Home কলাম অভ্যাস – এক বিষ্ময়কর শক্তির উৎস

অভ্যাস – এক বিষ্ময়কর শক্তির উৎস

জেমস ক্লিয়ার : অভ্যাস মানুষকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত করে। যখন একজন মানুষ এক জীবনে বিষ্ময়কর কিছু অর্জন করেন তখন আমরা মনে করি মানুষটি নিশ্চয় যাদু জানেন। বিষ্মিত হই, ভাবি কিভাবে সম্ভব। অসলে তার মৌলিক স্বভাবই তাকে এত দূর নিয়ে এসেছে। মানুষের পারিপার্শিক অবস্থা, মানসিক ও শারিরীক অবস্থা, ব্যক্তিগত বিশ্বাসবোধ, মূল্যবোধ ইত্যাদি মানুষের অভ্যাস গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। মানুষ চেষ্টা করলে খুব সহজেই অনেক ভাল অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন এবং খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন। মানুষ তার আচরণে অতি সূক্ষ্ণ পরিবর্তন করে জীবনে বিশাল সফলতা পেতে পারেন। অভ্যাসে সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ পরিবর্তন ঘটিয়ে কিভাবে নিজেকে একজন সফল মানুষে পরিণত করা যায় তা নিয়ে লেখক, উদ্যোক্তা এবং আচরণ বিশেষজ্ঞ জেমস ক্লিয়ার তার নাম্বার ওয়ান নিউ ইয়র্ক টাইম সর্বাধিক বিক্রিত গ্রন্থ ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। তিনি জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং নিউরোসায়েন্স থেকে ধারণাগুলি সংগ্রহ করেন যাতে ভাল অভ্যাসগুলিকে অনিবার্য এবং খারাপ অভ্যাসগুলিকে অসম্ভব করে তোলা যায়। সহজে বোঝা যায় এমন একটি নির্দেশিকা তৈরি করেছেন। এ যাবৎ ৪ মিলিয়নেরও বেশি সংখ্যক ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থটি বিক্রি হয়েছে। গ্রন্থটি সাপ্তাহিক বাংলা কাগজে ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী।

তিন.
সূচনা
বইটি আমি কিভাবে লিখলাম এবং কেন লিখলাম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ২০১৬ সালে আমার নিবন্ধগুলি টাইম, অন্ট্রাপ্রেনর এবং ফোর্বসের মতো দেশের সেরা পত্রিকাগুলোতে নিয়মিতভাবে প্রকাশ হতে শুরু করল। আমার কিছুতেই বিশ্বাস হয়না সেই বছর আমার লেখাটি আট মিলিয়নেরও বেশি লোক পড়েছিলেন। ন্যাশনাল ফুটবল লীগ, ন্যাশনাল বাস্কেটবল এ্যসোসিয়েসন এবং মেজর লীগ বেসবলের কোচবৃন্দ আমার নিবন্ধগুলো পড়তে শুরু করেন এবং এগুলো তাদের টিমের সদস্যদের শেয়ার করা শুরু করেন।

২০১৭ এর শুরুতে আমি হ্যাবিটস একাডেমি চালু করলাম। যেটি প্রতিষ্ঠানে এবং ব্যক্তি জীবনে এবং কর্মক্ষেত্রে আরও ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে আগ্রহীদের জন্য প্রধান প্রশিক্ষণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে ওঠে। ফরচুন ৫০০ এবং ক্রমবর্ধমান স্টার্ট আপ কোম্পানিগুলো তাদের নেতা এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য হ্যাবিটস একাডেমিতে নিবন্ধন করা শুরু করে। সব মিলিয়ে দশ হাজারের বেশি নেতা, ম্যানেজার, কোচ এবং শিক্ষকরা হ্যাবিটস একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। তাদের সাথে কাজ করার সুবাদে বাস্তবে অভ্যাস কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করি। (ফরচুন ৫০০ হল ফরচুন ম্যাগাজিন দ্বারা সংকলিত এবং প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ৫০০টি বৃহত্তম কর্পোরেশনগুলির একটি বার্ষিক তালিকা)

আমি ২০১৮ সালে এই বইটি যখন প্রকাশের জন্য চূড়ান্ত করি তখন জেমসক্লিয়ার-ডট-কমে প্রতি মাসে কয়েক মিলিয়ন নতুন পাঠক বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ আমার সাপ্তাহিক ইমেইল নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করেছেন – এটি এমন একটি সংখ্যা যা আমি কখনও প্রত্যাশা করিনি এবং এটি আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। যখন আমি বইটি লেখা শুরু করি সে সময় এ সংখ্যা সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না।

