জেমস ক্লিয়ার : অভ্যাস মানুষকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত করে। যখন একজন মানুষ এক জীবনে বিষ্ময়কর কিছু অর্জন করেন তখন আমরা মনে করি মানুষটি নিশ্চয় যাদু জানেন। বিষ্মিত হই, ভাবি কিভাবে সম্ভব। অসলে তার মৌলিক স্বভাবই তাকে এত দূর নিয়ে এসেছে। মানুষের পারিপার্শিক অবস্থা, মানসিক ও শারিরীক অবস্থা, ব্যক্তিগত বিশ্বাসবোধ, মূল্যবোধ ইত্যাদি মানুষের অভ্যাস গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। মানুষ চেষ্টা করলে খুব সহজেই অনেক ভাল অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন এবং খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন। মানুষ তার আচরণে অতি সূক্ষ্ণ পরিবর্তন করে জীবনে বিশাল সফলতা পেতে পারেন। অভ্যাসে সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ পরিবর্তন ঘটিয়ে কিভাবে নিজেকে একজন সফল মানুষে পরিণত করা যায় তা নিয়ে লেখক, উদ্যোক্তা এবং আচরণ বিশেষজ্ঞ জেমস ক্লিয়ার তার নাম্বার ওয়ান নিউ ইয়র্ক টাইম সর্বাধিক বিক্রিত গ্রন্থ ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। তিনি জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং নিউরোসায়েন্স থেকে ধারণাগুলি সংগ্রহ করেন যাতে ভাল অভ্যাসগুলিকে অনিবার্য এবং খারাপ অভ্যাসগুলিকে অসম্ভব করে তোলা যায়। সহজে বোঝা যায় এমন একটি নির্দেশিকা তৈরি করেছেন। এ যাবৎ ৪ মিলিয়নেরও বেশি সংখ্যক ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থটি বিক্রি হয়েছে। গ্রন্থটি সাপ্তাহিক বাংলা কাগজে ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী।

পাঁচ.
কেন সূ²াতিসূ² অভ্যাসগুলো পরিশেষে বিশাল পার্থক্য বয়ে আনে
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) আপনি একদিনে যা কিছু অর্জন করলেন সেটিকে সাধুবাদ জানান একটা জটিল ধারণা। আমরা প্রায়ই ক্ষুদ্র পরিবর্তনকে পাত্তা দিনা, কারণ সেই মুহূর্তে এমন ক্ষুদ্র পরিবর্তন কোন মূল্যই বহণ করে না। আপনি যদি এখন কিছু পরিমান টাকা সঞ্চয় করেন, তাই বলে আপনি তো আর কোটিপতি হয়ে গেলেন না। আপনি পরপর তিন দিন জিমে গেলেন, তিন দিন পর আপনার শারিরীক গঠনে এই তিন দিনের শরীর চর্চা তেমন কোন প্রভাবই ফেলবে না। আপনি আজ রাতে এক ঘণ্টা চীনা ভাষা ম্যান্ডারিন শেখার কাজে ব্যায় করলেন, এর মানে এই নয় যে আপনি ম্যান্ডারিন ভাষা শিখে গেছেন। এমন আল্প সময়ে আমরা চোখে পড়ার মতো তেমন কোন পরিবর্তন আনতে পারবো না, বড় ফলাফল দ্রুত আসে না। তাই আমাদের উচিৎ একটা দীর্ঘ সময় ব্যাপী অনুশীলন করার পর ফিরে দেখা।

