Home কলাম অশ্বারোহীর বিশ্বভ্রমণ-১১

অশ্বারোহীর বিশ্বভ্রমণ-১১

ফরিদুর রহমান : পিরগস শহরটা ছোট। শহরের বসবাস করে মাত্র হাজার পঁচিশেক মানুষ। তবে পিরগসের মিউনিসিপ্যাল এলাকা শহর ছাড়িয়ে কিছুটা বিস্তৃত বলে নয় বর্গ কিলোমিটার এলাকার জনসংখ্যা চল্লিশ হাজারের মতো। শহর এলাকাটা এতোই ছোট যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবার জন্যে কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই। কাছাকাছি শহর পাতরাস, আমলিয়াদা বা অলিম্পিয়া যাবার জন্যে বাস এবং ট্রেন চলাচল করে। নিজস্ব বাহন হিসাবে গাড়ি না হলেও মোটরবাইক বা সাইকেল সবারই আছে। না থাকলেও ক্ষতি নেই শহরের ভেতরে পুরোটাই পায়ে হেঁটে ঘুরে আসা সম্ভব।

সাধারণত চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে একই সাথে বিভিন্ন ভেন্যুতে বিভিন্ন ধরনের ছবি প্রদর্শিত হয়। অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পিরগসের এ্যাপোলো থিয়েটার এবং কনফারেন্স হল ছাড়াও অর্ফিয়ুস সিনেমা এবং ষোল কিলোমিটার দূরের শহর আমলিয়াদায় একযোগে চলছে উৎসব। অলিম্পাস হোটেল থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে এ্যাপোলো থিয়েটার এবং কনফারেন্স হলের সাথে আগেই পরিচয় ঘটেছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম নজরুলের কবিতায় পড়া অর্ফিয়ুসের বাঁশের বাঁশরির অলৌকিক সুরস্রাষ্ট অর্ফিয়ুসের নামে যে আধুনিক সিনে কমপ্লেক্স সেটিও কাছাকছি। গ্রিক পুরান অনুসারে এ্যাপোলোর পুত্র অর্ফিয়ুস। কাজেই এ্যাপোলো থিয়েটারের তুলনায় অর্ফিয়ুস সিনেমা আধুনিক হতেই হবে। এর থেকে একটা বিষয় অন্তত স্পষ্ট হয়ে যায়, তা হলো গ্রিসের মানুষ এখনো সিনেমা হলে ছবি দেখে। আসলে দেশে যদি চলচ্চিত্র তৈরিই না হয়, সিনেমার কোনো সংস্কৃতি গড়ে না ওঠে সে দেশে সিনেমা হল ভেঙে শপিং কমপ্লেক্স তো ভালো, আলু সংরক্ষণের হিমাগার কিংবা মাছের আড়ত যে তৈরি হচ্ছে না সে জন্য হল মালিকদের ধন্যবাদ দেয়া যায়।

রাত আটটায় আমলিয়াদায় প্রামাণ্যচিত্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার ইচ্ছে থাকলেও হিসাব করে দেখলাম পরে ‘অশ্বারোহী তাসমিনা’র প্রদর্শনী এবং তালিকার আরো কয়েকটি ভালো ছবির দিনে তো যেতেই হবে। অতএব সন্ধ্যায় এ্যাপোলো থিয়েটারে ছোট বড় কাহিনি ছবিগুলোই দেখা যাক। পুরোনো কাসিক ছবির প্রদর্শনী শুরু হবে বিকেল চারটায় আর প্রতিযোগিতার নতুন ছবির প্রদর্শনী সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায়। তার আগে কয়েক ঘণ্টা কোনা কাজ নেই। কনফারেন্স হল থেকে বেরিয়ে হোটেলের পথে হাঁটতে হাঁটতে নির্ধারিত রেস্টুরেন্টের কোনো একটাতে ঢুকে লাঞ্চ শেষে ঘরে ফিরে ঘুমানোও যেতে পারে।