বইটি কীভাবে আপনার উপকারে আসবে
উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী নাভাল রবিকান্ত বলেছেন, ‘একটা দুর্দান্ত বই লিখতে হলে আপনাকে প্রথমে বই হতে হবে।’ উক্তিটির মৌলিক ধারণাগুলো আমি প্রকৃত অর্থেই শিখতে পেরেছি। কারণ অভ্যাস সংক্রান্ত ধারণাগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সূক্ষাতিসূক্ষ অভ্যাসগুলো গড়ে তুলতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম। সর্বগ্রাসী আঘাত থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আর কোন বিকল্প পথ আমার সামনে খোলা ছিল না। ছোট ছোট অভ্যাস গড়ে তোলার উপর নির্ভর করতে হয়েছে। শারিরীক শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য আমাকে নিয়মিত জিমে যেতে হয়েছে। বেসবল মাঠে একটি উচ্চ স্তরের সঞ্চালক হয়ে উঠতে, লেখক হয়ে উঠতে, একটি সফল ব্যবসা গড়ে তুলতে এবং সহজভাবে একজন দায?িত্বশীল প্রাপ্তবয়স্ক যুবক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য ছোট ছোট পদক্ষেপে অভ্যাসের স্মরণাপন্ন হতে হয়েছে। ছোট ছোট অভ্যাস আমাকে আমার স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করেছে। আপনি যেহেতু এই বইটি পড়ার জন্য বাছাই করেছেন, আমার অনুমান আপনিও আপনার স্বপ্ন পূরণ করতে চান।

সামনের দিকে প্রতিটি পাতায় আমি ধাপে ধাপে ভালো অভ্যাস গড়ে তোলার পরিকল্পনা তুলে ধরবো? মাত্র কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহের জন্য নয়, বরং সারা জীবনের জন্য অভ্যাসগুলো আপনার চলার পথে সাহস যুগাবে। আমার গ্রন্থটি শতভাগ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত। বইটি কোন একাডেমিক গবেষণালব্ধ কোন কাগজপত্র নয় বরং এটি একটি ব্যাবহারিক ম্যানুয়াল বা হ্যান্ডবুক। সামনের দিকে আপনি খুঁজে পাবেন বিজ্ঞান ভত্তিক তথ্য এবং ব্যবহারিক উপদেশ এবং এ সমস্ত কিছুর কেন্দ্রে রয়েছে বিজ্ঞান। আপনি কিভাবে নতুন অভ্যাস গড়ে তুলবেন এবং কিভাবে অভ্যাসের পরিবর্তন করবেন তার ব্যাখ্যা দেয়া হবে। এমন এক উপায়ে ব্যাখ্যাগুলো উপস্থাপন করা হবে যা বোঝা এবং প্রয়োগ করা সহজ।
যে বৈজ্ঞানিক তত্ত¡-উপাত্ত আমি এ বইটিতে ব্যাবহার করেছি সেগুলো হল- জীববিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান, দর্শন, মনোবিজ্ঞান আর আমার বহু বছরের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান ধারণা, পর্যবেক্ষণ ইত্যাদির সমন্বিত রূপ। বইটিতে আপনি সেরা ধারণাসমূহের একটি বিশ্লেষণ পাবেন, বিশ্বের চৌকস মানুষেরা অনেক দিন আগে এগুলো লিখে গেছেন এবং স¤প্রতিক কালে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, যা শক্তিশালীভাবে অপ্রতিরোধ্য উপায়ে আপনার মনে আগ্রহ সৃষ্টি করবে, আপনাকে মনোযোগী হতে সাহায্য করবে। আমি যে কাজটি করেছি সেটা হচ্ছে ধারণাগুলো খুঁজে বের করে একটা নির্দিষ্ট ধারায় পরাস্পরকে সংযুক্ত করেছি যা অত্যন্ত কার্যকরভাবে মানুষের অভ্যাস গঠনে সহায়ক। বইটির পৃষ্ঠাগুলোতে যা কিছু সুন্দর ও বুদ্ধিদীপ্ত তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বিজ্ঞানের পন্ডিতবর্গ যারা আমাকে বইটি লিখতে প্রলুব্ধ করেছেন। আর যা কিছু অসুন্দর, বোকামীতে পূর্ণ ধরে নেবেন সেটা আমার ভুলের কারনে ঘটেছে।

এই গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে আমার উদ্ভাবিত চার-পদক্ষেপ বিশিষ্ট অভ্যাস গঠনের নতুন মডেল -সংকেত, ঐকান্তিক ইচ্ছা, প্রতিক্রিয়া, এবং পুরষ্কার – এবং আচরণ পরিবর্তনের চারটি নিয়ম যা মডেলের চারটি ধাপ অনুসারে বিবর্তিত হয়ে বিকশিত হয়। পাঠকদের মধ্যে যারা মনোবিজ্ঞান পড়েছেন তারা অপারেন্ট কন্ডিশনিং এর আমার উল্লেখিত চারটি পদক্ষেপ সম্পর্কে পূর্ব ধারণা থাকতে পারে, যা বি.এফ. স্কিনার ১৯৩০-এর দশকে “উদ্দীপনা, প্রতিক্রিয়া, পুরস্কার” হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন যা অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং স¤প্রতি চার্লস ডুহিগ-এর লেখা দ্য পাওয়ার অফ হ্যাবিট গ্রন্থে সংকেত, রুটিন, পুরষ্কার হিসেবে প্রকাশ পায়।

