শুজা রশীদ : (পর্ব ৩৭)
৫৩
রিমা এক রকম চুপি চুপি রিয়েল স্টেট এজেন্ট জাফরকে নিয়ে ঝঅঞঊঈ এর আশেপাশের এলাকাগুলোতে বেশ কিছু বাড়ি দেখল। কিন্তু যতই দেখছে ততই প্রথম বাড়ীটাকেই ভালো মনে হচ্ছে। অবস্থান, মূল্য, বাড়ীর হালহকিকত, বেসমেন্ট এপার্টমেন্ট- সব মিলিয়ে অন্যান্যগুলোর চেয়ে অপেক্ষাকৃত উত্তম। তারপরও একটু দ্বিধাদ্ব›দ্ব করছিল রিমা। বাড়িটাকে দেখলে এতো পুরানো মনে হয়! ও যদি টরন্টো থেকে আরেকটু পূর্বে অবস্থিত যে কোন একটা ছোট শহরে যেতে প্রস্তুত থাকত তাহলে একই দামে তুলনামূলকভাবে বড় আর অপেক্ষাকৃত নতুন বাড়ি পাওয়া যেত। কিন্তু তাতে সমস্যা হল ফায়জার ঝঅঞঊঈ এ যাওয়া হবে না এবং তাকেও অনেক খানি পথ ড্রাইভ করে কাজে যেতে আসতে হবে। ওর পরিচিত মানুষদের কাছ থেকেও দূরে সরে যাবে।
লিয়াকত একরকম ঝট করেই বাসা বদলে বার্চমন্ট রোডের উপরে একটা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে চলে গেছে। সাধারণত এপার্টমেন্ট ছাড়ার আগে মাস দুইয়ের নোটিশ দেয়াটা নিয়ম। মিন্টুর মৃত্যুর পর সে নিশ্চয় বেশ কিছুদিন ধরেই চলে যাবার পরিকল্পনা করছিল। নিশ্চয় আগেই নোটিশ দিয়েছিল। সে চলে যাওয়ায় রিমার একটু সমস্যাই হয়েছে। লিয়াকত এবং তার পরিবার কাছাকাছি যখন ছিল ও মনে একটু জোর পেত। জানত প্রয়োজনে তাদের সাহায্য সহযোগীতা পাওয়া যাবে। লিয়াকত অবশ্য নিজের বাসা পাল্টানোর ব্যাপারটাকে একেবারেই গুরুত্বের সাথে নেয়নি। সে তো আর অনেক দূরে চলে যায়নি। মাত্রতো মিনিট কয়েকের ড্রাইভ। যে কোন দরকার হলে রিমা যেন তাকে জানাতে বিন্দু মাত্র দ্বিধা না করে। কিন্তু রিমা বুঝেছে লিয়াকতের স্ত্রী চায় না সে রিমার সাথে খুব বেশি জড়িয়ে পড়ুক। পিন্টুর সাথে কোন ঝামেলায় যাওয়াটা তাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
সেই যে ওদের এপার্টমেন্টে এসেছিল নোমান তারপর সে আর রিমার সাথে কোন যোগাযোগ করেনি। রিমা খানিকটা আশা করেছিল নোমান ফোন দেবে। সেই সন্ধ্যাটা খুব ভালো কেটেছিল ওর। ধানমন্ডিতে থাকতে ফায়জাকে নিয়ে ওদের দুজনার যেমন চমত্কার সময় কাটত খানিকটা সেই রকম। হঠাত এতো চুপ করে যাবার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে বুঝতে পারে না রিমা। বাচ্চারা তাকে প্রথম পরিচয়েই পছন্দ করেছে। নোমান চাইলে তাদের জীবনে তার উপস্থিতি সবারই কাম্য হবে। হয়ত সামাজিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করছে। টরন্টোতে বাংলাদেশী কমিউনিটি এখন বিশাল বড় হলেও রিমার পরিচিতি সর্বত্র। মিন্টুর মৃত্যু নিয়ে প্রচুর প্রচারণা হওয়াতেই তেমনটি হয়েছে। যে কারণে তার কাছাকাছি যেই আসুক সেও অচিরেই পরিচিতি পেয়ে যাবে। হয়ত নোমান সেটা চায় না। ও নিজে তার সাথে যোগাযোগ করলে কি অসুবিধা? অনেক ভেবেছে এবং প্রতিবারেই মনে হয়েছে অসুবিধার কিছু নেই। কিন্তু তারপরও কি এক দ্বিধাবোধ ওকে বাঁধা দিয়েছে। প্রতিবারই যখন যোগাযোগ করবে বলে মনস্থির করেছে নানা অজুহাতে আরোও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হয়ত নোমানই করবে। কিন্তু সে করেনি। ফায়জা বেশ কয়েকবার নোমানের কথা জিজ্ঞেস করেছে। কি উত্তর দেবে রিমা? ফায়জা হয়ত কিছু একটা ধারনা করে নিয়েছে কারণ ইদানীং সে আর নোমানকে নিয়ে কোন প্রশ্ন করে না।
