মনীষ পাল : কানাডা প্রতি বছর সারা পৃথিবী থেকে কয়েক লক্ষ শিক্ষার্থীকে সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করবার অনুমতি দিয়ে থাকে।
সরকারের তথ্য মতে, করোনা পরিস্থিতির আগে ২০১৯ সালে চার লাখ নয়শো বিশজনকে কানাডায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। বিশ্বব্যাপী করোনার সময়টিতে ভ্রমণজনিত নিষেধাজ্ঞার কারণে যদিও এ সংখ্যা কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে, কিন্তু গত বছর নিষেধাজ্ঞা শিথিল হতে না হতেই বছর শেষে কানাডায় আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা মহামারীপূর্ব সময়কেও ছাড়িয়ে দাঁড়ায় সাড়ে চার লাখ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, বাংলাদেশ কানাডার উদার শিক্ষানীতির সুযোগ সেভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। গত বছরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, অনুমোদন পাওয়া সাড়ে চার লক্ষ শিক্ষাথীর মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে ছয় হাজারের কিছু বেশি, শতকরা হিসেবে যা দেড় শতাংশেরও কম। তুলনামূলক বিচারে ব্রাজিলের জনসংখ্যা বাংলাদেশের মাত্র এক চতুর্থাংশ, অথচ ২০১৯ সালে ব্রাজিল থেকে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল দশ হাজার, যেখানে বাংলাদেশ থেকে আসা শিক্ষার্থী ছিল অর্ধেকেরও কম। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, কানাডা সরকার শিক্ষা ভ্রমণের আওতায় বিশ্বের ১৪টি দেশকে বিশেষ অনুমোদন দিয়ে রেখেছে। ব্রাজিল সেসব দেশের মধ্যে অন্যতম। বিশেষ অনুমোদনের এই পদ্ধতির নাম স্টুডেন্ট ডিরেক্ট স্ট্রিম, যা সংক্ষেপে এস ডি এস নামে পরিচিত। এ অনুমোদনের আওতায় সেইসব দেশের শিক্ষার্থীরা মাত্র কুড়িদিনের মধ্যে তাদের আবেদনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পেয়ে থাকে। বাংলাদেশ সেই স্কিমের আওতাভুক্ত না হওয়ায় সেখানকার আবেদনকারীরা এই ত্বরান্বিত প্রক্রিয়ার সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে না।
কানাডা স¤প্রতি ক্যারিবীয় এবং দক্ষিণ আমেরিকার সাতটি দেশকে এই বিশেষ স্কিমের আওতায় শিক্ষার্থী প্রেরণের সুযোগ করে দেয়; এই দেশগুলো হলো, এন্টিগা এন্ড বারবুডা, ব্রাজিল, পেরু, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, সেন্ট ভিনসেন্ট এন্ড গ্রেনাডিনস এবং ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো। এগুলো শুরুর সাতটি দেশের সাথে নতুন প্রক্রিয়ার অধীনে যুক্ত হয়। অনুমোদিত দেশগুলোর মধ্যে আগেই অন্তর্ভুক্ত হয় এশিয়ার ভারত, চীন, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন এবং উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা থেকে যথাক্রমে মরক্কো এবং সেনেগাল।
বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তান এর প্রতিবেশী দেশ হওয়া সত্তে¡ও এই ১৪টি দেশের কাতারে সামিল হতে পারেনি । কানাডা সরকারের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, বিগত ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে; ২০১৫ সালে কানাডায় পড়তে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল যেখানে মাত্র ১৩৬৫, গত বছরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬৩৫। ২০২০ সালে মহামারীর কারণে কানাডায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ক্রমবর্ধমান এই হার কিছুটা কমে আসে। সে বছরটি বাদ দিলে দেখা যায়, গত ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে চারশো শতাংশেরও বেশি। কিন্তু এতো সম্ভাবনা সত্তে¡ও শুধুমাত্র পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে ষোলকোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশটির তরুণদের একটি বিরাট অংশ কানাডার উচ্চশিক্ষার সুবিধালাভ করতে পারছে না। এস ডি