স্কিনারের মতো আচরণ বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন যে আপনি যদি সঠিক পুরষ্কার বা শাস্তির প্রস্তাব দেন তবে আপনি একটি নির্দিষ্ট নিয়মে আপনার কর্মীবৃন্দকে পরিচালিত করতে পারবেন। স্কিনারের মডেল যখন বাহ্যিক উদ্দীপনা কীভাবে আমাদের অভ্যাসকে প্রভাবিত করে তার ব্যাখ্যা করেন তখন মডেলটি চমৎকার কাজ করেছে। কিন্তু আমাদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং বিশ্বাস কীভাবে আমাদের প্রভাবিত করে তার ব্যাখ্যার ঘাটতি ছিল। আচরণ পরিবর্তনে মানুষের অভ্যন্তরীণ অবস্থা- আমাদের মেজাজ এবং আবেগও গুরুত্বপূর্ণ। সা¤প্রতিক দশকগুলিতে বিজ্ঞানীরা মানুষের চিন্তা, অনুভূতি এবং আচরণের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করতে শুরু করেছেন । এই গবেষণাগুলোর প্রতিফলন ঘটবে এই গ্রন্থের নির্ধারিত পৃষ্ঠাগুলোতে।

আমি যে কয়েকটি ফ্রেমওয়ার্ক এ গ্রন্থে আলোচনা করেছি তার সবগুলোই জ্ঞানমূলক এবং আচরণগত বিজ্ঞানের সমন্বিত মডেল। আমি বিশ্বাস করি মানুষের আচরণ সম্পর্কিত মডেল সমূহের মধ্যে এটি একটি প্রথম মডেল যেখানে আমাদের অভ্যাসের উপর বাহ্যিক উদ্দীপনাসমূহের প্রভাব এবং অভ্যন্তরীণ আবেগের প্রভাব দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই সঠিকভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটিতে যদিও পরিচিত ভাষা ব্যাবহার করা হয়েছে তবে আমি বিশ্বাস করি আপনারা গ্রন্থটির গভীরে প্রবেশ করলে এবং আচরণ পরিবর্তনের চারটি নিয়মের প্রয়োগ পর্যবেক্ষণ করলে আপনারা অভ্যাস সম্পর্কে চিন্তা করার একটি নতুন উপায় খুঁজে পাবেন।
স্থান, কাল, পরিস্থিতি ভেদে মানুষের আচরণের পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু আমি এই গ্রন্থে আলোচনা করবো সেই সমস্ত আচরণ নিয়ে যেগুলোর খুব একটা পরিবর্তন হয় না। অর্থাত মানুষের মৌলিক মানবিক আচরণ নিয়ে আলোচনা হবে। আপনার আচরণের দীর্ঘস্থায়ী নীতিমালার উপর বছরের পর বছর নির্ভর করতে পারেন। অর্থাত আপনি একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেন, আপনার একটা পরিবার থাকতে পারে অথবা আপনি নিজের জন্য একটা নিজস্ব জীবন ব্যাবস্থা গড়ে তুলতে পারেন।

ভাল অভ্যাস গড়ে তোলার কোন সুনির্দিষ্ট সঠিক উপায় নেই। কিন্তু এই গ্রন্থটিতে আমার জানা মতে অভ্যাস গঠনের সর্বোত্তম উপায় সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। একটা বিশেষ পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে যা অত্যন্ত কার্যকর। আপনি কোথা থেকে শুরু করবেন এবং আপনি কি পরিবর্তন করার চেষ্টা করছেন তা বিষদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে আমি যে কৌশলগুলির আশ্রয় নিয়েছি তা যে কোন ব্যক্তির পক্ষে ধাপে ধাপে অনুসরণ করে অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটান সম্ভব। স্বাস্থ্য, অর্থ, উৎপাদনশীলতা, পারস্পরিক সম্পর্ক অথবা উপরের সবগুলোই আপনার লক্ষ্য হতে পারে। যদি এটি মানুষের আচরণের সাথে সংশ্লিষ্ট হয় তবে এই গ্রন্থটি আপনার পথ-প্রদর্শকের কাজ করবে।..(চলবে)
কোরবান আলী, অনুবাদক, টরোন্ট, ক্যানাডা।

Exit mobile version