Home কলাম অভ্যাস – এক বিষ্ময়কর শক্তির উৎস

অভ্যাস – এক বিষ্ময়কর শক্তির উৎস

জেমস ক্লিয়ার : অভ্যাস মানুষকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত করে। যখন একজন মানুষ এক জীবনে বিষ্ময়কর কিছু অর্জন করেন তখন আমরা মনে করি মানুষটি নিশ্চয় যাদু জানেন। বিষ্মিত হই, ভাবি কিভাবে সম্ভব। অসলে তার মৌলিক স্বভাবই তাকে এত দূর নিয়ে এসেছে। মানুষের পারিপার্শিক অবস্থা, মানসিক ও শারিরীক অবস্থা, ব্যক্তিগত বিশ্বাসবোধ, মূল্যবোধ ইত্যাদি মানুষের অভ্যাস গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। মানুষ চেষ্টা করলে খুব সহজেই অনেক ভাল অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন এবং খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন। মানুষ তার আচরণে অতি সূক্ষ্ণ পরিবর্তন করে জীবনে বিশাল সফলতা পেতে পারেন। অভ্যাসে সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ পরিবর্তন ঘটিয়ে কিভাবে নিজেকে একজন সফল মানুষে পরিণত করা যায় তা নিয়ে লেখক, উদ্যোক্তা এবং আচরণ বিশেষজ্ঞ জেমস ক্লিয়ার তার নাম্বার ওয়ান নিউ ইয়র্ক টাইম সর্বাধিক বিক্রিত গ্রন্থ ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। তিনি জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং নিউরোসায়েন্স থেকে ধারণাগুলি সংগ্রহ করেন যাতে ভাল অভ্যাসগুলিকে অনিবার্য এবং খারাপ অভ্যাসগুলিকে অসম্ভব করে তোলা যায়। সহজে বোঝা যায় এমন একটি নির্দেশিকা তৈরি করেছেন। এ যাবৎ ৪ মিলিয়নেরও বেশি সংখ্যক ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থটি বিক্রি হয়েছে। গ্রন্থটি সাপ্তাহিক বাংলা কাগজে ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী।

এক.
সূচনা
আমার গল্প
সেদিন আমার উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বছরের শেষ দিন আমি একটা প্রচন্ড আঘাত পেয়ে মারাত্মকভাবে আহত হলাম। আমরা সহপাঠীরা বেসবল খেলছিলাম। আমার সহপাঠী তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বলে আঘাত করার জন্য ব্যাট ঘুড়াল। কিন্তু ব্যাট আর বল একত্রিত না হয়ে ব্যাটটা তার হাত থেকে ছিটকে আমার দিকে উড়ে এল। কোনকিছু বোঝার আগেই আমার দুই চোখের মাঝখানে সরাসরি আঘাত হানল। বুঝলাম আমার স্মৃতিশক্তি কাজ করছে না। কি হলো এটা!

ব্যাটটা আমার মুখে এমন জোরে আঘাত করল যে সেটা আমার নাককে সোজা ভিতরে ঢুঁকিয়ে একটা ইংরেজি ইউ- আকৃতির ক্ষত সৃষ্টি করল। আঘাতের ফলে আমার মস্তিষ্কের নরম টিস্যু আমার মাথার খুলির ভিতরে ঢুকে পড়ল। সাথে সাথে আমার মাথা জুড়ে একটা ফোলানো ঢেউ দৃষ্টি গোচর হতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে আমার নাক ভেঙে গেল, মাথার খুলির একাধিক অংশ ভেঙে গেছে এবং চোখ দুটোর সকেটও ভেঙে গেছে।

আমি যখন চোখ খুললাম দেখলাম লোকেরা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে আছে। চার পাশের লোকজন ছুটছুটি করছে আমাকে সাহায্য করার জন্য। আমি নিচে তাকালাম। দেখলাম আমার পরণের কাপড় রক্তে লাল হয়ে গেছে। আমার এক সহপাঠী তার শার্টটা খুলে আমার হাতে দিল। আমি আমার ভাঙা নাক থেকে রক্তের স্রোতধারা বন্ধ করার জন্য এটি ব্যবহার করলাম। আমি হতবাক এবং বিভ্রান্ত। আমি বুঝতে পারছিনা আমি কতটা গুরুতরভাবে আহত হয়েছি।

আমার শিক্ষক আমার কাঁধের চারপাশে তার হাতটা জড়িয়ে ধরলেন এবং আমরা নার্সের অফিসের দিকে দীর্ঘ হাঁটা শুরু করলাম। পাহাড়ের নিচে মাঠ আর সারা মাঠ ব্যাপী অসংখ্য এলোমেলো হাত আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমাকে ধরে একদল মানুষ হাঁটছে, সময় নিয়ে ধীরে ধীরে আমরা সোজা স্কুলের দিকে হাঁটলাম। কেউ তখনও বুঝতে পারেনি প্রতিটি মিনিট কত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন নার্সের অফিসে পৌঁছলাম তখন তিনি আমাকে এক সিরিজ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা শুরু করলেন।
‘এটা কোন বছর?’
আমি উত্তরে বললাম, ‘১৯৯৮’। আসলে হবে ২০০২।
‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কে?’
আমি বললাম, ‘বিল ক্লিনটন।’ সঠিক উত্তর ছিল জর্জ ডবিøউ বুশ।
‘তোমার মায়ের নাম কি?’
‘উহ। উম।’ করতে করতে আমি থমকে গেলাম। দশ সেকেন্ড কেটে গেল। আমি স্বাভাবিক ভাবে বললাম, ‘প্যাটি;’যেন নিজের মায়ের নাম মনে করতে দশ সেকেন্ড লাগা স্বাভাবিক বিষয়।

এটিই শেষ প্রশ্ন আমার যতদূর মনে পড়ে। আমার শরীর মস্তিষ্কের দ্রæত ফোলাভাব সামাল দিতে পারছে না। অ্যাম্বুলেন্স আসার আগেই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। কয়েক মিনিট পরে আমাকে স্কুল থেকে বের করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল।
হাসপাতালে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার শরীর স্থবির হয়ে যেতে লাগল। ঢোঁক গিলতে এবং শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। শরীরের মৌলিক কার্যাদি সম্পন্ন করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। শরীর নিস্তেজ ও অচেতন হয়ে পড়ল। আমার শ্বাস-প্রশ্বাস পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। ডাক্তার তাড়াহুড়ো করে আমার জন্য অক্সিজেনের ব্যাবস্থা করলেন। পরিস্থিতি সামাল দিবার মতো যথেষ্ট মেডিকেল যন্ত্রপাতি হাসপাতালে না থাকায় তারা স্থানীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে সিনসিনাটির একটি বড় হাসপাতালে নিয়ে যাবে। তারা হেলিকপ্টার আসার নির্দেশনা পাঠালেন ।

আমাকে হাসপাতালের জরুরী রুমের দরজা থেকে বের করা হল। হেলিপ্যাড ছিল রাস্তার ওপারে। স্ট্রেচারটা একটা অসমতল ফুটপাতের উপর দিয়ে ক্যাচর ক্যাচর শব্দ করে হেলিপ্যাডের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একজন নার্স স্ট্রেচারটা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন আর একজন হাত দিয়ে আমার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস পাম্প করছেন। কয়েক মুহূর্ত আগে আমার মা হাসপাতালে এসে পৌঁছালেন। তিনি হেলিকপ্টারে আমার পাশে উঠে বসলেন। আমি অজ্ঞান অবস্থায় স্ট্রেচারে শায়িত এবং আমি নিজে থেকে শ্বাস নিতে অক্ষম। আমার মা সারাটা পথ আমার হাত ধরে আমার শয্যার পাশে বসেছিলেন।

