রাব্বান চৌধুরী : “বহুদিন ধরে, বহু ক্রোশ দূরে, বহু ব্যয় করি ….
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শিষের উপরে, একটি শিশির বিন্দু …”
আমরা অনেকে ইউরোপ-আমেরিকা বেড়াতে যাই, ক্যাল্গেরীর ব্যান্ফ, লাস-ভেগাস, লস-এঞ্জেলেস, কানকুন, পুন্টাকানা – ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমরা যারা জিটিএ-অন্টারিও থাকি তারা কি আমাদের আশেপাশে, ডে-ট্রিপ করা যায় এরকম অতীব সুন্দর সব জায়গায় গিয়েছি? প্রকৃতি এই দেশটাকে তার সমস্ত অর্ঘ, অপরূপ সৌন্দর্য অকৃপণ হাতে ঢেলে দিয়েছে। অন্টারিও এর মধ্যে অন্যতম। যারা এখানে নুতন অথবা এখনো যাদের খুব বেশি ঘুরাঘুরির সময় হয়নি তারা এই জায়গাগুলিতে দিনে-দিনে বেড়িয়ে আসতে পারেন। চাইলে অবশ্যই হোটেল-মোটেল-এয়ার-বিএনবি তে কিছুদিন থাকতেও পারেন। আমি ইতিমধ্যে যে সমস্ত জায়গায় স্বপরিবারে ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে গিয়েছি, ঘুরেছি, উপভোগ করেছি সেগুলির কিছু নিজের হাতে তোলা ছবি ও সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিচ্ছি:
Niagara on the lake: Whirlpool/White Walk : নায়াগ্রা ফলসে কে যায়নি? কিন্তু নায়াগ্রার আশেপাশে চমৎকার সব জায়গা আছে আমরা অনেকে ভুলে যাই অথবা জানিনা। নায়াগ্রা-হোয়াইট-ওয়াক এরকম চমৎকার একটা জায়গা যেখানে নায়াগ্রা রিভারের ভয়ংকর সৌন্দর্য দেখতে পাবেন। প্রতি জন্যে $১৮ টিকেট নিয়ে রাস্তার ধার থেকে এলিভেটরে করে আপনাকে ৩০০ ফুট নিচে নামিয়ে দেবে যেখান থেকে একেবারে নায়াগ্রা রিভারের সাদা-সবুজ পানির ধার ঘেঁষে বোর্ড-ওয়াক/কাঠের ডেকের উপর হাটতে পারবেন।
Hamilton Falls : হ্যামিল্টনের পাহাড়ী এলাকায় দশ/বারোটার মতো ছোট ছোট ফলস আছে। ট্রেইল-হাইকিং করে কয়েকটা লুক-আউট আছে সেখানে যেতে পারেন। পিকনিক ও ঘুরাঘুরি করে একটা চমৎকার দিন কাটাতে পারবেন।
Hamilton/St.Catherine area Cherry Picking : চেরী/ স্ট্রবেরী/ আপেল ইত্যাদি পিকিংয়ের জন্যে চমৎকার জায়গা। জিটিএ-এর পূর্বের ডারহাম রিজিওন থেকে শুরু করে পশ্চিমের নায়াগ্রা ফলস পর্যন্ত সামারে ফ্রুট-পিকিংয়ের জন্যে অনেক অনেক ফার্ম আছে। তবে ওদের ওয়েবসাইটএ খোঁজ নিয়ে পিকিংয়ের সঠিক সময়ে যেতে হয়। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে চমৎকার একটা আউটিং হয়।
Niagara region Winery tour : টরন্টো থেকে নায়াগ্রা যেতে বিশেষ করে সেন্ট-ক্যাথরিন এলাকায় ডানে-বামে অনেক ওয়াইনারি আছে, যেখানে নিজেদের আঙ্গুর ফলন থেকে ওয়াইন-প্রোডাকশন করা হয়। বিভিন্ন জাতের আঙ্গুর বাগানগুলি দেখতে অতীব চমৎকার। ওয়াইন কিনেন-না কিনেন, খান-না খান সেটা অন্য কথা, তবে বিভিন্ন জাতের আঙুরের সারি সারি বাগানগুলি সত্যই দেখার মতো।
Caledon Sunflower Field : মিসিসাগা/ব্র্যাম্পটনের উত্তর দিকে এক ঘন্টারও কম সময়ে এই বিশাল চমৎকার একটা সানফ্লাওয়ার ফার্মে যাওয়া যায়। আমার মনে হয় ওন্টারিওতে এটাই সবচেয়ে বড়ো সানফ্লাওয়ার ফার্ম। ইচ্ছেমত ঘুরে ঘুরে দেখা ও ছবি তোলার জন্য স্বর্গরাজ্য।
