Home কলাম অভ্যাস – এক বিষ্ময়কর শক্তির উৎস

অভ্যাস – এক বিষ্ময়কর শক্তির উৎস

জেমস ক্লিয়ার : অভ্যাস মানুষকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত করে। যখন একজন মানুষ এক জীবনে বিষ্ময়কর কিছু অর্জন করেন তখন আমরা মনে করি মানুষটি নিশ্চয় যাদু জানেন। বিষ্মিত হই, ভাবি কিভাবে সম্ভব। অসলে তার মৌলিক স্বভাবই তাকে এত দূর নিয়ে এসেছে। মানুষের পারিপার্শিক অবস্থা, মানসিক ও শারিরীক অবস্থা, ব্যক্তিগত বিশ্বাসবোধ, মূল্যবোধ ইত্যাদি মানুষের অভ্যাস গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। মানুষ চেষ্টা করলে খুব সহজেই অনেক ভাল অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন এবং খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন। মানুষ তার আচরণে অতি সূক্ষ্ণ পরিবর্তন করে জীবনে বিশাল সফলতা পেতে পারেন। অভ্যাসে সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ পরিবর্তন ঘটিয়ে কিভাবে নিজেকে একজন সফল মানুষে পরিণত করা যায় তা নিয়ে লেখক, উদ্যোক্তা এবং আচরণ বিশেষজ্ঞ জেমস ক্লিয়ার তার নাম্বার ওয়ান নিউ ইয়র্ক টাইম সর্বাধিক বিক্রিত গ্রন্থ ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। তিনি জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং নিউরোসায়েন্স থেকে ধারণাগুলি সংগ্রহ করেন যাতে ভাল অভ্যাসগুলিকে অনিবার্য এবং খারাপ অভ্যাসগুলিকে অসম্ভব করে তোলা যায়। সহজে বোঝা যায় এমন একটি নির্দেশিকা তৈরি করেছেন। এ যাবৎ ৪ মিলিয়নেরও বেশি সংখ্যক ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থটি বিক্রি হয়েছে। গ্রন্থটি সাপ্তাহিক বাংলা কাগজে ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী।

ছয়.
অগ্রগতির বাস্তবতা
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) কল্পনা করুন আপনার সামনে টেবিলে এক টুকরো বরফ রাখা আছে। রুম এত ঠান্ডা যে আপনি আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস দেখতে পাচ্ছেন। হঠাৎ রুমের তাপমাত্রা বেড়ে পঁচিশ ডিগ্রী হয়ে গেল। ধীরে ধীরে ঘর গরম হতে শুরু করল।
ছাব্বিশ ডিগ্রী।
সাতাশ।
আটাশ।
আইস কিউবটি এখনও আপনার সামনে টেবিলে রাখা আছে। কোন পরিবর্তন নেই।
ঊনত্রিশ ডিগ্রি।
ত্রিশ।
একত্রিশ।
তারপরও কিছু হয়নি।
বত্রিশ ডিগ্রি। বরফ গলতে শুরু করল মাত্র এক ডিগ্রির ব্যাবধানে। তাপমাত্রার মাত্র এক ডিগ্রি বৃদ্ধির কারণে আপনি একটা বিশাল পরিবর্তন লক্ষ করেছেন। যুগান্তকারী মুহূর্তগুলি প্রায়শই পূর্ববর্তী অনেকগুলি ক্রিয়াকলাপের ফলাফল যা একটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। সকল যুগান্তকারী ঘটনার পেছনের গল্প এক ও অভিন্ন। ক্যান্সার শরীরের ৮০ শতাংশ দখল করার আগে কদাচিৎ শনাক্ত করা যায়। তারপর কয়েক মাসের মধ্যে সমস্ত শরীর দখল করে নেয়। বাঁশ রোপন করার প্রথম পাঁচ বছর খুব সামান্নই পরিবর্তন দেখা যায়। পাঁচ বছর ব্যাপী এটি মাটির নিচে তার মূলের শাখা প্রশাখার বিস্তৃতি ঘটায় তারপর হঠাৎ বিস্ফোরণের মত ছয় সপ্তাহের মধ্যে নব্বই ফুট লম্বা বাঁশ মানুষের দৃষ্টি কাড়ে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক অতিক্রম না করলে এবং কর্মক্ষমতার একটা নতুন দিগন্ত আপনার সম্মূখে উন্মোচিত না হওয়া পর্যন্ত অভ্যাস কোনও পার্থক্য ঘটাতে পারে না। কোন অনুসন্ধানের প্রাথমিক অবস্থা থেকে মধ্যম পর্যায় পর্যন্ত নিরাশার পাহাড় আপনাকে হতাশ করবে। আপনার অগ্রগতি একটা সমান্তরাল সরল রেখায় ধাবমান থাকবে। দিন, সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস পরেও কোন ফলাফল না পাওয়া আপনাকে হতাশ করবে। মনে হবে প্রক্রিয়াটি অকার্যকর। আপনার অগ্রগতি কোন এক জায়গায় স্থবির হয়ে আছে। যে কোনও যৌগিক প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সর্বাধিক শক্তিশালী ফলাফল বিলম্বিত হয়।
দীর্ঘ দিনের মূল্যবান অভ্যাস গঠন করা অনেক কঠিন কাজ। এর মূল কারণ হচ্ছে মানুষ চটজলদি কোন ফলাফল দেখতে পায় না। কয়েকটি ছোট ছোট পরিবর্তন করার পর কোন বাস্তব ফলাফল না পেয়ে চর্চা করা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। আপনি নিজেই মনে করতে পারেন, ‘আমি প্রতিদিন এক মাস ব্যাপী দৌড়াচ্ছি আমি কেন আমার শরীরিক গঠনে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না?’ একবার এই ধরনের চিন্তাভাবনা মাথায় ঢুঁকলে ভাল অভ্যাসকে পথের ধারে ফেলে দেওয়া সহজ। কিন্তু একটা অর্থপূর্ণ পার্থক্য পাবার জন্য অভ্যাস বজায় রাখা প্রয়োজন। সমস্যার পাহাড় ভেদ করা যথেষ্ট কষ্ট সাধ্য, যথেষ্ট দীর্ঘ সময় অনুশীলনে রত থাকতে হয়। মানুষের সাফল্যের এই সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনকে আমি সুপ্ত ক্ষমতার উপত্যকা বলি।

