হিমাদ্রী রয় : স্মৃতি এমন এক পারিন্দা (পাখি) যে কখনই উড়ানের জন্য অনুমতি নেয় না। এই অন্ধকার সময়ে যখন কেবল বিয়োগ আর বিয়োগ যোগের ঘরে শুধুই স্মৃতি।
কিছু শ্রুতি আর কিছু স্মৃতি নিয়ে আজকের বিষয় নারী। কঠোরের প্রচ্ছন্নে কোমলতার পরশ, কভু জনকের জানকি কভু রামের সীতা, কভু কালীর ক্রোধ, কভু শকুন্তলার শীতলতা, যমকে হারাতে পারে নারী এমন পতিব্রতা, নারীর আঙুল ধরে চলতে শেখে সারা সংসার, দোয়াতে যার হাত উঠলে বয় জান্নাতের হাওয়া। নারী কিংবা মা-কে নিয়ে কত কিছুই লেখা যায় তবে নারী নিজে কেবল মহব্বত লিখতে জানে তা সে যে রুপেই হউক কন্যা, জায়া, কিংবা জননী।
স্মৃতির ফ্ল্যাশব্যাক এ অন্ধকার উজালা হতেই ভেসে ওঠে যে নারী মুখ সে হলো মা। মা যিনি একজন নারী, মানবতার গৌরব, বাত্সল্যের মানদন্ড, প্রেমের সৌরভ, তিনিই শক্তির উপাসনা। ‘ইয়া দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রুপেণ সংস্তৃতা’ সকল জীবের মধ্যে মা-মাতৃ শক্তি বিরাজমান অর্থাত নারী শক্তি।
এই মন্ত্র উচ্চারিত হলেই আমি চলে যাই সেই আনন্দ ধাম কুমোর বাড়িতে যেখানে নিমগ্ন হয়ে বাঁশি পাল প্রতিমার চোখ ফোঁটাতেন, মন ছুটে যায় একশো আটটা পদ্মের খোঁজে।
‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী-পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি আপন অন্তর হতে’।
রবীন্দ্রনাথ কি বাঁশি পালকে জানতেন না বাঁশি পালের অন্তরে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অন্তর্জামী হয়ে। এই অর্ধেক মানবী আর অর্ধেক কল্পনার শিল্পীত প্রকাশই একুশ শতকের নারীর ক্ষমতায়ন।
‘বিশ্বায়নে, পন্যায়নে, প্রযুক্তিতে গৃহকর্মে, রান্নাঘরে, আতুঁর ঘরে কোথায় নেই নারী’।
আমাদের সবার জীবনে প্রথম নারী মা। শুরু এবং অন্তিম গন্তব্য। সফলতার যে স্তরেই থাকি না কেন আয়ুষ্কালে মন তালাশি হয় মায়ের কোলের লাগি আর মাটি যদি মা হয়ে তবে সবাইকে মাটিতেই মিশে যেতে হয়।
মায়েরা সহিষ্ণুতার পরাকাষ্ঠা। আমার মাকে কোন দিন, কোন বিষয়ে অভিযোগ করতে শুনিনি। জাতীয়তা, আন্তর্জাতিকতা নিয়ে আমার মায়ের কোন মাথা ব্যাথা ছিল না, রামকৃষ্ণ দেবের কল্যাণে রাণী রাসমনিকে জানতেন তবে বেগম রোকেয়াকে চিনতেন কিনা জানা নেই। সংসারে মায়ের অস্তিত্ব বলতে সবার আগে ঘুম থেকে উঠা, ফুল তোলা, ঠাকুর ঘর আর রান্নাঘরে কাজের লোকেদের তদারকি করা, এবং সবার শেষে শুতে যাওয়া। মাকে জিজ্ঞেস করে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি কখনোই। এসব বাবা অথবা বড় ভাইয়েরাই নিতেন অবশ্য মাকে এসব বিষয় নিয়ে অধিকার যাতাতে যেয়ে অখুশি হতেও দেখিনি। এ জন্যেই হয়তো নারীকে বলা হয় ধরিত্রীর সহনশীলতা।
বাবা ছিলেন সিংহের গর্জন। তাঁর সামনে আমরা সবাই চুপচাপ থাকতাম। সেই অর্থে বাবার সাথে মায়ের তেমন সংলাপ চোখে পড়ার মত ছিল না। মা হয়তো অধিকারে না বেঁচে, কর্তব্যে বেঁচেছেন তাই মায়ের আপন জগত চুপচাপ থাকলেও আনন্দের ছিল। এখন আমরা সবাই অধিকারের বেলায় টনটন আর কর্তব্যের কথা মনে হলেই ঠনঠন।
মায়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যাই হউক না কেন সন্তানের মার্গ দর্শন কিন্তু মা’ই। সংগ্রামটা শিখতে হয় বাবার থেকে আর বাকি সব জালিম দুনিয়া শিখিয়ে দেয়। আমার মা স্কুলের গন্ডি পেরোননি। বই পড়া বলতে মহাভারত আর রামায়ণ। অথচ কি সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতেন রজঃস্বলা দ্রৌপদির পরিধেয় বস্ত্রের মধ্যে লুকিয়ে ছিল কুরুবংশের বিনাশ। তাই নারীকে সম্মান দিতে শিখো।