Lake Simcoe : টরন্টো থেকে এক ঘন্টার ড্রাইভে চমৎকার সুন্দর লেইক। এই লেইকের চারপাশেই হাজারো কটেজ-লেইকফ্রন্ট প্রপার্টি ও ছোট ছোট অনেক বীচ আছে। এই লেইকের পানি, অন্টারিও লেইকের পানির মতো অত ঠান্ডা না। আমি সাধারণত De La Salle Park এর সাথে লাগানো Georgiana Beach এ যাই। ইস্ট-সাইড থেকে কোনো বীচের পানিতে নামলে আধা-কিলোমিটার পর্যন্ত হাটু-পানি থাকে। নাইস-ক্লিন-সেন্ডি ফিলিং।
Friday Harbour : লেইক সিমকোর পশ্চিম পাড়ে ওরিলিয়া/ইনিসফিলে চমৎকার রিসোর্ট। কটেজ ভাড়া করে দুএকদিন থাকার জন্যে অপূর্ব জায়গা। বোটিং, কায়াকিং ইত্যাদি ওয়াটার-এক্টিভিটিজ করা যায়।
Blue Mountain : লেইক হিউরনের জর্জিয়ান বে-র ধারে চমৎকার স্কি-রিসোর্ট। টরন্টো থেকে দুই ঘন্টার ড্রাইভ। উইন্টার-এক্টিভিটিজ-এর জন্যে আদর্শ জায়গা। বাচ্চাদের যদি স্কিইং, স্কেটিং, স্নো-বোর্ডিং ইত্যাদি করাতে চান তাহলে উইন্টারে যাবেন। সামারেও অনেক ফান-এক্টিভিটিজ আছে। ওখানে Plange নামে একটা ইনডোর-আউটডোর পুল আছে। উইন্টারে ওটাতে অবশ্যই যাবেন। চিন্তা করেন – মাইনাস ১০/১৫ ডিগ্রিতে আউটডোর পুলের চমৎকার গরম পানিতে গোসল করতে কেমন লাগবে।
Wasaga Beach : ব্লু-মাউন্টেইনের কাছেই, ওখান থেকে চল্লিশ মিনিট ড্রাইভে ওয়াসাগা বিচে যাওয়া যায়। লং-সেন্ডি বীচ যেটা টরন্টো-মিসিসাগা, পিকারিং, অশোয়া এলাকার ছোট ছোট বিচের চেয়ে বড়ো-দীর্ঘ-সেন্ডি বীচ। খুবই পপুলার একটা বীচ।
Maskoka Cottage Country : মাস্কোকা পশ্চিমে জর্জিয়ান বে’ থেকে পূর্বে আলগনকুইন প্রভিন্সিয়াল পার্ক পর্যন্ত বিস্তৃত, টরন্টো থেকে দুই ঘন্টার ড্রাইভে, অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এখানে ১৬০০ লেইক আছে। পিকনিক করা, কটেজ ভাড়া করে থাকা, বীচ-বোটিং-কায়াকিং-ক্যানুইং-হাইকিং-কেম্পিং ইত্যাদির জন্যে আদর্শ জায়গা। হান্টসভিল, ভিক্টরিয়া হারবার, ব্চেীন, ব্রেইসবার্গ – মাস্ককার ইত্যাদি জায়গায় কটেজ ভাড়া করে আমি বিভিন্ন সময়ে থেকেছি এবং চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশে, শহরের ব্যস্ত ও কঠিন জীবন থেকে কয়েকদিন দূরে থেকে ব্যস্ত জীবনের মাথার জট ছাড়ানো ও স্ট্রেস দূর করার জন্যে আদর্শ জায়গা।
Tobermory (Flowerpot Island) : ব্রুস-পেনিনসুলায় টরন্টো থেকে চার ঘন্টার ড্রাইভে এটা একটা হারবার-টাউন। নাইন্টিন্থ-সেঞ্চুরির লাইট-হাউস আর লেইকের পানির নিচের শিপ-রেক দেখার জন্যে বিখ্যাত। হারবার থেকে বোট নিয়ে ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে ফ্লাওয়ার-পট আইলেন্ডে যাওয়া চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা।
Sauble Beach : টরন্টো থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে তিন ঘন্টার ড্রাইভ – ব্রæস পেনিনসুলায় চমৎকার সেন্ডি-বীচ। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের মতো সূর্যাস্ত দেখার জন্যে খুবই সুন্দর একটা বীচ।
Crow Bridge Conservation Area : পিটারবরোর পূর্বে টরন্টো থেকে দুই ঘন্টার ড্রাইভে চমৎকার একটা জায়গা। পাথুরে নদীতে স্ফটিক-স্বচ্ছ পানির ধারায় চমৎকার প্রাকৃতিক ফোয়ারায় বৌ-বাচ্চা নিয়ে গোসল করতে আদর্শ জায়গা। এই জায়গাটা অচেনা কিন্তু অনেক জনপ্রিয় জায়গার চেয়ে অনেক সুন্দর।
