জেমস ক্লিয়ার : অভ্যাস মানুষকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত করে। যখন একজন মানুষ এক জীবনে বিষ্ময়কর কিছু অর্জন করেন তখন আমরা মনে করি মানুষটি নিশ্চয় যাদু জানেন। বিষ্মিত হই, ভাবি কিভাবে সম্ভব। অসলে তার মৌলিক স্বভাবই তাকে এত দূর নিয়ে এসেছে। মানুষের পারিপার্শিক অবস্থা, মানসিক ও শারিরীক অবস্থা, ব্যক্তিগত বিশ্বাসবোধ, মূল্যবোধ ইত্যাদি মানুষের অভ্যাস গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। মানুষ চেষ্টা করলে খুব সহজেই অনেক ভাল অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন এবং খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন। মানুষ তার আচরণে অতি সূক্ষ্ণ পরিবর্তন করে জীবনে বিশাল সফলতা পেতে পারেন। অভ্যাসে সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ পরিবর্তন ঘটিয়ে কিভাবে নিজেকে একজন সফল মানুষে পরিণত করা যায় তা নিয়ে লেখক, উদ্যোক্তা এবং আচরণ বিশেষজ্ঞ জেমস ক্লিয়ার তার নাম্বার ওয়ান নিউ ইয়র্ক টাইম সর্বাধিক বিক্রিত গ্রন্থ ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। তিনি জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং নিউরোসায়েন্স থেকে ধারণাগুলি সংগ্রহ করেন যাতে ভাল অভ্যাসগুলিকে অনিবার্য এবং খারাপ অভ্যাসগুলিকে অসম্ভব করে তোলা যায়। সহজে বোঝা যায় এমন একটি নির্দেশিকা তৈরি করেছেন। এ যাবৎ ৪ মিলিয়নেরও বেশি সংখ্যক ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থটি বিক্রি হয়েছে। গ্রন্থটি সাপ্তাহিক বাংলা কাগজে ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী।
সাত.
লক্ষ্যের পরিবর্তে প্রক্রিয় নির্ধারণে মনোনিবেশ করুন
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) প্রক্রিয়া এবং লক্ষ্যের মধ্যে পার্থক্য কি? একটা পার্থক্য আমি প্রথম স্কট অ্যাডামসের কাছ থেকে শিখেছি, তিনি হাস্যরসাত্মক ডিলবার্ট কার্টুন লিখতেন । লক্ষ্য হচ্ছে আপনি যে ফলাফলগুলি অর্জন করতে চান সেগুলি। প্রক্রিয়া হচ্ছে আপনি কোন পথে এগোলে প্রত্যাশিত ফলাফলগুলি বের করে আনতে সক্ষম হবেন?
ক্স আপনি যদি একজন কোচ হন, আপনার লক্ষ্য হতে পারে একটি চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা। প্রক্রিয়া হচ্ছে খেলোয়াড় নিয়োগ করা, আপনার সহকারী প্রশিক্ষকবৃন্দকে পরিচালনা করা এবং অনুশীলন পরিচালনা করা।
ক্স আপনি যদি একজন উদ্যোক্তা হন তবে আপনার লক্ষ্য হতে পারে এক মিলিয়ন ডলার মুনাফা অর্জন। আপনার প্রক্রিয়া হতে পারে আপনার পণ্যের বাজার পরীক্ষা করা, কর্মচারী নিয়োগ দেয়া এবং বিপণন প্রচারাভিযান পরিচালানা করা।
ক্স আপনি যদি একজন যন্ত্রসঙ্গিত শিল্পী হন তবে আপনার লক্ষ্য হতে পারে নতুন নতুন সুর আপনার বাদ্যযন্ত্রে বাজানোর দক্ষতা অর্জন করা। প্রক্রিয়া হল আপনি কতবার অনুশীলন করেন, ব্যার্থ হলে আপনি কীভাবে ভেঙে পড়েন এবং কঠিন অবস্থার মোকাবেলা করেন এবং কীভাবে আপনি আপনার প্রশিক্ষকের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করেন।
এখন আকর্ষণীয় প্রশ্ন হচ্ছে: আপনি যদি আপনার লক্ষ্যকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেন এবং শুধুমাত্র লক্ষ্য অর্জনের প্রক্রিয়ার উপর মনোনিবেশ করেন তবে কি আপনি সফল হবেন? ধরুন আপনি একজন বাস্কেটবল কোচ এবং আপনি একটি চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার লক্ষ্য উপেক্ষা করে শুধুমাত্র আপনার দল কী করে তার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন, প্রতিদিন তাদের অনুশীলনে ব্যাস্ত রেখেছেন, আপনি কি এর পরেও চ্যাম্পিয়নশিপ জিততে পারেন?
