ফরিদুর রহমান : যে কোনো চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথমদিনে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরেই সাধারণত ‘ওপেনিং ফিল্ম’ হিসাবে একটা নির্বাচিত চলচ্চিত্র দেখানো হয়। অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এদিক থেকে ব্যতিক্রম। উপস্থাপক দুজনের উদ্বোধনী ঘোষণার পরে পরিবেশিত সঙ্গীত এবং ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিকের ফাঁকে ফাঁকে উপস্থিত গণ্যমান্যজনেরা দর্শক সারি থেকে উঠে মঞ্চে উঠে বক্তব্য দিয়ে গেলেন। এখানে লাইন দিয়ে মঞ্চ আলো করে বসে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রধান অতিথি গিওরগস গিওরোগিওপুলাসও মঞ্চে উঠে এসে সংক্ষেপে কথা শেষ করে একই সাথে অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং ‘ক্যামেরা জিজানিও’র উদ্বোধন ঘোষণা করলেন। ‘ক্যামেরা জিজানিও’ আসলে মূল চলচ্চিত্র উৎসবের পাশাপাশি তরুণদের তৈরি চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী। এখানে তিনটি ভিন্ন ক্যাটাগরিতে বার বছর বয়েস পর্যন্ত শিশু, তের থেকে ষোল বছর বয়েসের কিশোর-কিশোরী এবং সতের থেকে কুড়ি বছর বয়সের তরুণরা নিজেদের তৈরি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এই প্রতিযোগিতামূলক আয়োজনে পাঠাতে পারে। যে কোনো মাধ্যম ব্যবহার করে সর্বোচ্চ দশ মিনিট ব্যপ্তিকালের ছবির এই প্রদর্শনীও চলছে ষোল বছর ধরে।

এক সময়ের শিশু কিশোর নির্মাতাদের অনেকেই এখন শিল্পিত চলচ্চিত্র নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেছেন। গ্রিসের সিনেমাকে দেশে বিদেশে পরিচিত করিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং বাণিজ্য দুদিক থেকেই সাফল্য রয়েছে এই উদ্যোগের। সিনেমা তৈরিতে বেসরকারি উদ্যোগে গ্রিসের শিশুদের সাবালোকত্ব অর্জন করতে সময় লেগেছে পনের বছর। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা বা বিএফডিসি নামে আমাদের একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠান গত ষাট বছরেও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। আন্তর্জাতিক মান তো দূরে থাক, জাতীয় পর্যায়ের চলচ্চিত্রে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ বয়োবৃদ্ধ এই অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানটিকে এখন মৃত ঘোষণা করে সৎকার করার সময় এসে গেছে। বিদেশের যে কোনো চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিতে গেলে বা মানসম্পন্ন কোনো ছবি দেখলে এই কথাগুলো নতুন করে মনে হয়।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর

উৎসবের প্রাণপুরুষ ফেডিভ্যাল ডিরেক্টর দমিত্রিস স্পাইরোউ তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে বললেন, ‘পৃথিবীর অর্ধশতাধিক দেশ থেকে আসা ছবিগুলোর মধ্য থেকে যে সব ছবি প্রদর্শনীর জন্যে নির্বাচিত হয়েছে সেই সব ছবির বিষয়বস্তুর ভেতরে বর্তমান বিশ্বের আলোচিত সকল ইস্যুই উঠে এসেছে। তবে তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সিনেমা প্রেমিক তরুণরা নীরব দর্শক হয়ে এ সব ছবি উপভোগ করুক তা আমরা চাই না। তরুণদের ভাবতে হবে, বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে এবং সিনেমার মতো মাধ্যকে ব্যবহার করে যারা শিল্প সৃষ্টি করেছের সেই সব সৃজনশীল মানুষের নান্দনিক ভাবনার চর্চা করতে হবে। আমরা অবশ্যই আশা করতে পারি, শিশু ও তরুণদের একটি চলচ্চিত্র উৎসব তরুণদের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে।’

