ফরিদ আহমেদ : হার না মানার অপরিসীম জেদ এবং প্রবল আত্মমর্যাদা থেকে জন্ম হয়েছিলো তাঁর। সে কারণে নিজের নাম রেখেছিলেন অপরাজিতা। বাংলা সাহিত্যে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন অপরাজিতা দেবী। তাঁর স্রষ্টা রাধারানী দত্ত তাঁকে অতি সংগোপনে রেখেছিলেন আড়াল করে। এই আড়ালের দরকার ছিলো অবশ্য। যে চ্যালেঞ্জ তিনি নিয়েছিলেন, সেই চ্যালেঞ্জে জেতার জন্য অপরাজিতা এবং তাঁর সম্পর্ককে গোপন রাখাটা তাঁর জন্য অতি প্রয়োজন ছিলো।

কৈশোর থেকেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন তিনি। তাঁর প্রথম গল্প ‘বিমাতা’ প্রকাশিত হয় ‘মাসিক বসুমতী’তে, ১৯২৪ সালে। প্রথম প্রবন্ধ ‘পুরুষ’। প্রকাশিত হয় ‘কল্লোল’-এ। এর পাঁচ বছর বাদে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লীলাকমল’।

‘লীলাকমল’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কিছু দিন পরেই ঘটনাটা ঘটলো। যেটার কারণে রাধারানীর ভিতর থেকে অপরাজিতা বের হয়ে এলো। স্বর্ণকুমারী দেবীর সানি পার্কের বাড়িতে সান্ধ্য-কালীন আড্ডা চলছিলো। সাথে ছিলো প্রমথ চৌধুরী, ইন্দিরা দেবীও। সেখানেই বেফাঁস এক মন্তব্য করে বসেন প্রমথ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘মেয়েদের কোন নিজস্ব ভাষা নেই, নিজস্ব প্রকাশ নেই, তারা শুধু পুরুষের অনুকরণে লেখে। আজ পর্যন্ত কোনও মেয়ের লেখায় তার স্বকীয়তার ছাপ ফুটে উঠলো না।’

প্রমথ চৌধুরীর এই বক্তব্যকে মানতে পারলেন না রাধারানী। তিনি এর উত্তরে বললেন, ‘শিল্পীর মধ্যে পুরুষ ও নারী উভয় সত্তাই থাকে।’ সেই সঙ্গে মহত পুরুষ শিল্পীর লেখায় যেমন নারীর কথা জীবন্ত হয়ে ওঠে, তেমনই তার বিপরীত ঘটনা কেন ঘটবে না, প্রশ্ন তুললেন রাধারানী। প্রমথবাবুও নাছোড়। শেষমেশ তাঁর মোদ্দা বক্তব্য দাঁড়াল, ‘মেয়েরা কেন এমন লেখা লিখবে না, যে-লেখায় লেখকের নাম না থাকলেও কারুর বুঝে নিতে ভুল হবে না এ লেখা মেয়ের। পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়, ঠিক এমনতর লেখবার।’

প্রমথ চৌধুরীর এই বক্তব্যটাকে মনে মনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন রাধারানী। শুধু এখানেই নয়, এর আগেও এই ধরনের চ্যালেঞ্জ তিনি ছুড়ে দিয়েছেন নারীকে অবমাননা করার কারণে। ১৯২৯ সালে গঠন করা হয় ‘রবিবাসর’। রবীন্দ্র অনুরাগী সাহিত্যিকদের সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ছিলো এটা। ‘রবিবাসর’-এ রাধারানীকে সদস্য করে নেবার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন জলধর সেন। সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেন শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য ছিলো এই আসরে মহিলাদের প্রবেশ ঘটালে পুরুষ সাহিত্যিকদের ‘জিভে লাগাম’ পরাতে হবে। শরত্চন্দ্রের কথা শুনে ফুঁসে উঠেছিলেন রাধারানীও। তাঁর যুক্তি ছিলো সাহিত্য সংস্থায় পুরুষ এবং নারীদের যোগ দেবার সমান অধিকার রয়েছে। তর্কের মীমাংসা না হওয়া সবাই রবীন্দ্রনাথকে সালিশ মেনেছিলো। রবীন্দ্রনাথ শরত্চন্দ্রের পক্ষ নিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ‘না বাপু, আমিও শরতের সঙ্গে একমত। তোমরা ছেলেদের একটুও জিরোতে দেবে না, সব জায়গায় পাহারা দিয়ে হাজির থাকবে, এ হয় না।’

রাধারানীর এমন ফুঁসে ওঠার অভ্যাস সেই ছোটবেলা থেকেই ছিলো। কিশোরী বয়সে বন্ধুদের কেউ ‘মেয়েমানুষ’ বললেই প্রতিবাদ জানাতেন তিনি। বলতেন, “খবরদার, মেয়েমানুষ বলবি না, বলবি মানুষ মেয়ে। আগে মানুষ। পরে মেয়ে।”

মাত্র তেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। বিয়ের মাত্র কয়েক মাসের মাথায় এশিয়াটি ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে তাঁর স্বামী মারা যান। অকাল বৈধব্যের মধ্যে গিয়ে পড়েন তিনি। তাঁর শাশুড়ি ছিলেন উদার মহিলা। তিনি ছেলের বউয়ের আবার বিয়ে দেবার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু রাধারানীর মা সেকেলে মানসিকতার নারী ছিলেন। তিনি রাধারানীকে বৈধব্য মেনে চলার জন্য চাপ দিতে থাকেন। রাধারানী অবশ্য তাঁর বৈধব্যকে চিরকাল মেনে নেননি। কবিতা লেখালেখির সূত্রে তাঁর আলাপ-পরিচয় ছিলো কবি নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে। ১৯৩১ সালে তাঁর বয়স যখন ২৮ বছর, তিনি নরেন্দ্র দেবকে বিয়ে করেন। কন্যা স¤প্রদান করার মতো কেউ ছিলো না বলে নিজেই নিজেকে স¤প্রদান করেন তিনি। এই ঘটনাও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো তখন।

প্রমথ চৌধুরীর চ্যালেঞ্জ নিঃশব্দে গ্রহণের কিছু দিন পরে শিলং এ গেলেন তিনি হাওয়া বদলের জন্য। এখানেই সারি সারি পাইন গাছের মধ্যে জন্ম নিলেন অপরাজিতা দেবী। শুধুই জন্ম নিলো না। দুটো কবিতা লিখে তা পাঠিয়ে দিলো ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায়। কবিতা দুটো প্রকাশের সাথে সাথে সাহিত্য-মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। ১৯৩০ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বুকের বীণা’ বের হয়ে এলো।

অপরাজিতা দেবী নামে এই মহিলা আসলে কে, তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হলো।। এর প্রধান কারণ ছিলো, অপরাজিতার নামে লেখা কবিতাগুলি রূপে, রসে, গন্ধে, প্রকৃতিতে আর পাঁচ জনের চেয়ে একেবারে আলাদা ধরনের ছিলো। কারও সঙ্গে মেলানোই যায় না সেই লেখাকে। অপরাজিতা যে রাধারানীর থেকে জন্ম নিয়েছেন, সেই রাধারানীর লেখার ছাপও তাঁর মধ্যে ছিলো না। একেবারে ভিন্ন এক স্টাইলে লিখতেন অপরাজিতা। রহস্য যাতে আরও দানা বাঁধে, তাঁকে যেনো কেউ রাধারানীর সাথে মিলিয়ে না ফেলে, সে কারণে অপরাজিতা দেবী তাঁরর ‘পুরবাসিনী’ কাব্যগ্রন্থটির উত্সর্গ করলেন নিজের এবং স্বামী নরেন্দ্র দেবের করকমলে।

অনেকেই রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে বললেন যে, ‘এ কবি নিশ্চিত পুরুষ’। রাধারানীও গেলেন কবির কাছে। কবিকে তিনি জানালেন, অপরাজিতা তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। কিন্তু তাঁর এখন আত্মপ্রকাশের উপায় নেই। অপরাজিতা দেবীর কবিতা নিয়ে উচ্ছ¡সিত প্রমথ চৌধুরী কবিতাগুলি সম্পর্কে বললেন, ‘এ’রচনা যারই লেখা হোক, পুরুষের হতে পারে না। এ মেয়ের লেখা নিঃসন্দেহ।’ নারী যে পুরুষের অনুকরণে লেখে না, তাঁর নিজেরও আলাদা স্বকীয় এবং শক্তিশালী ভাষা রয়েছে সেটা প্রমাণের নীরব চ্যালেঞ্জে জিতে গেলেন রাধারানী দত্ত।
অপরাজিতা দেবী তাঁর চারটে কাব্যগ্রন্থের মধ্যে দু’টো উত্সর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। কাব্যগ্রন্থ দু’টো হচ্ছে ‘আঙিনার ফুল’ এবং ‘বিচিত্ররূপিনী’। রবীন্দ্রনাথকে উত্সর্গ করার আগে তিনি রাধারানীর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের অনুমতি চাইলেন। আমাদের মতোই রক্তমাংসের মানুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিজের যে কোনো ধরনের প্রচারেই আহ্লাদিত এবং আনন্দিত হতেন তিনি। কাজেই, এতে যে তিনি সানন্দে অনুমতি দেবেন, সেটাই স্বাভাবিক ছিলো। তিনি চিঠি লিখে অনুমতি দিলেন। সেই চিঠিটা এ’রকমঃ