মিলা ডাক্তারের প্রেমে এতোই মশগুল যে পৃথিবীর আর কোন কিছুতেই তার কোন মনযোগ নেই। তার সাথে আলাপ করতে গেলেই সে তার প্রেমিক প্রবরের প্রশংসায় এতো মত্ত হয়ে ওঠে যে মনে হয় তার চেয়ে উত্তম কোন পুরুষ হতে পারে না। প্যারিসে বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা খুব তোড়জোরে চলছে। মিলার আর তর সইছে না। বান্ধবীর উচ্ছ¡াস এবং আনন্দ দেখে মনে মনে খুব আনন্দিত হলেও রিমা নিজে একটু একাকী হয়ে পড়েছে। তার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সে, তার একটু সাহায্য সহযোগীতার দরকার ছিল, ঘনিষ্ট কারো সাথে আলাপ করার প্রয়োজন ছিল। মিলা যদি তাকে একটু সময় দিত, তার পাশে এসে দাঁড়াত এই সময়টাতে তাহলে মানসিকভাবে আরেকটু জোর পেত রিমা।
একটা আনন্দের বিষয় হল ওর মায়ের সাথে ওর ঝামেলাটা মিটে গেছে অভাবনীয়ভাবে। শুধু যে তাদের দুজনার আবার মিল মহব্বত হয়ে গেছে তাই নয়, বাসা ছাড়ার আগে তাদের দুজনার মধ্যে যে হৃদয়ের যোগাযোগ ছিল সেটা যেন আবার স্থাপিত হয়ে গেছে। রিমা কয়েক দিন পরপরই মাকে ফোন দেয়, বাচ্চাদেরকে নানীর সাথে আলাপ করতে লাগিয়ে দেয় যদিও ওর মা ইংরেজিতে একেবারেই কথা বলতে পারে না। বাচ্চারাই তার শিক্ষক হয়েছে। ভালোই যাচ্ছে। ছেলে দুইজন কিছু কিছু বাংলাও শিখছে। এমনিতে একেবারেই বাংলা বলতে চায় না। ফায়জা ভালো বাংলা জানায় তার সাথেই নানীর আলাপ হয় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ওর বাবার সাথে দূরত্বের কোন পরিবর্তন হয়নি। রিমা তার কথা জিজ্ঞেস করা থেকে বিরত থাকে, তিনিও নিজের থেকে ওর সাথে কথা বলার কোন আগ্রহ দেখাননি। মায়ের কাছ থেকে অবশ্য সব খবর পায় রিমা। জয়নাবের ব্লাড প্রেশার ইদানীং অনেক হাই থাকে, কোলেস্টেরলও বেশ বেড়েছে। খুব দেখে শুনে হিসাব করে খেতে হয়। প্রায় কিছুই নাকি খান না। যে কারণে ইদানীং বেশ ওজন কমে গেছে। যারা তাকে অনেকদিন দেখেনি তারা তাকে হঠাত দেখলে হয়ত চিনতেই পারবে না। রাফিয়া ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে রিমাকে তার বাবার ছবি দেখাতে চেয়েছেন কিন্তু রিমা খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। জনাব মহারথী যদি খুব রাগ দেখাতে পারেন তাহলে সে নিজেই বা কম যাবে কেন? তিনি চেয়েছিলেন রিমা নিজের পথ নিজেই দেখে নিক, তাকেও দেখিয়ে ছাড়বে। তারপর, যদি ওর ইচ্ছা হয়, তাহলে হয়ত বাবার ইদানিংকার একটা ছবি সে দেখবে এবং হয়ত আলাপও করতে চাইবে। তিনি যদি আলাপ করতে না চান তাতেও কোন সমস্যা নেই। রিমার সাথে যে ধরনের ব্যবহার তিনি করেছেন সেটা যদি তার কাছে মনে হয় যথপযুক্ত তাহলে সেই অনুভূতি নিয়েই পরপারে পাড়ি জমাতে হবে তাকে। গর্দভ!
