শুজা রশীদ : (পর্ব ১৩)
১৮.
সালটা ২০০২।
সন্ত্রাসী আক্রমণে টুইন টাওয়ারের ধ্বংসের স্মৃতি অধিকাংশ মানুষের চেতনায় তখনও স্পষ্ট জাগরূক। যদিও পৃথিবীর অন্য প্রান্তে, ট্রপিক অব ক্যান্সারের ঠিক নীচে অবস্থিত বাংলাদেশে সেই ঘটনায় পৃথিবীময় যে আলোড়ন উঠেছিল তার খুব একটা প্রকোপ পড়েনি।
রিমার বাবা মোহাম্মদ জয়নাব আলী ছিলেন হাইকোর্টের একজন বহুল পরিচিত উকিল, পৃথিবীর তাবৎ রাজনৈতিক ব্যাপারে ভয়ানক আগ্রহী ছিল তার। বিশেষ করে আগ্রহ ছিল আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় রিমাদের বাসায় তার বন্ধুদের বিশাল আড্ডা বসত, অধিকাংশই উকিল, চলত পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনীতি নিয়ে হেঁড়ে গলায় আলাপ, উত্তেজনা প্রায়শই এমন পর্যায়ে পৌঁছাত যে মনে হত যেন তাদের জীবন নির্ভর করছে সেই বিতর্কে জয়ী হবার উপর।
রিমার মায়ের আবার ঐসব ফালতু তর্কাতর্কি একেবারেই পছন্দ হত না। জয়নাবের চেম্বার এবং মূল বাসার মাঝখানে যে ভারী দরজাটা ছিল সেটাকে সবসময় বন্ধ করে রেখে টেলিভিশনে নানান ধরনের শো দেখেই সারাদিন কেটে যেত তার। বাসায় খান তিনেক গৃহকর্মী ছিল, তারাই সব কিছু দেখভাল করত। একজনের দায়িত্ব ছিল রান্নাঘর সামলান, আরেকজন করত ধোয়া মোছা, তৃতীয় জনের দায়িত্ব ছিল বাজার করা, বিল দেয়া সংক্রান্ত ব্যাপার স্যাপার। রিমা তখন ১৮। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গনটা খুব ভালো লাগত ওর, সেখানকার আবহাওয়ায় যে প্রাণের ছোঁয়া পেত সেটাও উপভোগ করত, বন্ধুর সংখ্যা ছিল অনেক, তার মধ্যে বেশ কয়েকজন সুদর্শন তরুণ। তারা দল বেঁধে গেছে দূরে বেড়াতে, পিকনিক করতে, অনেক রাত পর্যন্ত পার্টি করেছে, নেচেছে, মাঝে মাঝে একটু আধটু মদও খেয়েছে- জীবন ভালোই কাটছিল।
তারা ঢাকার যে পাড়ায় থাকত সেটাকে মোটামুটিভাবে ভালোই বলা চলে। চিকন রাস্তার দুই পাশে ইঁটের প্রাচীর ঘেরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু উঁচু দালান, দুইটা গাড়ি পাশাপাশি পার হওয়াও দুষ্কর। তাদের বাড়িটা ছিল ছয় তলা, মোট বারোটা এপার্টমেন্ট। অধিকাংশ বাড়ির মালিকরাই থাকত দুই তলায়, বাকি এপার্টমেন্টগুলো ভাড়া দেয়া থাকত। সুতরাং, স্বাভাবিকভবেই পাড়ার অধিকাংশ মানুষই ছিল ভাড়াটে। কিন্তু ভাড়াটেদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করত, একসময় হয় নিজেরাই বাড়ি কিনে চলে যেত নয়ত গগনচুম্বী ভাড়ার বোঝা বইতে না পেরে অন্য কোন সস্তা পাড়ায় চলে যেত। ঢাকায় বসবাস করা দিনকে দিন কঠিন হয়ে উঠছিল নিম্ন এবং মধ্যবিত্তদের জন্য। এই একটা ব্যাপারে কারো তেমন দ্বিমত ছিল না।
সেদিন ছিল ফেব্রুয়ারি মাসের ঠান্ডা এক সকাল। ঢাকার ঠান্ডা মানে ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের ধারে কাছে। সবাই রকমারি সোয়েটার, চাদর কিংবা পাতলা জ্যাকেট শরীরে চাপিয়ে ঘোরাঘুরি করে, বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব। রিমার একটা লম্বা সোয়েটার ছিল, সামনে বোতাম দেয়া, নীল-গোলাপী আর লাল রঙের খুব বাহারী দেখতে। ওর মা নিজ হাতে বুনে দিয়েছিলেন, নিজের ইচ্ছে মত রঙ মিশিয়েছেন। রিমার খুব একটা ভালো লাগত না কিন্তু না পরলে মা মন খারাপ করবে ভেবে পরত। মায়ের সাথের ওর সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। দুজন দুজনকে বুঝত, পারস্পরিক একটা শ্রদ্ধাবোধ ছিল। সেই তুলনায় বাবার সাথে ওর সম্পর্কটা খানিকটা শীতলই ছিল বলতে হবে। মানুষ হিসাবে ওর বাবা ছিলেন ভদ্র, ওকালতি আর রাজনীতি নিয়েই কাটত দিনের সিংহভাগ সময়, বিভিন্ন কাগজে আইনের উপর প্রতিবেদন লিখতেন, নিয়মিত ঢাকা ক্লাবে যেতেন বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিতে, তারপর যেটুকু সময় থাকত সেটুকু স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনদের সাথে কাজ করতেন গরীব মানুষদের বিভিন্ন ধরনের আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে সাহায্য করতে। পারিবারিক কোন ব্যাপারেই খুব একটা সময় দিতে পারতেন না। এমনও সময় গেছে যখন বাবাকে রিমা বেশ কয়েক দিন দেখেইনি।
ঐদিন সকালেই জানতে পারে তার ড্রাইভারের পরিবারে কি একটা সমস্যা হয়েছে, আগের দিন রাতেই সে হঠাৎ করে গ্রামে চলে গেছে। একটু বিপদেই পড়ে গেল রিমা। ওর সকালে ক্লাশ থাকে। মিস করতে চায় না। বাবাকে বলতে পারত ওকে একটু ইউনিভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে আসতে কিন্তু আগের দিন অনেক রাত পর্যন্ত মিটিং করেছেন তিনি, তখনও বিছানা থেকেই ওঠেননি। উপায় আরও দু-একটা ছিল- একটা রিক্সা কিংবা ঈঘএ নেয়া কিংবা বাসে চলে যাওয়া। স্থানীয় বাসে ও জীবনে চড়েনি, সুতরাং সেটা প্রথমেই বাদ।
তাহলে বাকি থাকে, রিক্সা কিংবা ঈঘএ। তাতেও একটা সমস্যা আছে। তাদের যে কোন একটা পেতে হলে প্রায় আধা কিলোমিটার হেঁটে গলির মোড়ে যেতে হবে যেখানে মূল সড়কের পাশে তাদের আখড়া। জিকু, যে ছেলেটা তাদের বাজার-সওদা করে, সে বাসায় থাকলে ঝট করে গিয়ে একটা কিছু নিয়ে আসতে পারত কিন্তু মা তাকে বাজারে পাঠিয়েছেন তাজা মাছ আনতে। ছোট ভাই রনক ইতিমধ্যেই স্কুলে চলে গেছে নইলে তাকেও বলা যেত। গেটে সবসময় একটা গার্ড থাকে। মাঝবয়েসী দাড়িয়ালা লোক, নাম মুহিত। গেটের পাশের ছোট একটা কামরাতেই তার বাস, পরিবার থাকে গ্রামে, প্রতি দুই মাসে একবার বেড়াতে যায়। তাকেও পাঠাতে পারত কিন্তু বাবার কড়া হুকুম সে যেন কোন অবস্থাতেই গেট ফাঁকা রেখে কোথাও না যায়। তারপরও হয়ত বলে কয়ে তাকে রাজি করান যেত কিন্তু বাবা যদি জানতে পারেন তাহলে বেচারার কাজ চলে যেতে পারে। তার বাবার কাছে নিয়ম হচ্ছে নিয়ম। নিয়ম যদি ভাঙ্গো তাহলে তার পরিণতিও মেনে নিতে হবে। কোন ব্যাতিক্রম চলবে না।
সেই দিন, জীবনে প্রথম বারের মত নোমানকে দেখেছিল ও, অথবা বলা যায় প্রথম লক্ষ্য করেছিল। কারণ পরবর্তিতে ভেবে দেখেছে এই লোকটাকে নানা সময়ে সে আগেও দেখেছে- ওদের দোতলার বেলকনিতে যখনই গিয়ে দাঁড়িয়েছে পাশের দালানের তিনতলার বেলকনিতে লোকটা উঁকি ঝুঁকি মারত। সে সুন্দরী, তরুণী, আকর্ষণীয়া, তার চারদিকে স্থাবকদের ভীড় সবসময় লেগেই থাকত, একেকজন একেকভাবে নিকটে আসার চেষ্টা করত। ঐ জাতীয় আগ্রহ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল ও। নিজেকে মাঝে মাঝে মনে হত বিখ্যাত কেউ। দেখতে শুনতে ভালো হবার ফলে সারা দুনিয়ার পুরুষ শ্রেণী তার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, মন্দ কি!
