বিদ্যুৎ সরকার : কে শ রী
১.
স্বাধীনতা পূর্ব বর্ধিষ্ণু একটি সাবডিভিশন টাউন। মৃত প্রায় নদীর দু’পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠা দোকান-পাট। একটু ভিতরে মূল ব্যবসা কেন্দ্রসমূহ। একসময় মৃত প্রায় নদীটিই ছিল স্রোতস্বিনী, চঞ্চল, বহমান সুদূর প্রসারিত ও প্রাণ সঞ্চারের উৎস। এ নদীতেই আসতো শত শত পালতোলা ব্যবসায়ী নৌকা, বজরা, গয়নার নৌকা আরো কত কি। এ নদীর কল্যানেই তখন গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহ। এ শহর থেকেই প্রত্যন্ত গঞ্জে চালান হতো মালামাল। এ শহরকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখানকার শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলার প্রসারে বিশেষ অবদান রাখতে সমর্থ হয় বলে সবার বিশ্বাস। নিয়মিত সংস্কৃতি চর্চার জন্য যেমন স্থাপিত হয়েছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তেমনি খেলাধুলার জন্য ছিল পর্যাপ্ত সংগঠন ও সংগঠক। বছর ধরেই চলতো মাঠে-ময়দানে খেলা ধুলার আয়োজন। শীতের মৌসুমে এ শহরের চিত্র ভীষণভাবে পালটে যায়। ময়দানে বসে যাত্রা, আসে সার্কাস, চলে পুতুল নাচের ইতিকথা। যাকে কেন্দ্র করে এতোকিছুর সমাবেশ তা হলো শিল্প ও কৃষি প্রদর্শনী। সে সময় প্রতিটি মহকুমা শহরগলোতে শীতকাল এলেই বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনায় মাসব্যপী চলতো এ প্রদর্শনী। প্রতি রাতে প্রদর্শনীতে বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জের লোদের সমাগম হয় এ সকল আনন্দ উপভোগ করতে। সারা বছরের শ্রম, কষ্ট লাঘবে গ্রামীণ জনপদের মেহনতি মানুষের শ্রেষ্ঠ উপহার যেন এসকল আনন্দ উৎসব। প্রদর্শনীর বাইরেও চলমান বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে ঘিরে চলতে থাকে মেলা। তখন মানুষের মনে জাগে প্রাণের সঞ্চার। দেখা ও কেনার যৌথ আনন্দ ধারায় সিক্ত গঞ্জের জনগণ।
কেশরী সেসকল জনগণেরই একজন। শীতকাল আসলে আসে তার মনে সুখের পরশ, আনন্দের ছোঁয়া। রঙ্গিন তাঁতের শাড়ির চমক, খোপায় বেলি বা কাঠ গোলাপের মালা, হাত ভর্তি রেশমি চুরি, কোমরে রূপার বিছা, ছোট্ট একটি কাজ করা কাপড়ের মানিব্যাগ নাভির নিচে কাপড়ের সাথে গূজা, গলায় পড়া রূপোর মস্ত একটা হার। কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে সর্পিল গতিতে হেলে-দুলে শত ভিরের মাঝে হেটে যেতে মোটেও তোয়াক্কা করে না কেশরী। এ শহরে বসবাসরত অনেকের কাছেই কেশরী পরিচিত তার রূপ – লাবণ্য, আচার-আচরণ ও কথা বলার ঢং-এর জন্য। আছে অটুট যৌবন, শরীরি বাঁক, কথার ঠাট। কালো মসৃণ দেহের প্রকট আলো। চোখ ধাঁধাঁনো নয়ন তারার দৃষ্টি বিনিময়ে অপ্রকাশিত কত কথা। পলক হীন তাকিয়ে থাকার মতো তার পথচলা। কেশরী নিজেও জানে তার দেহের কোথায় কোথায় তাদের দৃষ্টি থমকে যায় সময় অসময়ে অহেতুক। কর্পোরেশন অফিস থেকে শুরু করে সাবডিভিশনের বড় বড় সকল অফিসেই তার অবাধ চলা চল। এমনকি বড় মাঝারি অফিসারগণ তার আচার আচরণে কখনো মনক্ষুন্ন হতে শোনা যায়নি।
২.
থানার ঠিক পিছনের দুই রুমের কোয়ার্টারগুলোর একটিতে কেশরীর আবাস। কেশরী ছাড়াও ওখানে আরও কয়েক পরিবারের বসবাস। মহিলা -পুরুষ সবাই কাজ করে। প্রতি সকালে ওদের কাজের ব্যস্ততা তুলনা মূলকভাবে বেশি। মহিলারা বাইরের রুটিন কাজ শেষ করে ঘরের কাজে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পুরষদের রুটিন কাজ করার পরও অনেক ছোটা কাজের হুকুম আসে প্রায় সময়ই। এটা বেতন ছাড়া তাদের বাড়তি আয়। যার ফলে বাড়তি পয়সার আনন্দটাও কখনো কখনো অনেক বেশি বাড়াবাড়ির পর্যায় চলে যায়। কেশরীকেই তখন এসব সামাল দিতে হয়। বড় বাবু ডাকলে জবাবদিহী করতে হয়। বড় বাবু জানে কেমন করে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়। আর এটা সবারই জানা তাদের স¤প্রদায়ের বেবাক ঝুট – ঝামেলা নিরসনে কেশরীই অনন্য। তাই, এদের মধ্য কোন সমস্যা দেখা দিলে প্রথমেই কেশরীকে ডেকে পাঠানো হয়। এইতো সেদিন তাদের দু’জন ধ্যানো মদ খেয়ে এক পর্যায় তুমুল ঝগড়া বাদিয়ে দেয় তখন, কেশরী এসে তার মিমাংসা করে। থানার সবার সাথেই তার ভাল সম্পর্ক শুধু ছোট বাবুর সাথেই তার যত খটমট সম্পর্ক। বদলি হয়ে এখানে আসার দিন কয়েক পর যেদিন কেশরীর সাথে প্রথম দেখা সেদিন কেমনভাবে তাকিয়ে দেখছিল তাকে, যেন কেশরীর শরীরের প্রতিটি বাঁক, খাদ চোখ দিয়ে চষে বেরাবে সে। কেশরী ছোট বাবুর খুব কাছে এসে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করেছিল “বাবু কবে আপনার বৌকে বাসায় এনে তুলবেন, আমি কিন্তু দেখতে যাবো, মিষ্টি খাওয়াবেন কিন্তু?” এর পর থেকে ছোট বাবুর চোখের দৃষ্টিভঙ্গীর আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। এইতো সেদিন ওদের সবার ওভার টাইম বিল নিয়ে মিউনিসিপালিটির সাথে একটা ছোট খাটো ঝামেলা বেধে যায় তখন, কেশরীর মাধ্যমেই তা মিমাংসা করতে হয়।
৩.
শরীরে জ্বর জ্বর অনুভ‚ত হওয়ায় বেশ কিছুদিন ঘর থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়নি কেশরীর। এতোদিন ঘরে শুয়ে বসে থাকতে মোটেও ভাল লাগছিল না তার। তাই অনেকটা জোর করেই আজ ঘর থেকে বের হয়ে আসে সে। বড় বাবুর সাথে দেখা করে পানের খিলি হাতে দিতেই বড় বাবু জানতে চাইলো এখন শরীর কেমন, জ্বর ভালো হোয়েছে তো, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছুটা সময় ওখানে দাঁড়িয়ে বড় বাবুর কুশলাদি জিজ্ঞেস করে তার কাজে নেমে পড়লো কেশরী। অনেকদিনের কাজ জমে আছে সেগুলোর খোঁজ খবর নেওয়া প্রয়োজন। তার অনুপস্থিতির কারণে কর্পোরেশনের কাছে একটা বিল আটকে আছে। এটার সুরাহা করতে তার মধ্যস্থতার দরকার।
কাজ সেরে বিকেলে ফেরার পথে হঠাৎ করেই থানার সিড়িতে ছোট বাবুর সাথে দেখা
– কেশরী তোকে অনেক দিন ধরেই খুঁজছি আমি, কোথায় ছিলি?
