শুজা রশীদ : (পর্ব ৭)
রিমার মুখভাব দেখেই তার ভেতরে চাঁপা পড়ে থাকা হতাশার ইংগিত পায় মার্সেল। স্বভাবজাত ভঙ্গিতে আলতো এক টুকরো হাসি দেয় সে। “বেশি ভেব না। জীবন থেমে থাকে না।”

ঠিক সেই সময় বাইরে করিডোর থেকে হঠাত চীত্কার শোনা যায়। একজন পুলিশ অফিসার দৌড়ে ভেতরে এলো। “ডিটেকটিভ, একটা লোক এসেছে। বলছে সে মৃত লোকটার ভাই। খুব উত্তেজিত হয়ে আছে। কি করব ওকে নিয়ে?”

মার্সেল মাথা নাড়ল। “ওকে ভেতরে নিয়ে এসো। তবে কাছাকাছি থেকো।”
এই সময়ে পিন্টুর মুখোমুখি হবার বিন্দুমত্র ইচ্ছা ছিল না রিমার। অফিসার চলে যাবার পর মুহূর্তও পার হয়নি পিন্টু ছুটে এসে তার এপার্টমেন্টে ঢুকল। তার জামা কাপড় এলোমেলো, উশকোখুশকো চুল, রক্তিম মুখে জ্বলন্ত এক জোড়া চোখে প্রচন্ড ক্রোধ এবং ঘৃণার সমাবেশ।
“আমার ভাইকে ও খুন করেছে!” গলা ফাটিয়ে চীত্কার করে ওঠে পিন্টু। “অফিসার, ও একটা খুনী। আমার ভাইকে খুন করেছে। বেঁচে থাকতে ওর জীবনটাকে বারোভাজা করেছে, ওর যা ছিল সব হাতিয়ে নিয়েছে, তারপর ওকে খুন করেছে। আমার ভাইয়ের শরীরে ভালো করে দেখ কোন বিষ আছে কিনা। এই মহিলা নিশ্চয় ওকে আগে বিষ খাইয়ে মেরেছে তারপর ঠ্যালা দিয়ে উপর থেকে নীচে ফেলে দিয়েছে। ও একটা ডাইনি। ওকে দিয়ে সব সম্ভব।”
কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই দৌড়ে রিমার সামনে চলে আসে সে, থুক করে এক দলা থুতু ফেলে রিমার মুখে। ভয়ে আর্তচীতকার দিয়ে সরে যাবার চেষ্টা করে রিমা, ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে এলিয়ে পড়ে সে। মার্সেল দ্রুত এগিয়ে এসে রিমাকে ধরে দাঁড় করালো। দুজন অফিসার পিন্টুকে জাপটে ধরে ঠেলে পেছনে নিয়ে গেল। পিন্টু গলা ফাটিয়ে অশ্রাব্য গালাগালি করছে, অধিকাংশই বাংলায়। অফিসারদের সবাই ভিন্ন ভাষাভাষী। তারা গালির অর্থ না বুঝলেও পিন্টুর ভাবসাব দেখে যা বোঝার বুঝে নিল।

মার্সেল রিমাকে পাশের কামরায় পাঠিয়ে দিয়ে পিন্টুর মুখোমুখি দাঁড়ায়। “শান্ত হও। আমার নাম ডিটেকটিভ মার্সেল রাসেল। আমি এই কেসের ইনভেস্টিগাটিং অফিসার। তোমার মাথা ঠান্ডা হলে তোমার সাথে একাকী আলাপ করতে পারি একটু?”