কল্যাণীয়াসু,
বাংলাদেশে আমাকে গাল দিতে কেউ সঙ্কোচ করেনা আর আমাকে তোমার বই উত্সর্গ করতে এত সঙ্কোচ কেন? খুসি হব তাতে সন্দেহ কোরো না। তোমার লেখা অর্ঘ্য রূপে ব্যবহার করা চলে, তাকে অনাদর করব এতবড় গোঁয়ার আমি নই। বয়স হয়েছে কিন্তু অহঙ্কার জয় করতে পারিনি, আমার প্রতি কোনো ব্যবহারে তোমার যদি শ্রদ্ধা প্রকাশ পায় সেটাতে আমার মন প্রফুল্ল হবে, একথা তুমি ধরে নিতে পারো। সমাদর যতই পাই, তৃপ্তির শেষ হয়না, এর থেকেই বুঝতে পারবে শেষ বয়সে ঋষি তপস্বী হয়ে ওঠবার কোনো আশঙ্কা নেই, কবি জনোচিত অকৃত্রিম দাম্ভিকতা নিয়েই রঙ্গমঞ্চ থেকে প্রস্থান করব। অতএব বইটা উত্সর্গ করতে ভুলো না।

স্নেহাশীর্বাদক
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এমন চাপল্যে ভরা তারল্য সুধায় শিঞ্জিত ফ্লার্টিং করা চিঠি পাবার পরে কোনো মেয়েরই ভুল হবার কথা নয় উত্সর্গ করতে। অপরাজিতা দেবীও ভোলেননি।

বুড়ো কবি যদি তাঁর সাথে খুনসুটি করতে পারেন, তবে তিনি কেনো করতে পারবেন না, এই মনোভাব নিয়ে অপরাজিতাও মজা নেওয়া শুরু করেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে কবি ঠাকুরদা বলে ডাকা শুরু করেন। ছোট ছোট মজাদার চিঠি লেখা শুরু করেন কবিকে। রবীন্দ্রনাথও পালটা জবাব দেন মহা উত্সাহে। রাধারানী দুজনের চিঠির আদান প্রদানের মধ্যবর্তী ব্যক্তি হিসাবে কাজ করেন। একবার রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। পরে আবার সুস্থও হয়ে ওঠেন। অপরাজিতা দেবী রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন,
“দৈনিকী কাগজেতে পড়লাম বার্তা
ছিল কবি দুর্বল, নন তিনি আর তা
দুর্বল নন আর কবি? এ যে অপমান
এ খবরে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে কান।”
এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,
“বে ঠিকানা তব আলাপ শব্দভেদী
দিল এ বিজনে আমার মৌন ছেদী
দাদুর পদবী পেয়েছি, তাহার দায়
কোনো ছুতো করে’ কভুকি ঠেকানো যায়।”

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তিনি কখনোই অপরাজিতার আসল পরিচয় জানতে পারেননি। রাধারানীর প্রিয় বান্ধবী হিসাবেই জেনে এসেছেন। এ কারণে রাধারানী দেবীর কিছুটা অনুশোচনাও ছিলো। তিনি এক পত্রে লেখেন, “আমার আত্ম-অঙ্গীকৃত গোপনতাব্রত উদযাপন কালের আগেই কবি ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। এই সাধনা আমার সার্থক হয়েও, বিষাদে ব্যর্থ হয়ে গেছে, কবির কাছে সমস্ত কাহিনী উন্মোচনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছি বলে।”

রাধারানীর হয়তো অনুশোচনা হয়েছে, তবে আমার কাছে মনে হয়েছে এটাই বরং ভালো হয়েছে এক দিক দিয়ে। একজন তরুণীর সাথে খুনসুটি করছেন, এই পুলক নিয়েই কবি বিদায় নিয়েছেন। অপরাজিতার আসল পরিচয় জানার পরে সেই আনন্দের ঝিলিকটাতো নষ্ট হতোই, সাথে চরম এক বিব্রতকর অবস্থাতেও তিনি পড়তেন হয়তো রাধারানীর সামনে।
রাধারানীকে যাঁরা এখনো চেনেননি, তাঁদের জন্য বলছি, তিনি পদ্মশ্রী পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেনের মা।