বিদ্যুৎ সরকার : ডিসেম্বর মাস এলেই ঝর্না মাসীর কথা খুব বেশি মনে পড়ে আমার। তখন আমরা বাগেরহাট থাকতাম, শহরের প্রাণ কেন্দ্রে আমলা পাড়ার দো-চালা টিনশেড দুই কামরার বাড়িতে আমাদের আবাস। ঘরের সামনেই ছোট্ট একটি গোলাপ বাগান। মা’র মায়াবী হাতের সোহাগি ছোঁয়ায় কী এক মৌতাত নিয়ে গোলাপ তার পাপড়ি মেলে ধরতো দখিনা বাতাসে। সুবাস ছড়িয়ে দিত হৃদয়ের গহীনে। যেমন শোনা যেত মৌমাছিদের গুঞ্জন তেমনি জন-মানবের কলতানও। আমাদের একটি বাড়ির পরই ঝর্ণা মাসীদের বাড়ি। বয়সের অনেকটা পার্থক্য থাকা সত্তে¡ও আমার মা’র সাথে তার সখ্যতা ঘটে ছিল প্রায়শই আসা যাওয়ার কারণে। এটা ওটা বিশেষ কিছু রান্না করলে আমাদের জন্য নিয়ে আসাটা তার চাই। ফুল ভালোবাসাটা ছিল উভয়ের মধ্যে যোগাযোগের অন্যতম একটি কারণ। অনেকের মতো আমার ঝর্ণা মাসীও আসতো ফুলের শোভা দেখতে ও মন মাতানো সৌরভ নিতে।
আমি তখনও স্কুলের গন্ডি পের হয়নি, ঝর্ণা মাসী তখন কলেজে প্রাক্তন। আমাদের বাসার সামনে দিয়েই তার হেঁটে কলেজে যাওয়া আসা। আমি পড়ার টেবিল থেকেই জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম তার চলে যাওয়া। মাঝে মাঝে সে আমার জানালার গভীরে তাকিয়ে আমাকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করতো। এমন একটি ‘হাইড এন্ড সিক’ খেলার বিষয় আমাকে প্রাঞ্জল করে তুলতো নিয়ত। যেদিন মিস করতাম সেদিন মনটা খারাপ থাকতো সারাক্ষণ। বিকেলে এসে দু-তিনটি চকলেট হাতে গুজে দিয়ে দু’চোখে একটু আদর করে ও মিষ্টি হাসি দিয়ে মা’র কাছে চলে যেত। বিকেল হলে মা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতো কখন ঝর্ণা মাসী আসবে এবং একসাথে বসে চা-মুড়িমাখা খাবে। এভাবে ঝর্ণা মাসী বিশেষ করে মা ও আমার কাছে ভীষণ প্রিয় একজন হয়ে উঠলো। ঝর্ণা মাসী আমাদের বাসায় আসলে আমার ভাল লাগতো। এক সময় তার মাঝে মধ্যে না আসার ব্যাপার আমাকে কষ্ট দিতে শুরু করলো। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারতাম না, এমনকি ঝর্ণা মাসীকেও না। ঝর্ণা মাসীর উপর অনেক রাগ হতো কেন একবারও জড়িয়ে ধরে আদর করে জিজ্ঞেস করতো না, ‘কেন এতো মন খারাপ তোমার?’ তা হলেই তো আমি ভাল হোয়ে যেতাম তক্ষুনি।
এখন ঝর্ণা মাসী আমার রাগগুলো বুঝতে পারে। হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলে মা আমাকে ভীষণভাবে বকেছিল অংকে খারাপ করার জন্য। তাই সারাদিন শুয়ে বালিশে মুখ গুজে লজ্জা, রাগ, অভিমানে কেঁদে ছিলাম। বিকেলে ঝর্ণা মাসী এসে আমাকে ডেকে তার কোলে আমার মাথাটা তুলে চুলে হাত রেখে বলছিলো ‘কাল থেকেই আমি তোকে অংক করাবো এবং ফাইনালে তোকে লেটার মার্ক্স পাইয়ে ছারবো দেখিস’। পরদিন বিকেল থেকেই ঝর্ণা মাসী আমাকে অংক বুঝাতো এবং করাতো সহজভাবে। আমার কছে কিছুদিনের মধ্যে অংক হয়ে গেল সব চেয়ে সহজতর সাবজেক্ট।
– কি, অংক এখন কেমন লাগছে?
– ভালইতো।
– অংক বিষয়টা যে তোর কাছে এতো দূর্বোধ্য তা আগে বলিসনি কেন? শুধু কি কাঁদলেই অংক সহজ হয়ে যাবে?
– সেদিন কেঁদেছিলাম বলেইতো তোমার গায়ের ফুলের মিষ্টি গন্ধটা আমি নিতে পারলাম। মাসী তুমি সত্যি ভারি মিষ্টি।
আমার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। ঝর্ণা মাসী একদিন অংক প্রশ্ন ও এর সলিউসনগুলো আমার কাছ থেকে শুনে বলে দিল আমি নাকি অবশ্যই একশতে কমপক্ষে নব্বই পাবোই। এই বলে আমাকে মিষ্টি করে আদর করে দিল। আর যাবার সময় বার বার বলে গেল দীপাবলির দিন সন্ধ্যায় আমি যেন মাসীর বাসায় যাই প্রদীপ জ্বালানোতে তাকে সাহায্য করতে। আর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে গেল অনেক অনেক লাড়ু খাওয়াবে ও মিষ্টি একটি ফুলের গন্ধ শুকতে দেবে। আমিতো সেদিন থেকেই কাউন্ট ডাউন শুরু করে দিলাম সেই দীপাবলি দিনটির জন্য। অত:পর সে দিনটি এলো। আমার এক জন্মদিনে ঝর্ণা মাসীর দেয়া টি-শার্টটি পরেই গেলাম সন্ধ্যা হবার আগে ভাগেই। আমাকে দেখেতো মাসী যার পর নাই খুশী। কাছে যেতেই জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে আমাকে ভরিয়ে দিল। ঠোঁট উল্টিয়ে অভিমান করে জিজ্ঞেস করলো কেন আসতে এতো দেরি করলাম। দুপুর থেকেই মাসী একা বসে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করে আসছিল। ‘সরি’ বলতেই মাসী শাস্তি স্বরূপ চার চারটি চুমু আদায় করে নিল আমার কাছ থেকে। আমার কিন্তু একটু একটু লজ্জা করছিল কিন্তু উপায় ছিল না। আমার আদরের ঝর্ণা মাসী বলে কথা – আদরের নাছোড়বান্দা আঁচর তার চাইই চাই। আমিও কি বুঝে চোখ বুজে তাকে আদর দিয়ে দিলাম ঝটপট।
অনেকগুলো প্রদীপ হাতে দিয়ে দেখিয়ে দিল কেমন করে সাজাতে হবে। সেও আমার সাথে সাথে প্রদীপ সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তার সাজানো শেষ হওয়াতে ভিতরে গিয়ে বাটি ভর্তী বিভিন্ন রকমের নাড়ু নিয়ে এলো সাথে মিষ্টান্নও। ওগুলো দু’জনে মিলে খেয়ে শেষ করতে করতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। তখন প্রদীপ জ্বালানোর পালা, আমরা একে একে সব প্রদীপ জ্বালানোর কাজ শেষ করলাম তখন সত্যিই দারুণ লাগছিল দেখতে। মাসী আগে থেকে ঘরের সবগুলো লাইট নিভিয়ে রেখেছিল। তা না হলে এতটা সুন্দর দেখাতো না। আমার হাতে এক বক্স তারা বাজি দিয়ে বললো জ্বালাতে। সেও ওখান থেকে কয়েকটি নিয়ে জ্বালাতে শুরু করে দিল। পড়ে, মাসী অন্ধকার এক কোনে বসে আমার বাজি পোড়ানো দেখছিল আর মিটি মিটি হাসছিল। বাজি পোড়ানো শেষ হলে মাসী ডাকতেই ছুটে গেলাম। কাছে যেতেই এক টানে আমাকে জড়িয়ে ধরে তার বুকের মাঝে রেখে দিল অনেকক্ষণ। আমি যেন বেলী ফুলের মাঝে আমার মুখ লুকিয়ে রেখে ছিলাম আর সুবাস নিচ্ছিলাম প্রাণ ভরে। সেদিনই প্রথম আমি একটা ভিন্ন ধরনের শিহরণ অনুভব করলাম আমার দেহে ও মনে। যা এর আগে কখনো পাইনি আমি। কিছুক্ষণ পর মাসী জিজ্ঞেস করলো, আজকের বেলী ফুলের গন্ধটা কেমন লাগলো? আমি কিছুই বলতে পারলাম না। মাসী আমার নাক টিপে দিয়ে শুধু বললো, দুষ্টু মিষ্টি জান পাখিটা আমার।