দুই পুলিশ অফিসার তাকে জাপ্টে ধরে থাকলেও পিন্টুর ব্যবহারের কোন পরিবর্তন হল না। সে গর্জে উঠল, “তুমি বুঝতে পারছ না কেন, ঐ মহিলা তার স্বামীকে খুন করেছে। শয়তানী একটা। ওকে এখনই এরেস্ট কর নইলে কিন্তু পালাবে।”

“তুমি যদি শান্ত না হও তাহলে আমি তোমাকেই এরেস্ট করব,” মার্সেল এবার ভয় দেখায়।
তাতে কাজ হল। পিন্টু অবশেষে চীত্কার চেঁচামেচি বন্ধ করে বুক ভরে কয়েকবার শ্বাস নিল, অফিসার দু’জনের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে আঙ্গুল দিয়ে মাথার চুল ব্রাশ করল আনমনে, তারপর তাকাল মার্সেলের দিকে। “আচ্ছা, চল কথা বলি। আমি তোমাকে সব খুলে বলব।”

১০
মিন্টুর মৃত্যুর পর খুব দ্রæত ভীষণ আশ্চর্যজনক একটা ঘটনা ঘটল। রিমা হঠাত করে খুব বিখ্যাত হয়ে গেল। শুধু কানাডায় নয়, বাংলাদেশেও ঘরে ঘরে তার নাম বহুল পরিচিত হয়ে উঠল। কানাডার জাতীয় এবং স্থানীয় প্রায় সব কাগজেই কম বেশি ফলাও করে খবরটা প্রকাশ হল।

মর্মান্তিক এক মৃত্যু
স্কারবোরতে অবস্থিত সুউচ্চ এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স ক্রিসেন্ট টাউনের একটি দালানের সামনে চল্লিশ বছরের এক লোককে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে মৃত ব্যক্তি হয়ত তার এপার্টমেন্টের বেলকনি থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশ এখনও খুব বেশি তথ্য প্রকাশ করেনি তবে তাদের ভাষ্য অনুযায়ী এই মৃত্যু সন্দেহজনক। মৃত মিন্টু আহমেদ একজন বাংলাদেশী অভিবাসী ছিলেন যিনি প্রায় বারো বছর আগে তার পরিবারের সাথে কানাডায় আসেন। তিনি তার স্ত্রী এবং তিনটি সন্তানকে পেছনে ফেলে গেছেন।

স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে যে এই খবর প্রকাশিত হবে সেটা রিমা আশা করেছিল, কিন্তু এই ঘটনা যখন বাংলাদেশের খবরের কাগজেও আলোড়ন তুলল তখন সে বেশ আশ্চর্য হয়েছিল। ঢাকায় তার বাবা-মা-ভাই এসব নিয়ে কিছু শুনুক সেটা সে চায়নি। বহুদিন হয়ে গেল তাদের সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই। সেটা ছিল তার জীবনের আরেকটা বেদনাময় অধ্যায়। ওসব নিয়ে ভাবতে ওর ভালো লাগে না। চারদিকে ছড়িয়ে গেছে তার নাকি পরকীয়া ছিল এবং লাইফ ইন্সুরেন্সের টাকার জন্য সে নিজেই তার স্বামীকে হত্যা করেছে। যে সমস্ত মানুষদের সাথে সে কত বছর কথা বলেনি তারাও ফোন করে সহানুভূতি জানিয়েছে, ভয়েস মেইলে লম্বা মেসেজ রেখেছে। রিমা কারো কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করেনি। সে বরং চেয়েছে সবাই তাকে এবং তার তিনটি বাচ্চাকে অকারণে বিরক্ত না করে। নিজের সন্তানদের সাথে সে চুপচাপ শান্তিতে জীবন কাটাতে চায়।

মার্সেল তার সাথে দেখা করতে এলো তিন দিন পর। গুজব, কানা ঘুষা আর সংবাদ মাধ্যমে অতিমাত্রায় প্রচারণা হওয়ায় সে-ই রিমাকে উপদেশ দিয়েছিল বাচ্চাদের নিয়ে কয়েকটা দিনের জন্য নিজের বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও একটু গা ঢাকা দিয়ে থাকার জন্য। রিমা মিলার বাসায় এসে ওঠে।

মার্সেল এলো সন্ধ্যায়, অন্ধকার হয়ে যাবার পর, কেউ যেন তাকে অনুসরণ না করে সেটা নিশ্চিত করে। ভয় বেশি সাংবাদিকদের নিয়ে। মিলার বাসা থেকে বেশ দূরে গাড়ি রেখে হেঁটে আসে সে।

