ইউসুফ কামাল : এগার.
প্রনবেশ দা’র কাহিনীটা লিখতে যেয়ে আমি একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। তার কারণ তাদের সম্পর্কের শেষ পর্যায়ের একটা বিশেষ মূহূর্তে আমি জড়িয়ে পড়েছিলাম ঘটনার আকস্মিকতায়। বিয়োগান্তক সেই স্মৃতিগুলো এখনো আমি যে ভুলতেই পারিনি। লেখাটা আমার অনেক আপন জনেরাই পড়েছেন। কয়েকজন আমাকে এ নিয়ে ভালো মন্দ কথা শুনিয়েছেন। একজন তো রীতিমতো শক্ত কথা শুনিয়ে দিলো, ভাগ্য ভালো বলতে হবে এগারো হাজার মাইল দূরে আছি, কাছে পেলে হয়তো রুটি বানানোর বেলুন দিয়ে মাথাটাই ফাটিয়ে দিতাম। প্রত্যুত্তরে আমি শুধু বলেছি, বাস্তব গল্পের চেয়েও নির্মম হতে পারে। অতর্কিত ঘটনাসমুহ মানুষের জীবনকে ভিন্ন মোড়ে ঘুড়িয়ে দেয়, যা প্রতিহত করার ক্ষমতা তখন কারোই থাকে না। খুব স্বাভাবিক কারণেই দু:খের কথা শুনলেই সবাই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে। এটাই মানুষের চরিত্র।

সুদীর্ঘ তিন বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে ’৭৮ এর শেষ দিকে যখন উনি দেশে ফিরলেন তখন তো অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। জীবনের তিনটা বসন্ত পার হয়ে গেছে সবারই জীবন থেকে, উনার চেহারা দেখে আমার রাগটা একটু স্তিমিত হয়ে আসলো। চেহারাটা একটু খারাপ হয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে মানসিক ধকলের সাথে শরীরের উপর অযত্নের ছাপটাও পরিস্কার দৃশ্যমান। কয়েকদিন পর জিজ্ঞাস করলাম, ঘটনা কি, এমন করলেন কেনো? নিরুত্তাপ কন্ঠে শুধু বললেন, জীবন দিয়েই জীবনের মূল্য পরিশোধ করতে হয় যে! আমার জীবনের অনিশ্চয়তার সাথে অন্যের জীবনকে জড়ানো কি যুক্তিসংগত হতো? অকাট্য যুক্তি। এ কথার উত্তর তো আমার জানা নাই। যোগ করলেন, ভেবেছিলাম শীঘ্রই ফিরে আসবো, যখন দেখলাম অবস্থাটা প্রতিকুলতায় ভরে গেলো, কবে ফিরবো? আদৌ ফিরতে পারবো কিনা? এমতাবস্থায় তখন আর কিই বা করতে পারতাম বলো? তার মুখের দিকে তাকিয়ে আর দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করতে পারলাম না। লোকটা মাথা নীচু করে বসে রইলো। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বয়সটা যেনো বিশ বছর বেড়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অনেক চিন্তা করেই তোমাকে তখন ঐ চিঠিটা পৌঁছে দিতে বলেছিলাম। তোমাকে কষ্ট দিয়েছিলাম কিছু মনে নিও না’। কি জবাব দেবো? পরিমাপ করতে চেষ্টা করলাম মানুষটার ভিতরটাকে। মনের গভীরতা কিভাবে মাপতে হয় জানি না তবে সেটা চোখের অসহায় নিস্পলক চাহনিতে মনে হয় কিছুটা ধরা পড়লো। মনে হলো কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন – হয়তোবা হারনো অতীতের কোনো স্বর্ণালী মূহূর্তে। জীবন যুদ্ধের একজন ব্যার্থ সৈনিকের ছবি যেনো আমার সামনে। নিস্তব্ধ মৌন অসাঢ় একটা জলজ্যান্ত মূর্তি। আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হলো, কোনো অদ্যপান্ত হিসেব না করেই কেন হুট করে বিরুপ ধারণা করতে গেলাম? তাইতো, তার জায়গায় আমি নিজে হলেই বা কি করতে পারতাম? পারিপাার্শ্বিকতার কাছে আমরা সবাই কি নিদারুন অসহায়। জীবনের ভাগ্য লিপি যে একজনেরই হাতে, ইচ্ছা করলেই কি বদলাতে পারি? ভাগ্যের লাটাই যে অন্য জায়গায়। নিয়তির কাছে আমরা কতটা অসহায়। আর সেটার প্রতিদান হয়তো নিজের জীবনের উপর দিয়েই দিতে হয়। যে স্বপ্ন পুরণই হয়নি সেটার মধ্যে নতুন কাউকে না এনে বাকী জীবনটা একাকীত্বের জালে আবদ্ধ রাখাটাই হয়তো ভালো।

