মণিজিঞ্জির সান্যাল : আমাদের পৃথিবীটা হঠাৎ কেমন বদলে গেল এই দুবছরে। চেনা পরিবেশ, চেনা মানুষ, চেনা বন্ধু, আত্মীয় পরিজন সব এক ঝটকায় কেমন পালটে গেল। বিশেষ করে ছাত্র ছাত্রীদের জীবনের রংটাই ফিকে হয়ে গেল কিভাবে কখন। শিশু থেকে কিশোর, কিশোরী, যুবক যুবতী সম্পূর্ণ ছাত্র সমাজ। জীবনের আসল সময়টাই তাদের মেঘে ঢাকা তারার মতো। সবুজ কেড়ে নিল এই বিষাক্ত করোনা ভাইরাস। বিশেষ করে শিশুদের জীবন হয়ে উঠেছে বড্ড একঘেয়ে, পাশাপাশি ভয়ার্তও।
সারাদিন ঘরে থাকতে থাকতে, স্কুলে না যেতে যেতে তারা কেমন খিটখিটে হয়ে উঠেছে। আসলে এই দুটো বছর বন্ধ সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ সময় স্কুলের বাইরে থাকার কারণেই অনেক শিশুর মধ্যেই অস্বাভাবিক আচরণগত কিছু পরিবর্তন এসেছে। এমন পরিস্থিতি একদিকে যেমন তাদের সঠিক মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অনভ্যস্ত হওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে বেশিরভাগ শিশুদের মধ্যে।
এই অনলাইন ক্লাসের কারণে শিশুদের সবচেয়ে বেশি আসক্তি বেড়েছে মোবাইল এবং ইন্টানেটের প্রতি। সন্তানদের মধ্যে আরো অনেক আচরণগত নানা পরিবর্তন লক্ষ্য করার মতো। আসলে স্কুল বন্ধ থাকায় সারাক্ষণই বাড়িতে থাকছে ছেলে মেয়েরা। তাই সর্বক্ষণের সঙ্গী এই মোবাইল এবং ইন্টারনেট। মনোযোগ হারাচ্ছে স্বাভাবিক জীবন থেকে। অভিভাবকরা একটু অসাবধান হলেই মোবাইল নিয়ে গেমসের নেশায় মত্ত হচ্ছে অনেক বাচ্চাই।
অন্যদিকে আবার এই ছবিও পরিস্কার, যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস পরিচালনায় ব্যর্থ, সেক্ষেত্রে ছাত্র ছাত্রীদের ভবিষ্যত ধ্বংসের মুখেই বলা যেতে পারে। ঘরে থাকতে থাকতে সত্যিই তারা বিরক্ত হয়ে পড়েছে, দ্রুত স্কুলে ফিরতে তারা উদগ্রীব। আবার অনেকের সাথে কথা বলে দেখেছি তারা আবার এই সিস্টেমটার সঙ্গে এমনভাবে নিজেকে মিশিয়ে ফেলেছে যে, বাইরে বেরতেই চাইছে না। তাদের কাছে ঘরে বসে, শুয়ে অনলাইন ক্লাসই আনন্দের। বাইরের জগতের সঙ্গে বাস্তবে যোগাযোগ করার ইচ্ছেটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
কেউ কেউ আবার দিনের শেষে অনুশোচনা করে নিজের কাছে নিজেই। আসলে ফোন নিয়ে বসে থাকতে থাকতে নিজের অজান্তেই মোবাইলে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার, ল্যাপটপ দেখা, গান শোনা। পড়াশোনাটাই কেবল পিছিয়ে যাচ্ছে।
আর শিশুরা বাড়িতে থাকলেও কেমন যেন নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে এসেছে। স্নান, খাওয়া, ঘুম সবকিছুই অনিয়মিত। নিয়মতান্ত্রিক জীবনে আর অভ্যস্ত নয় তারা। অনেক শিশুই প্রচণ্ড জেদ করছে, কারো কারো ইমোশনাল রিঅ্যাকশন হচ্ছে, কান্নাকাটি করছে কেউ কেউ, কেউ হয়তো জেদ করে কোন কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যবহার যত বাড়ছে ততই এই ধরনের মানসিক প্রভাব পড়ছে তার উপর। এই যে আচরণগত পরিবর্তন,শিশুদেরকে মহামারি পরবর্তী জীবনেও তাদের খাপ-খাইয়ে নিতে অসুবিধার সৃষ্টি করবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললেও সেখানে অন্য শিশুদের সাথে খাপ খাওয়ানো এবং ক্লাসে মনোযোগ বজায় রাখা কষ্টকর হবে। টানা একটা রুটিনে থাকতে থাকতে, তারপর যদি আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়, সেখানে কিন্তু তাকে খাপ-খাওয়াতে বেশ বেগ পেতে হবে।