লোকটাকে রিমা বিশ্বাস করে। তার ব্যবহারে মনে হয় রিমা এবং তার সন্তানদের নিরাপত্তা এবং স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে সে আন্তরিকভাবেই উদ্বিগ্ন। রিমার দর্শনে সে বিশাল এক টুকরো হাসি দেয়। “চিন্তার কোন কারণ নেই। কেউ আমার পিছু নেয় নি। তোমরা সবাই কেমন আছো?”
রিমা মিলার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেয়। হাত মেলাল দুজন। মিলা কফি দিতে চাইল কিন্তু মার্সেল ঠান্ডা এক গ্লাস পানি চাইল। জুলাই মাস, প্রচান্ড গরম। তার খুব ব্যস্ত দিন গেছে। ক্লান্ত হয়ে ছিল, বাসায় ফিরতে পারলে বাঁচে। কিন্তু রিমার সাথে দেখা করাটাও জরুরি।

মিলার বেসমেন্ট এপার্টমেন্টে লিভিং রুম বলে কিছু নেই। দুই বেডরুমের মধ্যে একটাতে কুইন সাইজের একটা বিছানা পাতা, অন্যটাতে দুটি পুরানো সোফা বসান, বাড়ীর মালিক নতুন সোফা কেনার আগে তার পুরানো সোফাগুলো এখানে বসিয়ে দেয়। তাতেই খুশী মিলা।
বাচ্চাদেরকে মিলার সাথে শোবার ঘোরে পাঠিয়ে দিয়ে ছোট ঘরটাতে রিমাকে নিয়ে বসল মার্সেল। রিমাকে তার আরোও কিছু প্রশ্ন করার আছে। ফায়যা মায়ের পাশে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু মার্সেল মানা করল। বড়দের ব্যাপার, তার থাকাটা যথাযথ হবে না- সে ফায়যাকে বুঝিয়ে বলে।

লম্বা সোফাটাতে ভদ্রতাসূচক দূরত্ব বজায় রেখে বসে তারা, কাঁচের টেবিলে মার্সেলের ফোনটা রাখা, তার কোলে একটা নোটবুক, দুই আঙ্গুলের ফাঁকে কলম। রিমা শান্তভাবে বসে থাকে, ভাবে আর কি প্রশ্ন করার বাকী আছে লোকটার? মাত্র তিন দিন আগেও যদি কেউ তাকে বলত তার জীবন এভাবে মোড় নেবে সে হয়ত হেসে উঠত। কিন্তু এই মুহুর্তে এক পুলিশ ডিটেকটিভের সামনে শূষ্ক মুখে বসে আছে সে, যে তার স্বামীর মৃত্যুর তদন্ত করছে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তার। রিমার কোন সন্দেহ নেই সে সন্দেহভাজনদের একজন। ভেতরে ভেতরে কেমন যেন একটা ভোতা অনুভূতি হয় ওর, মনে হয় ওর চারদিকে যা যা ঘটছে সব কিছু ও পরিষ্কার করে বুঝতে পারছে না। সবচেয়ে বেশী দূর্ভোগ হচ্ছে পিন্টুকে নিয়ে। রিমাকে নিয়ে কত যে অসম্ভব বাজে বাজে কথা বলে বেড়াচ্ছে সে!

“একটা সুসংবাদ আছে এবং একটা দারুণ খবর আছে,” মার্সেল বলে, তার স্বভাবজাত মুচকি হাসি হেসে।
“পিন্টু সারাক্ষণ মিথ্যা কথা বলে,” রিমা ভড়ভড়িয়ে বলে ওঠে। “আমার নামে যা যা বলছে সব বানিয়ে বানিয়ে বলছে। আমার স্বামীর পরিবার আমাকে কখন পছন্দ করেনি। আমাকে তারা গ্রহণও করেনি। সবসময় নানান ভাবে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে। এই কথাগুলো তোমার জানা দরকার।”

“সেটা আমি ইতিমধ্যেই আন্দাজ করেছি,” মার্সেল শান্তভাবে বলে। “কিন্তু কোন মৃত্যু নিয়ে তদন্ত করবার সময় সব পক্ষের কথাই আমার শুনতে হয়। কিন্তু সব কথা আমি কানে নেই না। পিন্টুর কথা বার্তার কোন মাথামুন্ডূ নেই। সুতরাং ওকে নিয়ে তোমার চিন্তা করবার কিছু নেই।”
রিমা মাথা দোলায়। পিন্টু তার নামে মার্সেলের কাছে কি বলেছে জানতে পারলে ভালো হত কিন্তু মার্সেলের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে না সে রিমার কাছে কিছু ফাঁস করবে। জোর করাটাও খুব একটা ভালো দেখাবে না।

“ঐটা ছিল ভালো খবর,” মার্সেল বলে। “পিন্টুর কথাবার্তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমার সহকর্মীদের আমি বলেছি পিন্টুর উপর নজর রাখতে। ভীষণ ক্ষেপে আছে। ওর বাবা মায়ের সাথে এখনও কথা বলার সুযোগ হয়নি আমার। শীঘ্রই বলব। তোমার এখানে এসে ওঠার সিদ্ধান্তটা ভালো হয়েছে। তুমি কোথায় আছো কেউ জানে না। কাউকে জানিও না। বাচ্চাদেরকে স্কুলে পাঠিও না। কয়েক দিনের মধ্যেই সবকিছু একটু থিতিয়ে যাবে। জানি এখন দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে, কিন্তু পরিস্থিতি একসময় ভালো হয়ে যাবে। আমার উপর আস্থা রাখো। ঠিক আছে?”

রিমা নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ে। ফায়যার স্কুলে যাওয়াটা দরকার। সে ছাত্রী হিসাবে যেমন ভালো তেমনি স্কুলের অন্যন্য কর্মকান্ডের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। খুব বেশীদিন ক্লাস মিস করাটা ওর জন্য ভালো হবে না। জিব্রান এবং রবিনের তেমন কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু রবিনকে নিয়ে কোন নিশ্চয়তা নেই। পরিস্থিতি খুব দ্রুত পালটে যেতে পারে। যদি কোন কারণে বিচলিত হয়ে পড়ে, চীত্কার করে কান্না কাটি শুরু করে, তাহলে এখানে থাকাটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। মিলার বাড়িওয়ালা উপরের তলাতেই থাকে এবং তারা আওয়াজ খুব একটা পছন্দ করে না। মিলার জন্য কোন সমস্যার সৃষ্টি করতে চায় না রিমা।

মার্সেল লম্বা একটা শ্বাস নেয়। “এবার দারুণ খবরটা দেই। মিন্টুর অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে খোঁজ খবর নেবার সময় আমি জেনেছি তার আসলে একটা লাইফ ইন্সুরেন্স পলিসি ছিল। তুমি ঐ ব্যাপারে কিছু জানো না?”
রিমা অবাক হয়। মিন্টু তাকে কেন কিছু বলে নি? “আমার কোন ধারণাই ছিল না। আমাকে কখন কিছু বলেনি মিন্টু।”
তার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল মার্সেল। “তোমাকে কখন পলিসি ব্রসিওর জাতীয় কিছু দেখায়নি সে?”
“দেখালে নিশ্চয় মনে থাকত আমার।”
মার্সেল তার সাথে নিয়ে আসা একটা ফাইলের ভেতর থেকে কয়েকটা ছাপানো কাগজ বের করল। “আধা মিলিয়ন ডলারের পলিসি। ২০১১ র ডিসেম্বর মাসে নিয়েছিল। মনে পড়ে কিছু?”