দুর্ভাগ্যক্রমে পরিবর্তন বা বিবর্তন বা রূপান্তরের এই ধীর গতির কারণে মানুষ যে কোন বদ অভ্যাসের ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারেন। শুধু এক বেলা আপনি অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলেন সেটি আপনার শরীরে তেমন কোন প্রভাবই ফেলবে না। আপনি শুধু আজকে রাত জেগে কাজ করলেন এবং আপনার পরিবারকে কোন সময়ই দিলেন না, তারা আপনাকে ক্ষমা করে দেবেন। আলস্য বসত আপনি আজকে আপনার দপ্তরের কোন কাজই করলেন না – তাতে কি, আপনি আবশ্যই পরে কাজটি শেষ করার সময় পাবেন। একটি একক সিদ্ধান্ত বাতিল করা খুব সহজ।
কিন্তু আমরা যখন দুর্বল সিদ্ধান্তের পুণরাবৃত্তি করি, ছোট ছোট ভুলগুলো খোঁড়া যুক্তি দিয়ে যৌক্তিক করে তুলি, ১ শতাংশ ভুল দিনের পর দিন বার বার করতে থাকি তখন ক্ষতিকর বিষাক্ত ফলাফল বহুগুণে বেড়ে যায়। এটা অনেক ভুল পদক্ষেপের সঞ্চিত ফলাফলÑ যত্রতত্র খেয়ালের ভুলে অভ্যাসে ১ শতাংশ অবনতিÑ যা শেষ পর্যন্ত একটা বড় পরিনতির দিকে নিয়ে যায়।
আপনার অভ্যাসের পরিবর্তনের প্রভাবের সাথে একটি বিমানের গতিপথ পরিবর্তনের তুলনা করা যায়। মাত্র কয়েক ডিগ্রির হেরফেরের প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। মনে মনে কল্পনা করুন আপনি লস এঞ্জেলেস থেকে নিউ ইয়র্ক সিটিতে উড়ে যাচ্ছেন। পাইলট সামান্য অমনোযোগী হবার কারনে গতিপথ পরিবর্তনের মিটারটা ৩.৫ ডিগ্রি দক্ষিণে স্থির রাখলেন। আপনার আর নিউ ইয়র্ক সিটিতে যাওয়া হবে না, আপনি ওয়াশিংটন ডিসি-তে অবতরণ করবেন। টেকঅফের সময় এই ধরনের একটি ছোট পরিবর্তনের ফলে বিমানের নাকটি মাত্র কয়েক ফুট সরে যায়, পরোক্ষণেই যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানচিত্রটি বড় করে বিমানের গতিপথে দৃষ্টিপাত করবেন ততক্ষণে আপনি আপনার গন্তব্য থেকে আরও শত শত মাইল দূরে চলে গেছেন।

একইভাবে আপনার দৈনন্দিন অভ্যাসে অতি সামান্য পরিবর্তন আপনাকে পরিচালনা করতে পারে এক আজানা-অচেনা ভিন্ন গন্তব্যে। আপনাকে শুধুমাত্র পছন্দ করতে হবে আপনি ১ শতাংশ ভাল চান না ১ শতাংশ খারাপ। শুরুর মুহূর্তে এটাকে তুচ্ছ মনে হতে পারে কিন্তু ভুললে চলবে না প্রতিটি মুহূর্ত যোগ করে একটা জীবনকাল সৃষ্টি হয়। শুরুতেই আপনার এই পছন্দ নির্ধারণ করে আপনি কে এবং আপনি কে হতে পারেন। সাফল্য হল দৈনন্দিন অভ্যাসের ফসল। জীবনে শুধুমাত্র একবার নাটকীয় পরিবর্তনের জন্য সাফল্য আসে না।
আপনি কতটা সফল বা ব্যর্থ তা বিবেচ্য বিষয় না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই মুহূর্তে আপনার অভ্যাস আপনাকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিনা। আপনার বর্তমান অবস্থার চেয়ে আপনার গতিপথ বা অভ্যাসের দিকে আরও বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। আপনি কোটিপতি কিন্তু আপনি প্রতি মাসে যা আয় করেন তার চেয়ে বেশি ব্যয় করেন তবে আপনি একটা ভুল গতিপথে হাঁটছেন। যদি আপনার ব্যয়ের অভ্যাস পরিবর্তন না হয়, তবে আপনার আগামী দিনগুলো ভালো যাবে না। অপর পক্ষে আপনি যদি কপর্দকশূন্যও হন তথাপিও আপনি প্রতি মাসে সামান্য কিছু টাকা-পয়সা সঞ্চয় করে রাখেন, তাহলে আমি বলবো আপনি আর্থিক স্বাচছন্দের পথে হাঁটছেন- হতে পারে আপনি আপনার আকাঙ্খার চেয়ে অত্যন্ত ধীর গতিতে অগ্রসর হচ্ছেন।
আপনার অর্জিত ফলাফল সবসময় আপনার অভ্যাস করার পরে পরিমাপ করতে হয়। আপনার সম্পদের নীট মূল্য আপনার আর্থিক অভ্যাসের একটা দীর্ঘ সময় পরে পরিমাপ করা যুক্তিযুক্ত। আপনার শরীরের ওজন আপনার নির্দিষ্ট খাদ্যাভ্যাসের পরে দৃষ্টিগোচর হবে। একটা দীর্ঘ সময় ব্যাপী শেখার অভ্যাস রপ্ত করার পর আপনার পাশের মানুষটি বুঝতে পারবেন আপনি কি পরিমান জ্ঞানী। আপনার বিশৃঙ্খল জীবন যাপন আপনার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার অভ্যাসকে অনুসরণ করবে। আপনি ঠিক যেমনটি পুনরাবৃত্তি করবেন ফলাফলও ঠিক তেমনই পাবেন।