কারণ এই যে একা থাকা, একা মোবাইল বা ল্যাপটপের সামনে বসে পড়াশোনা করা এতেই তারা দিনের পর দিন অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। ফলে পরবর্তীতে স্কুলে পাঠানো খুবই কষ্টকর হয়ে পড়বে।কিছুতেই স্কুলে যেতে চাইবে না, বন্ধুদের সাথে মেলামেশা এবং সামাজিকীকরণেও এক ধরণের সমস্যা তৈরি হতে পারে।
করোনাভাইরাসের কারণে পরবর্তী পরিস্থিতিতে শিশুদের মানসিক এবং সামাজিক উন্নয়ন ও বিকাশে বাবা-মাকেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। একদিকে যেমন তাদের পাশে থাকতে হবে, অন্যদিকে সন্তানরা যাতে পরিবারে থেকেই নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সন্তানদের বিশেষ করে শিশুদের কিছুতেই হতাশ হতে দেওয়া চলবে না, বাবা-মাকে তার পাশে থাকতে হবে। পরিবারের বিকল্প কিন্তু কিছুতেই নেই। আর এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পরিবারের উপরই এসে পড়বে। বাচ্চাদের পাশে, কিশোর-কিশোরীদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের বোঝানো, তাদের ঠিকমতো সময় দেওয়া পরিবারকেই করতে হবে।
স্কুল বন্ধ থাকলেও শিশুদের নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত রাখতে হলে তাদের দৈনন্দিন কাজের একটি রুটিন করে দেওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে, যোগাসন, সামান্য এক্সারসাইজ, খাওয়া দাওয়া, ঘুম, পরিবারের সবার সাথে গল্প আড্ডা, বাবা-মায়ের সাথে বিভিন্ন কাজে অংশ নেওয়া এবং পড়াশুনার জন্যও একটা সময় বেঁধে দিতে হবে।
বয়সে কিছুটা বড় কিশোর কিশোরীদের মধ্যে এই প্রতিক্রিয়া কিছুটা আলাদা। একটু বড়রা পরিবারের অন্যদের সাথে দূরত্ব তৈরি করছে, আইসোলেটেড হয়ে আছে, তারা তাদের ঘরেই বেশি সময় কাটাচ্ছে। স্কুলে একটানা দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানান সমস্যা হচ্ছে।
অনেক ছাত্র ছাত্রীর বাড়িতে সাধারণ মোবাইল। তারা ক্লাস করতে পারছে না। তাদের প্রচুর ক্ষতি হয়ে গেল। এই ক্ষতি পূরণ করার নয়। আমরা শুনেছি অনেকেই জমি বা গরু ইত্যাদি বিক্রি করে একটা ভাল স্মার্ট ফোন কিনেছেন, একমাত্র ছেলে মেয়ের অন লাইন ক্লাসের জন্য। এ যে কতো কষ্টের আর মন খারাপের কথা।
একঘেয়ে ঘরে বসে থাকতে থাকতে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রচুর। তাছাড়াও স্কুল খোলা থাকা মানে সময়ের বিষয়ে সচেতন থাকে ছাত্র ছাত্রীরা। আর স্বাস্থ্যগত দিক? যে বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে মানসিক বিকাশ হয়, এখানে সেই সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। অনেকেরই দিনের পর দিন বসে থাকতে থাকতে শরীরে মেদ জমে যাচ্ছে। স্বাভাবিক হাঁটাচলাতেও আলস্য ঘিরে ধরেছে তাদের। চিকিৎসকেরা আগেই সাবধান করেছিলেন, স্মার্টফোনের আলোয় চোখের ক্ষতি করে। সেই সঙ্গে মানসিক ক্লান্তি আনে। অনলাইন ক্লাসে মোবাইল ব্যবহার করতেই হয়। ফলে চোখের সঙ্গে অন্য সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে ছাত্র ছাত্রীদের।
