Home কলাম অমল ধবল পালে লেগেছে

অমল ধবল পালে লেগেছে

ভজন সরকার : একটু রাত করেই হাঁটতে যাই। কাগজে-কলমে গ্রীষ্মের শেষ এই উত্তর মেরুতে। তাই সূর্যাস্তও হয় আগে। বিকেল গড়াতেই টুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। পশ্চিমে পাহাড়ের উঁচু গাছের ফাঁক গলে তখনো গোধুলীর আলো। এক সময় সে আলোকচ্ছটাও স্তিমিত হয়ে যায়। কিন্তু পশ্চিম আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের উপর তখনো একটু একটু আলো। আকাশের পুবে-উত্তরে-দক্ষিণে একটু একটু করে নক্ষত্র থেকে মিটমিট আলো ছড়িয়ে পড়ে আকাশে।

বাংলাদেশে এখন শরৎ ঋতু। প্রকৃতি ছয় ঋতুতেই ভিন্নভিন্ন রূপে সেজে ওঠে। প্রতিটি ঋতুরই একক ও অনন্য বৈশিষ্ট আছে। চারপাশের গাছপালাসহ জলহাওয়াতেও আসে অনবদ্য সব পরিবর্তন। ঋতুকে মাসে ব্যবচ্ছেদ করলেও এই পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়। কিন্তু একমাত্র শরতেই অনন্য এক বৈচিত্র দেখা যায় শুধু মাত্র আকাশে। বর্ষায় যখন আকাশ বলতে শুধু মেঘের মুখ ভারকরে সেজে থাকা। শরৎ কালে সেখানে মেঘের হালকা ওড়াওড়ি। এই রোদ, এই ছায়া। থোকা থোকা মেঘেদের ভেসে বেড়ানো। পেছনে বিশাল নীলের এক অনন্ত ক্যানভাস। সেই ক্যানভাসের ওপর চিত্রকরের নিখুঁত আঁকাআঁকি। এক মনোরম আর্ট-ওয়ার্ক যেনো আকাশের যে কোন প্রান্তেই। কী দিন কী রাত্রি! শরত-আকাশের সৌন্দর্য যেন সব সময়েই।

ক্ষণজন্মা বাঙালি, প্রত্যেক বাঙালির প্রাত্যহিক সংগী এবং বাংলা সাহিত্যের সর্বস্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্রকে তাঁর রচনায় অনিন্দ্য নৈপুন্যে তুলে ধরেছেন। গল্প-কবিতা-উপন্যাস তো আছেই, রবীন্দ্রনাথের ঋতু-বর্ণনার সার্থক উপস্থাপনা বোধ হয় তাঁর গান। গানে রবীন্দ্রনাথ ছয় ঋতুকে এমন পুংখানুপুংখ চিত্রায়ণ করেছেন যা চিন্তা করলেই বিস্মিত হতে হয়। বিশেষকরে শরতের আকাশকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে অপূর্ব ভাষাব্যঞ্জনায় তুলে এনেছেন। অনেক গানের কথাই মনে পড়ছে। তবে একটি গান উল্লেখ করতেই হয়, “অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া”। গানটির সঞ্চারীর শেষ একটি লাইনই যেন শরতের আকাশকে তুলে আনার জন্য যথেষ্ঠ, “মুখে এসে পড়ে অরুণকিরণ ছিন্ন মেঘের ফাঁকে”। কী অপূর্ব বর্ণনা। মেঘের ফাঁক গলে রোদের আলোকচ্ছটা যেনো পাঠকের মুখে এসে পড়ে তৎক্ষণাৎ।

শুধু কী আকাশ। আমাদের চারপাশের গাছ-পালাসহ প্রকৃতিতে যে পরিবর্তন আসে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে তাও যেন রবীন্দ্রনাথসহ বাঙালি কবি-সাহিত্যিক-চিত্রকরেরা তুলে ধরেছেন। সেই সাথে আবহমান কাল থেকেই বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য কৃষ্টি- সংস্কৃতি এই ঋতু পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। তাই তো শারদীয় উৎসবের উৎস মূল এই শরৎ ঋতু।

আমার অভিবাসী জীবনে উত্তর মেরুর এই দেশটিতেও প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে। এখানে ঋতু প্রধানত ৪টি। বাংলাদেশের শরতের সমকালীন ঋতুটি গ্রীষ্ম আর শীতের মাঝামাঝি সময়। এখানে এই সময়ে গাছের পাতা ঝরার সময়। গাছের পাতা টুপ করে ঝরে পড়ে বাহারি রংয়ে চরাচর রাঙিয়ে দিয়ে। প্রস্তুত হয় তীব্র শীতের। তাই একটু একটু করে শীত নেমে আসে। রাত বাড়তে থাকে, কমতে থাকে দিন।

আমার প্রাত্যহিক বৈকালিক হাঁটা তাই সন্ধে পেরিয়ে রাতে গড়িয়ে যায়। ক’দিন থেকে চাঁদ আকৃতিতে বেড়ে বড় হচ্ছে। আজ মনে হলো দ্বাদশী। তাই চাঁদের আকারও অনেকটাই পূর্নাবয়বে। বছরের এই সময়টাতে চাঁদ একটু দক্ষিণ-আকাশে সরে থাকে। তাই আমার ড্রইং রুমের চন্দ্রমুখী জানালা দিয়ে ধরা পড়ে না। একটু রাত করে হাঁটার সময়ে আজ তাই চাঁদের সাথেই হাঁটলাম অনেকটা সময়। হঠাৎ করে চাঁদের পাশে দেখলাম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
মহাকাশ নিয়ে আগ্রহ থাকলেও প্রাত্যহিক রাতের আকাশের খতিয়ান রাখার মতো জ্ঞান বা লেখাপড়া আমার নেই। হাতের সেলফোন দিয়ে কয়েকটি ছবি তুলে নিলাম। বাড়িতে এসে ‘আজকের রাতের আকাশের দৃশ্যমান তারকামন্ডলির’ খোঁজ নিতেই জানলাম যে, এই সময়ে চাঁদের পাশের ওই উজ্জ্বল আলোর খন্ড কোনো নক্ষত্র নয়। আসলে ওটা আমাদের সৌরমন্ডলির একটা গ্রহ। সূর্যের কাছাকাছি দ্বিতীয় গ্রহটিই ভেনাস বা শুক্র। পৃথিবীর প্রতিবেশী এই ভেনাস বা শুক্র। পৃথিবীর অন্য প্রতিবেশী গ্রহটি মারস বা মঙ্গল।

পৃথিবী থেকে ভেনাস বা শুক্রের দূরত্ব ৪ কোটি ১৫ লক্ষ কিলোমিটারের মতো। পৃথিবীর আরেক প্রতিবেশী গ্রহ মংগলের দূরত্ব ৫ কোটি ৫৮ লক্ষ কিলোমিটারের মতো। সেদিক থেকে ভেনাস বা শুক্রই পৃথিবীর নিকটতম গ্রহ। মেঘহীন আকাশে চাঁদের পাশের তারকা সদৃশ্য উজ্জ্বল আলোকখন্ডটুকুই ভেনাস বা শুক্র।

আয়তনের দিক থেকে ভেনাস বা শুক্র গ্রহটি পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের চেয়ে ১০ গুণের চেয়ে বেশী বড়। পৃথিবী থেকে ভেনাস বা শুক্রের দূরত্বও চাঁদের চেয়ে ১০০ গুণ দূরে। তাই তো খালি চোখে পূর্ণাবয়ব চাঁদের তুলনায় খুব সামান্যই মনে হয় ভেনাস বা শুক্র গ্রহটিকে; কোটি কোটি মাইল দূরের নক্ষত্র বা তারার চেয়ে একটু বড়। যতই সামান্য হোক না কেনো, এতো দূরের পৃথিবীর নিকটতম প্রতিবেশী গ্রহটিকে খালি চোখে দেখার আনন্দটাই অন্যরকম।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)

Exit mobile version