Home কলাম অভিবাসী মন, অভিবাসী জীবন : মোহসেনি বনাম কানাডা – সত্য গোপন তাই...

অভিবাসী মন, অভিবাসী জীবন : মোহসেনি বনাম কানাডা – সত্য গোপন তাই নাকচ ভিসার আবেদন

মনীষ পাল : বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। ভিসা কর্মকর্তা ২০১৭ সালে এহসান মোহসেনি নামে ইরানের এক ভদ্রলোকের টেম্পোরারি রেসিডেন্ট ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যেই তিনি মন্ট্রিয়েল আসতে ইচ্ছে পোষণ করেন। আবেদনে মোহসেনি ২০১৬ সালে আমেরিকায় একবার ভিসা প্রত্যাখ্যান হবার কথা গোপন করেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, জ্ঞাতসারে তিনি এই ভুল করেননি। আমেরিকার ভিসা প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় তিনি এই ব্যাপারটি উল্লেখ করতে ভুলে যান। ভিসা কর্মকর্তা তার এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেন নি কেননা, সেই কর্মকর্তার মতে, আমেরিকার ভিসা প্রত্যাখানের ব্যাপারটি কানাডায় মোহসেনির ভিসা আবেদনের মাত্র কয়েক মাস আগের ঘটনা, তাই এই ব্যাপারটি ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক বই কি। অভিবাসন আইনের প্রাসঙ্গিক ধারা উল্লেখ করে ভিসা কর্মকর্তা মোহসেনির ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, মোহসেনি তার আবেদন ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং আবেদনে এমন কিছু সত্য গোপন করেছেন যেটির কারণে অভিবাসন আইনের প্রয়োগে ভিসা কর্মকর্তার সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল হবার আশংকা থেকে যায়। মিথ্যা উপস্থাপনা বা মিসরেপ্রেজেন্টেশন আইনের চোখে মারাত্মক একটি অপরাধ। তাই আইন অনুসারে পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি কানাডায় ঢুকতে পারেন না।

অন্যদিকে মোহসেনি যুক্তি দেখান, এই ভুল, যেটি জ্ঞাতসারে করা হয়নি, যুক্তিসঙ্গত আর তাই সেটি অভিবাসন আইনের আওতায় পড়তে পারে না। তিনি আরো বলেন, তিনি ‘সেনজেন’ এর ভিসা প্রত্যাখানের কথা আবেদনে এড়িয়ে তো যাননি, বরং পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করেছেন, তাই আমেরিকার ভিসা প্রত্যাখানের ব্যাপারটি ইচ্ছেকৃত এড়িয়ে যাবার কোনো কারণ থাকতে পারে না। তিনি যুক্তি দেন, আমেরিকার বিষয়টি আবেদনে এড়িয়ে যাওয়া কানাডার ভিসার সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে পারে না, কেননা ভিসা কর্মকর্তা জানতেন, কোনো ঝামেলা ছাড়াই ইতিমধ্যেই তার স্টাডি পারমিট নবায়ন হয়ে যায়।