পিন্টু এবং তার পরিবারের সবাই হঠাত করেই যেন একেবারে নীরব হয়ে গেছে। কোন সমস্যা হয়েছে কিনা কে জানে? রেস্টুরেন্টে সেই লোকটার সাথে কামালের মারপিট হবার পর আশ্চর্যজনকভাবে গভীর রাতের দরজায় টোকা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। কালামকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা তার ছিল না। সে তাকে একদিন বাসায় দাওয়াত করে নিজে রেঁধে ভালোমন্দ খাইয়েছে। চলে যাবার আগে সব খাবারের রেসিপি বিস্তারিত লিখে নিয়ে গেছে কালাম। কানাডা আসার পর থেকে নিজে রান্নাবান্না করে খেতে খেতে রান্নার প্রতি বেশ একটা আসক্তি এসে গেছে তার। সময় থাকলে সে ইউটিউবে গিয়ে বিভিন্ন বাংলাদেশী রান্নার চ্যানেল দেখে মুখরোচক তরকারী রান্না করে খায়। একদিন সে রিমা এবং বাচ্চাদের সবাইকে দাওয়াত দিয়ে নিজের রান্না খাওয়াবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রিমা হেসেছে। ও নিজে রান্না করতে একেবারেই পছন্দ করে না। প্রয়োজন আছে বলেই করে। মিন্টু আবার খুব পছন্দ করত। তার রান্নায় হাতও ভালো ছিল। কিন্তু শেষ কবে সে ওকে রান্না করে খাইয়েছে মনে করতে পারে না রিমা। তার সাথে ছয় বছরের বিবাহিত জীবনটা খুব দ্রুত আবছায়া, কুয়াশার মত হয়ে যাচ্ছে। ভাবতেও অপরাধবোধ হয় কিন্তু সত্য হচ্ছে মিন্টুর সাথে তার মানসিক ব্যবধান বেশ কিছুদিন ধরেই তৈরী হচ্ছিল। হতাশা কিংবা ডিপ্রেশন, তার আকস্মিক মৃত্যুর পেছনে কারণ যাই হয়ে থাক যে অদম্য ভালোবাসা আর আবেগ নিয়ে তাদের পথযাত্রা শুরু হয়েছিল শেষ দিকে তার কিয়দংশও আর অবশিষ্ট ছিল না।
যে দিন থেকে কালাম মরিয়মের পৈত্রিক বাসায় গিয়ে পিন্টুর দুই মেয়েকে পড়াতে শুরু করেছে সেদিন থেকেই রিমা বুঝতে পেরেছে আহমেদ পরিবারে খুব গুরুতর কোন সমস্যা হয়েছে। এসব নিয়ে কালামকে কোন প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয়নি। কালাম নিজের থেকেই জানিয়েছে মরিয়ম তাকে বলেছে তারা কিছুদিন তার বাবার বাসায় থাকবে। সে জলির মুখ থেকে শুনেছে তার বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া হবার পর তার মা তাদেরকে নিয়ে নানু বাড়ি চলে এসেছে। রিমা মনে মনে মরিয়মের সাহসিকতার প্রশংসা করেছে। এতো বছর পর সে যে পালটা আঘাত করবার শক্তি খুঁজে পেয়েছে দেখে ভালো লেগেছে।
৫৪
