জেমস ক্লিয়ার : অভ্যাস মানুষকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত করে। যখন একজন মানুষ এক জীবনে বিষ্ময়কর কিছু অর্জন করেন তখন আমরা মনে করি মানুষটি নিশ্চয় যাদু জানেন। বিষ্মিত হই, ভাবি কিভাবে সম্ভব। অসলে তার মৌলিক স্বভাবই তাকে এত দূর নিয়ে এসেছে। মানুষের পারিপার্শিক অবস্থা, মানসিক ও শারিরীক অবস্থা, ব্যক্তিগত বিশ্বাসবোধ, মূল্যবোধ ইত্যাদি মানুষের অভ্যাস গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। মানুষ চেষ্টা করলে খুব সহজেই অনেক ভাল অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন এবং খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন। মানুষ তার আচরণে অতি সূক্ষ্ণ পরিবর্তন করে জীবনে বিশাল সফলতা পেতে পারেন। অভ্যাসে সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ পরিবর্তন ঘটিয়ে কিভাবে নিজেকে একজন সফল মানুষে পরিণত করা যায় তা নিয়ে লেখক, উদ্যোক্তা এবং আচরণ বিশেষজ্ঞ জেমস ক্লিয়ার তার নাম্বার ওয়ান নিউ ইয়র্ক টাইম সর্বাধিক বিক্রিত গ্রন্থ ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। তিনি জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং নিউরোসায়েন্স থেকে ধারণাগুলি সংগ্রহ করেন যাতে ভাল অভ্যাসগুলিকে অনিবার্য এবং খারাপ অভ্যাসগুলিকে অসম্ভব করে তোলা যায়। সহজে বোঝা যায় এমন একটি নির্দেশিকা তৈরি করেছেন। এ যাবৎ ৪ মিলিয়নেরও বেশি সংখ্যক ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থটি বিক্রি হয়েছে। গ্রন্থটি সাপ্তাহিক বাংলা কাগজে ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী।

দুই.
সূচনা
আমার আরোগ্যলাভ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) এক বছর পর আমি যখন বেসবল মাঠে ফিরে আসি তখন বেসবল নিয়ে আমার যে স্বপ্ন সে সম্পর্কে সচেতন ছিলাম। সাথে সাথে মনের গহীনে এক ধরণের ব্যাথা চিন চিন করছিল। আমার জীবনের একটি প্রধান অংশ জুড়ে ছিল বেসবল । আমার বাবা সেন্ট লুই কার্ডিনালসের হয়ে মাইনর লিগ বেসবল খেলতেন। আমারও বেসবল খেলাকে পেশা হিসাবে বেছে নিবার স্বপ্ন ছিল। মাসের পর মাস পুনর্বাসনে থাকার পর সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে আমি প্রথমত যা চেয়েছিলাম তা হচ্ছে বেসবল খেলার মাঠে ফিরে যাওয়া।
কিন্তু বেসবল খেলায় প্রত্যাবর্তনের পথ আমার জন্য মসৃণ ছিল না। যখন বেসবল মৌসুমের বল মাঠে গড়াল তখন আমিই একমাত্র জুনিয়র যাকে ভার্সিটি বেসবল টিম থেকে বাদ দেয়া হল। আমাকে জুনিয়র টিমে হাইস্কুলের ছেলেদের সাথে খেলতে পাঠানো হল। আমি চার বছর বয়স থেকে খেলছি এবং যে কারও তুলনায় খেলাধুলায় সবচেয়ে বেশি সময় ব্যায় করেছি এবং আমার আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আর আমার মতো একজন খেলোয়াড়ের মূল টিম থেকে বাদ পড়া অপমানজনক। আমি এ দিনটির কথা আজও ভুলতে পারিনি। আমি গাড়িতে বসে কাঁদলাম। গাড়ির রেডিওর সেন্টারগুলো উলটপালট করে মরিয়া হয়ে এমন একটা গান খুঁজছিলাম যা আমাকে কিছুটা স্বস্তি দেবে।