জীবনের পরিধি বেশি বড় না, সংক্ষিপ্ত এ জীবন যতই লম্বা করার চেষ্টা করি না কেনো দেখতে দেখতেই চলে যাবে, রয়ে যাবে শুধু এক রাশ স্মৃতি যা স্পর্শ করা যায় না শুধু অনুভবেই ফিরে আসে। হয়তো তাই স্বপ্ন টাকে বুকের ভিতরে প্রাণ ভোমরার মতো সযতেœ লালন করে একাকীই জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছেন। স্মৃতি স্বত:তই সুখের।

হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র
আলম দীর্ঘ দিন ধরেই রোজীর সাথে তার সম্পর্কটা ধরে রেখেছে কিন্তু সেটা যে টিকে আছে কার কল্যাণে সেটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। কারণ আলমের যে ধরনের তিরীক্ষী মেজাজ তাতে খুব ধৈর্যশীল ও সহনীয় পর্যায়ের মেয়ে না হলে এ সম্পর্ক টিকে থাকার কথা না। কিছু মানুষই বোধ হয় এই চরিত্রের হয়। ক্লাশ শেষ করে প্রায় রোজই বিকেলে রেসকোর্সে যেয়ে বসতাম, সময় কাটানোর সাথে সাথে আলম রোজীদেরকে সাহচর্য্য দেওয়া। অনেক সময় সিকান্দর, বিদ্যুৎ ওরাও থাকতো। ওরা দুজনও আবার অনেক সময় আমরা সাথে না থাকলে কেমন যেন স্বচ্ছন্দ্যও পেতো না। এর মধ্যে দুজনের আবার খুঁটিনাটি বিষয়ে হাল্কা লেগেও যেতো যা আবার পরে আমরাই মিটিয়ে দিতাম। সেদিন টিএসসির ভিতরে লনে আলমের সাথে কথা বলছি, উঠার মূহূর্তে রোজী এসে হাজির সাথে একটা মেয়ে। বসলো সামনা সামনি। পরিচিত হলাম। রোজীর পরিচিত নড়াইল বাড়ি। আলমের মুখের ভাবে কেনো যেনো আমার কাছে ব্যাপারটা রহস্যজনক মনে হলো। পরের দিন বিষয়টা পরিস্কার হয়ে গেলো রোজীর প্রশ্নে, ভাই যুথীরে কেমন লাগলো? একটু সময় নিয়ে বললাম কেনো ভালোই তো। আপনার আত্মীয়া নাকি? বুঝলাম আমার একাকীত্ব ঘোচানোর উদ্দেশ্য আলম রোজীকে একদিন আমার সামনেই বলেছিলো। তোমার বান্ধবী কেউ আছে নাকি? ঐ দিন বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবলাম, জিনিষটা হাল্কা পর্যায়ে নেওয়া সঠিক হবে না। নিজের বিবেক যে বাঁধা পড়ে আছে অন্যত্র সেটা খুলে বলে দেওয়াই ভালো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরদিন দুপুরের খাবার সময় আলমকে বুলার কথা খুলে বললাম। সব শুনে সে তো মোটামুটি অবাক, আরে তাই নাকি? আমাকে আগে বলো নাই কেনো? এ সব ব্যাপারে সে পরিচ্ছন্ন, রোজী’র বিকল্প কোনো চিন্তা তার মাথাতে কখনই দেখিনি। নির্ভেজাল প্রেমিক যাকে বলে একান্তই তাই। বিশ্বস্ততার প্রমাণ রেখেছে আলম, পড়াশুনা শেষ করে রোজীকে নিয়েই সংসার পেতেছে। দুইজনই সরকারি চাকরি শেষ করে এখন অবসরে। বুলাও তো আমার জীবনের এক অমিমাংসিত কবিতা। কোথায় যেন মিশে আছে হাজার মনের ভীড়ে। স্মৃতিপটে চির জাগরুক এক চির ভাস্বর চিত্র …পাবো কি দেখা কোনো এক দিবসের শেষ প্রহরে?
(চলবে)

ইউসুফ কামাল : লেখক, উডরীজ, ভার্জিনিয়া, আমেরিকা