দমিত্রিস তাঁর ‘ভাবতে হবে’ কথটা এমন জোর দিয়ে একাধিকবার বললেন, যে আমার সঙ্গে সঙ্গেই ঋত্তি¡¡ক ঘটকের কথা মনে পড়ে যায়। তিনিই তো বলেছিলেন, ভাবো, ভাবো, ভাবা প্রাকটিস করো।’ দমিত্রিস চলচ্চিত্র নির্মাতা নন, কিন্তু তিনি একজন অসাধারণ চলচ্চিত্র সংগঠক। তিন দশকের বেশি সময় ধরে শুধু গ্রিসে নয়, ইউরোপের একটা বড় অংশ জুড়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা, চলচ্চিত্র কর্মী ও চলচ্চিত্রে উৎসাহী, বিশেষ করে তরুণদের নিয়ে কাজ করছেন। এদিকে ঋত্তি¡কের মৃত্যুর চারদশক পার হলেও আমরা এখনো ভাবতে শুরু করিনি। আসলে ঋত্তি¡ক ঘটককে নিয়ে আমাদের আবেগ যতো বেশি তাঁর চলচ্চিত্র চিন্তা নিয়ে আমাদের ভাবনা ততোটাই অস্বচ্ছ এবং অসংগঠিত।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হতেই রাত সাড়ে দশটা বেজে গেল। মান্দি আগেই বলে রেখেছিল ওপেনিং নাইট ডিনারে যাবার জন্যে আমরা যেনো অনুষ্ঠান শেষে বাইরে দাঁড়ানো বাসে উঠে পড়ি। ক্যামেরা জিজিনিওর তরুণ নির্মাতা, মঞ্চের শিল্পী এবং কলাকুশলী আয়োজকদের কেউ কেউ উঠে পড়ার পরেই বাস চলতে শুরু করলো। এমনিতেই পিরগসের পথে জনসমাগম কম, রাতের শহর আরো শান্ত, আরো নির্জন। মিনিট দশ পনের পরে আমরা যেখানে এসে পৌঁছলাম সেটি মনে হলো শহর থেকে এখটু বাইরে। বিশাল রেস্টুরেন্টের সামনে বিস্তৃত পার্কিংলট, চারদিকটা বেশ খোলামেলা। রেস্তোরাঁর পুরো হলটাই অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জন্য বুক করা ছিল। ভেতরে ঢুকে বুঝলাম, যাদের নিজেদের বাহন আছে অথবা যাদের পথঘাট চেনা আছে তেমন অনেকে আমাদের আগেই এসে উপস্থিত হয়েছেন। ভোজসভা বলে কথা। খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে আগেভাগে চলে আসার ব্যাপারটা নিশ্চয়ই এরাও জানে!

আমি চারিদিকে তাকিয়ে কোথায় বসা যায় ভাবছিলাম। ইউরোপে খাবার টেবিলে একেবারে অপরিচিতজনদর সাথে বসার ক্ষেত্রে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি। এখানে পার্টি চলতে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। এতোটা সময় টেবিলে মুখ গুঁজে শুধু খাবার খেয়ে সময় কাটানো কঠিন। বাঙালির বিয়েবাড়ির দাওয়াত হলে হাপুস হুপুস করে খেয়ে পান মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়া যায়। এখানে পান দিয়েই শুরু হয়, তবে সে পান চিবিয়ে খাবার জন্যে নয়। আমি যখন শূন্য আসনের জন্য এদিক সেদিক তাকাচ্ছি তখন লোলা আর একবার ‘ওলা ওলা’ বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার সামনের শূন্য আসনটা দেখিয়ে দিল। ধন্যবাদ দিয়ে বসে পড়লাম এবং তার পরপরই পান পাত্র ভরে পানীয় আসতে শুরু করলো। যেহেতু এটি একটি সার্বজনীন সমাবেশ, সেই কারণে কঠিন কোনো ড্রিংকের ব্যবস্থা ছিল না। তবে কোকাকোলা ফান্টার মতো কোমল পানীয়ের সাথে পরিবেশিত হলো রেড ওয়াইন এবং হোয়াইট ওয়াইনের মতো একেবারেই নির্দোষ কিছু তরল পদার্থ। আমি বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবছিলাম। লোলার পাশে বসা মেয়েটি বললো, ‘এটা কিন্তু টেবিলের শোভা বর্ধনের জন্যে নয়। ঢেলে নাও, অবশ্য আমি তোমকে সাহায্য করতে পারি।’ বলেই সে আমার পাত্র পূর্ণ করার পূণ্য অর্জনে আর দেরি করলো না।

ইতিমধ্যেই দেখা গেল গ্রিক যোদ্ধাদের মতোই বিশালদেহী পরিবেশকরা তাদের হাতের তালুতে বড় আকারের পরিপূর্ণ ট্রে নিয়ে অবলীলায় ছুটে বেড়াচ্ছে টেবিল থেকে টেবিলে। স্যুপ, সালাদ, বেকড, ফ্রাই, গ্রিল একের পর টেবিলে এসে নামতে থাকে। গ্রিকদের নৈশভোজ কয় পর্বে সম্পন্ন হয় আমার জানা নেই। তবে ইউরোপের সভ্য সমাজের পাঁচ কোর্স ডিনারের ককটেইল, এপিটাইজার, স্টার্টার, মেইন কোর্স এবং ডেজার্ট এই পাঁচটি পর্ব সম্পন্ন হতে হতেই রাত প্রায় বারোটা বাজলো। স্বাদে গন্ধে আমাদের উপমহাদেশিয় খাবারের সাথে গ্রিক খাবারের বেশ কিছুটা মিল আছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিশেষ করে ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম বা পোল্যন্ডে যে সকল বাঙালি খেতে না পেরে হা হুতাশ করেন, তাঁরা গ্রিসে এলে হতাশ হবেন না সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আমি ভোজন রসিক না হয়েও এটা সেটা চেখে দেখতে দেখতেই মনে হলো বেশি খেয়ে ফেলেছি। সকালের ঘোরাঘুরি, সারাদিনের জার্নি, সন্ধ্যার দীর্ঘ অনুষ্ঠান শেষে ভালোমন্দ খাওয়া দাওয়ার পরে আমার রীতিমতো ঘুম পাচ্ছিলো। কিন্তু গল্পগুজব, হৈচৈ এবং হাসির হুল্লোড় দেখেমনে হলো এই তুমুল আড্ডা খুব সহজে শেষ হবে না।

উদ্বোধনী নৈশ্যভোজ

এখান থেকে একা হোটেলে ফিরে যাবার কোনো ব্যবস্থা নেই। কাজেই রাত সাড়ে বারোটার দিকে যখন ভাবছি কী করা যায়, তখন মান্দি এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি খুব টায়ার্ড? যদি হোটেলে ফিরতে চাও তাহলে ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’ আমি একটু দ্বিধা নিয়েই বললাম, ‘থেকে যেতে পারলে ভালোই হতো, কিন্তু আমার সত্যিই ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।’ মান্দি বললো, ‘আরো কত রাত পর্যন্ত এই আড্ডা চলবে বলা কঠিন। তুমি আমার সাথে এসো।’
লোলা এবং তার পাশ্ববর্তিনীকে হাতের ইশারায় বিদায় জানিয়ে বাইরে এসে দেখলাম দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি। একটি মাইক্রোবাসে আমার মতো দুই তিনজন ছাড়াও বয়োবৃদ্ধ একজন জুরি আগে থেকেই উঠে বসে আছেন। তবে অবাক হলাম, বলকানের কয়েকজন তরুণ, যাদের এখন হৈচৈ করার বয়স, তারাও বেরসিকের মতো আনন্দ কোলাহল পেছনে ফেলে আমাদের সাথে শহরের পথে ফিরে চললো। হোটেলে নিজের ঘরে পৌঁছে দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়লাম।
একটানা প্রায় সাত ঘণ্টা ঘুমিয়ে পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো সাড়ে আটটার দিকে। হোটেলে ব্রেকফাস্ট সকাল সাতটায় শুরু হয়ে দশটা পর্যন্ত চলে। কাজেই আলসেমী করার উপায় ছিল না। তাছাড়া অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের অভ্যর্থনা কেন্দ্র এবং মূল অফিস পিরগসের কনফারেন্স হলে পৌঁছাতে হবে সকাল দশটায়। কাজেই নাস্তা শেষ করেই বেরিয়ে পড়লাম। অলিম্পাস হোটেল থেকে কনফারেন্স হল সাত আট মিনিটের হাঁটা পথ, তবে এবারের রাস্তা এ্যাপোলো থিয়েটারের রাস্তার বিপরীত দিকে। মূল রাস্তা ধরে এগোবার পরিবর্তে মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে গলিপথের ফুটপাথ ধরে হাঁটছি। হঠাৎ করেই বেশ মোটাসোটা দশাসই এক মহিলা পথ আগলে দাঁড়ালেন। তার হাতে একটা লম্বা হাতলওয়ালা ঝাড়–, সম্ভবত দোকানের সামনেটা পরিস্কার করছিলেন। প্রথমে বিপদের আশঙ্কা করে একটু চমকে গেলেও তাঁর হাসি হাসি মুখ দেখে একটু ভরসা পেলাম। তিনি ভেতরের দিকে লক্ষ করে উচ্চ কণ্ঠে কাকে যেনো ডাকছিলেন এবং একই সাথে আমাকে কী যেনো বলে বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন। একটু পরেই যিনি ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন তার চেহারা সুরত দেখেই বোঝা যায় তিনি আমার দেশিভাই নির্ভেজাল বঙ্গদেশি। কিন্তু আমি অবাক হলাম এই মহিলা কেমন করে ধারণা করলেন ছেলেটি আমার দেশের মানুষ! আমি এবারে তাঁর কথার মর্মার্থ উদ্ধার করলাম। তিনি আসলে বলতে চেয়েছিলেন, ‘ইওর কান্ট্রি ম্যান! ইওর কান্ট্রি ম্যান!’

আমার কান্ট্রিম্যান কিভাবে এই পাণ্ডববর্জিত গ্রিসের সুদূর পিরগসে এসে পৌঁছালেন আমি সেই রহস্য ভেদের চেষ্টা করলাম। জিজ্ঞেস করলে নাম বললেন সিরাজ। ত্রিশ বত্রিশ বছরের তরুণ আট বছর আগে মাদারিপুর থেকে ইতালি এসেছিলেন, তারপরে কয়েক বছর ইতালিতে কাটিয়ে সেখান থেকে বছর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বছর তিনেক আগে ঢুকে পড়েছেন গ্রিসে। প্রথম দিকে এথেন্সে থাকলেও গ্রিসের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে থাকলে কিছুদিন আগে পিরগসে এসেছেন। সিরাজের ধারণা পিরগসের মতো ছোট শহর অবৈধ অভিবাসিদের জন্য অনেকটা নিরাপদ। জানতে চেয়েছিলাম, বাড়িতে যোগাযোগ আছে কিনা? জানালেন, বাড়িতে যোগাযোগ আছে, এখানে ছোট একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করে মাঝে মাঝে টাকা পয়সাও পাঠান, কিন্তু দেশ ছাড়ার পরে আর কখনোই দেশে যাওয়া হয়নি। আশা আছে ‘কাগজ’ হয়ে গেলেই একবার দেশে যাবেন।

আমার আরো কিছু জানবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম সময় পৌনে দশটার কাছাকাছি। আমি শুধু আমার বিস্ময় প্রকাশ করে জানতে চাইলাম, ‘তোমার সহকর্মী আমাকে চিনতে পারলেন কেমন করে?’
সিরাজ জানালেন, ‘এমনিতে ও খুবই খুব ভালো মানুষ, বুদ্ধিশুদ্ধিও ভালো। আপনাকে দেখেই ধারণা করেছে।’ আমি কেন পিরগসে এসেছি জানতে চেয়েছিলেন সিরাজ। বললাম, একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এসেছি।’
‘ওহ আপনি ফিল্মের লোক!’