এই মামলার বাস্তবতা মোটেও জটিল নয়, কোনো পক্ষই তথ্যের বাস্তবতা নিয়ে চ্যালেঞ্জ জানায়নি। মোহসেনি প্রথম কানাডায় আসেন ২০১৩ সালে, ডক্টরেট করবার উদ্দেশ্যে মন্ট্রিয়েল এর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৭ সালে তিনি আবেদন করেন টেম্পোরারি রেসিডেন্ট ভিসার জন্য। ভিসার জন্যে তখন কেন আবেদন করতে হলো, সেটি জানা যায়নি, হতে পারে ভিসার মেয়াদ শেষ হবার পথে। তবে সেই আবেদনে তিনি কয়েকটি বিষয় খোলাসা করেন, যেমন ইতোপূর্বে ২০১২ সালে তিনি একবার কানাডায় ভিসার আবেদন করেন, ২০১৬ সালে আরেকবার স্টাডি পারমিট এর জন্যে আবেদন করেন। আরো জানান, তিনি ২০১৫ সালে একবার আমেরিকায় ভ্রমণ করেন। শুধু তাই নয়, ইউরোপের ‘সেনজেন’ দেশগুলো ভ্রমণের জন্য একবার তার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। তবে এই মামলায় যে বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান, সেটি হচ্ছে ২০১৬ সালে আমেরিকায় তার ভিসা প্রত্যাখ্যান। সেবার একটা বার্ষিক সম্মেলনে তিনি আমন্ত্রিত হন। সম্মেলনে নিবন্ধ পাঠের জন্যে তিনি ভিসার আবেদন করেন কিন্তু সম্মেলন শুরুর চার দিন আগেও ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় তিনি সম্মেলনে যোগদানের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। অবশেষে সেই সিদ্ধান্ত পান, সম্মেলন শেষের অনেক পর, ২০১৭ সালের এপ্রিলে তাকে পরপর দুটো ইমেইলে জানানো হয়, তিনি আমেরিকায় ভ্রমণ ভিসার জন্য উপযুক্ত নন। কানাডার ফেডারেল আদালতের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনায় এই বাস্তব তথ্যগুলো কোনো পক্ষই অস্বীকার করেনি।

ভিসা কর্মকর্তা তার নথিতে লিখেন, আবেদনকারী আমেরিকার ভিসা প্রত্যাখানের তথ্য গোপন করেন। তথ্য গোপনের বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে চাইলে আবেদনকারীকে আরো সময় দেয়া হয়। ভিসা কর্মকর্তার মতে ,ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত আবেদনকারীর বিপক্ষে সিদ্ধান্ত দেন তিনি। সিদ্ধান্তে বলা হয়, প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে তথ্য গোপনের দায়ে আবেদনকারী কানাডায় প্রবেশে যোগ্যতা রাখেন না। তাছাড়া, তথ্য গোপন বা মিথ্যা কথনের জন্য অভিবাসন আইনের আলোকে ভিসা কর্মকর্তার সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যাহত হয় ও অভিবাসন আইনের লঙ্ঘনের কারণে তাই আবেদনকারীর টেম্পোরারি রেসিডেন্ট ভিসার অনুমোদন দেয়া হয়নি। এটি একটি গুরুতর অপরাধ, তাই তার পক্ষে পাঁচ বছরের জন্য কানাডায় প্রবেশ সম্ভব নয়।

প্রতীকী ছবি : সত্য গোপনের দায়ে কানাডায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা

যাই হোক, এই মামলা ফেডারেল আদালতে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার জন্য গ্রহণ করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই, এই মামলার ক্ষেত্রে পর্যালোচনার মানদন্ড নিয়ে কোনো পক্ষই বিতর্কে জড়ায়নি। আইনি মানদন্ডে যুক্তিসঙ্গত ভাবে পক্ষগুলো তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। আবেদনকারীকে প্রমান করতে হয়, যে, ভিসা কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত ন্যায়মূলক নয়, সেই সাথে সিদ্ধান্তে রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব এবং সিদ্ধান্ত অবোধ্য অথবা, তথ্য এবং আইন দিয়েও এই সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।

আবেদনকারীর যুক্তি ছিল, আমেরিকার ভিসা নাকচের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া একটি সরল ভুল, তাও জেনেশুনে এই ভুল করা হয়নি। তার মতে, এই একটি সৎ ভুলের কারণে ভিসা কর্মকর্তার নেতিবাচক সিদ্ধান্ত কোনোমতেই যুক্তিসংগত নয়। আবেদনকারী যুক্তি দেখিয়ে বলেন, যে মুহূর্তে তিনি সম্মেলন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন, সেই সময় থেকেই তিনি আমেরিকার ভিসা প্রক্রিয়ার বিষয়টি আর অনুসরণ করেন নি। তিনি বলেন, কাজের চাপে তিনি খুব ব্যস্ত ছিলেন। তিনি যুক্তি দেখান, আমেরিকার ভিসা প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা আর তার নিজের ব্যস্ততায় তিনি আমেরিকার ভিসা প্রত্যাখানের বিষয়টি উল্লেখ করতে বেমালুম ভুলে যান।