আমাদের মায়েরা হয়তো সংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল তবে অমানবিক ছিলেন না। আমাদের বাড়িতে গাভী বাছুর প্রসব করার একুশ দিন পর প্রথম দিন যে দুধ নেয়া হত তার অর্ধেক দিয়ে আসতাম মসজিদে আর অর্ধেক জগন্নাথ বাড়িতে। আমাদের বাড়িতে মালিক-কর্মচারি এক সাথে বসে খাওয়ার প্রচলন ছিল, এখনো আছে। সাম্য স¤প্রীতি আর সকল বিশ্বাসের প্রতি প্রীতির পাঠ মায়ের কাছ থেকেই নেয়া। যুক্তি দিয়ে বিচার করার দর্শন অবশ্য বাবার থেকে শেখা আর বাকিসব দুনিয়া শিখিয়েছে।
মায়ের কিছু নিত্য অতিথি ছিল এর মধ্যে একজন ছিল জ্ঞানের মা, সাদা থানের কাপড় পরা এমন আরো কয়েকজন বিধবার আনাগোনা ছিল মায়ের কাছে, যাওয়ার সময় তেলের শিশি ভরে আর আঁচলের মধ্যে পুটলি বেঁধে চাল নিয়ে ফেরতো। মা এই কাজগুলো করতেন লুকিয়ে, নিজের সংসারে নিজেই চুরি করে অন্যকে দিতেন, যেন বাড়ির পুরুষেরা না জানে। সমাজতন্ত্রের কোন জায়গায় এই উদ্বৃতি আছে কিনা জানি না তবে মায়ের ভাষায় ‘বাইট্টাচিরা খায় কুলের লাগাল পায়’।
এখন আমরা আধুনিক হয়েছি তবে একলা খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। আমাদের প্রায় নিরক্ষর মায়েরা দুপুরের ভাতঘুম শেষে প্রতিবেশীদের নিয়ে যে বৈঠকি আড্ডা দিতেন তাতে গৃহপরিচারিকারা যুক্ত হতো খুশ-গল্প করতো। এখন অধিকার সচেতন ও অধিকতর উচ্চশিক্ষিত মায়েরা গৃহপরিচারিকাকে কি চোখে দেখেন তা পত্রপত্রিকার সংবাদই বলে দেয়। প্রতিবেশী এখন দরকার হয় না, ঘরের ভিতরেইতো পড়শি অনেক। মেয়ে নিজরুমে ডেস্কটপে, ছেলে ল্যাপটপে আর মা সোফায় মোবাইলে, বাবা স্টেটাস আপডেট দিচ্ছেন হ্যাপি ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স ডে হানি। মানুষ কথাবলা শুরু করার আগে আকার-ইঙ্গিতে কথা বলতো আর এই আধুনিক সভ্যতায় এসে আমরা কথা বলছি ইমোজি চেপে। সবাই একই ছাদের নিচে ভদ্র পড়শি কেউ কাউকে বিরক্ত করছি না। লালন বেঁচে থাকলে গাইতেন ঘরের ভিতর আরশি নগর এলেডি স্ক্রিনে পড়শি বসত করে।
আধুনিক সংসারে নারী-পুরুষ অধিকার ধরে রাখার চেয়ে পরখ করাতে ব্যাস্ত। লাভ এট ফার্স্ট সাইট ডিভোর্স এট ফার্স্ট ফাইট। ভুল করে সরি বলা সহজ আর ভিক্টিম নিজে হলে তখন ভুলে যাওয়া কিংবা ক্ষমা করা খুব কঠিন হয়ে যায় সবার কাছেই। এক বিবাহিত নারী বললেন সমঝোতাকে গিলে সকল যন্ত্রণা আর চোটকে লুকিয়ে মুখে হাসি নিয়ে সমাজের সামনে একে অন্যের গ্রেট সোল উপস্থাপন করা হলো আধুনিক দাম্পত্যের রসিকতা। পাঠক কিভাবে দেখবেন জানি না তবে জীবন অনেক কিছুই দেখায়।
নারীর অধিকার আদায়, বৈষম্য দূর করে মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বিপ্লব হয়ে গেছে সেই কবে। ১৯১৪ সালের ৮ই মার্চ দিনটি নারী দিবস হিসাবে মান্যতা পেয়ে আসছে। সেই থেকে প্রতিটি দিবসের মত নারী দিবস আসে আমরা উদযাপন করি, অনুভব করি কি? এখনো রজঃস্বলা নারীর মন্দিরে উঠতে নিষেধ করা হয় এখনো ফতোয়া জারি হয় নারী কাজী হতে পারবে না।
আমার নিজের রুটিনও সেই আছে। প্রতিটি দিনের মতো আমার বৌ সকাল সাতটায় উঠে। ছেলের নাস্তা, লাঞ্চ, স্কুল ব্যাগ রেডি করবে, আমি পুরুষ তখন সকালের ঘুমে। স্বপ্নে বেহুলা উপস্থিত হয়েছেন ইন্দ্রপুরীতে মৃত লক্ষীন্দরকে নিয়ে, জীবন ফিরিয়ে নেয়ার বিনিময়ে তিনি নৃত্য করছেন দেবতাদের মনোরঞ্জনের জন্য।
নক নক ওয়েক আপ হানি নয়টা বাজে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পোষ্ট দিচ্ছি। নারীদের চেয়ে এই দিনটিতে আমাদের পুরুষদের আত্মবিশ্লেষণ করা জরুরি। আদি থেকে আধুনিকতার এই যুগে এসেও নারীকে দেমাগে (মস্তিষ্কে) হয়তো বসিয়েছি কিন্তু দিলে বসিয়েছি কি?