দেরী করে বিছানা ছেড়েছে মরিয়ম। আজ রোববার। পাশেই তার দুই কন্যা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। উইকএন্ডে মনের সুখে ঘুমায় তারা। নিজের বাসায় থাকতে মরিয়ম প্রতিদিনই বেশ সকাল করে উঠত, ফজরের নামাজ পড়ে শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর জন্য নাস্তা বানাত, পিন্টুর জন্য কফি, পরে বাচ্চাদেরকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে আসত, পিন্টুকে নাস্তা দিত, তারপর যতখানি সম্ভব বাসা গোছগাছ-পরিষ্কার করে রেস্টুরেন্টে চলে যেত যেখানে থাকত বিকেল পর্যন্ত, কখন কখন আরোও বেশিক্ষণ। বাবার বাড়িতে আসা অবধি বাচ্চাদেরকে স্কুলে ড্রাইভ করে দিয়ে আসা আর নিয়ে আসা ছাড়া তার আর কোন কাজই নেই। বাবা হাজী সাহেবের বয়েস হয়েছে আশীর মত, মা বেগমের সত্তর- কিছুদিন আগে একটা স্ট্রোক হয়েছিল তার। এখন অবশ্য ভালোই আছেন। তাদের সাথে থাকে বড় ভাই আবুল আর তার স্ত্রী দোলন। এখানে এসে ভালো লাগলেও মনে মনে তাড়াতাড়ি নিজের বাসায় ফিরে যাবে বলে আশা করছে ও। মেয়েদের স্কুল পাল্টানোর কোন ইচ্ছা ওর নেই।
যে কামরায় এসে উঠেছে সেটা ছিল ওর পুরানো কামরা। বিয়ের আগে বারোটা বছর ঐ কামরায় ছিল ওর আস্তানা। আসবাবপত্র বলতে একটা ডাবল বেড আর একটা আয়নাসহ ওয়ারড্রোব। বিয়ে হয়েছিল বাইশ বছর বয়েসে। মাত্র পলিটিকাল সায়েন্সে গ্রাজুয়েশন শেষ করে কাজ খুঁজবার তোড়জোড় করছিল হঠাত একদিন লাট্টু আর নীতা এসে হাজির বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। তাদের ব্যবসায়ী ছোট ছেলে পিন্টু নাকি মরিয়ম কে কোথায় দেখেছে। তার খুব ভালো লেগে গেছে। গভীর প্রেম। হাজী পরিবার কি দয়া করে তাদের এই প্রস্তাব বিবেচনা করে তাদের সোনার টুকরা মেয়েটিকে আহমেদ পরিবারের উদীয়মান তারকার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দুই পরিবারের মধ্যে একটা চিরস্থায়ী বন্ধনের সৃষ্টি করবেন? তখন লাট্টুর আহমেদ’স কিচেন স্থানীয়দের কাছে যথেষ্ট পরিচিত নাম যদিও অধিকাংশ মানুষই গলা কাটা দামের জন্য সেখানে খেতে যেত না। কিন্তু বিয়ের বাজারে সেই জাতীয় খ্যাতির মর্যাদাই অধিক। শুনলেই মালিকের ধন-সম্পত্তি আর প্রতিপত্তির একটা উজ্জ্বল চিত্র সবার চোখে ভেসে ওঠে। প্রস্তাব পেয়ে হাজী সাহেব একেবারে বাকবাকুম হয়ে উঠেছিলেন। মরিয়ম খুব একটা উচ্ছ¡সিত হয়নি। পিন্টুর চেহারা সুরত নিয়ে অভিযোগ করবার কোন কারণ ছিল না, থাকার কথাও নয়। সেই বয়েসে তাকে বরং যথেষ্ট সুদর্শণ এবং কামনীয় মনে হয়েছিল। মরিয়মের সমস্যা ছিল ছেলেটির চরিত্র নিয়ে। সে ছিল বিশৃঙ্খল, রগচটা, মারকুটে এবং প্রায় সকলের এবং সব কিছুর প্রতিই বীতশ্রদ্ধ। তার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল মরিয়ম। দেখা করানোর ব্যবস্থা হয়েছিল।