আপনি যদি আন্দাজ করতে চান আপনি জীবনে কতদূর এগোবেন তবে আপনাকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অর্জনগুলো যোগ করতে হবে বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্ষতির বক্ররেখা অনুসরণ করতে হবে। আপনি স্পষ্ট দেখতে পাবেন কিভাবে আপনার প্রতিদিনের পছন্দগুলি দশ বা বিশ বছর ধরে যৌগিক ফলাফল এনে দিচ্ছে। আপনি কি প্রতি মাসে আয়ের চেয়ে খরচ কম করছেন? আপনি কি প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত শরীর চর্চা করছেন? আপনি কি নিয়মিত বই পড়ছেন এবং প্রতিদিন নতুন কিছু শিখছেন? এই ধরনের ছোট ছোট যুদ্ধ লড়তে থাকলে আপনার ভবিষ্যত আপনি নিজেই গড়ে তুলতে পারবেন।
সময় সাফল্য এবং ব্যর্থতার মধ্যেকার পার্থক্যকে বড় করে দেখতে সাহায্য করে। আপনি এখন যা বপন করবেন দশ বছর পরে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি পাবেন। ভালো অভ্যাস সঙ্কটকালে আপনার সহযোগী হয়ে উঠবে। খারাপ অভ্যাস সঙ্কটকালে আপনার শত্রু হয়ে উঠবে।

অভ্যাস একটি দ্বি-মূখী তলোয়ার। খারাপ অভ্যাস সহজেই আপনাকে কেটে ফেলতে পারে ঠিক তেমনি ভাবে ভালো অভ্যাস আপনাকে গড়ে তুলতে পারে। যে কারণে অভ্যাস সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যাস আপনার জীবনে কেমন ভাবে কাজ করে তা আপনাকে জানতে হবে এবং কিভাবে আপনি এগুলোকে পছন্দ অনুযায়ী আপনার জীবনে সুবিন্যাস্ত করবেন সে সম্পর্কে জানাও অতিব জরুরী বিষয়। এ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকলে আপনি বেøডের তীক্ষ্ণ ধারের বিপজ্জনক আঘাত থেকে বাঁচতে পারবেন।