তিনি আদালতের পুরনো এক মামলার রায় তুলে ধরে বলেন, একটা সরল ভুল অথবা ভুল বোঝাবুঝি অভিবাসন আইনের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না ও তিনি বলেন, তার এই ভুলের কারণ সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ইউরোপের সেনজেন এর ভিসার ব্যাপারটি তিনি লুকোননি, তাই আমেরিকার ভিসার ব্যাপারটি ভুলবশত অনুল্লেখিত থেকে যায়।
তিনি আরো বলেন, পাঁচ বছরের জন্য যদি তাকে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, তবে এর জেরে তার উচ্চতর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, পরবর্তীতে তার ওয়ার্ক পারমিট এবং তারও পরে পার্মানেন্ট রেসিডেন্স বা স্থায়ী আবাসের আবেদন করা থেকেও তাকে বঞ্চিত করা হবে।
কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, আবেদনকারী কেবল ভিসা কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন কিন্তু তার সপক্ষে কোনো যুক্তি তুলে ধরতে পারেন নি। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক বলে দাবি করেন আবেদনকারী কিন্তু সেই দাবির পক্ষে একটিও যুক্তি বা প্রমান তুলে ধরতে পারেননি। সরকারের আইনজীবী যুক্তি তুলে ধরেন, সত্য গোপন বা মিথ্যা কথন স্বেচ্ছাকৃত বা অবহেলার ভুল, আইনে সেটি নিরুপনের দরকার পড়ে না। বাস্তবতা হচ্ছে, আবেদনকারী ভিসার আবেদনে সত্য গোপন করেছেন আর তাই যুক্তিসঙ্গতভাবেই এই উপসংহার টানা যায়, আমেরিকার ভিসা প্রত্যাখানের বিষয়টি জানাতে আবেদনকারীর ব্যর্থতা অভিবাসন আইনের প্রয়োগে ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে প্ররোচনা দিতে পারে।

ফেডারেল আদালতের বিচারক সরকারের যুক্তি মেনে নেন। আবেদনকারীর পার্শবর্তী দেশে ভিসা প্রত্যাখ্যান হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা গুরুত্ব বহন করে কারণ কানাডার ভিসা কর্মকর্তা তদন্ত করতে চাইতে পারেন, কেন আমেরিকার ভিসার অনুমোদন দেয়া হয়নি। কিন্তু আবেদনে এই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ায় কানাডার ভিসা কর্মকর্তার প্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়। আবেদনকারী ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আমেরিকার টেক্সাস ভ্রমণের জন্য অনুমোদিত ভিসার কথা উল্লেখ করতে ভুলে যান নি কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মাথায় ক্যালিফর্নিয়া ভ্রমণের জন্য ভিসার যখন অনুমতি মেলেনি, সেটি স্বচ্ছন্দে ভুলে বসে আছেন।
বিচারকের মতে, আমেরিকার ভিসা না মেলার বিষয়টি কানাডার ভিসার সিদ্ধান্তের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক এবং তাই আবেদনে এটির উল্লেখ না থাকা সত্য গোপনের শামিল। আর সত্য গোপনের কারণে অভিবাসন আইনের আলোকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এই ক্ষেত্রে ব্যাহত হয়।
তাই পক্ষে বিপক্ষের বক্তব্য শেষে বিচারক রায় দেন, আবেদনকারী তার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তিসংগত কোনো উপস্থাপনা করেননি আর তাই তার আবেদনের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা এখানে খারিজ করে দেয়া হয়।

মনীষ পাল – লেখক ও অভিবাসন উপদেষ্টা, টরন্টো

Exit mobile version