এক বছর দ্বিধাদ্ব›েদ্ব থাকার পর আমি ভার্সিটি টিমে সিনিয়রদের সাথে খেলার জায়গা করে নিলাম। কিন্তু আমি খুব কম সংখ্যক ম্যাচ খেলেছি। উচ্চ বিদ্যালয়ের হয়ে সব মিলিয়ে এগারোটা বেসবল ইনিংস খেলেছি যা একটা গেম সিরিজের একটু বেশি।
হাইস্কুল লেভেল ক্যারিয়ারে খুব সামন্য পারফরমেন্স থাকা সত্তে¡ও আমি এখনও বিশ্বাস করি যে আমি নিজেকে একজন বিখ্যাত খেলোয়াড় হিসাবে গড়ে তুলতে পারবো। যদি সবকিছু আমার অনুকুলে চলে আসে, প্রতিবেশের উন্নতি হয় তবে আমার বিশ্বাস সেটা আমার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার করণেই সম্ভব হয়েছে। আঘাত পাওয়ার দুই বছর পর ঘুরে দাঁড়ানোর সময় আসল। সে সময় আমি ডেনিসন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করি। এটি আমার জীবনে একটা নতুন অধ্যয়ের শুভসূচনা। এটিই সেই জায়গা যেখানে আমি প্রথমবারের মত ছোট্ট একটা অভ্যাসের আশ্চর্যজনক শক্তি আবিষ্কার করলাম।

অভ্যাসের এই যাদুময় শক্তির কথা আমি কিভাবে শিখলাম
ডেনিসন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আমার জীবনের অন্যতম সেরা সিদ্ধান্ত ছিল। আমি বেসবল টিমে একটা জায়গা করে নিতে পেরেছিলাম। যদিও নিচের সারিতে নবীনদের তালিকায় আমার নাম ছিল। তবুও আমি বেশ রোমাঞ্চিত ছিলাম। হাইস্কুলে পড়ার সময় আমার জীবন বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ থাকা সত্তে¡ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নিজেকে একজন ক্রীড়াবিদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলাম।
আমি শীঘ্র বেসবল খেলায় নিজেকে নিমগ্ন করতে চাই না বরং আমার জীবনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার কাজে মনোনিবেশ করলাম। আমার সমবয়সীরা দেরি করে ঘুম থেকে উঠে, ভিডিও গেম খেলে। আমি ভাল ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলেছি। প্রতি রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে গেছি। ছাত্রাবাসের নোংরা অগোছালো পরিবেশে আমি আমার রুমটি পরিষ্কার আর পরিপাটি রাখার চেষ্টা করেছি। আমার এই উন্নতি ছিল অতিক্ষুদ্র কিন্তু এটা আমাকে আমার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার শিক্ষা দিয়েছে। সে সময় নিজের মধ্যে একটা আলাদা অনুভূতির অনুরণন হচ্ছিল। ধীরে ধীরে আমি আবার আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম। এই ক্রমবর্ধমান বিশ্বাসবোধ আমাকে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস যুগিয়েছে। শ্রেণীকক্ষে মনোযোগী হয়েছি। অধ্যয়নের অভ্যাস উন্নত করেছি। ফলত প্রথম বর্ষে আমি সরাসরি এ-গ্রেড অর্জন করলাম।

একটা সুনির্দিষ্ট রুটিন মাফিক কাজ করাকে অভ্যাস বোঝায়। অথবা অভ্যাস একটা নিয়মিত আচরণকে নির্দেশ করে যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়। প্রতিটি সেমিস্টার পার হওয়ার সাথে সাথে আমার সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ অভ্যাসগুলো শেষ পর্যন্ত এমন এক ফলাফল বয়ে আনে যা আমি যখন শুরু করি তখন আমার কাছে অকল্পনীয় মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ আমার জীবনে প্রথমবারের মতো প্রতি সপ্তাহে একাধিকবার ভার উত্তোলনের অভ্যাস গড়ে তুললাম। কয়েক বছর পরে দেখতে পেলাম আমার ছয়-ফুট-চার ইঞ্চির শারিরীক ফ্রেমটি ১৭০ পাউন্ড ফিদারওয়েট থেকে মেদহীন ২০০ পাউন্ডে উন্নিত হয়েছে।