কর্মব্যস্ত ফেস্টিভ্যাল দপ্তর

বললাম, ‘নারে ভাই, আপনি যে অর্থে ফিল্মের লোক ভাবছেন তা নয়।’ একজন অভিবাসি শ্রমজীবী মানুষকে ডকুমেন্টারি ফিল্ম বা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বোঝানো একটু কঠিন। সময় না থাকায় আমি দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কনফারেন্স হলের পথ ধরলাম।

কনফারেন্স হল খুঁজে বের করতে কোনো সমস্যা হলো না। হলের বাইরে সিঁড়িতে তরুণ চিত্র নির্মাতারা আসর জমিয়ে বসে আছে। এখানেই কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হবে তরুণ নির্মাতাদের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি। অফিস কক্ষে উপস্থিত হয়ে দেখলাম টেবিলে লাপটপ, ডেস্কটপ, প্রিন্টার, স্ক্যনারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম সাজিয়ে মান্দিসহ আরো কয়েকজন তরুণ তরুণী উৎসবের বিভিন্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত। মান্দি একটি ছেলের সাথে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পরে সে পরিচয়পত্র, ক্যাটালগ, সময়সূচি এবং পিরগস শহরের ম্যাপ ও নির্ধারিত ভ্যেনু-হোটেল-রেস্টুরেন্টের তালিকা ইত্যাদিসহ আমার হাতে একটি ব্যাগ ধরিয়ে দিল। কমলা রঙের ফিতাওয়ালা আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে ছেলেটির সামনে বসলে সে একগুচ্ছ কুপন দিয়ে বললো, ‘এই হচ্ছে তোমার লাঞ্চ এবং ডিনারের কুপন। নির্ধারিত এগারোটা রেস্টুরেন্টের যে কোনোটাতে ঢুকে এই কুপন জমা দিয়ে তোমার পছন্দ মতো খাবার নিয়ে খেতে পারো। তবে কুপনের সর্বোচ্চ সীমা সাড়ে সাত ইউরো, বিল এরচেয়ে এর বেশি হলে সেটা তোমার নিজের পরিশোধ করতে হবে। কোনো আনুষ্ঠানিক ডিনার বা লাঞ্চ থাকলে সেদিন অবশ্য কুপন ব্যবহার করার দরকার হবে না। এ ছাড়া বিয়ার বা অন্য কোনো এ্যালকোহলিক ড্রিংক কুপনে অন্তর্ভূক্ত নয়। আমি মনে মনে বললাম, সাড়ে সাত ইওরো শেষ করাই আমার জন্যে কঠিন হবে, আর পানি যদি পান করতে ইচ্ছে করে সে জন্য বাড়তি দুই ইওরো পকেট থেকে বের করতে কোনো কষ্ট হবে না।

দাপ্তরিক ঝামেলা শেষ করে আমি কনফারেন্স হলে ‘ক্যামেরা জিজানিও’ শিরোনামের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি দেখতে ঢুকে গেলাম। কনফারেন্স হলের মিলনায়তনটা আধুনিক এবং ধারণ ক্ষমতাও মনে হলো অনেক বেশি। সকাল সাড়ে দশটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত শিশু কিশোর নির্মাতাদের অনেকগুলো ছোট ছোট ছবি দেখলাম । তার মধ্যে ক্রোয়েশিয়ার ‘ইন সাইড দ্য ওয়াল’ একটি বিচ্ছিন্ন পরিবারের গল্প এবং দুই অসম বয়েসী বন্ধুত্বের গল্প নেদারল্যান্ডসের ‘সুইট কিটি’ বেশ মনে আছে। তবে এই দিনের সবচেয়ে ভালো লাগা ছবিটি ইজরায়েলের ‘দ্য বøাক স্ক্রিন’ অনেকটা গোয়েন্দা কাহিনির আদলে তৈরি। ছবিটির সারকথা সত্যের অনুসন্ধান! ছোট ছোট ছবি, বিশেষ করে অনেকগুলো এ্যানিমেশন ফিল্ম ভালো লাগলেও অনেক ছবির ভিড়ে বেশিরভাগই স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে।

কনফারেন্স হল থেকে যখন বের হলাম তখন লাঞ্চের সময় হয়ে হেছে। ম্যাপ দেখে নিশ্চয়ই রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করা যাবে। কিন্তু এগারোটা রেস্টুরেন্টের মধ্যে একটাকে বেছে নেওয়া সত্যিই কঠিন। (চলবে…)