মনীষ পাল : এটি আশির দশকের ঘটনা। জোসেফ চিয়ারেল্লি নামের এক ইতালীয় অভিবাসী মাদক চোরাচালানের দায়ে অভিযুক্ত হন। তিনি কানাডায় আসেন ১৯৭৫ সালে। তিনি ১৯৮৪ এর শেষের দিকে ছয় মাসের জেল খাটেন। চিয়ারেল্লি তখনো কানাডার নাগরিকত্ব পাননি। তাই ১৯৮৬ সালে তার পার্মানেন্ট রেসিডেন্সির শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে তাকে এক শুনানিতে হাজির হতে বলা হয়। অভিবাসন আইনে বলা আছে, কোনো স্থায়ী অভিবাসী, যাদের এখনো নাগরিকত্ব হয়নি, তারা কোনো গুরুতর অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হলে তাদেরকে কানাডা থেকে অপসারণ করা যাবে। তবে অপরাধের মাত্রা প্রকৃত সাজার উপর নির্ভর করে না, বরং খতিয়ে দেখা হয়, অপরাধ কি পাঁচ বছর বা তার বেশি মেয়াদের জন্য সাজার উপযুক্ত কিনা । তার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। অভিবাসন বিভাগের এক আদেশে চিয়ারেল্লিকে শুনানি শেষে অপসারণের আদেশ দেয়া হয়।
কানাডিয়ান চার্টার অফ রাইটস এন্ড ফ্রিডম অনুযায়ী, কেবলমাত্র নাগরিকরাই কানাডায় ঢোকা, বসবাস করা এবং দেশ ত্যাগের অধিকার রাখে। শুধুমাত্র কোনো দেশের সাথে প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকলেই কোনো নাগরিককে আদালতের আদেশে অন্য দেশের হাতে তুলে দেয়া যাবে। অন্যদিকে, পার্মানেন্ট রেসিডেন্টরা যদিও সীমিত আকারের অধিকার ভোগ করে, কিন্তু কানাডায় থাকা তাদের সাংবিধানিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না। অভিবাসন আইন অনুযায়ী তাদের এই দেশে থাকবার কোনো শর্ত লংঘিত হলে তাদেরকে এই দেশ থেকে আইনগতভাবে অপসারণের সুযোগ সরকারের রয়েছে।
এই যে দীর্ঘ মেয়াদে যারা কানাডায় বসবাস করছেন যেমন পার্মানেন্ট রেসিডেন্টরা, তাদেরকে নির্বাসনে পাঠানোর এই আইনটি কতটুকু সংবিধানসম্মত, এটি আমরা একটু খতিয়ে দেখতে পারি।
চার্টারে সাত নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে এবং মৌলিক বিচারের নীতির ব্যত্যয় ছাড়া কোনোভাবেই তাদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। পার্মানেন্ট রেসিডেন্টদের মতো যারা দীর্ঘ মেয়াদে কানাডায় বসবাস করছে, যারা তাদের পরিবার, সমাজ এবং কাজের সূত্রে এখানে শেখর গেড়েছে , তাদেরকে এই দেশ থেকে অপসারণ তাদের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তার লঙ্ঘন ছাড়া আর কিছুই নয়। এই চন্ড নীতি মৌলিক বিচারের নীতির সাথে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অভিবাসন আইন বিগত কয়েক দশক ধরে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কারণগুলোর মধ্যে বলা যায়, অভিবাসন প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির স্বার্থের অধিকার, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশ্বায়ন, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রশাসনিক এবং সাংবিধানিক আইনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। কিন্তু তারপরও অভিবাসন আইন ও প্রয়োগে রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করবার জো নেই। তাই অভিবাসন এখন এক সংকটময় সময় অতিক্রম করছে। একদিকে আশির দশকে সিং বনাম কানাডায় সর্বোচ্চ আদালত চার্টারের আলোকে শরণার্থী আইনে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসে, আবার অন্যদিকে নব্বই এর মাঝামাঝি চিয়ারেল্লি মামলায় নাগরিক আর অনাগরিকদের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়।
