Home কলাম অভিবাসী মন, অভিবাসী জীবন : মাভি বনাম কানাডা : যে রায়ে স্পন্সর...

অভিবাসী মন, অভিবাসী জীবন : মাভি বনাম কানাডা : যে রায়ে স্পন্সর এর দায়মুক্তি মেলেনি

মনীষ পাল : ১৯৭৮ সালে কানাডায় প্রথম পারিবারিক অভিবাসন শুরু হয়। কানাডায় অনেকেই প্রথমে আসেন একা। কেউ আসেন পড়াশোনা করতে, কেউ বা কাজ। সময়ের পরিক্রমায় তারা আইনি পথে স্থায়ীভাবে থাকবার সুযোগ পেয়ে যান। তারপর একটু থিতু হলে চেষ্টা করেন তাদের পরিবার পরিজনকে নিয়ে আসবার জন্যে। কিন্তু পরিবার নিয়ে আসলেই যে সুখ দানা বাঁধবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কথায় আছে, সব সুখী পরিবারের ধরণ একই, কিন্তু প্রতিটি অসুখী পরিবার একে অন্যের থেকে আলাদা। শিরোনামের এই মামলাটির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এখানে আটজনের মধ্যে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পাচঁজনের সংসারে নেমে আসে অশান্তি, দ্ব›দ্ব বিবাদে ভেঙে যায় সংসার। ষষ্ঠজন তার মাকে নিয়ে আসেন, কিন্তু চাকুরী হারিয়ে তার নিজের আয়ের পথটাই বন্ধ হয়ে যায়। সপ্তম জন, এক কেস ওয়ার্কার এর পরামর্শে, অসুস্থ মার সেবা করবার জন্য সরকারের কাছে বিশেষ স্বাস্থ্য সুবিধা নেন। আর অষ্টমজন তার বাবাকে নিয়ে আসেন, বাবার সাথে শেষ পর্যন্ত বনিবনা হয় না, বাবা তাকে ছেড়ে সরকারের আর্থিক সহায়তার আবেদন করে। দেনার দায় এসে পড়ে ছেলের উপর। আটজনের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এই রায় নির্ধারণ করে দেয়, জীবনের প্রতিক‚ল সময়ে দেনা পরিশোধের দায় কার।

এই আটজনের প্রত্যেকের পরিবার কোনো না কোনো অজুহাতে তাদের ছেড়ে যায় আর এদিকে ছেড়ে যাওয়া স্বজনরা নিজেদের ভরণপোষণের জন্যে সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন করে বসে। আর সরকারও কালবিলম্ব না করে অভাবী আত্মীয়দের আবেদনে সাড়া দিয়ে কল্যাণ ভাতার ব্যবস্থা করে। ঘটনা এখানেই শেষ হলে ভালো হতো কিন্তু তা হবার নয়। অন্টারিও সরকার কল্যাণ ভাতার বিপরীতে এই আটজনের উপর সমপরিমাণ ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়। সরকারের মতে, এই আটজন যখন তাদের নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের জন্য অভিবাসন আবেদন করেন, তখন সরকারের সাথে তারা একটা অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেন যা সরকারের সাথে চুক্তি বৈকি। পরিবারের সম্পর্কের ধরণ অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদের জন্যে সরকারের সাথে চুক্তি হয়। যেমন, কারো যদি স্ত্রী বা স্বামীকে আনবার জন্যে স্পন্সর করা হয়, তাহলে সেই চুক্তির মেয়াদ হতে পারে ন্যূনতম তিন বছর, যদিও দুদশকেরও আগের এই ঘটনায় দশ বছরের অঙ্গীকার এর নিয়ম ছিল। বাবা মায়ের ক্ষেত্রে সেটি বিশ বছর, অর্থাৎ বাবা বা মাকে যদি পারিবারিক অভিবাসনের আওতায় নিয়ে আসা হয়, তবে তাদের ভরণপোষণের জন্য আমন্ত্রণকারী ব্যক্তি অন্তত বিশ বছরের জন্য দায়বদ্ধ থাকবেন।
এখন এই মামলার ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তাতে সরকারের চাপিয়ে দেয়া ঋণ ব্যক্তিবিশেষে বিভিন্ন মাত্রার হলেও পরিমাণে বেশ বড়ো। এদের কারো ঋণ দশহাজার, আবার কারো ক্ষেত্রে তা চুরান্নব্বই হাজার। এই বড়ো অংকের দেনার দায় অস্বীকার করে তারা অন্টারিও সুপিরিয়র আদালতে মামলা করেন। তারা দাবি করেন, অভিবাসন এবং শরণার্থী সুরক্ষা আইনে স্পন্সর এর অঙ্গীকারের শর্ত পালন বাধ্যতামূলক নয়, বরং ঋণ আদায় বা মউকুফে সরকারের ইচ্ছা বা বিবেচনার সুযোগ আছে। কিন্তু বিচারক যুক্তি তুলে ধরেন, পারিবারিক অভিবাসনের আওতায় স্পন্সর এর আবেদন একটি চুক্তি আর তাই প্রতিটি আবেদনের ক্ষেত্রে এখানে সরকারের ইচ্ছে বা বিবেচনার আলাদা করে কোনো সুযোগ নেই।

বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা আবার উচ্চ আদালতে আপিল আবেদন করেন। তাদের আবেদনে উচ্চ আদালত বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত কিছুটা বদল করেন। রায়ে বলা হয়, এই মামলার ক্ষেত্রে সরকারের কিছুটা বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। সরকার চাইলে অভিবাসন আইনের প্রয়োগে কিছুটা নমনীয়তা দেখতে পারে অর্থাৎ সরকার চাইলে এদের ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়িয়ে দিতে পারে, এমনকি চাইলে একেবারে মওকুফও করে দিতে পারে।

রায়ে বিচারকরা আরো বলেন, স্পন্সর এর প্রতি সরকারের প্রসিডিউরাল ফেয়ারনেস বা পদ্ধতিগতভাবে ন্যায় আচরণের কর্তব্য রয়েছে, যেখানে এমন একটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত, সরকার স্পন্সর এর কথা শুনে, তাদের দুরবস্থার বিষয়টি বিবেচনা করে তবেই একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছুবে।

প্রতীকী ছবি : জীবনসঙ্গীর অভিবাসনের আবেদন

শেষ পর্যন্ত এই মামলা কানাডার সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছায়। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়, স্পন্সর এর প্রতি সরকারের কর্তব্য আছে বৈ কি কিন্তু ঋণ অবশ্যই পরিশোধযোগ্য, আগে অথবা পরে। ফেডারেল বা প্রভিন্সিয়াল এটর্নি জেনারেলরা পারিবারিক অভিবাসনে চুক্তির কথা বলে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, এই ঋণ আদায়ের বিষয়ে সরকারের কোনো পদ্ধতিগত কর্তব্যের প্রশ্ন উঠে না কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মতভাবে তাদের যুক্তি নাকচ করে দেন। স্পন্সররা যুক্তি দেন, সরকারের ঋণ আদায় কার্যকর করবার আগে পরিস্থিতি বিবেচনায় নেয়া উচিত কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তাদের সেই যুক্তি বাতিল করে দেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আরো বিস্তারিত প্রক্রিয়া অনুসরণের প্রয়োজন নেই, ঋণ মওকুফে সরকারের সামর্থ দেখানোরও সুযোগ নেই।

এই মামলায় একটি দিক পরিষ্কারভাবে উঠে আসে – স্পন্সর এর কারণে না হলে তাদের পরিবার পরিজনের এদেশে আসবার কোনো সুযোগ নেই আর তাই সরকারের সাথে অঙ্গীকারনামার কারণে পরিবারের সদস্যদের যাবতীয় দায়দেনা পরিশোধের দায়িত্ব স্পন্সর এর উপরই বর্তায়, তারা তাদের সদস্যদের সরকারি তহবিল গ্রহণের ব্যাপারটা জানুক বা না জানুক। তবে এই রায়ে সবাই খুশি, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। সমালোচকরা বলেন, সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি ন্যায় বিচার নিশ্চিত করেনি। সুপ্রিম কোর্টের নিজেদের পর্যবেক্ষণেও এই বিষয়টি উঠে আসে। তারা মনে করেন, এই রায় ভাঙ্গনোন্মুখ সম্পর্ক আবার জুড়ে দিতে খুব একটা কাজে আসবে না, তাছাড়া সহায়হীন স্পন্সর এর আইনের আওতায় ঋণ পরিশোধে বাধ্য করে কানাডার সমাজকে এগিয়ে নিতেও এই রায় কোনো ভূমিকা রাখবে না। ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে স্পন্সর হয়ে যেতে পারে ঋণ খেলাপি আর একজন ঋণ খেলাপি কখনোই সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে না। তাছাড়া, কঠোর নিয়মের কারণে স্পন্সররা ভবিষ্যতে তাদের পরিবার পরিজনকে নিয়ে আসতে নিরুৎসাহিত হবে আর তাতে কানাডার পরিবার পুনরেকত্রীকরণের যে নীতি, সেটি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যদিও এই রায়ের কারণে অভিবাসন ব্যবস্থার অপব্যবহার কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব, তবু সমালোচকরা মনে করেন, এই রায়ের অন্যতম নেতিবাচক দিক, স্পন্সররা যাদেরকে নিয়ে আসেন, তারা স্পন্সর এর উপর অন্যায় সুযোগ নিতে পারেন, যেহেতু তারা জানেন, ঋণের বোঝা স্পন্সরদেরকেই বইতে হবে। এই মামলার প্রতিটি বাদীর অবস্থা পর্যালোচনা করে সমালোচকদের পর্যবেক্ষণ অস্বীকার করবার কোনো জো নেই।

স্পন্সররা যদিও জেনে শুনেই অঙ্গীকারাবদ্ধ হন, কিন্তু কেই বা জানবে, জীবনের গতিপথ কখন কোথায় মোড় নিতে পারে, এরকম কঠোর নিয়মের কারণে স্পন্সররা পড়তে পারেন সীমাহীন দুর্ভোগে, তাই বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, সরকারকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্তের সুযোগ দেয়াটাই সমীচীন অর্থাৎ পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার যাতে ঠিক করতে পারে ঋণগ্রহীতা কিভাবে কখন ঋণ পরিশোধ করবে, আদৌ সামর্থ আছে কিনা, না থাকলে সেটি মওকুফের কোনো সুযোগ দেয়া যায় কিনা। কিন্তু সম্ভবত সংসদে আইনপ্রণেতাদের কাছে এই বিষয়ের সমাধান চাওয়াটাই ভালো, আদালত থেকে নয়।
মনীষ পাল – লেখক ও অভিবাসন উপদেষ্টা, টরন্টো

Exit mobile version