এস তথা স্টুডেন্ট ডিরেক্ট স্ট্রিমে যেখানে আবেদনকারী শিক্ষার্থীদের মাত্র কুড়িদিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়, সেখানে সাধারণ নিয়মের অধীনে সিদ্ধান্ত পেতে কয়েক সপ্তাহ বা মাস লেগে যেতে পারে। বাংলাদেশ এই কোটার বাইরে থাকায় সেখান থেকে আবেদনকারী শিক্ষার্থীদের এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দোলাচলে পড়ে যাবার ঝুঁকি বরাবর থেকে যায়। অথচ বিশেষ এই ত্বরান্বিত প্রক্রিয়ার নিয়মাবলীর যাবতীয় শর্ত মেনে আবেদন করা বাংলাদেশিদের পক্ষে কোনোভাবেই অসম্ভব কিছু নয়। বিশেষ নিয়মের অধীনে মূল দুটো শর্তের মধ্যে আছে এক বছরের টিউশন ফী এবং আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ হিসেবে দশ হাজার ডলারের গ্যারান্টিড ইনভেস্টমেন্ট সার্টিফিকেট প্রদান। তাছাড়া ইংরেজী ভাষায় দক্ষতা প্রমাণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পরীক্ষার সুযোগ তো দেশে রয়েছেই। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে বাংলাদেশ এখনো এই বিশেষ প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি।
বাংলাদেশ সরকার চাইলে কানাডার সাথে যোগাযোগ করে এই বিষয়ে একটা ফলপ্রসূ আলোচনার সূচনা করতে পারে। শোনা যাচ্ছে, কানাডা এই বিশেষ কোটার অধীনে শিগগির আরো নতুন কিছু দেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। সেই ক্ষেত্রে কালবিলম্ব না করে এই বিষয়ে বাংলাদেশের এখনই যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা সমীচীন।
প্রয়োজন হলে অভিবাসী কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উচ্চ পর্যায়ে উত্থাপনের চেষ্টা করতে পারে। বাংলাদেশ থেকে কানাডায় পড়তে আসা হাজারো শিক্ষার্থীরা কৃতিত্বের সাথে পড়াশোনা শেষ করে এখানকার সরকারি বেসরকারি নানান জায়গায় সাফল্য নিয়ে কাজ করছে।
বাংলাদেশ সরকার উদ্যোগ নিয়ে কানাডা সরকারের সাথে যোগাযোগ করলে এই বিষয়ে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে বলে স্থানীয়রা আশাবাদ ব্যক্ত করছেন। পরবর্তী ধাপে বাংলদেশ যদি এই বিশেষ কোটায় যুক্ত হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশী আবেদনকারীদের উচ্চ শিক্ষার্থে কানাডায় আসা অনেক সহজ হয়ে যাবে, এই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
উল্লেখ্য, পড়াশোনা শেষে কানাডায় কাজের সুযোগ ক্রমে বেড়েই চলেছে। মূলত গিগ ইকোনমির কারণে এসব উন্নত দেশে শ্রম বাজার ভীষণভাবে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। বাইরের দেশ থেকে পড়তে আসা তরুণ তরুণীরাই এই শ্রম বাজারের মূল যোগানদাতা। তাই অন্যান্য উন্নত দেশের মতো এখানেও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সাথে খণ্ডকালীন চাকরীর অনুমতি দেয়া হয়।
এতে কানাডা যেমন একদিকে তার শ্রম স্বল্পতা মেটাতে পারে, আবার অন্যদিকে কাজের সুবাদে শিক্ষার্থীদের আয়ের সুযোগও তৈরী হয়। তাছাড়া, এখানকার অভিবাসন আইন অনুযায়ী, কোনো শিক্ষার্থী সাফল্যের সাথে শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করলে তাকে সর্বোচ্চ তিন বছরের পূর্ণকালীন কাজের অনুমতি দেয়া হয়। তারপর এক বছর কাজের অভিজ্ঞতা শেষে দেশে ফিরতে না চাইলে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদনেরও সুযোগ রয়েছে। স্থায়ীভাবে বসবাসের কয়েক বছরের মাথায় পরবর্তীতে আবারো অভিবাসন আইন মেনেই নাগরিকত্বের আবেদন করা যায়। তাই কানাডায় শিক্ষা গ্রহণের বৃহত্তর সুযোগ সৃষ্টি বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন পূরণে নিশ্চিতভাবে সহায়ক হবে। এখানকার অভিবাসন আইন অনুযায়ী, কোনো শিক্ষার্থী সাফল্যের সাথে শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করলে তাকে সর্বোচ্চ তিন বছরের পূর্ণকালীন কাজের অনুমতি দেয়া হয়।
মনীষ পাল – লেখক ও অভিবাসন উপদেষ্টা, টরন্টো