আমি মনে করি আপনি নিশ্চিতভাবে জিততে পারেন।
যে কোনো খেলার লক্ষ্য সেরা স্কোর দিয়ে শেষ করা, তাই বলে স্কোরবোর্ডের দিকে তাকিয়ে পুরো খেলার সময় ব্যয় করা হাস্যকর হবে। প্রকৃতপক্ষে জয়ের একমাত্র উপায় হল প্রতিদিন ভাল ফলাফল বের করে আনা। জাতীয় ফুটবল লীগে তিনবারের সুপার বোল বিজয়ী বিল ওয়ালশের কথায়, ‘স্কোর নিজেই নিজের প্রতি যত্নশীল।’ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আপনি যদি আরও ভাল ফলাফল চান তবে লক্ষ্য নির্ধারণ করার কথা ভুলে যান। কোন প্রক্রিয়াই ভালো ফলাফল অর্জন করতে চান সেটার প্রতি মনোযোগী হন, আর কিচ্ছু লাগবে না।
আমি উপরের কথাগুলো দিয়ে কি বোঝাতে চাই? লক্ষ্য নির্ধারণের কি কোন মূল্য নেই? না আমি অবশ্যই সেটা বলিনি। একটা দিক নির্দেশনার জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ জরুরী। তবে কার্যকর উপায় নির্ধারণ করতে পারলে সেরা অগ্রগতি নিশ্চিত করা যায়। বেশ কিছু সমস্যা দৃষ্টিগোচর হবে আপনি যখন লক্ষ্য সম্পর্কে চিন্তা করতে বেশি সময় ব্যয় করবেন এবং প্রক্রিয়া নির্ধারণের সময়ে ঘাটতি পড়ে যাবে।
সমস্যা # ১: বিজয়ী এবং পরাজিতদের লক্ষ্য একই থাকে।
লক্ষ্য নির্ধারণ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার লড়ায়ে পক্ষপাত দোষে গুরুতরভাবে ভুগতে থাকে। যারা শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় আমরা তাদের উপর মনোনিবেশ করি- যারা শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল-এবং ভুলভাবে অনুমান করি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণই তাদের সাফল্য এনে দিয়েছে এবং সেই সমস্ত লোকদের উপেক্ষা করি যাদের একই উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি।
যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের প্রত্যেকে অলিম্পিক স্বর্ণপদক জিততে চান। প্রত্যেক প্রার্থী চাকরি পেতে চান। সফল বা ব্যর্থ যাই হন না কেন প্রত্যেকের লক্ষ্য একই থাকে, লক্ষ্য কখনও পরাজিত এবং বিজয়ীর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। ব্রিটিশ সাইক্লিস্টদের ‘ট্যুর ডি ফ্রান্স’ জেতার লক্ষ্য তাড়িত করে নাই কিন্তু তারা সেই সাইকেল দৌড় প্রতিযোগিতার শীর্ষে নিজেদের নাম লিখতে সক্ষম হয়েছেন। সম্ভবত অন্যান্য পেশাদার দলের মত তারাও আগে প্রতি বছর ‘ট্যুর ডি ফ্রান্স’ জেতার স্বপ্নে বিভোর থাকতেন। লক্ষ্য সবসময় যতার্থ ছিল। কিন্তু যখন তারা ক্রমাগতভাবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উন্নতির প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করল তাদের স্বপ্ন বাস্তব হয়ে ধরা দিল। তারা সকল প্রতিযোগিতায় ভিন্ন ফলাফল অর্জন করা শুরু করল।