আপনি যদি নিজেকে দেখেন একটা ভাল অভ্যাস গঠন করতে বা খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে, ঠিক হয়ে উঠছে না। এর মানে এই নয় যে আপনি উন্নতি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। এমনটা হতেই পারে, কারণ আপনি এখনও সুপ্ত সম্ভাবনার উপত্যাকা অতিক্রম করেননি। পরিশ্রম করেও সফলতা না পাওয়ার অভিযোগ করার মতো বিষয়। আপনি বরফের ঘনকটি গলানোর বিষয়টি চিন্তা করুন। পঁচিশ থেকে একত্রিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় বরফ গলে না। যেই না বত্রিশ ডিগ্রি তাপ প্রয়োগ করা হল অমনি বরফ গলা শুরু হল। আপনার কোন প্রচেষ্টাই বৃথা যায়নি; আপনার সকল প্রচেষ্টা সংরক্ষিত আছে। আপনাকে কেবল বত্রিশ ডিগ্রি পর্যন্ত ধৈর্য সহকারে আপনার সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
আপনি অবশেষে যখন সুপ্ত ক্ষমতার উপত্যকায় আরোহণ করবেন, মানুষ বলবে আপনি রাতারাতি সাফল্য পেয়ে গেলেন। বাইরের জগৎ দীর্ঘ দিনের সকল প্রচেষ্টা লক্ষ করে না, শুধুমাত্র নাটকীয় ফলাফল দেখে বিষ্মিত হয়। কিন্তু আপনার মনে রাখা প্রয়োজন আপনি দীর্ঘ সময় আগে এই অভ্যাসটি শুরু করেছিলেন—যখন আপনার মনে হয়েছিল কোনো অগ্রগতি হয়নি বা হচ্ছে না— নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে আপনি আজকে এক লাফে সেই ফলাফল অর্জন করেছেন।

ভূতাত্তি¡ক চাপ আর মানসিক চাপ একই রকম হয়ে থাকে। দুটি টেকটোনিক প্লেট লক্ষ লক্ষ বছর ধরে একে অপরকে একটু একটু করে পিষতে থাকে। ধীরে ধীরে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। তারপর একদিন তারা আবার একে অপরকে প্রবল বেগে ধাক্কা দেয়। যুগ যুগ ধরে পুঞ্জিত ক্ষোভের বহিপ্রকাশ ঘটে। ফলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। ঠিক তেমনই পরিবর্তন আসতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন সহসা আসে না।
যে কোন কিছু নিজের আয়ত্তে আনার জন্য ধৈর্যের প্রয়োজন। জাতীয় বাস্কেট বল এ্যাসোসিয়েশনে ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা দল ‘সান আন্তোনিও স্পার্স’। তারা তাদের লকার রুমে সামাজ সংস্কারক জ্যাকব রিসের একটি উদ্ধৃতি ঝুলিয়ে রেখেছিলেন: ‘যখন কোন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না তখন আমি দূরে দাঁড়িয়ে একজন হীরক সন্ধানি শ্রমিকের পাথর কাটার দৃশ্য দেখি । তিনি ক্রমাগতভাবে হাতুড়ি দিয়ে পাথরে আঘাত করে চলেছেন কিন্তু পাথরে কোন ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে না। সম্ভবত একশো বার আঘাত হানলেন, কিচ্ছুই হল না। যেই না একশো একতম হাতুড়ি চালালেন অমনি বিশাল পাথরটি দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেল। আমি জানি শেষ আঘাতে পাথরটি দ্বিধা বিভক্ত হয়নি – এর আগে আরও একশো বার আঘাতের গুরুত্বও কম না।’

