললেও বুঝতে পারছিলাম না। তবে চালক একবার ইংরেজিতে বললেন, বন্দরের রাস্তায় ট্রাফিক অস্বাভাবিক কম মনে হচ্ছে। কিল্লিনি পোর্টের কাছাকাছি এসে দেখা গেল বন্দর এলাকা প্রায় পুরোটাই জনশূন্য।
পোর্ট কিল্লিনি ক্যাফের সামনে গাড়ি রেখে আমরা অন্দরের খবর নেবার জন্যে বন্দরের টিকেট ঘর থেকে জেটি পর্যন্ত ঘুরে এলাম। কোথাও তেমন লোকজন নেই এবং থাকলেও তারা কেবল দুর্বোধ্য গ্রিকভাষাই জানে, আমাদের সহজ সরল ইংরেজি, ফরাসি এমন কি বুলগেরিয়ানসহ ¯øাভিক কোনো ভাষাই তাদের জানা নেই। আমরা জাকিনথোস দ্বীপে যেতে চাই শুনে বুকিং অফিসের একজন ইংরেজি এবং গ্রিক মিলিয়ে যা বললেন, তার অর্থ হলো কিল্লিনি বন্দরে জেনারেল স্ট্রাইক চলছে, সেই কারণে সব ধরনের নৌ যান চলাচলসহ বন্দরের কাককর্ম বন্ধ! একেই বলে কপাল। ভেবেছিলাম পুরোটা মুফতে না হোক অনেকটা সাশ্রয়ী মূল্যে গ্রিসের সমুদ্রে একটা দ্বীপ দর্শন হয়ে যাবে। কিন্তু ‘যাত্রা করো যাত্রা করো যাত্রীদল উঠেছে আদেশ, বন্দরের কাল হল শেষ’ বলার আগেই শুনতে হলো সাধারণ ধর্মঘট!
এতোদিন হরতাল, ধর্মঘট, বনধ্ এবং বন্ধন তো আমাদের একচেটিয়া ব্যাপার বলেই ভাবতাম। অজকাল আমাদের সাথে সাথে তা ইউরোপেও পাড়ি জমিয়েছে। অগত্যা ক্যাফের ভেতরে ঢুকে নরম সোফায় বসে গরম কফির অর্ডার দেয়া হলো। এলদোরা জানতে চেয়েছিল, স্যান্ডউইচ চলবে কিনা! জন মানব শূন্য রেস্তোরা যে আমাদের কফি দিতে রাজি হয়েছে সেই তো অনেক। তাছাড়া অলিম্পিয়া হোটেলের চমৎকার কম্িপ্লমেন্টারি ব্রেকফাস্টের কল্যাণে বেলা সোয়া এগারোটায় এক কাপ কফিই যথেষ্ট। কফির কাপ হাতে টেবিলে পড়ে থাকা ইংরেজি পত্রিকার পাতায় হেড লাইনটা চোখে পড়ার পরে বুঝলাম, একটা দিন পরে এলেই দ্বীপ দর্শনের আকাক্সক্ষা অপূর্ণ রেখে ফিরতে হতো না। পত্রিকাটি লিখেছে: The seamen union extended its strike, boats and ferries will remain docked until Thursday, December 8th, midnight.
ফেরার পথে গাড়ি চালিয়েছে এলদোরা। ব্যর্থ বন্দর অভিযান শেষে সাড়ে বারোটা দিকে ফিরে এলাম কনফারেন্স হলে। বন্দরে যে ধর্মঘট চলছে, সে কথা মান্দি বা অফিসের কেউই জানে না। মান্দি বললো, ‘তোমরা তাড়াতাড়ি ফিরে আসাটা অবশ্য অন্য একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। পিরগস টেলিভিশনের একটা ইউনিট তোমাদের ইন্টারভিউ নিতে চায়। ইউনিট বলতে একজন প্রোডিউসার এবং একজন ক্যামেরাম্যান। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ইউনিট একটা সাক্ষাৎকার নিতে গেলে এখনও পাঁচ থেকে সাতজনের ইউনিট না হলে নড়াচড়া করতে পারে না। অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং নিজেদের ডকুমেন্টারি ছবি নিয়ে প্রথমে এলদোরার এবং পরে আমার বক্তব্য রেকর্ড করলো পিরগস টেলিভিশন। বুলগেরিয়া গ্রিসের নিকট প্রতিবেশি একটি দেশ। কাজেই এলদোরা তার প্রামাণ্যচিত্র ‘কেম্ব্রিজ’ সম্পর্কেই কথা বলেছে। ‘অশ্বারোহী তাসমিনা’ প্রসঙ্গে বাড়তি হিসাবে বাংলাদেশ, দেশের ভৌগলিক অবস্থান এবং সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কেও খানিকটা ধারণা দেবার কথা বলেছিলেন প্রযোজক। কতটা বলতে পেরেছি জানি না, তবে প্রযোজক মেয়েটিকে বেশ খুশিই মনে হলো। সে রিপোর্ট প্রচারের একটা সময়ও বলেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা দেখা হয়ে ওঠেনি।
টেলিভিশনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেষ হতে হতেই লাঞ্চের সময় হয়ে এসেছিল। সঙ্গে যাবার মতো কাউকে না পেয়ে একাই হাঁটতে হাঁটতে ‘জয় জাকারিয়া’ পৌঁছে গেলাম। আমার আগেই সেখানে পেপে লোলা এবং আলবার্তো হাজির। আমি বোধহয় একটু দেরি করে ফেলেছি। ডিসপ্লে দেখে পছন্দের খাবার অর্ডার দিতে গিয়ে জানলাম অনেক কিছুই শেষ হয়ে গেছে, তবে পাওয়া গেল বেগুনের তৈরি পাপুতসাকিয়া এবং গ্রিক পাস্তা। বেগুনের মধ্যে মাংসের কিমার পুর দেয়া কাছাকাছি এক ধরণের খাবার প্রথমবার খেয়েছিলাম উড়িষ্যার কটকে আমার চিত্রনাট্য রচনার শিক্ষক সাগির আহমেদের বাড়িতে আর দ্বিতীয়বার চীনের শিয়াংয়ের একটি রেস্টুরেন্টে। তবে কটকের বেগুন এখন পর্যন্ত র্যাংকিংয়ে এক নম্বরে! পাপুতসাকিয়া সাথে পরিবেশিত খাবারটি ছিল ভেজিটারিয়ান গ্রিক পাস্তা। পাস্তা জিনিসটা আমার কখনোই পছন্দ নয়, তরে সুস্বাদু গরম পাপুতসাকিয়া এবং শীতল মিথোসের সাথে লাঞ্চটা খারাপ হয়নি।
খাবার শেষ করে আমরা টেবিলেই বসে কথা বলছিলাম, এর মধ্যে স্বয়ং ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর আরো দুজন সঙ্গীসহ এসে ঢুকলেন। দমিত্রি লাঞ্চ টেবিলে বসে পড়ার আগেই লোলা, পেপে এবং আলবার্তো দমিত্রিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। প্রথম ছবিটা আমি তুললাম, পরে আমাদের গ্রæপ ছবিটা তুলেছিল পেপে! (চলবে…)