আতোয়ার রহমান : বেশ কয়েক বছর পরে বাংলাদেশে একমাস কাটিয়ে জানুয়ারির শেষে টরন্টোতে ফিরে এলাম। বাংলাদেশে স্বল্পসময়ের অবস্থানকালে সেখানকার কিছু সড়ক অবকাঠামোগত ও অন্যন্য আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের ছবি আমাকে মুগ্ধ করেছে। অনেকদিন পর যেন এক অন্য বাংলাদেশ দেখলাম। ভেবেছি কানাডায় ফিরে এসে এ বিষয়ে লিখব।
এর আগে বাংলাদেশের যে আর্থ সামাজিক অবস্থা দেখে এসেছিলাম, এবার তার অনেক পরিবর্তন তথা উন্নয়ন চোখে পড়ল। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা সদর থেকে বেশ দূরে আমার গ্রামের বাড়ি গিরাই গ্রামে যাওয়ার একমাত্র কাঁচা রাস্তাটি পাকা হয়েছে। শুধু এই রাস্তাই নয়, আশপাশের আরো কম গুরুত্বপূর্ণ ও ছোটখাট কাঁচা সড়কগুলোও পাকা হয়েছে দেখলাম। রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের ছয় লেন করার কাজ খুব জোরেশোরে চলছে। এটি সমাপ্ত হলে চার ঘণ্টায় রংপুর থেকে ঢাকায় যাওয়া যাবে আগে যেখানে ছয় থেকে সাত ঘন্টা লাগত। ব্রিজ কালভার্ট উড়াল সড়ক নির্মাণ হচ্ছে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা উন্নয়নের যেন এক মহাযজ্ঞ চলছে দেশে। শহর গ্রামের এসব সড়ক কানাডার সারি সারি নানা প্রজাতির রঙ-বেরঙের গাছগাছালি এবং মাঝে মধ্যে গভীর বনের সমাহারে হরেক প্রজাতির পাখির কু’জনে মুখরিত ছবির মতো সড়ক মনে না হলেও সেগুলো যাত্রী চলাচলে সদাব্যস্ত ও প্রাণচঞ্চল।
মানুষের মধ্যে অভাব পুরোপুরি দূর না হলেও হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। গ্রামের গরিব মানুষ দিনের শেষে শুধু দু’মুঠো শাক ভাত বা ডাল ভাতই নয়, মাছ ভাতও খাচ্ছে এখন। গ্রামের রাস্তাঘাটে বা বাড়ির উঠোনে আগের মতো হাতে বাঁকা এনামেল থালা নিয়ে হাঁটা ভিক্ষুকের সারি চোখে পড়লো না। প্রত্যন্ত এ অঞ্চলের হাট বাজারে আগের চেয়ে অনেক বেশি মাছ ও শাক সব্জির সরবরাহ চোখে পড়ল। জিনিসপত্রের দাম আগের চেয়েও বাড়লেও কৃষক ও খেটে খাওয়া মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। খড়ের ঘরের জায়গায় টিনের ঘর, টিনের বাড়ির স্থানে ইটের পাকা বাড়ি হয়েছে দেখলাম। তবে নতুন নতুন বাড়িঘর তৈরি হওয়ায় ফসলি জমি ক্রমশ কমে যাচ্ছে। অনেক রিকশা ভ্যান চালকের হাতেও চার পাঁচ লাখ টাকা আছে। মানুষের চোখমুখে অনিশ্চয়তা বা আশঙ্কার ছাপ দেখলাম না। সবাই কম বেশি হাশি খুশি। তাদের হাতে কাজ পেটে ভাত আছে।
মানুষের এই হাসির পেছনে রয়েছে গত কয়েক বছর ধরে ধান সহ কৃষি উৎপাদনের ফলন বৃদ্ধি ও কৃষি পন্যের দাম বৃদ্ধি। কৃষকরা ৫০ বছর আগে যে পরিমাণ ধান ফলাতেন, এখন একই জমিতে ফলাতে পারেন তারচেয়ে চারগুণ বেশি ধান। ধান থেকে মাছ মুরগি ও অন্যান্য অনেক কিছুতেই দেশের কৃষি খাতে বিপ্লব এনেছে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার আর সুজলা-সুফলা আমাদের এই ভুমির পরিশ্রমী কৃষক ও চাষি। আমরা এখন দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পাশাপাশি শাকসবজি ও দেশীয় ফলমূলের ব্যাপক উৎপাদন জাতীয় পর্যায়ে দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদা পুরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় পূর্বাভাস দিয়েছিল বাংলাদেশ হচ্ছে একটি ‘তলাবিহিন ঝুড়ি’ তথা ‘গন কেস’Ñ অর্থাৎ বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এ পূর্বাভাসের সমুচিত জবাব হয়ে এসেছে এই চারগুণ ধান উৎপাদন। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে বিস্ময় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। চাল উৎপাদনে বিশ্বে আমাদের অবস্থান এখন তৃতীয়। যদি চাষযোগ্য জমির পরিমাণ পরিমাপক হিসেবে নেওয়া হয় তাহলে আমাদের অবস্থান হবে শীর্ষে। গত ২০-২৫ বছরে আমাদের কৃষিখাতের অর্জন অভাবনীয়।
শুরুতে কৃষি গবেষণা কেবল ধান উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বিজ্ঞান ও গবেষণা ধীরে ধীরে মৎস্য, পোল্ট্রি, দুগ্ধ ও গবাদিপশুর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত এক সূত্র মতে স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ফসল, মাছ ও গবাদিপশুর মোট ১ হাজার ১৬০টি নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
রংপুর দিনাজপুর অঞ্চলে আগে মূলত ধান পাট আলু আর তামাকের চাষ হতো। এখন সেখানে চা ও আমের ব্যাপক উৎপাদন হচ্ছে। আলুর উৎপাদন আগের থেকে অনেক বেড়েছে। এখানকার উৎপাদিত আলু মালয়েশিয়া কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশের শাকসবজি মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে।
দেশের রপ্তানি আয় ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। মোট রপ্তানি আয়ের বেশির ভাগই এখনও তৈরি পোশাক খাত থেকে আসছে। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি হিমায়িত খাদ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল ও প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানিও বেড়েছে। যদিও পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আগের থেকে অনেক হ্রাস পেয়েছে।
মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর, কর্ণফুলী টানেলের মতো মেগা প্রকল্প যখন হাতে নেয়া হয় তখন অনেক নৈরাশ্যবাদী মানুষ এগুলোকে রূপকথার গল্পের মতো বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। রাজধানীতে মেট্রোরেল আর ফ্লাইওভার, কর্ণফুলী নদীর তলা দিয়ে পাকা সুড়ঙ্গপথ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, সারা দেশে বিস্তৃত ইন্টারনেট সংযোগ, অফিসাদালতে উল্লেখযোগ্য ডিজিটালাইজেশন দেশব্যাপী অনলাইন শিক্ষার বিস্তার, দৃষ্টিনন্দন বিমানবন্দর ইত্যাদি অনেক বড় বড় প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে। জাতি দারিদ্রকে জাদুঘরে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখতে সাহস পেয়েছে। দারিদ্র্যের অনেক চিহ্ন বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থার রিপোর্টে বাংলাদেশের অর্থনীতির চমকপ্রদ সাফল্যের পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন যে ধরণের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিক্স এন্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে এই পূর্বাভাস দিয়েছে। ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তির দেশ। ২০৩৫ সাল নাগাদ যেসব অর্থনীতিকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে যাবে তার মধ্যে আছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ডেনমার্ক, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, নরওয়ে, আর্জেন্টিনা, ইসরায়েল, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, নাইজেরিয়া, বেলজিয়াম, সুইডেন, ইরান এবং তাইওয়ান। বর্তমান বিশ্ব সূচকে এই দেশগুলো বাংলাদেশের উপরে, কারণ তাদের অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে বড়।
তাই বলে উন্নয়নের এই মহাজজ্ঞে যে আমরা সবকিছু পেয়ে গেছি বা সব সমস্যার সমাধান হয়েছে-তা কিন্তু নয়। উন্নয়নের সুফল সকলের কাছে সমানভাবে পৌছায় নাই। বাংলাদেশ এখন ধনী হলেও তার আগের সেই রং নেই। মানুষের মধ্যে আগের মতো উদারতা সরলতা নেই। বন্ধুত্ব নেই। সমতা স¤প্রীতি সহাবস্থান নেই। তাই যদি হতো, তাহলে শত শত বাংলাদেশী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধূসর সাহারা মরুভূমি ও ভূমধ্যসাগরের হিমশীতল নীল পানি পাড়ি দিতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ দিতেন না, তারা কফিনে মোড়া স্বপ্ন হয়ে দেশে ফেরত আসতেন না। বিদেশে একটি চাকরির জন্য ঘটিবাটি ভিটামাটি বিক্রি করতেন না। বগুড়ার আলমগীরের মতো উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবক দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাওয়ার বিজ্ঞাপণ দিতেন না।
তবে আমরা খুবই আশাবাদী। কেননা আমাদের আছে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জনের গৌরব। এক নদী রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন করার অহংকার। মুক্তিযুদ্ধে জাতির জেগে ওঠার আর ঐক্যবদ্ধতার আর সাহসিকতার আর ত্যাগের চেতনা বুকে ধারণ করে বাংলাদেশ তার উন্নয়নের মহাসড়কে চলার পথের সকল প্রতিক‚লতা জয় করে কাঙ্খিত সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছবেই, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সমাপ্ত
লেখক : কবি ও গল্পকার।