নোমান হঠাৎ কোথা থেকে হাজির হয়েছিল জানে না। ওকে দেখে খুব একটা মনবল নিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে কয়েক কদম এগিয়ে এলো, যেন কিছু একটা বলবে, তারপর বোধহয় ভয় পেয়ে গেল, কারণ মাঝপথে থেমে গিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। প্রথমে লোকটাকে ঐভাবে এগিয়ে আসতে দেখে রিমা একটু ভড়কেই গিয়েছিল, কিন্তু তার আচমকা থমকে যাওয়া দেখে ভীতিবোধটা দ্রæত কৌতুহলে পরিণত হল। ভাবল নিশ্চয় আরেক প্রেমিক প্রবর, তার কাছে প্রেম নিবেদন করতে এসেছে। দেখে মনে হল মধ্য বিশ হবে বয়েস, বেশ সুদর্শন, সুন্দর করে দাঁড়ি মোচ কামানো, কালো ট্রাউজার পরনে, নীল একটা শার্ট, চমৎকার নীল একটা টাই, সামান্য ভারি শরীর কিন্তু মোটা সোটা নয়। সব মিলিয়ে মন্দ নয়। পুরুষ শ্রেণীর কাছ থেকে সর্বক্ষণ এতো আগ্রহ উদ্দীপনা দেখতে দেখতে এখনও নিজেও তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করতে শিখেছে। প্রতিটা স্তাবককে সে নানাভাবে বিচার বিবেচনা করে একটা করে মার্ক দিত। বিচার্যের বিষয়ের মধ্যে ছিল সৌন্দর্য, স্বাস্থ্য, পোষাক-আষাক, ব্যবহার, আচরণ। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে সে বেশ ভালো নাম্বারই দিল যদিও তাকে দেখে মনে হল একটু লাজুক। যে মেয়েটিকে ভালো লাগে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস যদি সঞ্চয় করতে পারো তাহলে তার চোখের সামনে এমন উজবুকের মত জমে গেলে লাভের লাভ কিছুই হবার সম্ভাবনা নেই। তাতে মেয়েটার চোখে নিজেকে ক্ষুদ্র এবং হাস্যকর করে তোলা হয়।
“কিছু বলবেন?” রিমা বলেছিল। একজন অচেনা মানুষের সামনে মুখোমুখি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকাটা খুব একটা প্রীতিকর ব্যাপার নয়।
ভদ্রলোক চোখ তুলে তাকিয়ে তোতলাতে শুরু করল, “না, মানে, আমার নাম নোমান। আমি তিন তলায় থাকিৃ” সে আঙ্গুল উঁচিয়ে পাশের বাসার তিন তলার একটা এপার্টমেন্ট দেখাল।
রিমা হেসেছিল। ইতিমধ্যে এই জাতীয় পরিস্থিতিকে কিভাবে সামাল দিতে হয় সেটা সে ভালোভাবেই শিখে গেছে। “তাই নাকি? জেনে খুশী হলাম। আমি এই বাসার দোতলায় থাকি। আমার নাম রিমা। পরিচয় হয়ে খুব ভালো লাগল।” আরেকটা মুচকি হাসি দিয়ে ঝট করে উল্টো ঘুরল, হাঁটতে শুরু করল মোড় অভিমুখে যেখানে গেলে রিক্সা- ঈঘএ কিছু একটা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখনও মনে মনে আশা করছে জিকু হয়ত মাছ নিয়ে ফিরে আসবে। মোড়ে নানা ধরনের মানুষের ভীড় ভাট্টা থাকে, হকারদের আর রাজ্যের ভিখারীদের রাজত্ব, দেখলেই এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে, ঐ পরিবেশে রিমা একেবারেই স্বস্তি বোধ করে না।
দশ পাও যেতে পারেনি পেছনে ছুটন্ত পদক্ষেপ শুনে থামতে হল। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল নোমান। “তোমার কি রাইড লাগবে?”
“হ্যাঁ, লাগত,” রিমা দ্বিধা নিয়ে বলে। রাস্তার পাশে একটা নীল কেমরি পার্ক করা দেখতে পেল। বোধহয় এই ভদ্রলোকের। কিন্তু সদ্য পরিচিত কারো গাড়িতে চেপে বসার কোন প্রশ্নই ওঠে না। “আমি সামনে স্ট্যান্ড থেকে একটা রিক্সা-টিক্সা নিয়ে নেব।”
“দাঁড়াও, দাঁড়াও,” নোমান দ্রæত বলে, “আমি ঝট করে গিয়ে তোমার জন্য একটা রিক্সা নিয়ে আসছি।”
রিমা একাধারে অবাক এবং সন্দেহপরায়ণ হয়ে ওঠে। এই লোক হঠাৎ এতোখানি পথ হেঁটে গিয়ে ওর জন্য রিক্সা আনতে এতো আগ্রহী কেন?
“কোন দরকার নেই,” ও প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করে। “আমার কোন অসুবিধা হবে না। আপনার দুশ্চিন্তা করবার কোন কারণ নেই। ধন্যবাদ।” লোকটাকে বেশি পাত্তা দিতে চায়নি। স্তাবকদেরকে নিয়ন্ত্রণ করবার কিছু গোপন সূত্র আছে। তাদেরকে কখন একটা গন্ডীর ভেতরে আসার সুযোগ দিতে হয় না। তাতে পুরো ব্যাপারটার ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং হয়রাণীর শিকার হবার সম্ভাবনা থাকে।
দ্রæত পায়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে ওর মনে হচ্ছিল এই বুঝি লোকটা ওর পিছু পিছু আসে, নাছোড়বান্দার মত কিছু একটা নিয়ে আলাপ জমানোর চেষ্টা করে। সে আসেনি। রিমার ইচ্ছা হচ্ছিল ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ফিরে দেখে লোকটা কি করছে। কিন্তু নিজেকে সম্বরণ করতে হল। দেখে ফেললে একটা ভুল সংকেত পেতে পারে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কৌতুহলের জয় হল। নীচু হয়ে জুতা ঠিক করছে এইরকম একটা ছুতা করে আলতো করে পিছু ফিরে তাকায় সে। নীল গাড়িটা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে লোকটা। উল্টো পথে গেছে সে। আপন মনে কাঁধ ঝাকিয়েছিল ও। একটা আপদ চুকেছে। এইবার স্ট্যান্ডে গিয়ে রাজ্যের মানুষের ফ্যালফ্যালে দৃষ্টির সামনে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কে জানে।
ওর রিকশা যখন ওকে আর্টস ফ্যাকালটির কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে গেল তখন দশটা বেজে গেছে। যা ভেবেছিল তার চেয়ে সময় বেশি লেগেছে রাস্তায় জ্যাম থাকার জন্য। ঢাকার জীবনের অবধারিত একটা ব্যাপার। ক্লাশে যাবার আগে একজনের সাথে দেখা করার কথা ছিল ওর। এদিক ওদিক তার খোঁজে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করল। শেষে হতাশ হয়ে যখন ক্লাশে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিল তখন এক তরুণ তার পিছু থেকে এসে আচমকা দুই বাহুর মাঝে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, খেলাচ্ছলে উঁচিয়ে মাটি থেকে শূণ্যে তুলে ফেলল। প্রথমে ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল রিমা কিন্তু যখন ভুল ভাঙল তখন খিল খিল করে হেসে উঠল। তরুণটা তাকে নিজের চারপাশে কয়েকবার ঘুরিয়ে আবার মাটিতে নামিয়ে দিল, হাত ছাড়িয়ে ওকে ঘুরিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল, ওর মুখটাকে দুই হাতের তালুতে ধরে খুব আবেগভরা গভীর কন্ঠে বলল, “প্রাণেশ্বরী, কেমন আছো বল।”
রিমা হেসে ওঠে। এই হচ্ছে লাভলু। ছয় ফুটের উপর লম্বা, পেশীবহুল শরীর, দেখতেও সুদর্শন। তাকে দেখে একেবারে মডেল মনে হয়। রঙ চটা জিন্স আর হাত কাটা টি শার্ট পরে বাইসেপের ভাজ দেখিয়ে সে যখন তার লম্বা ব্যাক ব্রাশ করা চুলে কাঁপন তুলে হেঁটে যায় ডিপার্টমেন্ট শুধু নয়, ইউনিভার্সিটির অনেক মেয়েরাই তার সঙ্গ পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। এই ছেলেটি তার ছেলে বন্ধু। তার চাহিদা অনেক, মানসিক এবং শারীরিক উভয় দিকেই। রিমা সবসময় ভাবত সে যৌন সঙ্গম করবে একমাত্র বিয়ের পরই, ওর বাবা-মা সেটাই আশা করবে তার কাছে। তাছাড়া সামাজিক একটা ব্যাপারও আছে। কিন্তু সব কিছু কি সবসময় প্ল্যান মাফিক হয়? যখন কোন একজন পুরুষের ভালোবাসা পাবার জন্য একটা মেয়ের সমস্ত অস্তিত্ব উন্মুখ হয়ে থাকে, তার শরীরের উষ্মা পাবার জন্য নিজের অজান্তেই একটা আচ্ছন্নতা তৈরী হয়, তার ঠোঁটের দৃঢ়তায় নিজেকে সঁপে দিতে ইচ্ছে হয় তখন নিজেকে সামলানো সহজ কাজ নয়। তাদের সম্পর্কটা ঐ দিকে মোড় নিক সেটা ও চায় নি কিন্তু যখন নিল তখন সেটাকে থামানোর ক্ষমতাও ওর ছিল না। অনেক মেয়েরাই সেই প্রলোভনে পা দেয়, পরে কেউ কেউ অনুশোচনা করে। কিন্তু রিমার কোন অনুশোচনা হয় নি। তার ভালোবাসার পুরুষটার সাথে শারীরিক প্রেমে জড়িয়ে পড়ার ব্যপারটা তার কাছে মনে হয়েছে স্বাভাবিক। কখন কখন ঘুমের মধ্যেও সে তার সাথে সঙ্গমের স্বপ্ন দেখত।
ভাগ্য চক্রই ওকে আর লাভলুকে ইকনমিক্স ক্লাশে সাক্ষাৎ করিয়ে দিয়েছিল। প্রথম ক্লাশ, দুজনে পাশাপাশি সিটে বসেছিল। লাভলু নিজের পরিচয় দেয়, ওর নাম জিজ্ঞেস করে। ক্লাশের পরে বলে তার অনেক ক্ষিধে পেয়েছে। সে যাচ্ছে ক্যানটিনে। জানতে চায় রিমা তার সাথে যাবে কিনা। রিমা নিঃশব্দে মাথা দুলিয়েছিল এবং তাকে অনুসরণ করেছিল। সেই দিনের পর থেকে তারা দুজন দুজনের ছায়া সঙ্গী হয়ে গেছে ইউনিভার্সিট প্রাঙ্গণে। তারপর যা ঘটেছে, তা ঘটেছে স্বতস্ফূর্তভাবে। পৃথিবীর এমন কোন শক্তি ছিল না যা তাকে থামাতে পারত। অগ্নিয়গিরির অগ্নুৎপাতের মত তাদের তারূণ্য এবং নিষ্পাপতা তাদেরকে ঠেলে দিয়েছিল এক অবধারিত কামনার আগুনে, তাদের সমস্ত মানসিক বাঁধায় নেমেছিল তাৎক্ষনিক এক ধ্বস।
লাভলু! ঐ নাম রিমা আবৃত্তি করতে পারত সারাদিন। সে ছিল তার সঙ্গীত, তার হৃদয়ের জীয়ন কাঠি, তার নক্ষত্রখচিত আকাশ!