যখন আমার মা আমার সাথে হেলিকপ্টারে উঠে পড়লেন তখন আমার বাবা আমার ভাই এবং বোনের খোঁজ খবর নিতে বাড়ি ফিরে গেলন। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটা তাদের বুঝিয়ে বললেন। সে রাতে আমার ছোট বোনের অষ্টম-শ্রেণি সম্পন্ন করার অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানটিতে আমাদের আর যাওয়া হল না। বাবা তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেন। চোখের জল ফেললেন। আমার ভাই-বোন দুজনকে এক বন্ধুর পরিবারে রেখে সিনসিনাটির সেই হাসপাতালের উদ্দেশ্যে গাড়ি চালিয়ে রওয়ানা হলেন।

যখন আমার মা এবং আমি হাসপাতালের ছাদে নামলাম তখন প্রায় বিশ জন ডাক্তার এবং নার্সের একটি দল হেলিপ্যাডে ছুটে এসে আমাকে ট্রমা ইউনিটে নিয়ে গেলেন। এই সময়ের মধ্যে আমার মস্তিষ্কে ফোলাভাব এতটাই তীব্র হয়ে উঠল যে আমার শরীরে বার বার পোস্ট-ট্রমাটিক খিঁচুনি হচ্ছিল। আমার মাথার খুলির ভাঙ্গা হাড়গুলো জোড়া লাগান জরুরী ছিল কিন্তু আমার অস্ত্রোপচার করার মতো অবস্থা ছিল না। তৃতীয় বার খিঁচুনি হওয়ার পর মেডিসিন প্রয়োগ করে আমাকে গভীরভাবে অচেতন করা হল এবং যান্ত্রিক ভেন্টিলেটরে রাখা হল, যাতে আমার শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায়।

আমার বাবা-মার কাছে এই হাসপাতাল অপরিচিত নয়। দশ বছর আগে আমার বোন তিন বছর বয়সে লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পরে তারা একই ভবনের নিচতলায় আর একবার এসেছিলেন। তখন আমার বয়স পাঁচ বছর। আমার ভাইয়ের বয়স তখন মাত্র ছয় মাস। আড়াই বছরের কেমোথেরাপি চিকিৎসা, মেরুদণ্ডের ট্যাপ এবং অস্থি মজ্জার বায়োপসি করার পর আমার ছোট বোন অবশেষে হাসপাতাল থেকে সুখী, সুস্থ এবং ক্যান্সার মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে। দশ বছর স্বাভাবিক জীবন যাপনের পর এখন আমার বাবা-মা নিজেদেরকে একই জায়গায় অন্য একজন সন্তানের সাথে আবিষ্কার করলেন।

যখন আমি কোমায় চলে গেলাম তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একজন পুরোহিত এবং একজন সামাজ কর্মীকে আমার বাবা-মার কাছে পাঠালেন। আমার বাবা-মাকে সান্ত¡না দেবার জন্য তারা নিয়োজিত ছিলেন। কাকতলীয়ভাবে তাদের সাথে একই পুরোহিতের দেখা হয়ে গেল। এক দশক আগে এক সন্ধ্যায় যখন তারা জানল আমার বোনের ক্যান্সার হয়েছে তখন সেই একই পুরোহিত এসেছিলেন তাদের সান্তনা দেবার জন্য।

দিনের সব আলো নিভে রাত ঘনিয়ে আসছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে একের পর এক যন্ত্র আমাকে বাঁচিয়ে রাখার কাজে নিয়োজিত করা হচ্ছে। আমার বাবা-মা হাসপাতালের বিছানায় গভীর উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা নিয়ে ঘুমোতে গেলেন। এক মুহূর্তের মধ্যে সারা দিনের ক্লান্তি তাদের গ্রাস করে ফেলল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। আবার পরের মুহূর্তে অজানা আশংকায় জেগে উঠলেন। আমার মা পরে আমাকে বলেছিলেন, ‘সে দিনের সেই রাতটি আমার সবচেয়ে খারাপ রাতগুলির মধ্যে একটি ছিল।’