– জ্বর ছিল তাই বের হই নাই। কেন আমাকে দরকার?
– তোর বৌদি মানে আমার বৌ দু’দিন বাদেই আসছে, ঘর-দোর একটু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করার প্রয়োজন তো!
– অন্য কাউকে ডাকলেই তো হতো?
– সবাইকে দিয়ে কি সব কাজ হয় কেশরী। তুই যেমন করে একটা কাজ গুছিয়ে করবি সেটা কি অন্য কেউ পারবে বলে মন হয় তোর?
– শুধু ঘর-দোর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করাই তো?
– সে তো অবশ্যই, কোন আসবাব – পত্র কোথায় থাকবে, ঘরের আর কি কি জিনিস আনা প্রয়োজন?
– ঠিক আছে কাল আসিতো আগে, পড়ে দেখা যাবে।
আজও কেশরীর খোপায় বেলীফুলের মালা জড়িয়ে কপালে বড় একটি কালো টীপ লাগিয়েছে। হালকা নীল তাঁতের শাড়ির সাথে সাদা বেলীফুলের মালাটি খুব মানিয়েছে কেশরীকে। ঠোঁটে সাচি পানের রক্তিম আভা। ঘরের দরজা কিছুটা চপানো ছিল, তা ঠেলে ঢুকতেই চোখাচোখি হোয়ে যায় ছোট বাবুর সাথে। ছোট বাবু পত্রিকার আড়াল থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে হাসিমুখে কেশরীকে ভিতরে আসতে সম্ভাষণ জানায়। ছোট বাবু কিছু বলার আগেই শাড়ির আঁচল কোমড়ে পেচিয়ে ঘর পরিস্কারের কাজে নেমে পড়লো। কোন আসবাবপত্র কোথায় স্থাপন করলে ভালো দেখাবে এ সমস্ত কিছুও সে আয়ত্ত করেছে বিভিন্ন বড় অফিসারদের বাসায় কাজ করে করে। ছোট বাবু কেশরীর কাজের তারিফ করতে জানতে চাইলো তার কোন সহযোগিতার প্রয়োজন আছে কি না? তার দরকার নেই জানিয়ে কেশরী আনমনে কাজ করে যাচ্ছিল। ছোট বাবু তাকিয়ে তাকিয়ে নতুন কর দেখছিল কেশরীর দেহ-পল্লব, তার চঞ্চলতা, চপলতা, ঘুরে দারানোর ভংগী – যতই দেখছে তাকে ততই যেন অবাক হচ্ছে ক্রমশ। ছোট বাবু মনে মনে ভাবতে থাকে – নারীর যৌবন ফিরে আসে না, ফিরে আসে না ঝরা পাতার শোক আর বসন্তের শিহরন। কেশরী এখন রান্নাঘর পরিস্কারে ব্যস্ত। ছোট বাবু আধ শোয়া থেকে উঠে বসে ভাবছে এক অতি সাহসী পুরুষ বনে যেতে। ছোট বাবুর ছোট্ট একটি ইচ্ছে পূরণ, তাই বা কেন অপূর্ণ থাকবে হাতের নাগালের এতোটা কাছে এসে। হাত বাড়ালেই তো আকাশ, সে আকাশের একটি মাত্র তারাকেই তো একটু ছুঁয়ে দেখবে। কেশরী নিশ্চয়ই এতোটা নির্দয় হবে না, অবুঝের মতো ফিরিয়ে দিবে না তাকে। তার বিশ্বাস, কেশরী বাইরে থেকে যতটা কঠিন মনে হচ্ছে ভেতরটা মাখনের চাইতেও নরম মোলায়েম। যেই না কাছে এসে ছোট বাবু কেশরীকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো সাথে সাথে সে ফিরে তাকালো। ছোট বাবু কিছু বলা কওয়ার আগেই পাশে থাকা মাছ কাটার দাও হাতে তুলে নিয়ে ডান হাতের কব্জি বরাবর কোপ দিল। কেশরী ঘর থেকে ধির পায়ে বের হোয়ে গেল। ছোট বাবুর হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছিল অনবরত বিরামহীন।