আমার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো, কলেজে ভর্তিও হয়ে গেলাম আমি। আমার কলেজে যাওয়া শুরু হবে দু’দিন বাদেই। এরই মধ্যে দেশেজুড়ে শুরু হয়ে গেল অসহযোগ আন্দোলন এবং যা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে রূপ নিল। তখনই শুরু হয়ে গেল পাক বাহিনীর নিধন যজ্ঞ। সবাই তখন শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পালাচ্ছে আত্ম রক্ষার্থে। আমরা ও ঝর্ণা মাসীরা প্রথমে তাই করলাম। কিছুদিন পর বুঝে গেলাম গ্রামে থাকাটাও নিরাপদ নয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো ওপার বাংলায় চলে যাওয়া। যেখানে আমরা নিরাপদ থাকতে পারবো। চলে এলাম কল্যাণী শরনার্থী শিবিরে। আমরা ও ঝর্ণা মাসীরা শিবিরে একই সাথে ছিলাম প্রায় নয় মাসের মতো।
একাত্তরের ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে আমরা সরাসরি চলে এলাম বাগেরহাট। আমাদের পুরনো সেই বাড়িতেই। কিন্তু ঝর্ণা মাসীদের বাড়ির কোন চিহ্ন বা স্মৃতি সেখানে খুঁজে পাওয়া গেল না। যেটুকু ছিল শুধু মনের গভীরেই। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিরে এলাম। ওখানে এখন এক দখলদারের ইট – সিমেন্টের বাড়ি শোভা পাচ্ছে।
এ খবর জেনেই ঝর্ণা মাসীরা আসার সব উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে নিশ্চয়ই। কেনই বা ফিরে আসবে, কিসের টানে আসবে,কোথায় আসবে? তারা তো এখন ঠিকানা বিহীন, বাস্তু ভিটাহীন নতুন আরেক উদবাস্তু নিজ দেশে!
ডিসেম্বর মাস এসে যেমন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়। তেমনি, মনে করিয়ে দেয় ঝর্ণা মাসীর সেই হাসি হাসি মুখখানির কথা। বড় জানতে ইচ্ছে করে ঝর্না মাসী তুমি কি সেই আগের মতোই হাস? তুমি কি এখনো দীপাবলি এলে প্রদীপ জ্বালিয়ে ঘর সাজাও, বুকের মাঝে কি এখনো বেলী ফুল ফোটে, সুবাস ছড়ায়? ঝর্ণা মাসি আমাদের সেই কল্যাণী উদবাস্তু শিবির।বিনা টিকেটে ট্রেনে চড়ে প্রায়ই তোমার-আমার কাঁচরা পাড়া যাওয়া। ঘুগনি,চটপটি আর ফুসকা খাওয়া।
পয়সা জমিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে হিন্দি ছবি দেখা। এসব মধুর স্মৃতিগুলোর সাথে তুমিও বুঝি দু:খময় এক স্মৃতি হয়ে রয়ে গেলে আমার হৃদয়ের গভীরে?
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা