Home কলাম অভিবাসী মন, অভিবাসী জীবন : মিস বেকার বনাম কানাডা – যে রায়...

অভিবাসী মন, অভিবাসী জীবন : মিস বেকার বনাম কানাডা – যে রায় কানাডায় শিশু অধিকার রক্ষার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে

মনীষ পাল : মেভিস বেকার শুধুমাত্র ভ্রমণের জন্য জ্যামাইকা থেকে কানাডায় আসেন ১৯৮১ সালে; তারপর আর কখনো ফিরে যাননি। তাকে পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়া হয়নি, এগারো বছর ধরে অবৈধভাবে তিনি এই দেশে থেকে যান। গৃহকর্মী হিসেবে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। কানাডায় থাকা অবস্থাতেই তিনি আবার চারটি সন্তানের জন্ম দেন। সর্বশেষ সন্তান ডেসমন্ড এর জন্মের পর, মিস বেকার এর প্রসবোত্তর মানসিক রোগ ধরা পড়ে। ডাক্তাররা সনাক্ত করেন প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া। মিস বেকার তখন সরকারের কল্যাণভাতার জন্য আবেদন করেন। প্রথম যখন তার মানসিক রোগ ধরা পড়ে, তার সন্তানদের মধ্যে দুজনকে তাদের বাবার জিম্মায় দিয়ে দেয়া হয়, আর বাকি দুজনকে দেয়া হয় পালক পরিবার বা ফর্স্টার কেয়ার এর দায়িত্বে। পরবর্তীতে তার মানসিক অবস্থা একটু ভালোর দিকে উন্নতি হলে পালক পরিবার থেকে তার দু সন্তানকে আবার তার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

কানাডায় অবৈধ অবস্থানের কারণে মিস বেকারকে ১৯৯২ এর ডিসেম্বরে কানাডা থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেয়া হয়। অবৈধভাবে এগারো বছর কাজ করাটাও বেআইনি বলে বহিস্কার আদেশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এদিকে তিনি ১৯৯৩ সালে অভিবাসন আইনের প্রাসঙ্গিক ধারা ১১৪ অনুযায়ী মানবিক কারণে সহানুভূতি চেয়ে পার্মানেন্ট রেসিডেন্স আবেদনের যাবতীয় বাধ্যবাদকতা থেকে তাকে অব্যাহতির আবেদন করেন। তার আইনজীবী আবেদনের সাথে যুক্ত করে দেন চিকিৎসার যাবতীয় নথি, সেই সাথে চিলড্রেন এইড সোসাইটির সোশ্যাল ওয়ার্কার এর চিঠি। আবেদনে উল্লেখ করা হয়, যদিও তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, কিন্তু তার অবস্থার ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে। আরো বলা হয়, তাকে যদি জ্যামাইকায় ফিরতে বাধ্য করা হয়, তাহলে সেখানে তার অবস্থার অবনতি হতে বাধ্য, কেননা জ্যামাইকায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা মিলবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তার আবেদনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়, তার কানাডায় জন্ম নেয়া সন্তানদের দুজন তার সাথে থাকে এবং তাদের যাবতীয় ভরণ পোষণের দায়িত্ব কেবল তিনিই বহন করেন। অন্য দু সন্তান যদিও ও তার সাথে থাকে না, কিন্তু তারা মানসিক সমর্থনের জন্য তার উপর নির্ভর করে; তাই সন্তানদের কাছ থেকে তাকে আলাদা করা হলে তার মনোকষ্ট আরো বাড়বে বই কমবে না।

মিস বেকার এর আবেদন অভিবাসন কর্মকর্তা নাকচ করে দেন। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল এর ১৮ তারিখে এক চিঠিতে এই সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। এতে শুধু বলা হয়, যে আইনের আওতায় মানবিক কারণে কানাডায় অবস্থান করে স্থায়ী অভিবাসী হবার আবেদন তিনি করেন, সেই কারণগুলো যথেষ্ট নয়। চিঠিতে এই নেতিবাচক সিদ্ধান্তের অনুক‚লে কোনো যুক্তি বা কার্যকারণ তুলে ধরা হয়নি। এবার তার আইনজীবীর অনুরোধে তদন্তকারী কর্মকর্তার কিছু নথির সারমর্ম পাওয়া যায়। এই কর্মকর্তা তার নথিতে লিখেন, আবেদনপ্রার্থী এখন বেকার, কোনো আয়ের সংস্থান নেই, কোনো সহায় সম্পত্তি নেই, সরকারি কল্যাণ তহবিল থেকে তার সংস্থান করা হয়। তার জ্যামাইকায়ও আগের চার সন্তান রয়েছে। সেই কর্মকর্তার নথিতে তার আবেদনের সাথে সংযুক্ত তথ্যের খুব একটা অমিল নেই, তাছাড়া তার ডাক্তার এবং সোশ্যাল ওয়ার্কার এর চিঠিতে তার মানসিক এবং শারীরিক যে বিপর্যস্ত অবস্থার কথা বলা হয়েছে, সেইগুলোও প্রকারান্তরে একইভাবে নথিতে উঠে আসে। আসলে তদন্তকারী কর্মকর্তার নথিই উর্ধতন কর্মকর্তা তার সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে বহাল রাখে।
বাড়তি যে বিষয়টি সরকারের নথিতে লেখা হয়, সেটি হচ্ছে তাদের সিস্টেম এর ঘাটতি আর দীর্ঘসূত্রিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ‘আবেদনকারী ১৯৮১ তে কানাডায় আসে অথচ ১৯৯২ পর্যন্ত তাকে ফেরত পাঠানোর আদেশ হয়নি এবং এখন ১৯৯৪, মক্কেল এখনো কানাডায় বহাল তবিয়তে আছে’।