আপনার অভ্যাস আপনার জন্য বা আপনার বিরুদ্ধে যৌগিক ফলাফল বয়ে আনতে পারে
ইতিবাচক যৌগিক প্রভাব
উৎপাদনশীলতার যৌগ। কোন একদিন একটি অতিরিক্ত কাজ সম্পাদন করা একটি ছোট্ট কৃতিত্ব বটে কিন্তু এটি পুরো ক্যারিয়ারের জন্য অনেক বেশি গুরুত্ব বহণ করে। একটি পুরানো কাজকে স্বয়ংক্রিয় বা সহজসাধ্য করা বা একটা নতুন দক্ষতা আয়ত্ত করার প্রভাব আরও বেশি হতে পারে। চিন্তা করে সময় নষ্ট না করে আপনি যত বেশি কাজ করতে পারবেন, অন্যান্য কাজে মনোনিবেশ করার জন্য আপনার মস্তিষ্ক তত বেশি মুক্ত থাকবে ।

জ্ঞানের যৌগ। একটা নতুন ধারণা শেখা আপনাকে প্রতিভাবান করে দেবে না, তবে আজীবন শেখার প্রতিশ্রæতি নিয়ে এগোলে আপনার জীবন পাল্টে যেতে পারে। প্রতিটি বই পড়া আপনাকে কেবল নতুন কিছু শেখায় না বরং পুরানো ধারণাগুলি সম্পর্কে চিন্তা করার বিভিন্ন উপায়ও খুঁজে পেতে সাহায্য করে। ওয়ারেন বাফেট যেমনটি বলেছেন, ‘জ্ঞান চক্রবৃদ্ধি সুদের হারে বৃদ্ধি পায়।’

সম্পর্কের যৌগ। মানুষ আপনারই আচরণকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দেয়। আপনি যত বেশি অন্যকে সাহায্য করবেন, ততই অন্যরা আপনাকে সাহায্য করতে চাইবে। মানুষের প্রতি প্রতিটি আচরণ কিছুটা সুন্দর করার চেষ্টা করলে সময়ের সাথে সাথে আপনার আচরণ আরও ভালো হতে থাকবে এবং আপনার বিশাল ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠতে পারে।

নেতিবাচক যৌগিক প্রভাব
মানসিক চাপের যৌগ। যানজটে পড়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হওয়া। স্ত্রী-সন্তানদের দায?িত্ব ভার। পাওনাদারের টাকা পরিষোধের দুশ্চিন্তা। সামান্য উচ্চ রক্তচাপের দুশ্চিন্তা। আমরা নিজেরাই এই সমস্ত মানসিক চাপের তুচ্ছ কারণগুলি খুঁজে বের করে সমাধান করতে পারি। কিন্তু আমরা যখন বছরের পর বছর ধরে দুশ্চিন্তাগুলো বয়ে বেড়ায় তখন সেটা গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়।

নেতিবাচক চিন্তার যৌগ। আপনি নিজেকে যত বেশি মূল্যহীন, মূর্খ বা কুৎসিত মনে করবেন, তত বেশি আপনি নিজেকে সেইভাবে পরিচালিত করবেন। আপনি একটা দুশ্চিন্তার ফাঁদে আটকা পড়বেন। আপনি অন্যদের সম্পর্কে কী ভাবেন তাও একইভাবে সত্য। একসময় আপনার চারপাশে সর্বত্র শুধু বদমেজাজী, অসৎ, স্বার্থপর মানুষ দেখতে পাবেন। এটা আপনার অভ্যাসে পরিণত হবে।

ক্রোধের যৌগ। দাঙ্গা, বিক্ষোভ, গণ-আন্দোলন ইত্যাদি কোন একটি ঘটনার ফলফল হিসাবে সৃষ্টি হয় না। প্রথমে ছোট ছোট আগ্রাসনের সৃষ্টি হয় এবং প্রতিদিন কোন না কোন বিষয় নিয়ে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়। দীর্ঘদিন ব্যাপী একটার পর একটা আগ্রাসনের প্রতিবাদ স্বরূপ ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
কোরবান আলী, অনুবাদক, টরোন্ট, ক্যানাডা।