এ্যনমেশন ওয়ার্কশপ

চোখের সামনে ম্যাপটা খুলে কয়েকটা নাম দেখে নিয়ে মূল সড়ক থেকে বাঁয়ে একটা অপ্রশস্ত রাস্তা বেছে নিলাম। খুব বেশি দূরে যেতে হলো না, তার আগেই তালিকার একটা রেস্টুরেন্ট চোখে পড়লো। এন লেফকো নামের রেস্তোরাঁর মূল প্রবেশ পথেই শোভা পাচ্ছে অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের পোস্টার। অতএব নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়লাম। নিচে সম্ভবত কোনো পার্টি চলছে, রেস্টুরেন্টের কর্মকর্তা কর্মচারি সকলেই একটু ব্যস্ত মনে হলো। বেরিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো কিনা ভাবছি, এই সময় একজন সিঁড়ি দেখিয়ে উপরে চলে যেতে বললো। দোতলায় পুরোটাই ফাঁকা। এন লেফকো নামের অর্থ ‘ভেতরটা সাদা’। আমরা সাদা মনের মানুষ দেখেছি কিন্তু এই প্রথম সাদা মনের রেস্টুরেন্ট দেখলাম। নামের সার্থকতা প্রমাণ করতে পেতে রাখা দুই সারি সাদা ধবধবে চেয়ার টেবিলের ভেতর দিয়ে সামনে এগিয়ে বসলাম শেষ প্রান্তে জানালার কাছে।

টেবিলে রাখা ম্যেনুর পাতা উল্টিয়ে দেখলাম প্রায় সবই গ্রিক কুইসিনের অপরিচিত খাবারের নাম। প্রথম দিনেই কোনো রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না ভেবে যে দুই একটি পরিচিত নাম খুঁজে পেলাম তার মধ্যে মুসাকাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে হলো। পেটিসের মতো আয়তাকার এই খাদ্যবস্তুটিতে সাধারণত টমাটো এবং বেগুনের সাথে ভেড়া বা গরুর কিমার পুর দেয়া থাকে। এছাড়া চিজের টপস এবং যথেষ্ট পরিমাণে ক্রিম ও সস সহযোগে পরিবেশিত এই খাবার ভাত খাওয়া বাঙালির কাছে নেহায়েতই বিকেলের নাস্তা মনে হতে পারে। এতে আমাদের মূল খাবার ভাত বা রুটি নেই এবং দামও মাত্র সাড়ে চার ইউরো। এর সঙ্গে আরও কিছু যুক্ত না করলে আমার সাড়ে সাত ইউরোর তিন ইউরোই গচ্চা যাবে। অতএব মুসাকার সাথে যায় কিনা না জেনেও খাদ্য তালিকা দেখে ঠিক করলাম গ্রিক পটেটো সালাদ। এই সালাদ সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও আলু যেহেতু সবকিছুর সাথেই চলতে পারে তাই ভাবলাম এটা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। এরপরেও আমার পঞ্চাশ সেন্ট থেকেই গেল। বেশ কিছু সময় পরে মুসাকার সাথে গ্রিক পটেটো সালাদ টেবিলে হাজির হলে দেখলাম দৃশ্যমান সেদ্ধ আলু পেঁয়াজ, জারিত জলপাই এবং উপরে ছোট ছোট চিজের টুকরোর সাথে সম্ভবত লেবুর রস বা ভিনিগার এবং জলপাই তেল! উপকরণ যাই হোক, মুসাকার পাশে আলুুর সালাদ বেমানান হয়নি। পরীক্ষামূলক লাঞ্চ শেষ করে যখন বেরোলাম তখনও নিচে বেশ হৈচৈ চলছে। যে কোনো উপলক্ষে আনন্দ কোলাহলে মেতে উঠতে গ্রিকদের জুড়ি নেই।

সন্ধ্যা নামার আগেই পৌঁছে গেলাম এ্যাপোলো থিয়েটারে। ভেতরে পুরেনো কাসিক ছবি ‘দেয়ার ইজ আ ড্রাগন ইন দ্য ভিলেজ ব্যাকইয়ার্ড’এর শো চলছে, কিন্তু বাইরেও চলছে জমজমাট আড্ডা। আমি কমলার জুসের একটা বোতল শেষ করে প্রতিযোগিতার প্রদর্শনী শুরু হবার আগেই হলে ঢুকে গেলাম। প্রথম ছবিটি দক্ষিণ কোরিয়ার এ্যানিমেশন ‘কালারস ইন দ্য সাবওয়ে।’ একটি ছেলে জীবনে প্রথমবারের মতো মেট্রোরেলের যাত্রী হয়ে বিভিন্ন মানুষেকে তার নিজের কল্পনার নানা রঙে দেখতে পায়। এরপরই ছিল স্বল্পদৈর্ঘ্য ‘দ্য মুন এ্যান্ড আই’। একরাতে ছেলেটির যখন ঘুম আসছিল না, তখন জানালা দিয়ে একটা চাঁদ ঢুকে পড়ে তার ঘরে। সে যখন ধরতে যায় তখনই জানালা দিয়ে পালিয়ে যায় চাঁদ। তবে চাঁদের সাথে অনেকটা সময় খেলাধুলা করে খুশি হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ছেলেটি। প্রিজনেস ইন্টারন্যাশনালে একবার দেখা থাকলেও অরো একবার দেখতে ভালোই লেগেছে।