আমি যখন দ্বিতীয় বর্ষে উঠলাম তখন আমি একটা ছোট দলের নেতা নির্বাচিত হলাম। প্রথম বর্ষের ছোটছোট অভ্যাস গুলোর ফলাফল হিসাবে আমি ছোট দলের অধিনায়ক হলাম। আর দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টার শেষে ভোট পেয়ে আমি অল-কনফারেন্স দলের নেতা নির্বাচিত হলাম। প্রথম বর্ষে শুরু করা আমার ঘুমের অভ্যাস, অধ্যয়নের অভ্যাস এবং শারিরীক শক্তি বৃদ্ধির অনুশীলন সত্যিই মূল্য দিতে শুরু করল।
ছয় বছর আগে আমি মুখমন্ডলে বেসবলের ব্যাট দিয়ে আঘাত পেয়েছিলাম। হেলিকপ্টার উড়িয়ে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমার বাঁচার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল, আমি কোমায় চলে গেছিলাম। সেই আমি ডেনিসন ইউনিভার্সিটিতে শীর্ষ পুরুষ ক্রীড়াবিদ হিসেবে নির্বাচিত হলাম এবং ইএসপিএন একাডেমিক অল-আমেরিকা তালিকায় আমার নাম দ্যূতি ছড়াল। সারা দেশে মাত্র তেত্রিশ জন খেলোয়াড়কে এই সম্মানে সম্মানিত করা হল, আমি তাদেরই একজন। আমি স্নাতক পাশ করার সময় আটটি আলাদা বিভাগে স্কুলের রেকর্ড বুকে তালিকাভুক্ত হলাম। একই বছর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ একাডেমিক সম্মান প্রেসিডেন্ট এ্যাওয়ার্ড লাভ করি।

আশা করি আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন যদি উপরে উল্লেখিত কথাগুলোর মধ্যে কোথাও কোন অহংকারের ছোঁয়া পান। সত্যি কথা বলতে আমার অ্যাথলেটিক ক্যারিয়ারে কোন ঐতিহাসিক অর্জন ছিল না বা আমি কোন কিংবদন্তিও নই। আমি কখনই পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে জীবন অতিবাহিত করিনি। তা সত্বেও পেছনের বছরগুলোর দিকে চোখ ফিরালে আমি বিশ্বাস করি আমি বিরল কিছু অর্জন করেছি: আমি আমার সুপ্ত ক্ষমতার পুরোপুরি বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি এই বইয়ের ধারণাগুলি আপনারও সুপ্ত ক্ষমতার বিকাশে সহায়তা করতে পারে।
আমরা সকলেই জীবনে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই। তদ্রæপ আমিও এক জীবন-মরণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করি। এটি আমাকে একটি জটিল পাঠ শিখিয়েছে। যে পরিবর্তনগুলি প্রথমে ছোট এবং গুরুত্বহীন বলে মনে হয় তা উল্লেখযোগ্য ফলাফলের দিকে আপনাকে নিয়ে যাবে আপনি যদি বছরের পর বছর লেগে থাকতে ইচ্ছুক হন। আমরা সকলেই বাধা বিপত্তির সাথে যুদ্ধ করি তবে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের জীবনের গুণগতমান প্রায়শই নির্ভর করে আমাদের অভ্যাসের গুণগতমানের উপর। যেমন অভ্যাসে অভ্যস্ত হবেন, ঠিক তেমনই ফল পাবেন। কিন্তু ভালো অভ্যাস গড়তে পারলে জীবনে যে কোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব।