ছেলেটা প্রমাণ করেছিল চাইলে সে ভদ্র, নম্র, এবং বিনীত হতে পারে। আরোও কয়েকবার দেখা সাক্ষাতের পর মরিয়ম তাকে বিয়ের পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, প্রধানত ওর বাবা-মায়ের অসম্ভব আগ্রহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করেই। আবুল শুরু থেকেই এই বিয়ের বিপক্ষে ছিল। কিন্তু নিজের মতামত প্রকাশ করবার ব্যাপারে সে কখনই খুব একটা দৃঢ়তা দেখাত না। মরিয়ম অবশ্য ভাইয়ের সাথে আলাপ করেছিল, তার মতামত জানতে চেয়েছিল।
জীবনটা তো তোর, মরিয়ম। এই সিদ্ধান্ত তোকেই নিতে হবে। আমি তোকে শুধু এই টুকুই বলতে পারি ভবিষ্যতে যাই হোক না কেন আমি সব সময় তোর পাশে থাকব। সব সময়।
তারপর আর দেরী করেনি মরিয়ম। আবুলের মত একজন ভাই যখন অমন একটা প্রতিশ্রুতি দেয় তখন তা যে কারো মনের জোর বহুগুণ বাড়িয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। ও জানত যদি কোন কারণে বিয়েটা না টেকে তাহলে তার যাবার একটা স্থান থাকবে। আশ্চর্য, আজ এতো বছর পর সেই বাসাতেই তাকে ফিরে আসতে হল। ওর বাবা মা এখনও বেঁচে থাকলেও এই বাসার চালক এবং চালিকা শক্তি আবুল এবং দোলন, স্বাভাবিক কারণেই।
চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে উঠল ও, মেয়েদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিতে চায় না। জানালার ভারী পর্দাটা সামান্য সরিয়ে বাইরে উঁকি দিতে দেখল হালকা তুষার পড়ছে। শরত আসতে না আসতে চলে গেল, হাজির হয়েছে শীতকাল। শীত ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ নয় ওর। দুই কন্যা অবশ্য পুরো বিপরীত। তাদের ভয়ানক তুষারপ্রীতি আছে। ঘুম থেকে উঠে যদি দেখে তুষার পড়ছে আনন্দে লাফিয়ে উঠবে। মন্দের ভালো এই যে, মরিয়মকে কষ্ট করে তাদেরকে নিয়ে এই ঠান্ডার মধ্যে বাইরে তুষারে যেতে হবে না। দোলন হাসি মুখে সেই দায়িত্ব পালন করবে।
দোলনকে ও পছন্দ করে। তার বয়েস অল্প, চব্বিশ-পঁচিশ হবে। হাজী সাহেব যে গ্রামের মানুষ সেই গ্রামেরই এক গরীব চাষীর মেয়ে সে। এখানে আবুলের বিয়ের চেষ্টা করছিলেন তারা। যখন বেশ কয়েকটা সম্ভাব্য বিয়ের প্রস্তাব নানান কারণে ভেঙে গেল তখন হাজী সাহেব এবং তার স্ত্রী গেলেন দেশে ছেলের বউ খুঁজতে। দোলনের বাবা নিজে এসে তাদের কাছে যেঁচে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার মেয়েটাকে একটা সুযোগ দেয়া হোক। দোলনের তখন বয়স মাত্র আঠারো, হাই স্কুল শেষ করেছে, কলেজে পড়তে চায় কিন্তু দরিদ্র বাবার তাকে পড়ানোর সামর্থ্য নেই। তার আরও চার চারটি সন্তান রয়েছে। দোলন ছিল দেখতে সুন্দর, আলাপী। আবুলের বয়েস তখন পঁয়ত্রিশের মত। মেয়েটিকে দেখেই তার অসম্ভব মনে ধরেছিল।