দিতি ব্রুক ও দমিত্রি স্পাইরো

এ দিনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি ছিল সুইজারল্যান্ডের ‘লিটল মাউন্টেন বয়’। আল্পস পর্বতমালার পায়ের কাছে ছোট্ট এক শহরে বাবা-মা এবং ছাগল-ভেড়া-কুকুরের সাথে ‘মাউন্টেন বয়’ উর্সলির বসবাস। পশু পাখিদের বুঝতে পারা এবং তাদের লালন পালনের উর্সলির দক্ষতা বিস্মযকর। শীতের সময় পুরো এলাকা বরফে ঢেকে গেলে শহর ছেড়ে তারা উপরের দিকে যায় আবার গ্রীষ্মে বরফ গলতে শুরু করলে নেমে আসে নিচে নিজেদের গ্রামে। পর্বতের আশ্রয় থেকে ফসল এবং অন্যান্য জিনিসপত্র একটা ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে ফেরার পথে খাড়া পাহাড়ের গায়ে দুর্ঘটনায় তারা সবকিছু হারিয়ে ফেলে। এ সময় বন্ধু সেরিনার সহায়তায় পূর্ব পুরুষের একটি ঘণ্টা উদ্ধারের এক বিপদসঙ্কুল অভিযানে যাত্রা করে উর্সলি। বিরূপ প্রকৃতি এবং মানুষের বৈরিতার মধ্যে লড়াই করে বাঁচার এই মানবিক কাহিনিতে গল্প উদ্বেগ আশঙ্কা এবং টানটান উত্তেজনা সবছিুই আছে। কিন্তু আমি ভাবছিলাম বিস্তৃত বরফে ঢাকা পার্বত্য জনপদে কিভাবে এই ফিকশন ছবি তৈরি করা সম্ভব! উত্তর পেতে অবশ্য বেশিদিন দেরি করতে হয়নি। পরদিন সন্ধ্যায় দেখা হয়েছে ‘লিটল মাউন্টেন বয়’ ছবি প্রযোজকের সাথে।

পরদিন সকালে কনফারেন্স হলে পৌঁছে দেখলাম হলের বিশাল প্রাঙ্গণ শিশুদের কলকাকলিতে মুখর। প্রজেকশন হলের বাইরের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে শুরু হয়ে গেছে ছোটদের এ্যানিমেশন ওয়ার্কশপ। সারা মেঝেতে কাগজ রং পেন্সিল ক্রেয়ন ছড়িয়ে পাঁচ-ছয় বছর থেকে এগার-বারো বছর বয়সের একদল ছেলে-মেয়ে শুয়ে বসে উপুড় হয়ে যে যেভাবে পারে ছবি আঁকছে। প্রশিক্ষক এনিমেটর ছোটদের আঁকা এইসব ছবি নিয়ে এ্যানিমেশন লাইট বক্সে ফেলে কেমন করে ছোট ছোট কার্টুন ছবি তৈরি করা যায় তা হাতে-কলমে শিখিয়ে -িচ্ছেছন। এর ফলে যাদের ছবি আঁকা বা এ্যানিমেশনে গল্প বলার ইচ্ছে আগ্রহ এবং সামান্য পারদর্শিতা আছে তারা স্কুলের ছাত্র জীবন শেষ করার আগেই এ্যানিমেশনে দক্ষ হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। শিশু বা তরুণদের কথা বাদই দিলাম, আমাদের দেশে চলচ্চিত্রে ছোটখাটো এ্যানিমেশনের কাজ করতে গেলে বুড়োদেরও হেরিকেন দিয়ে খুঁজে বের করা কঠিন।