অনলাইন ক্লাসের জন্য দীর্ঘ সময় মোবাইল হাতে বসে থাকছে পড়ুয়ারা। অনেকেই বিভিন্ন ধরনের হেডফোন ব্যবহার করছে। এর ফলে নানা ধরনের কানের সমস্যার শিকার হচ্ছে খুদেরা। অনলাইন ক্লাস চলাকালীন হেডফোন ব্যবহারের ফলেই ছোটদের কানে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
হেডফোনে ক্লাস করার পর কান ব্যথা করে। মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে।
একটানা হেডফোন কানে থাকার জন্য ছেলে মেয়েদের চাঞ্চল্য দেখা দিচ্ছে। একটুতেই বিরক্তি-সহ নানা ব্যবহারিক পরিবর্তনও ঘটছে।
ছোটরা অনলাইন ক্লাসে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। ছেলে মেয়েদের মধ্যে অদ্ভুত এক অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ব্যবহারে পরিবর্তনের নিদর্শন হল, কেউ কেউ ঘরে ঘনঘন ফ্রিজ খুলে নানা ধরনের খাবার খাচ্ছে। শারীরিক পরিশ্রম কম হয়ে যাওয়ার জন্য মেদও বাড়ছে। কারো মধ্যে আবার উল্টো আচরণ। তাদের ক্ষিধে ও ঘুম কমে গেছে।
কিন্তু এতোকিছুর পরেও বলতেই হয়, বিকল্প ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত, অনলাইন ক্লাস করতেই হবে। না হলে হয়তো পড়াশুনা থেকে পিছিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু এটাও ঠিক সব মিলিয়ে ছেলে মেয়েদের মনে চাপ বাড়ছে। এখন তো টিউশন, নাচ, গান এমনকি ক্যারাটের অনলাইন ক্লাসও শুরু হয়েছে। অনেকটা সময় মোবাইল ব্যবহার করতে হচ্ছে।
এসব কারণে ছেলে মেয়েরা মাঠে যেতে পারছে না। রোদ না লাগায় ভিটামিন তৈরি হচ্ছে না। ভিটামিন-ডি শরীর মন চনমনে রাখতেও সাহায্য করে। অভিভাবকদেরই এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। পড়ার সঙ্গেই ছোটদের ক্লাসিক সিনেমা দেখিয়ে মন ভাল রাখার চেষ্টা করতে হবে। দাবা, ক্যারমের মতো খেলাতেও সঙ্গ দেওয়া যেতে পারে। আসলে এখন সবকিছুই অনলাইন, এই অনলাইনে নাচ, গান শেখানোয় ধীরে ধীরে মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে নব প্রজন্ম।
আসলে আমাদের জীবনকে এক ধাক্কায় অনেকটা বদলে দিয়েছে এই অসুখটি। অনলাইন ক্লাস ব্যাপারটার সঙ্গে আপনার সন্তান এবং আপনি নিজে যত তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিতে পারবেন, ততই মঙ্গল।