চিত্র ২: আমরা প্রায়শই প্রত্যাশা করি অগ্রগতি হবে সরল রৈখিক। আরও প্রত্যাশা করি অগ্রগতি দ্রুত আসবে। বাস্তবে আমাদের প্রচেষ্টার ফলাফল বিলম্বিত মাস বা বছর পরে আসে। আগের কাজগুলোর আমরা প্রকৃত মূল্য উপলব্ধি করতে পারি না। এর ফলে একটি ‘হতাশার উপত্যকা’ সৃষ্টি হতে পারে। যখন মানুষ কয়েক সপ্তাহ পরে নিরুৎসাহিত বোধ করেন। মাস ব্যাপী কঠোর পরিশ্রমের পর কোন ফলাফল না পেয়ে অনুশীলন ছেড়ে দেন। আসলে এই পরিশ্রম নষ্ট হয়নি। সবকিছুই সংরক্ষিত রয়েছে। এর পরেও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে পূর্ববর্তী সকল প্রচেষ্টার ফলাফল প্রকাশিত হয়।

সমস্ত বড় জিনিস ছোট থেকে শুরু হয়। প্রতিটি অভ্যাসের বীজ একটি ক্ষুদ্র সিদ্ধান্ত থেকে উদ্ভূত। সেই ক্ষুদ্র সিদ্ধান্তই যখন বারবার অনুশীলন করা হয় তখন সেটা অভ্যাসে পরিণত হয় এবং শক্তিশালী হতে থাকে। শিকড় মাটির গভীরে তার শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটাতে থাকে আর উপরে বৃক্ষের ডাল-পালার বিস্তৃতি ঘটে। একটি খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করার কাজটি আসলে আমাদের শরীর থেকে একটা শক্তিশালী বটবৃক্ষ স্বমূলে উপড়ে ফেলার মতো একটা কাজ। আর ভালো অভ্যাস গড়ে তোলার কাজটি হলো একদিন একটি ফুলগাছের চারা বপন করার মতো।
তবে এমন কোন যাদু আমাদের অভ্যাসকে দীর্ঘ সময় ব্যাপী ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং আমাদের সুপ্ত সম্ভাবনার উপত্যকায় পৌঁছে দেয়? কী কারণে কিছু মানুষ অবাঞ্ছিত অভ্যাস পরিত্যাগ করে এবং অন্যদেরকে ভালো অভ্যাসের যৌগিক প্রভাব উপভোগ করতে সক্ষম করে তোলে?

লক্ষ্যের পরিবর্তে প্রক্রিয় নির্ধারণে মনোনিবেশ করুন
প্রচলিত ধ্যান-ধারণা মতে আমরা জীবনে যা চাই তা অর্জন করার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে – নির্দিষ্ট কর্মযোগ্য সমৃদ্ধ লক্ষ্য নির্ধারণ করা। যেমন হতে পারে আপনার শারিরীক গঠন আকর্ষণীয় করা, একটি সফল ব্যবসা সৃষ্টি করা, উত্তেজনা বা উদ্বেগ হ্রাস করা এবং কম চিন্তা করা, পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে বেশি সময় কাটানো ইত্যাদি।
বহু বছর ধরে আমিও আমার প্রত্যেকটা অভ্যাসের পেছনে একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করে এসেছি। প্রতিটি লক্ষ্যে পৌঁছানোই ছিল অনুশীলন করার মূল উদ্দেশ্য। আমি যে গ্রেডগুলি চাই তার জন্য আমি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি নিয়মিত স্কুলে যাওয়া, আমি জিমে যেয়ে ভার উত্তোলনের অভ্যাস করেছি একটা আকর্ষণীয় শারিরীক গঠন বিনির্মাণের জন্য, মুনাফার জন্য ব্যবসা করতে চেয়েছি। আমি কয়েকটিতে সফল হয়েছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি। দীর্ঘ সময় পরে আমি বুঝতে শুরু করেছি প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জনের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতোটা গুরুত্বপূর্ণ আমি কোন প্রক্রিয়ায় লক্ষ্য অর্জন করতে চাই সেটা নির্ধারণ করা। (চলবে)..
কোরবান আলী, অনুবাদক, টরোন্ট, ক্যানাডা।

Exit mobile version