আশির দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে দুজন শিল্পী এবং সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্মকর্তাকে এ্যানিমেশন শিখতে জার্মানিতে পাঠানো হয়েছিল। কর্মকর্তাদ্বয় কি শিখে এসেছিলেন আল্লাহ মালুম। তবে বিটিভির শিল্পী দুজন ফিরে এসে কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন। একটি এ্যানিমেশন টেবিল এবং লাইট বক্স ইত্যাদি অল্প কিছু ব্যয় অনুমোদনের জন্য বিস্তর লেখালিখির পরেও এ্যানিমেশনের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগই সফল হয়নি। ফেরদৌসি পিনু আপা, যিনি পরবর্তী সময়ে বিটিভির শিল্প নির্দেশনা বিভাগের পরিচালক হিসাবে অবসরে গেছেন, তিনি হতোদ্যম হয়ে সম্ভবত এক সময় শেখা এ্যানিমেশনের কথা ভুলেও গেছেন। আশির দশকেই আমার প্রযোজিত একটি অনুষ্ঠানে টাইটেল হিসাবে আমরা দেড় মিনিটের একটি এ্যানিমেশন ব্যবহার করেছিলাম। এ্যানিমেশনের সেল ড্রইং করেছিল এনামুল করিম নির্ঝর এবং ষোল মিলিমিটার ক্যামেরায় এক ফ্রেম এক ফ্রেম করে ছবি তুলেছিলেন চিত্রগ্রাহক মাযহারুল ইসলাম।

অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ফর চিল্ড্রেন এ্যান্ড ইয়ং-পিপল উপলক্ষে এ্যানিমেশন ওয়ার্কশপ ছাড়াও পাশাপাশি মাসব্যাপী সেমিনার, ওয়ার্কশপ, মাস্টার কাস এবং প্রদর্শনী উত্তর-পশ্চিম গ্রিসের পেলোপনেসের পুরোটা জুড়েই চলতে থাকে। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ কর্মশালা, স্পেশাল ইফেক্ট ওয়ার্কশপের মতো পেশা ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বিশেষ একটি উদ্যোগ স্কুল ফিল্ম প্রজেক্ট। স্কুলের শিক্ষকদের চলচ্চিত্র নির্মাণের সহজবোধ্য সাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাণ কৌশলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে পরবর্তী সময়ে ছাত্র-ছাত্রীদের যুক্ত করে ছোট ছোট ছবি তৈরি করে স্কুল থেকেই উৎসবে পাঠানো হয়। নির্বাচিত স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ছবিগুলো প্রদর্শন ছাড়াও পুরস্কারেরও ব্যবস্থা থাকে। আমাদের স্প্যানিশ বন্ধু লোলা ফার্নান্দেজের ছবিটিও তেমনি একটি নির্মাণ। বাইরে যখন এ্যানিমেশন ওয়ার্কশপ চলছে তখন ভেতরে চলছে স্কুল সিনেমা। লোলার ছবিসহ স্কুলের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আরো কিছু কাজ দেখার জন্যেই ঢুকে পড়লাম প্রদর্শনী হলে। স্কুলের মেয়েদের খেলাধুলা, (শরীরিক কসরৎ এবং কোরিওগ্রাফির সমন্বয়ে একটি মিউজিক্যাল ডকুমেন্টারি বলা যায়। আহামরি ধরনের না হলেও লোলার স্কুলের কাজটি ভালো লেগেছে। প্রত্যেক প্রদর্শনীর পরেই কিছুক্ষণ প্রশ্নোত্তোর পর্ব চলতে থাকে, দর্শকদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ, বিশেষ করে তরুণ নির্মাতারা অনেক কিছু জানতে চায়। তেমনি প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হলে স্প্যানিশ ভাষার কারণে প্রশ্নোত্তরের কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে প্রশ্নোত্তরের বিভিন্ন পর্যায়ে লোলা যখন উত্তর দিচ্ছিল, তখন মহা উত্তেজনায় পেপে তার সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিল বারবার। কোনো প্রশ্নের উত্তর সে দেয়নি, কিন্তু স্ত্রীর চেয়ে তাকেই যে বেশ নার্ভাস লাগছিল, সেটা দেখে বেশ মজা পেয়েছি।