আমার আরোগ্যলাভ
সৌভাগ্য ক্রমে অপ্রীতিকর কিছু ঘটল না। পরের দিন সকালের মধ্যে আমার শ্বাস প্রশ্বাসের সাভাবিক গতি ফিরে আসল। ডাক্তারবৃন্দ আমাকে কোমা থেকে মুক্তি দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেন। অবশেষে যখন আমি চেতনা ফিরে পেলাম আমি আবিষ্কার করলাম যে আমি গন্ধ নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। আমার নাকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য একজন নার্স আমাকে আপেলের রসের বাক্স শুঁকতে বললেন। পরোক্ষণেই দেখলাম আমার গন্ধের অনুভূতি ফিরে এসেছে। কিন্তু নাক দিয়ে জোরে বাতাস টানার জন্য আমার চোখের ভাঙ্গা সকেটে চাপের সৃষ্টি করে সকলকে অবাক করে দিয়ে আমার বাম চোখ বাইরের দিকে ঠেলে বেড়িয়ে এসেছে। আমার চোখের মণিসহ গোলাকার সাদা অংশটা সকেটের বাইরে চলে এসে বিপদজনকভাবে ঝুলে পড়েছে। অপটিক নার্ভগুলো যা আমার চোখকে আমার মস্তিষ্কের সাথে সংযুক্ত করেছে সেগুলোও বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে।

চক্ষু বিশেষজ্ঞ বললেন যে চোখের থলে থেকে বাতাস বের হয়ে যাবার সাথে সাথে আমার চোখও ধীরে ধীরে জায়গা মতো ফিরে যাবে। তবে ঠিক হতে কতদিন লাগবে তা বলা কঠিন। এক সপ্তাহ পরে অস্ত্রোপচারের জন্য একটা তারিখ নির্ধারিত হল। যাতে আমার শরীরটা আরও কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে তার জন্য আরও কিছুটা অতিরিক্ত সময় পেলাম। আমার মনে হচ্ছিল আমি একটি বক্সিং ম্যাচের ভুল প্রান্তে ছিলাম কিন্তু আমাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল। নাক ভাঙা ছাড়াও মুখমন্ডলের অর্ধ ডজন ফ্র্যাকচার এবং স্ফীত বাম চোখ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

পরের মাসগুলো আমার জন্য বেশ কঠিন ছিল। মনে হচ্ছিল আমার জীবনের সবকিছু থেমে গেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি যে কোন জিনিস দুটো করে দেখছিলাম। আমি আক্ষরিকভাবে সরাসরি কোন কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার চোখের মণিসহ গোলাকার সাদা অংশটা শেষ পর্যন্ত তার স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে আসতে এক মাসেরও বেশি সময় লেগে গেল। খিঁচুনি এবং আমার দৃষ্টি সমস্যাগুলো সেরে উঠতে আট মাস সময় লেগে গেল। আমি আবার গাড়ি চালাতে পারলাম আট মাস পরে। আমার শারীরিক থেরাপিগুলোর মধ্যে একটা ছিল আমি একটি সরল রেখায় হাঁটার অনুশীলন করেছি দীর্ঘ দিন। এটি একটা বায়োমেকানিকাল অনুশীলন । আমি আমার প্রাপ্ত আঘাতকে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। কিন্তু সেই সব দিনগুলোর মধ্যে কিছু কিছু মুহূর্ত আমি বিষণ্ণতায় ডুবে থাকতাম। মনে হত আমি হিম শীতল হয়ে মাটির নিচে কবরে শায়িত। ..(চলবে)
কোরবান আলী, অনুবাদক, টরোন্ট, ক্যানাডা।

Exit mobile version