তারা অভিমত দেন, মিস বেকার বাকি জীবন সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার এর উপর একটা বড়ো বোঝা হয়ে দাঁড়াবেন। তাদের মতে, তার কানাডায় জন্ম নেয়া চার সন্তান ছাড়া মানবিক দিক বিবেচনার আর কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ নেই। ‘আর আমরা কি সেই একটি কারণেই তাকে এই দেশে থেকে যেতে দেবো? আমার মতে, কানাডা এই ধরণের উদারতা দেখানোর সামর্থ্য রাখে না। তবু ও, পরিস্থিতি এমন, এই বিষয়টি জানাজানি হলে বিরূপ প্রচারণার ঝুঁকি থেকে যায়’। নথি লিখায় দায়িত্ব প্রাপ্ত অফিসার আবেদন অগ্রাহ্যের সুপারিশ করেন, কিন্তু সতর্কতা হিসেবে বাস্তবায়নের আগে আঞ্চলিক কার্যালয়ের সাথে বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত আলাপের পরামর্শ দেন।

শেষ পর্যন্ত মিস বেকার এর আবেদন অগ্রাহ্য করা হয়। ১৯৯৪ এর ২৪ মে তাকে নোটিস দেয়া হয় যাতে তিনি কানাডা ত্যাগের জন্য জুন এর সতেরো তারিখে বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে তার আপিল আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়ায় সেই যাত্রায় তিনি কানাডা ছেড়ে যাওয়া থেকে বেঁচে যান।

মিস বেইকার এর আইনজীবী অভিবাসন কর্মকর্তার এই আদেশের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার আবেদন করেন। কিন্তু ফেডারেল আদালতও তার এই আবেদন নাকচ করে দেন। কিন্তু নাকচ করলেও আদালত জনগুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্নের অবতারণা করেন যা একমাত্র ফেডারেল আদালতের আপিল বিভাগে শুনানি হতে পারে। আদালত প্রত্যয়ন করেন, শিশুর সর্বোচ্চ স্বার্থ বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইনকে মান্য করবার জন্য কানাডার নিজস্ব আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই, সেই ক্ষেত্রে অভিবাসন কর্তৃপক্ষের সেই আইন মানার ক্ষেত্রে কি কোনো বাধ্যবাদকতা আছে? ফেডারেল আদালত এর আপিল বিভাগও বিচারিক আদালতের পর্যালোচনা বহাল রাখে; তারা অভিমত দেন, মিস বেকার এর আবেদন পর্যালোচনায় শিশুর সর্বোচ্চ স্বার্থের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। শেষ পর্যন্ত এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে গড়ায়। কানাডার সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত পাল্টে দেয়। তারা অভিমত দেন, পদ্ধতিগত ন্যায্যতা (প্রসিডিউরাল ফেয়ারনেস) দাবি করে, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর মিস বেকার এর সন্তানদের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া দরকার। শিশুর অধিকারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক সনদে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ আছে আর তাই যে কোনো আবেদন বিবেচনায় যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়া সমীচীন। তারা মনে করেন, সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সামঞ্জস্য থাকা উচিত।

মিস বেকার সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার জন্য সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেন। তার অন্যতম যুক্তি ছিল, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ন্যায্যতা তার প্রাপ্য এবং সেই ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনের কারণগুলো জানানো সরকারের কর্তব্য। আদালত সেই যুক্তিকে সমর্থন করেন, তবে অভিবাসন কর্মকর্তার দেয়া নথি এই ক্ষেত্রে সরকারের কর্তব্য পালন হিসেবে গ্রহণ করে কিছুটা নমনীয়তা দেখান।

মিস বেকার আরো দাবি করেন, কোনো ধরণের পক্ষপাতমূলক আচরণ থেকে সরকারের স্বাধীন ও মুক্ত থাকা উচিত। আদালত এই দাবির পক্ষ অবলম্বন করেন এবং বলেন, অভিবাসন কর্মকর্তার নথি পক্ষপাতমূলক, এই অভিযোগের পক্ষে যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে আর যা বিচারিক আদালতগুলো তাদের সিদ্ধান্ত নিতে কাজে লাগিয়েছে।

কানাডা ১৯৯১ সালে প্রথম শিশু অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষর করে। আরো একশো নব্বইটা দেশের সাথে কানাডা শিশু অধিকার রক্ষার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, রাষ্ট্রের যে কোনো কর্মকান্ডে, সেটা সরকারি বা বেসরকারি হউক, শিশুদের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষা হবে মূল বিবেচনা। কানাডা আরো প্রতিশ্রুতি দেয়, যে কোনো বিচারিক বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বয়স এবং পরিপক্কতা বিবেচনায় শিশুদের মত প্রকাশের সুযোগ থাকবে। উল্লেখ্য, গুটিকয় ব্যতিক্রম বাদে এখানকার অধিকাংশ প্রদেশে আঠারো বছরের নিচে যে কাউকেই শিশু আইনের আওতায় গণ্য করা হয়। কানাডার বিচারিক ইতিহাসে বেকার বনাম কানাডা শিশুদের সর্বোচ্চ স্বার্থের বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে যুগান্তকারী রায় হিসেবে এক মাইলফলক হয়ে আছে।
মনীষ পাল – লেখক ও অভিবাসন উপদেষ্টা, টরন্টো

Exit mobile version