লিটল মাউন্টেন বয়

বিকেলে এ্যাপোলো থিয়েটারের দিকে যাবার জন্যে বেরিয়েছি, তখনই টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হলো। এমনিতেই যথেষ্ট ঠাণ্ডা তারমধ্যে বৃষ্টি এসে রীতিমতো কাঁপ ধরিয়ে দিলো। বৃষ্টির মধ্যেই বেশ জোরে হেঁটে, বলা যায় ছুটতে ছুটতে ফুটপাথ ধরে এগোচ্ছি। পেছন থেকে একজন আমার চেয়েও দ্রুত হেঁটে আমাকে ধরে ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইউ মাস্ট বি গোয়িং ট্যু এ্যাপোলো থিয়েটার?’ আমার চেহারা সুরত গ্রিকদের মতো নয়, তাছাড়া একজন বিদেশি যখন বৃষ্টি মাথায় করে সামনে ছুটছে, সে নিশ্চয়ই ফিল্মের লোকই হবে। অবশ্য হতে পারে তিনি তিনি আমাকে হোটেল থেকে বেরোতে দেখেছেন। বললাম, ‘তোমার অনুমান সঠিক।’ জানতে চাইলেন, আমি কোন দেশ থেকে এসেছি। আমি ধরেই নিয়েছিলাম এরপরে আমাকে বাংলাদেশ কোথায় সেটা বোঝাবার জন্যে অনেক কথা বলতে হবে, তবুও বললাম, ‘বাংলাদেশ!’ আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে তুমি নিশ্চয়ই ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের নাম শুনেছো?’ বললাম, ‘ফেস্টিভ্যাল তো বটেই, ঢাকা শহরে যারা দীর্ঘদিন ফিল্ম নিয়ে কাজ করছে তাদের সবাইকেই কমবেশি চিনি।’ এবারে তিনি বললেন. ‘তোমাদের ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যালে আমাদের ছবিটা পাঠিয়েছি। আগে ওরা বেশ যোগাযোগ রেখেছিল, কিন্তু ছবি পাঠাবার পরে এখন মেইলেরও উত্তর দিচ্ছে না।’
এর মধ্যে আমরা এ্যাপোলো থিয়েটার চত্বরে পৌঁছে গেছি। এবারে আমার প্রশ্ন করার পালা। বললাম, ‘তোমার কোন ছবি? অলিম্পিয়া ফেস্টিভ্যালে এসেছে?’ নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি দিতি ব্রæক, লিটল মাউন্টেন বয় ছবির প্রযোজক। ছবিটাগতকাল দেখানো হয়েছে।’

‘অসাধারণ ফিল্ম- চমৎকার নির্মাণ। আমি গতকাল থেকেই ভাবছিলাম, এ ধরনের একটা ছবি তৈরি করা কিভাবে সম্ভব!’ প্রযোজক দিতি ব্রুক তাঁর ছবি নির্মাণের কথা, বিশেষ করে কিভাবে প্রকৃত তুষারপাতের দৃশ্যের সাথে স্টুডিওতে কৃত্রিম তুষারের দৃশ্য সৃষ্টি করে দুটোকে মিলিয়ে নিয়েছেন সেই কৌশলগত দিকগুলো বিস্তারিত বললেন। বাজেট সম্পর্কিত প্রশ্ন করাটা নেহায়েত ভদ্রজনোচিত নয় বলে বললাম, ‘তোমার বাজেট নিশ্চয়ই অনেক বড় অংকের?’ দিতি যে বাজেটের কথা বললো, তা শুনে আমার হয়তো তখনই হার্ট এ্যাটাক হয়ে যেতো। কিন্তু সেই মুহূর্তে মান্দি এসে আমাকে বাঁচিয়ে দিল। সে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমরা তো মনে বৃষ্টিতে ধরা পড়েছিলে?’ আমি বললাম, ‘এমনিতে শীতের সময় তার মধ্যে বৃষ্টি! তোমরা এই অসময়ে উৎসব আয়োজন করেছো কেন?’

মান্দি বললো, ‘বছরের এই সময়টা পিরসগে কখনোই বৃষ্টি হয় না, এবারে ব্যতিক্রম!’
বললাম, ‘তা হতে পারে। আমি তো বৃষ্টি বাদলের দেশ থেকে বৃষ্টি সাথে করেই এসেছি।’
কথা হয়তো আরো কিছুক্ষণ চলতো। এরই মধ্যে পরবর্তী শো-এর সময় হয়ে এসেছিল। আমি আর দিতি থিয়েটারের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। এ দিনের প্রতিযোগিতার মূল ছবিটা ছিল রূপকথার কাহিনি, চেক রিপাবলিকের ‘দ্য ক্রাউন প্রিন্স।’ ছবি শেষে আবারো সেই দীর্ঘশ্বাস, গত পঞ্চাশ বছরে এমন একটা সিনেমাও আমরা বানাতে পারিনি। (চলবে…)

Exit mobile version