অনলাইন আর অফলাইন ক্লাসের কিছু পার্থক্য কিন্তু আছেই। বাচ্চা বা কিশোর-কিশোরীদের সামলানোর মানসিক প্রস্তুতি থাকে শিক্ষক শিক্ষিকাদের মধ্যে। তাদের স্বাভাবিক দুষ্টুমি বা অবাধ্যতার সঙ্গে তাঁরা পরিচিত। কিন্তু বাড়ি থেকে লেখাপড়ার ব্যবস্থা অর্থাৎ এই অনলাইন ক্লাস যেদিন থেকে শুরু হয়েছে অভিভাবকরা বড্ড বেশি কথা বলছেন তাদের ক্লাসে। সেটা সামলাতে শিক্ষক শিক্ষিকাদের অনেক বেশি অসুবিধে হচ্ছে। তাই বাবা, মাকে সতর্ক হতে হবে। বাচ্চা দুর্বল হোক বা অতি স্মার্ট হোক, স্কুলের ক্লাস চলার সময়ে বাবা, মায়ের কোনোরকম হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। প্রথম প্রথম অসুবিধে হলেও তারা খুব দ্রæত মানিয়ে নেবে পরিস্থিতির সঙ্গে। আর ছোটোখাটো কিছু দুষ্টুমিও সে করতে পারে, সেটা শিক্ষক সামলাবেন। সেখানে বাবা বা মায়ের ঢোকার দরকার নেই।
সেই সঙ্গে বাড়িতে বাচ্চাকেও কয়েকটি বিষয় শেখাতে হবে। যেমন, অনলাইন ক্লাস চলার সময়েও স্কুলের ডিসিপ্লিন মানাটাই নিয়ম। ক্লাস শুরুর আগেই তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে, প্রতিদিনের কাজ শেষ করতে হবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। সাধারণত অ্যাটেনডেন্স মার্ক করার আগে শিক্ষক ভিডিয়ো অন করতে বলেন, তাই স্কুলের পোশাক পরে তৈরি হয়ে ক্লাসে বসতে হবে। ক্লাস চলাকালীন ভিডিয়ো এবং অডিয়ো অফ রাখতে বলা হয় — তা না মানলে শিক্ষকের পড়াতে অসুবিধে হয়। সে নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা উচিত। সাধারণত সব শিক্ষকই ছাত্রকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেন, কোনও অসুবিধে থাকলে তখনই জেনে নিতে হবে। বাচ্চা ক্লাসে মন দিচ্ছে কিনা, নোট নিচ্ছে কিনা, সেটা আপনি দেখলেই বুঝবেন। তবে তখনই হামলে পড়ে বকাঝকা করার দরকার নেই। পরে তার সঙ্গে কথা বলুন, বোঝান যে এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। মনে রাখবেন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা বা খুনসুটি সেও খুব মিস করছে — তাই অযথা বকাবকি না করে তাকে সুন্দর করে বোঝাতে হবে। যুক্তি দিয়ে বোঝালে বাচ্চারা সব কথা শোনে।
সন্তান স্কুলের কাজ ঠিকমতো করছে কিনা বা শিক্ষকের দেখিয়ে দেওয়া ভুল শুধরে নিচ্ছে কিনা সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখুন। প্রথমদিকে একটু এদিক ওদিক হতে পারে, কিন্তু এই পরিস্থিতি কবে বদলাবে কেউ জানে না। তাই তাকে সবদিক দিয়েই তৈরি করার দায়িত্ব প্রতিটি বাবা, মায়ের।
যাই হোক পরিশেষে একথাই বলতে চাই, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় তাড়াতাড়ি খুলে যাক। পৃথিবী শান্ত হোক। শিশুরা আবার হাসতে হাসতে এই সবুজের বুকে খেলে বেড়াক। তারা হাসতে হাসতে স্কুলে যাক। কিশোর কিশোরীরা আবার স্বপ্ন দেখা শুরু করুক। যুবক যুবতীরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে গিয়ে নতুন ভবিষ্যতের পথ খুঁজে নিক।
ভাল সময় আসছে। ততদিন পর্যন্ত প্রতিটি সন্তানের বাবা, মায়েরা সন্তানের সবচেয়ে ভাল বন্ধু হয়ে উঠুন। পরিবারটি ভালবাসার বন্ধনে গড়ে উঠুক। শিশুকে সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক রাখার সব দায়িত্ব কিন্তু হাসিমুখে পালন করতে হবে বাবা এবং মা’কেই। তাই আপনাদের বন্ধনও হোক দৃঢ়, মধুর।
মণিজিঞ্জির সান্যাল : কথা সাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত