ভজন সরকার : অনেকের আশঙ্কাই ঠিক হলো। শুক্রবারে ঘটে গেল ধর্মান্ধদের আরেকবার তান্ডব। এবার সেই ঐতিহাসিক নোয়াখালিতে। নোয়াখালি যেন আছে সেই নোয়াখালিতেই। দেশভাগের পরে নোয়াখালি কিলিং হয়েছিল অক্টোবর মাসে। সরকারী হিসেবে সে বছর নিহত হয়েছিল ৫,০০০।

এবার কতজন মরেছে? সরকারী হিসেবে ১জন; সেও নাকি স¤প্রীতির দেশে প্রতিবেশীর নিরাপত্তার আশ্বাস হ্নদযন্ত্র সইতে না পেরে, ভয়ে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে এক চেলাকাঠের আঘাতে। আরো ৩ জনের মৃত্যুর খবর সোসাল মিডিয়াতে ভেসে বেড়াচ্ছে। নোয়াখালির চৌমহনীতে ইসকন মন্দিরে হামলা হয়েছে। ভেসে উঠেছে দুইজন ইসকন সাধুর লাশ;একজনের পাঁচ টুকরা লাশ। লাশ নিয়ে মিছিল করেছে বিক্ষুব্ধ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা।
পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব নাকি ঘটেছে। যদিও বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এগুলো ব্ল্যাক-আউট করেছে। কেন, ব্ল্যাক-আউট করলো? সরকারী নির্দেশে? নাকি, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্যাতন হয় এসব খবর প্রকাশ করলে তথাকথিত ‘সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি’র বাংলাদেশের গল্প ব্যাহত হবে?

আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক ধর্মীয় সংখ্যাগুরুদের সাথে কথা বলেছি। অনেকেই তো বিশ্বাসই করেন না। হয়ত আমিও এসব বিশ্বাস করি নি। আমার মতো অনেকেই বিশ্বাস করেন নি। তাই কবি-পদ্যকারেরা স¤প্রীতির কবিতা-ছড়া লিখছেন। দেশে-বিদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও কুমিল্লাসহ সারাদেশের ভাংচুর-লুটপাট-মৃত্যুকে যেন থোরাই কেয়ার করেছে।
কোথাও দেখেছেন আনন্দের কোন ঘাটতি? সিঁদুর খেলা হয়েছে, ধুপচি নাচ চলেছে, হই-হুল্লুর হয়েছে। কোনো মন্দিরে গিয়ে কোথাও জনস্রোত কম দেখেছেন? নিউইয়র্কে-টরণ্টোতে মন্দিরে মন্দিরে জন-জোয়ার।

কোথাও কাউকে বলতে শুনেছেন, এ অপমান-নির্যাতনের প্রতিবাদে মন্দির বন্ধ করে দিয়ে বলেছেন হবে না অষ্টমী, হবে না নবমী, হবে না বিসর্জন?
বাংলাদেশের সনাতনী হিন্দুদের মূল সমস্যা এখানেই। মেরুদন্ড সোজা করে না দাঁড়ালে প্রতিবেশী বলুন, আইন প্রশাসন বলুন কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। প্যারাসিটামল দিয়ে সব অসুখ সারলে এন্টি-ব্যায়োটিক আবিষ্কৃতই হতো না। শান্তির ললিতবাণী দিয়ে সব কিছু হলে নিরীহ গাধা হতো পশুর রাজা।

নোয়াখালীতে যে ক’জন মারা গেলো, হাজীগঞ্জে যে পরিবারগুলো ধর্ষণের অভিযোগ করেছেন, যাদের দোকানপাট-বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না করে স¤প্রীতির ছড়া-কবিতা লেখা ওই নির্যাতনের শিকাত মানুষকেই অপমানের সামিল নয় কি?

একবার ঘটনার উৎসমূলে ফিরে তাকালেই বোঝা যায় ষড়যন্ত্র অন্য জায়গায়। এর পেছনে ধর্মের সাথে আছে রাজনীতির লোনাজল। কয়েক মাস আগের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তান্ডবের পরে সরকার একটু হার্ড লাইনে। তাই সরকারকে বিপদে ফেলার চক্রান্ত আগেই ছিল। হেফাজত, জামাত-শিবিরসহ ওয়াজি ধর্মান্ধরা সরকারকে বিপদে ফেলতে আরেকটি সুযোগের সন্ধানে ছিল। স¤প্রতি কুমিল্লার পূজামন্ডপে হনুমানের মূর্তির কোলে কোরান রেখে কৌশলে সে সুযোগটি কাজে লাগাল।

গত ২৪ ঘন্টায় কুমিল্লাসহ সারাদেশে কত পূজামন্ডপে হামলা হয়েছে? কত হিন্দুদের বাড়িঘর-দোকানপাট ভাংচুর হয়েছে? কতজন মানুষ মারা গেল? কত পরিবারের নারীরা লাঞ্ছিতা হলেন? সে পরিসংখ্যান কোনদিনই জানা যাবে না। তবে সোস্যাল মিডিয়ায় এ পর্যন্ত যে সংবাদ বেরুচ্ছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং লজ্জার।

একটু স্বাভাবিক বুদ্ধি দিয়ে ভাবলেই বোঝা যায় যে, হনুমানের কোলে কোরান রাখার বিষয়টি খুব পরিকল্পিত। পূজামন্ডপে অন্য ধর্মের গ্রন্থ রাখা মানে হিন্দুদের কাছে মন্দিরের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ করা। হনুমান দুর্গাপূজার সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। দুর্গামন্ডপের আসল বেদীর দুইপাশে অনেক মন্দিরে কিছু মূর্তি থাকে। কুমিল্লার সেই মন্দিরে সে রকমই কিছু মূর্তি ছিল, যার মধ্যে হনুমান মূর্তিও ছিল। হিন্দু ধর্ম মতে সব দেব-দেবীরই বাহন থাকে। হনুমানের বাহন গ্রন্থ নয়। তবে কেন হনুমানের কোলে গ্রন্থ রাখবে কোনো সনাতন ধর্মীয় হিন্দুরা?

সনাতন ধর্মবিশ্বাসী হিন্দুদের পূজামন্ডপে পূজার অধিকার ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য হিন্দুদেরও নেই; সেখানে ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কোরান নিয়ে কোনো হিন্দু যাবে সেটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঘটনাটি আমরা বিশ্বাস না করলেও সংখ্যাগুরু অনেক মুসলমানই বিশ্বাস করেছে। তার প্রমান কুমিল্লাসহ সারা দেশের এই স¤প্রীতি বিনষ্টকারী তান্ডব।

কুমিল্লার পরে সারাদেশের অসংখ্য জায়গায় হিন্দু মন্দিরে হামলা হয়েছে, লুটপাট হয়েছে, নারী নির্যাতন হয়েছে, নিহত হয়েছে এ পর্যন্ত জানামতে ৯ জন মানুষ। এসব সা¤প্রদায?িক হামলা কি চলতেই থাকবে? ১৯৭১, ১৯৯০, ১৯৯২, ২০০১, ২০২১…. আর কতো?
আমরা সবাই জানি প্রতি মাসেই বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়। শুধু একটু বড় ঘটনাই প্রচারে আসে। তাহ’লে কি চলতেই থাকবে এ ধরণের নারকীয় ঘটনা? আমরা কি নির্বাক থাকবো?

আইন ও প্রশাসন দিয়ে সব কিছু হয় না। এক যুগেরও অধিক সময়ে ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লিগের নেতা কর্মীরা হেফাজত-জামাত-শিবিরের এই ষড়যন্ত্র রুখে দিতে পারে। কিন্তু কোথাও ক্ষমতাসীন দলকে প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। এটা যেমন খুব দুঃখের, তেমনি আওয়ামী লিগের জন্য পরোক্ষ হুমকিও বটে। তাই এই ষড়যন্ত্রকারীদের আজকালের মধ্যে খুঁজে বের করা আওয়ামী লিগ সরকারের দায়িত্ব। সা¤প্রদায়িক হামলা এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নির্যাতন করে দেশকে অস্থিতিশীল করার দেশি-বিদেশি চক্রান্ত অব্যাহত থাকলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লিগের জন্যেই তা হিতে বিপরীত হবে।

ষড়যন্ত্রকারীরা যেন বাংলাদেশকে আরেকটা আফগানিস্তান বা পাকিস্তানে পরিণত করতে না পারে, দলমত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এ ব্যাপারের চোখ কান খোলা রেখে সতর্ক থাকা দরকার।

‘৭১-এ ৭ কোটি বাঙালির মাত্র কয়েক শতাংশ ছিল পাকিস্তানীপন্থী রাজাকার-আল-বদর। তখন বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা ছিলেন। তবুও ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছিল। ২ লক্ষ মা-বোন নির্যাতিতা হয়েছিলেন। আর এখন ১৮ কোটি মানুষের কত শতাংশ ধর্মান্ধ? কত শতাংশ রাজাকার-আলবদরের উত্তরসূরী? কোথায় চলেছে বাংলাদেশ?

২১ শতাংশ ধর্মীয় সংখ্যালঘু মাত্র ৫০-৬০ বছরে নেমে এসে এখন মাত্র ৮-৯ শতাংশ। এই সংখ্যা নেমে এসে আরও কমে যাবে যখন, তখন কি নির্যাতন করার মতো কোনো ধর্মীয় স¤প্রদায়কে হাতের কাছে পাওয়া যাবে? এখন যেমন পাকিস্তানে নেই, আফগানিস্তানে নেই। সা¤প্রদায়িকতা, ধর্মীয় স¤প্রীতি, পরমত সহিষ্ণুতা এ শব্দগুলোই তখন অপ্রাসংগিক হয়ে যাবে। কিন্তু তখনও কি নিস্তার আছে? আজও কি নিজ ধর্মের মানুষ দ্বারাই নির্যাতিত হচ্ছে না পাকিস্তানে, আফগানিস্তানে প্রগতিপন্থী মানুষেরা? প্রতি শুক্রবার নিয়ম করে ধর্মীয় স্থানে বোমা হামলা হচ্ছে। গত ক’সপ্তাহ ধরে প্রতি শুক্রবারেই পাকিস্তানে-আফগানিস্তানে অন্তত অর্ধ-শতাধিক মানুষ মরেছে মসজিদে বোমা হামলায়।

আজ প্রতিবেশী সংখ্যালঘু হামলার শিকার হচ্ছে, আগামীকাল সংখ্যাগুরুর দরজায় যে ধর্মান্ধরা হামলা করবে না, তার কি নিশ্চয়তা আছে? তাই এই উগ্রবাদীদেরকে শক্তহাতেই রুখে দিতে হবে। নইলে আজ যাঁরা ধর্মীয় সংখ্যাগুরু বলে নিরাপদে নিশ্চিন্তে আছেন, তাঁদের অবস্থাও খারাপ হবে। ধর্মীয় উগ্রবাদ সর্বগ্রাসী। একে উৎসমূলেই নির্মূল করতে হবে।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)