রিমা বড় করে শ্বাস নেয়। ২০১১’র ডিসেম্বর! একটা সন্তানকে পেটে ধারণ করবার দিন কোন মেয়ে কি কখন ভুলতে পারে? ডিসেম্বরের এক শীতল সকাল ছিল সেটা, তার পিরিয়ড মিস হবার দ্বিতীয় দিন। একরকম ঠাট্টা করেই মিন্টুকে বলেছিল সে। মিন্টু এক দৌড়ে দোকানে গিয়ে তিনটা বিভিন্ন ধরনের প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট নিয়ে আসে। তার মুখের সেই উত্তেজনা ভোলার মত নয়। তার যেন আর তর সইছিল না। প্রথম টেস্ট কিটই পজিটিভ এলো। তারপরও বাকীগুলো টেস্ট করাল সে, নিশ্চিত হবার জন্য। আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল সে। বাচ্চাদের সামনেই তাকে জড়িয়ে ধরে লম্বা একটা চুমু খেয়েছিল, তারপর একডজন ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছিল তার মুখ। বাচ্চারা লাজুক ভঙ্গিতে খিল খিলিয়ে হেসে উঠেছিল। মিন্টু পারলে তখনই ছুটে গিয়ে নিকটবর্তী কোন একটা মিষ্টির দোকান থেকে ট্রাক ভর্তি মিষ্টি কিনে বাড়ী বাড়ী বিতরণ করতে শুরু করে। তার সেই অসম্ভব উত্সাহ এবং উদ্দীপনার কথা রিমা কখন ভুলবে না।

কিন্তু খানিকটা বাধ্য হয়েই রিমাকে তার উদ্দীপনায় রাশ দিতে হয়েছিল। তাকে বলতে হল সবাইকে জানানোর আগে কয়েকটা মাস অপেক্ষা করাটা ভালো। বাচ্চা পেটে এলেই যে সব কিছু ঠিকঠাক মত হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। মাস তিনেক অপেক্ষা করাটা প্রয়োজন। শুনে তার মুখখানা একেবারে বেলুনের মত চুপসে গিয়েছিল। থম থমে মুখে মেঝেতে বসে ছিল অনেকক্ষণ। “আমার মাকে বলতেই হবে,” শেষে বালসুল্ভ জেদ নিয়ে বলেছিল সে।
হাসি ঠেকাতে কষ্ট হয় রিমার। সেই মিন্টুর কথা ভাবলেই ওর মনটা ভরে ওঠে। তার হাত ধরে সে গভীর কুয়ায় ঝাঁপ দিতে পারত, অতল সমুদ্রে তলিয়ে যেতে পারত, মহাশূণ্যে উড়ে যেতে পারতৃসেই মিন্টুকে সে মনেপ্রাণে ভালোবেসেছিল।

মার্সেল তার মুখ দেখে মনের ভাব বুঝতে পারে। “মনে পড়েছে তাহলে!”
রিমা মাথা দোলায়। তার ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু হাসিটা পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারে না। “ঐ দিন আমরা জানতে পারি রবিন আমার পেটে এসেছে।”
“আচ্ছা!” মার্সেল হাসি মুখে বলে। “সে ঐ দিনই একটা লাইফ ইন্সুরেন্স পলিসি কিনেছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার, তোমাকে এটা নিয়ে কিছুই বলে নি।”
“হয়ত ভেবেছিল আমি ওকে নিয়ে হাসাহাসি করব। উত্তেজনায় যেমন টগবগ করে ফুটছিলৃওর প্রথম বাচ্চাৃসুযোগ পেলেই আমি ওকে ক্ষ্যাপাচ্ছিলামৃ” কথা শেষ করতে পারে না রিমা। ওর দু’চোখ পানিতে ভরে ওঠে। দুই হাতের তালুর মাঝে নিজের মুখ লুকায়।
মার্সেল তাকে কিছুটা সময় দেয় ধাতস্থ হতে।
“খুব ভালো কাজ করেছিল,” সে বলে। “আধা মিলিয়ন ডলার অনেক টাকা। তোমার খুবই উপকারে আসবে এখন।”

রিমা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। একটু আগেও ও কিভাবে সংসার চালাবে ভেবে চিন্তায় মাথার চুল ছিড়বার উপক্রম করছিল। অথচ মিন্টু ঠিকই ব্যবস্থা করে গেছে। কিন্তু টাকাটা কি সত্যি সত্যিই পাবে ও? কোথায় যেন শুনেছিল আত্মহত্যা করলে নাকি ইন্সুরেন্সের টাকা পাওয়া যায় না।
“পলিসিটা ছয় বছর আগে নেয়া হয়েছিল,” মার্সেল বলে। “নিয়মিত পেমেন্ট করেছে সে। একটা সুইসাইড ক্লস আছে কিন্তু সেটা মাত্র দুই বছরের। অনেক আগেই সেই সময় পেরিয়ে গেছে। সুতরাং এই কাগজে যা লেখা আছে তার পুরো অংকটাই তোমার পাবার কথা।” সে কাগজগুলো ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে। “আমি একটা কপি করেছি আমার জন্য। একটা নিরাপদ জায়গায় রেখ এটাকে। এখনও টাকাটার জন্য আবেদন করতে পারবে না। ডেথ সার্টিফিকেট লাগবে আবেদন করবার জন্য, যেটা পাবে একমাত্র কেসের অনুসন্ধান শেষ হবার পর। আরোও কিছুদিন লাগবে। করোনার পোস্ট মর্টেম করবে। সেটা হয়ে গেলে সে মৃত দেহ ছেড়ে দেবে। ওকে কোথায় কবর দেবে ঠিক করেছ?”

রিমা ভড়কে যায়। এসব নিয়ে একবারের জন্যও ভাবে নি সে। এখানে কবর দেয়া সম্বন্ধে কোন কিছুই জানে না। মার্সেলের দিকে অনুসন্ধিত্সু দৃষ্টিতে তাকায়।
“আমার কোন ধারণা নেই,” মার্সেল বলল। “কিন্তু তোমার খোঁজ খবর শুরু করতে হবে। লাশ তোমার হাতে তুলে দেয়া হবে। হাতে সময় বেশী নেই।”
চিন্তায় পড়ে যায় রিমা। কানাডা আসার পর এক মসজিদে জনৈক প্রবীণ ব্যাক্তির মৃত্যুর জানাজায় শরীক হয়েছিল সে। ভদ্রলোককে কোথায় কিভাবে কবর দেয়া হয়েছিল সে জানে না। মিলা কি জানবে? মনে হয় না। মানিক? মিন্টুর পরিবার কি সাহায্য করবে? বেশ কিছুদিন ধরে তাদের সাথে মিন্টুর সম্ভবত কোন সম্পর্ক ছিল না। এই ক্ষেত্রে তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে সে জানে না। মুসলমানদের জন্য এখানে কবরের ভিন্ন ব্যবস্থা। হয়ত স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাহেব সাহায্য করতে পারবেন। কত খরচ হতে পারে? ব্যাংকে হাজার দুই টাকা আছে। ওর নিজের একাউন্টে। ওর উপার্জনের টাকা সেখানে জমা হয়। সংসার প্রায় পুরোটাই চালাত মিন্টু। কত টাকা উপার্জন করত, কত টাকা খরচ করত, কোথায় খরচ করত, কত টাকা সঞ্চয় ছিল – এসব নিয়ে মিন্টু কখন কথা তোলে নি, রিমাও কখন কিছু জিজ্ঞেস করে নি। ওর কাছে মিন্টুর অর্থনৈতিক দিকটা ছিল সম্পূর্ণ অজানা।

মার্সেল বিদায় নিয়ে চলে গেল। রিমা একলা বসে ভাবতে থাকে। “তোমার বন্ধুদের সাথে আলাপ কর,” যাবার আগে বলে গিয়েছিল মার্সেল। “কেউ না কেউ জানবে। আর ঘাপটি মেরে থাকো। কোন কিছু নিয়ে সমস্যা হলে আমাকে ফোন দিও। ঠিক আছে?”
রিমা নীরবে মাথা নেড়েছিল। প্রতিবার যখনই ওর সাথে দেখা করতে আসে লোকটা, যাবার আগে নতুন কোন একটা ধাঁধাঁয় ফেলে দিয়ে যায় ওকে।