Couberg : টরন্টো থেকে ৪০১-ইস্টে সোয়া-এক ঘন্টার ড্রাইভে আর একটি চমৎকার বীচ। পাশে বড়-সড়ো গ্রূপ-পিকনিকের জন্যেও চমৎকার পার্কও আছে। খুবই জনপ্রিয় ও সামারে প্রচন্ড ভীড় থাকে। পানিতে নামার জন্যে চমৎকার।
Thousand Island : থাউজেন্ড আইল্যান্ডের নাম শুনে নাই এমন কেউ নেই। কানাডার দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে বেড়াতে আসে। টরন্টো থেকে ৪০১-ইস্ট ধরে কিংস্টন ফেলে সাড়ে-তিন ঘন্টার রাস্তা। কানাডা-আমেরিকার মাঝখানে বিস্তৃত সেন্ট লরেন্স নদীতে ছোট-বড়ো মিলিয়ে ১৮০০ দ্বীপ নিয়ে এই থাউজেন্ড-আইল্যান্ড। এখানে মিনি-সাইজের কয়েক বর্গ-ফুটের আইল্যান্ডও আছে। অনেক আইল্যান্ডে বাড়িঘর ও আছে। অনেক আইল্যান্ড শুধু একটা বাড়ি নিয়ে। আপনি ওই বাড়ি কিনবেন মানে পুরা আইল্যান্ডই কিনবেন। এখানে দেখবেন পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট (৩২ ফুট) আন্তর্জাতিক ব্রীজ, যেটা আমেরিকা-কানাডাকে সংযুক্ত করেছে। আপনি এক-ঘন্টা, তিন-ঘন্টা অথবা সারা দিনের ক্রূজ নিতে পারেন যা আপনাকে এই আইল্যান্ডগুলির আশে-পাশে, মাঝখান দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাবে।
Pickering/Ajax/Whitby/Oshawa Beaches : টরন্টো, স্কারবোরো, মিসিসাগার বীচগুলি ছাড়াও ডারহাম-রিজিওনের পিকারিং, এজাক্স, হুইটবী, অশোয়া এলাকায় ও চমৎকার সব পার্কের সাথে ছোট ছোটো বীচ আছে যেগুলিতে একটা সুন্দর বিকেল কাটানোর চমৎকার জায়গা। পানিতে নেমে একটু দাপাদাপি করতে চাইলে এর ভিতর একমাত্র অশোয়া-বীচই উপযুক্ত। পিকনিকের জন্যে প্রত্যেকটা বিচের সাথে চমৎকার ওয়াক-ওয়ে, ট্রেইল ও পার্ক আছে।
Algonquin Provincial Park : টরন্টো থেকে তিন ঘন্টার মতো ড্রাইভ এই ৭৬৫৩ বর্গ কি.মি.-এর সুবিশাল প্রভিন্সিয়াল পার্ক। নদী, লেইক, বন-জঙ্গল ও মুজ, ভাল্লুক অন্যান্য পশু পাখি নিয়ে এটা একটা বিশাল কনজারভেশন এরিয়া। এটার সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ হলো হাইওয়ে-৬০ ধরে এই পার্কের বুক চিড়ে চারিদিকের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এমাথা থেকে ওমাথা ২৬ কিলোমিটার ড্রাইভ করা। ফল-কালার দেখার জন্যে এর চেয়ে সুন্দর জায়গা ওন্টারিওতে আর নেই, কানাডার কথা জানি না। মিড্-সেপ্টেম্বর থেকে মিড্-অক্টবর পর্যন্ত ফল-কালার দেখার সময়। এ-সীজনের পিক টাইম হচ্ছে এই অক্টোবরের প্রথম দুই সপ্তাহ।
এছাড়াও অন্টারিওতে নিশ্চয় আরো অনেক জায়গা আছে যেখানে আপনারা ইতিমধ্যে গিয়েছেন অথবা জানেন। বাংলাদেশের চেয়ে সাতগুন বড়, দেড়-কোটি মানুষের এই অন্টারিও প্রভিন্স সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব সৃষ্টি। এই প্রভিন্স সারা জীবন ঘুরলেও এর সৌন্দর্য দেখে শেষ করা যাবে না। এই প্রভিন্সের গাড়ির লাইসেন্স প্লেইট যেমন বলে – “Yours To Discover”, তেমনি চলুন আমরা আগে নিজের ঘরের সৌন্দর্য আবিস্কার করি, উপভোগ করি – তারপর না হয় ইউরোপ-আমেরিকা যাই।
রাব্বান চৌধুরী : রিয়েল এস্টেট এজেন্ট, আই-প্রো রিয়েলটি
টরন্টো, অন্টারিও, grc.toronto@gmail.com