হয়তো এমনও মানুষ আছেন যিনি রাতারাতি অবিশ্বাস্য সাফল্য অর্জন করতে পারেন। আমি তাদের কাউকেই চিনি না এবং আমি অবশ্যই তাদের মধ্যে থেকে আসিনি। চিকিৎসাশাস্ত্র মতে যখন আমি কোমায় ছিলাম এবং যখন আমি অল-আমেরিকান একাডেমিক অ্যাওয়ার্ড পেলাম এই দীর্ঘ যাত্রায় আমার কোন নির্দিষ্ট বিশেষ মুহূর্ত ছিল না। অমি ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছি। ছোট ছোট জয়ের দীর্ঘ সিরিজ আমাকে বর্তমান জায়গায় নিয়ে এসেছে। আমি অগ্রগতির একমাত্র উপায় খুঁজে পেয়েছিলাম অথবা আমার কাছে একটি মাত্র পথ খুলা ছিল সেটা হচ্ছে – ছোট ছোট পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়া। কয়েক বছর পরে যখন আমি আমার নিজের ব্যবসা শুরু করি এবং এই বইটি লেখা শুরু করি এই একই কৌশল অনুসরণ করেছি।

বইটি আমি কিভাবে লিখলাম এবং কেন লিখলাম
২০১২ এর নভেম্বরে আমি জেমসক্লিয়ার-ডট-কমে নিবন্ধ প্রকাশ করা শুরু করি। বেশ কয়েক বছর ধরে আমি অভ্যাস সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার নোট রাখছিলাম এবং অবশেষে সে সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কিছু অংশ জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য প্রস্তুত হলাম। আমি প্রতি সোমবার এবং বৃহস্পতিবার একটা নতুন নিবন্ধ প্রকাশ দিয়ে শুরু করি। কয়েক মাসের মধ্যে এই সহজ লেখার অভ্যাসটি আমাকে প্রথম এক হাজার ই-মেইল গ্রাহক সাড়া দিল, এবং ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ সেই সংখ্যা দাঁড়াল ত্রিশ হাজারেরও বেশি।

২০১৪ সালে আমার নিবন্ধগুলোর ই-মেইল সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা এক লক্ষেরও বেশি হয়ে গেল। আমার প্রকাশিত নিবন্ধগুলো একটি দ্রæত বর্ধনশীল নিউজলেটারগুলির মধ্যে একটিতে রূপান্তর হল। কয়েক বছর আগে আমি যখন নিবন্ধ লিখতে শুরু করি তখন নিজেকে একজন প্রতারক মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন আমি অভ্যাস বিশেষজ্ঞ হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছি —একটি নতুন লেবেল যা আমাকে উত্তেজিত করেছে কিন্তু অস্বস্তিও বোধ করছি। আমি নিজেকে কখনই এই বিষয়ের একজন মাস্টার মনে করিনা বরং নিজেকে পাঠকদের মতোই একজন অভ্যাস পর্যবেক্ষক মনে করি।

২০১৫ সালে আমি দুই লাখ ই-মেইল গ্রাহককে আমার নিউজলেটার পৌঁছে দিয়েছি এবং পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউসের সাথে একটি বই প্রকাশের চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। আপনি এখন যে বইটি পড়ছেন এটিই সেই বই। আমার শ্রোতা যেমন বেড়েছে তেমনি আমার ব্যাবসা করার সুযোগও বেড়েছে। অভ্যাস গঠনের বিজ্ঞান, আচরণ পরিবর্তন এবং ক্রমাগত উন্নতি শীর্ষক সংস্থাগুলি থেকে আমার ডাক পড়েছে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য এবং তা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ বিষয়ে প্রধান বক্তা হিসাবে বক্তব্য প্রদান করেছি।..(চলবে)

কোরবান আলী, অনুবাদক, টরোন্ট, ক্যানাডা।