বিয়ের অল্প কিছুদিন পরেই কানাডা চলে এসেছিল দোলন এবং এই সংসারের দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নিয়েছিল। কলেজে যাবার আগ্রহ তার দ্রুত উবে গিয়েছিল। এই বাসা আর তার বাসিন্দাদের দেখভাল করাটাই হয়ে উঠেছিল তার জীবনের প্রধান উদ্দ্যেশ্য। পাশাপাশি সে সোশাল মিডিয়াতেও ভীষণ সক্রিয়, তার নিজস্ব রান্না এবং বাগানের চ্যানেল আছে। আর দু’ দশটা মেয়ের মত শপিং করতেও খুব পছন্দ করে। মরিয়ম এবং তার দুই মেয়ের জন্য তার ভালোবাসার কোন অন্ত নেই। মরিয়মের কাছে এটা খুবই স্বস্তিকর। ভাবী পছন্দ না করলে কোন বোনের জন্যই ভাইয়ের বাসায় থাকা সম্ভব নয়। দোলনের দয়া মায়ার শরীর। সবার প্রতিই তার মায়া মমতা। তার এখনও কোন সন্তান নেই, খুব সম্ভবত আবুলেরই কোন সমস্যার কারণে। সেই জন্যে জলি আর হ্যাপি এলে দোলনের আনন্দের শেষ থাকে না। মরিয়ম জানে এখানে তার যতদিন ইচ্ছা সে থাকতে পারে। কেউ তাকে কখন চলে যেতে বলবে না। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এখানে খুব বেশীদিন সে নিজেই থাকতে চায় না। কেমন দেখাবে ব্যাপারটা? এগারো বছর সংসার করবার পর দুই মেয়েকে নিয়ে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসতে হবে কেন তাকে? নিজেকে তার ভয়ানক ব্যার্থ মনে হয়। পিন্টুকে পথে আনার জন্য এগারোটা বছর তার হাতে ছিল। সে পুরো সময়টাই অপচয় করেছে।
বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুতে ধুতে পিন্টুর কথা মনে এলো। কি করছে লোকটা এখন? মরিয়ম আর কন্যাদের অভাব কি বোধ করছে? নাকি কিভাবে রিমাকে শায়েস্তা করা যায় তাই নিয়ে নতুন ফন্দী আঁটতে ব্যাস্ত? বিয়ের এতোগুলো বছরে অনেক কিছুই অবজ্ঞা করেছে ও, নানা ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছে, কিন্তু এইবার ওর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। নিজের ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী এবং তার তিনজন অপরিণত বয়স্ক সন্তানকে যে আতংকের মধ্যে রাখতে পারে তার অধঃপতনের আর বাকী থাকে কি? ঐ মানুষের সাথে কি আর কখন সংসার করা সম্ভব হবে? যদি হয় তাহলে ঠিক কি ধরনের শর্ত সাপেক্ষে হবে? পিন্টুর দিক থেকে যদি বড়সড় কোন উদ্যোগ না নেয়া হয় তাহলে মরিয়ম ফিরে যাবে না বলে বদ্ধপরিকর। আর মানুষটাকে ও যতটুকু চিনেছে এতোদিনে, কাউকে দুঃখিত বলা, নিজের অন্যায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা তার চরিত্রে নেই। সেক্ষেত্রে আপাত দৃষ্টিতে সাময়িক এই বিচ্ছেদের পরিসমাপ্তি কিভাবে হবে মরিয়মের জানা নেই।