সমস্যা # ২: লক্ষ্য অর্জন শুধুমাত্র একটি ক্ষণস্থায়ী পরিবর্তনের কথা বলে।
ধরুন আপনার ঘরটি নোংরা অগোছালো এবং আপনি এটি পরিষ্কার করার লক্ষ্য নির্ধারণ করলেন। ঘরটি পরিপাটি করার জন্য মনোনিবেশ করলেন, ইচ্ছে করলে একদিনেই আপনি ঘরটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তুলতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি নিজেই অগোছালো হয়ে থাকেন এবং ইঁদুরের মতো ঘরের মধ্যে ময়লা আবর্জনার ঢিবি করা আপনার অভ্যাস হয়ে থাকে তবে দু-এক দিনের মধ্যে ঘরটি আবার যে-কার-সেই ময়লা আবর্জনার স্তুপে পরিণত হবে এবং তারপর ঘর পরিষ্কার করার অনুপ্রেরণায় ভরপুর আরেকটি সুযোগ খুঁজতে থাকবেন। কারণ আপনি কেবল ফলাফলের পিছনে ছুটছেন, আপনি ঘর পরিষ্কার রাখার সিস্টেমে কোন পরিবর্তন করেননি। আপনি ঘরটি অপরিচ্ছন্ন থাকার কারণগুলো অনুসন্ধান করে সেগুলো নির্মূল করার কোন চেষ্টায় করেননি, আপনি শুধু উপসর্গের চিকিৎসা করেছেন।
লক্ষ্য অর্জন শুধুমাত্র মুহূর্তের জন্য আপনার জীবনে পরিবর্তন আনতে সক্ষম। এহেন পরিবর্তনকে উন্নতি বলে না। আমরা মনে করি আমাদের ফলাফলে পরিবর্তন আনা দরকার, কিন্তু ফলাফল সমস্যা নয়। কাঙ্খিত ফলাফলের জন্য আমাদের জীবনে পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সমস্যার মূল উৎপাটন করা প্রয়োজন। যখন আপনি ফলাফল স্তরে সমস্যাগুলির সমাধান করেন, আপনি আসলে ক্ষণস্থায়ী উন্নতির জন্য সমস্যার সমাধান করলেন, আপনাকে আসলে সিস্টেম বা পদ্ধতির ভুলত্রুটির সমাধান করা প্রয়োজন বা নতুন পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। ইনপুট ঠিক করুন, আউটপুট আপনা আপনি ঠিক হয়ে যাবে।
সমস্যা # ৩: নির্ধারিত লক্ষ্য আপনার আনন্দময় জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দকে সীমাবদ্ধ করে।
যে কোন লক্ষ্যের পিছনে একটা সুপ্ত অনুমান বহাল থাকে : ‘একবার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলে আমার আনন্দের সীমা থাকবে না।’ লক্ষ্য নির্ধারণের সমস্যা হচ্ছে- পরবর্তী লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আমার সুখ স্বাচ্ছন্দ আমি জলাঞ্জলী দিলাম, আমার নাওয়া-খাওয়া বন্ধ একটাই তপস্যা লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। এই ফাঁদে আমি অনেক বার পড়েছি, এখন আর মনে নেই ঠিক কতবার আমাকে এভাবে মাইল ফলক অতিক্রম করতে হয়েছে। বছরের পর বছর আমি আমার সুখ-স্বাচ্ছন্দ আরাম-আয়েসকে উপরের তাকে সংরক্ষণ করে রেখেছি ভবিষ্যতের জন্য। একবার আমি নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম আমি বিশ পাউন্ড পেশী অর্জন করার পর শান্ত হব, আনন্দ উপভোগ করবো অথবা আমার নতুন ব্যবসা সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমস-এ নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর, আমি থিতু হবো একটুখানি জিরিয়ে নেব।
এছাড়াও লক্ষ্য সবসময় একটা বিশেষ ধরণের দ্ব›দ্ব সৃষ্টি করে: যদি আপনি আপনার লক্ষ্য অর্জন করেন তাহলে আপনি সফল অথবা আপনি যদি ব্যর্থ হন তবে আপনি মানসিকভাবে হতাশ হবেন। অর্থাত আপনি সুখের একটি সংকীর্ণ সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে নিজেকে পরিচালিত করছেন। এটা অনেক সময় মানুষকে বিপথগামী করে। আপনার জীবনের প্রকৃত পথ আপনার পছন্দের সঠিক যাত্রার সাথে হুবহু মিলে যাবে তেমনটা আশা করা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই না, এটা প্রায় অসম্ভব একটা বিষয়। সুতরাং শুধুমাত্র একটি দৃশ্যে আপনার সন্তুষ্টিকে সীমাবদ্ধ করার কোন মানে হয় না, যেখানে আপনার সামনে সাফল্যের অনেক পথ উন্মুক্ত।
সিস্টেম প্রথমত: আপনার মানসিকতাকে সুস্থ সবল রাখার জন্য প্রতিষেধক প্রদান করে। আপনি যখন কোন পণ্যের পরিবর্তে পণ্যটির প্রস্তুত প্রণালীর প্রেমে পড়ে যাবেন তখন নিজেকে সুখী করার জন্য কারও অনুমতির প্রয়োজন হবে না। আপনার প্রক্রিয়া চলাকালীন যে কোনো সময় আপনি সন্তুষ্ট হতে পারেন, আনন্দে আত্মহারা হতে পারেন। একটি সিস্টেম শুধুমাত্র আপনি যেমনটি কল্পনা করেছেন ঠিক সেই ভাবে ছাড়াও আরও অনেক ভাবে সফলতার পথ দেখায়।
সমস্যা # ৪: লক্ষ্যগুলি দীর্ঘমেয়াদী অগ্রগতির সাথে বিরোধপূর্ণ।
একটা লক্ষ্য-ভিত্তিক মনসিকতা একটি উদ্ভট ফলাফল সৃষ্টি করতে পারে। অনেক দৌড়বিদ কয়েক মাস ধরে কঠোর পরিশ্রম করে কিন্তু যেইনা তারা প্রতিযোগিতার শেষ লাইন অতিক্রম করে অমনি তাদের প্রশিক্ষণ, অনুশীলন সব বন্ধ। দৌড়ের অনুশীলন তাদের আর অনুপ্রাণিত করে না। আপনার সমস্ত পরিশ্রম যখন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিবদ্ধ থাকে তখন এটি অর্জনের পরে আপনাকে এগিয়ে নেবার জন্য আর কী অবশিষ্ট থাকে? এ কারণে অনেক মানুষ তাদের পুরানো অভ্যাস ফিরে পাবার জন্য আর একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেন।
লক্ষ্য নির্ধারণের উদ্দেশ্য হল খেলা জেতা। উদ্দেশ্যে যখন একটা সিস্টেম নির্মাণ হয় তখন খেলা চালিয়ে যাওয়াই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সত্যিকারের দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা হচ্ছে লক্ষ্যহীন চিন্তা। এটা কোনো একক ফলাফল অর্জনে সীমাবদ্ধ থাকে না। এটা অন্তহীন সংশোধন, সংযোজন আর পরিমার্জনের চক্র যা ক্রমাগত উন্নতি নিশ্চৎ করে। শেষ কথা হল প্রক্রিয়ার প্রতি আপনার প্রতিশ্রুতি আপনার ক্রমাগত অগ্রগতি নির্ধারণ করবে। (চলবে)…
কোরবান আলী, অনুবাদক, টরোন্ট, ক্যানাডা।