চিয়ারেল্লি মামলায় যা দেখতে পাই, দীর্ঘ মেয়াদি অভিবাসীর দেশ থেকে অপসারণ ইস্যুতে আদালত ব্যক্তির উপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কোনো সাংবিধানিক রক্ষাকবচের গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়। প্রথমত, আদালত দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করা অভিবাসীর ব্যক্তি অধিকারকে সম্পূর্ণ মূল্যায়ন করেননি, দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়ে ব্যক্তির মানবাধিকার বা মৌলিক বিচারের আরো অন্যান্য বিষয়গুলোকে খতিয়ে দেখেননি। মূলত আদালত ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের অধিকারের মধ্যে কার্যকর কোনো সমতা বিবেচনায় আনেননি। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে একমাত্র বিবেচনায় নিয়ে সর্বোচ্চ আদালত অভিবাসীর কানাডায় দীর্ঘমেয়াদি জীবন যাপনের যাবতীয় গুরুত্বকে একেবারে নাকচ করে বিপক্ষের যুক্তিকে একেবারেই আমলে নেননি। তার উপর চিয়ারেল্লিকে নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে সিকিউরিটি সনদ ইস্যু করে ভবিষ্যতের মামলাগুলোর যাবতীয় আপিলের দরজাও বন্ধ করে দেয়া হয়। পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট যারা দীর্ঘ মেয়াদের কানাডায় আছেন, কেবলমাত্র নিরাপত্তার অজুহাতে তাদেরকে কানাডা থেকে অপসারণের বিষয়টি সংবিধানের আলোকে সর্বোচ্চ আদালতের আবারো পরখ করে দেখা উচিত। ব্যক্তির অধিকার অর্থাত পরিবার, সমাজ বা জীবিকা থেকে ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা এবং রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার মধ্যে একটা অর্থবহ ভারসাম্য নিয়ে আসা আদালতের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তবেই আদালত নাগরিক এবং অনাগরিকদের মধ্যে রাষ্ট্রের আচরণের তারতম্য আইনের আলোকে ব্যাখ্যা দিতে পারেন ।
মৌলিক বিচার ব্যবস্থার নীতিমালা খতিয়ে দেখতে প্রথমেই জানা দরকার, ব্যক্তির কোন স্বার্থ বিপন্ন হতে পারে কিনা। যেমন শরণার্থীর ক্ষেত্রে, স্বদেশে ফেরত পাঠালে ব্যক্তির নিরাপত্তা এমনকি জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। সিং মামলায় এই বিষয়টি আদালত স্বীকার করে নিয়ে শুনানিতে শরণার্থীর পক্ষের যুক্তি উত্থাপনের ভিত গড়ে দেন। পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট এর ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি প্রযোজ্য হতে পারে। যদি গুরুতর অপরাধের কারণে তাদেরকে অন্য দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়, যেখানে তারা দীর্ঘদিন বাস করেননি এবং যারা পরিবার এবং সমাজ থেকে ছিটকে যেতে পারেন, তাদের ক্ষেত্রেও মুক্ত এবং নিরাপদ জীবন যাপন হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই চার্টারের অনুচ্ছেদ সাত এর বিশ্লেষণে প্রেক্ষিত বিবেচনায় নেয়া সঙ্গত বই কি।
আইনের চোখে নাগরিক ও অনাগরিকদের মধ্যে বিচারের তারতম্য আন্তর্জাতিক সনদও সমর্থন করে না। ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিউনিটি চুক্তির আওতায় ইউরোপের সদস্য রাষ্ট্রগুলো সিটিজেন এবং নন-সিটিজেনদের জন্য দু ধরণের আইন প্রনয়ণ করতে পারে না। অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে ইউরোপীয় চুক্তি ঢালাও অপসারণ সমর্থন করে না। কাউকে তখনি অপসারণ করা যাবে যদি সেই ব্যক্তি সমাজের জন্য পরিষ্কারভাবে এই মুহূর্তে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিলে কানাডায় দীর্ঘ মেয়াদে যারা বসবাস করছেন এবং যারা ইতোমধ্যেই নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন, তারা যদি দেশের প্রতি উল্লেখযোগ্য কোনো ঝুঁকির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, তবে তাদেরকে অপসারণ কোনো মৌলিক বিচারের মধ্যে পড়ে না। তাদেরকে সেই ক্ষেত্রে এই দেশে থাকবার অধিকার দেয়া উচিত। পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট যারা দীর্ঘমেয়াদে এই দেশে আছেন, তাদেরকে এই দেশ থেকে অপসারণ করা মরার উপর খাড়ার ঘা ছাড়া আর কি হতে পারে। প্রথমত তারা তাদের অপরাধের জন্য শাস্তি ভোগ করেন, তারপর সাজা শেষে দেশ থেকে বিতাড়িত হন। এটি একই অপরাধের জন্য দু দুবার সাজার শামিল। আদালতের এই বিষয়টি আরো গভীরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। চার্টারের আরো অনেক অংশে বলা হয়েছে, কেউ একই অপরাধের জন্য দুবার সাজা প্রাপ্ত হতে পারে না, সবাইকে সমানভাবে আইনের সুরক্ষা দিতে হবে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে দেশ থেকে অপসারণ পার্মানেন্ট রেসিডেন্টদের জন্য দুবার সাজার শামিল, এবং অপসারণ একটা নিষ্ঠুর এবং অস্বাভাবিক শাস্তি প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে, এবং সর্বোপরি, খোলা চোখে এটি অভিবাসীদের জন্য একই অপরাধে নাগরিকদের চেয়ে কঠোরতর সাজার বিধান বই কি। তাই মৌলিক বিচার নিশ্চিতকরণের জন্য চার্টারের অন্যান্য অনুচ্ছেদ বিবেচনায় নিয়ে চার্টারের সপ্তম অনুচ্ছেদ ব্যাখ্যা করা দরকার।
যাই হোক, সুখবর এই যে, বর্তমানে ইমিগ্রেশন আপিল বিভাগ অপসারণের শিকার ব্যক্তিকে অনেক ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত পরিত্রাণ দেয়া যায় কিনা বিবেচনা করছে। অভিবাসন আইন অনুযায়ী, ভারসাম্যমূলক বিচারের জন্য ব্যক্তির সকল পারিপাশ্বিকতা বিবেচনায় নেয়া উচিত , সেই সাথে অপরাধের মাত্রাও। ব্যক্তির পরিশোধন আর পুনর্বাসনের সুযোগ আছে কিনা, কানাডায় বসবাসের সময়, পরিবার আর সমাজের সাথে বন্ধন কোন মাত্রার, এবং সাধারণভাবে অপসারণ কিরকম দুর্দশা বয়ে নিয়ে আসতে পারে, সে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবার জন্য আদালতেরই আরেক রায়ে (রিভিক বনাম কানাডা) নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি সামনে চলে আসে, তা হলো, শুধুমাত্র ন্যায়সঙ্গত এবং ভারসাম্যমূলক বিবেচনার নির্দেশনা কি ব্যক্তির অধিকারের পূর্ণ সুরক্ষা দিতে পারে? আইন বিশারদরা মনে করেন, ব্যক্তির অধিকারের কেবল সাংবিধানিক স্বীকৃতিই ব্যক্তির অধিকারের একমাত্র পর্যাপ্ত রক্ষাকবচ হতে পারে। তবেই সিটিজেন এবং পার্মানেন্ট রেসিডেন্টদের মধ্যে আইনের যে তারতম্য, সেটির অবসান হতে পারে চিরতরে।
মনীষ পাল – লেখক ও অভিবাসন উপদেষ্টা, টরন্টো