বিদ্যুৎ সরকার: আলো নির্জন সিঁড়ি মাড়িয়ে তুমি সহজেই উঠে গেলে তোমার সুন্দর গৃহকোণে। এ ঘরটি একান্তই তোমার। নৈশব্দের শব্দ এক যোগে বেজে উঠে, ঝংকৃত হয় তোমার চলে আসায়। সাধারণত এ সময়টাতে তুমি কখনই ঘরে ফিরে আসো না। তবুও তোমাকে আসতে হয়েছে – জোনাকি আজ আসছে। পিয়ারসন্স এয়ারপোর্টে গিয়ে তাকে নিয়ে আসতে চেয়ে ছিল, জোনাকিই বারণ করে দিয়েছে। দু’দুবার আসা-যাওয়ার জন্য বাসাটি খুঁজে পেতে মোটেও অসুবিধে হবে না, তার দৃঢ় বিশ্বাস। তাই, হাফ অফিস করে সরাসরি বাসায় ফিরে এসেছে রক্তিম। ও’র প্রিয় খাবারগুলো কালই রেধে ফেলা হয়েছে। আলুভাজি, মশুরের ডাল, ডিম ভুনা – ব্যাস্ এতেই সে খুশিতে আট খানা। ও’কে খাইয়ে মন জয় করতে মোটেও বেগ পেতে হয় না রক্তিমের। ঘরে ঢুকেই ব্যাকপ্যাকটা মেঝেতে রেখে সরাসরি ওয়াশ রুমে। ফ্রেশ হয়ে এসেই চেয়ারটা টেনে নিজ হাতে দুটো ডিশে ভাত সাথে আলুভাজি নিয়ে রক্তিমকে এসে বসতে বলে খেতে শুরু করে দিল জোনাকি। রক্তিম : কেমন লাগছে আমার আয়োজন? জোনাকি : লা জওয়াব, আর তুমিতো এদ্দিনে জেনে গেছো আমার পছন্দ-অপছন্দের বিষয় -আসয়গুলো সম্পর্কে। : তবুও জিজ্ঞেস করলাম। : কেন, প্রসংগ খুঁজে পাচ্ছ না? কেন জানতে চাচ্ছ না, কেন হুট করে চলে এলাম দু’দিনের নোটিশে? : তুমি তো এমনটাই। হুট-হাট করে চলে আস। আর, এভাবে হঠাৎ চলে আস বলেই তোমার আসা এবং অবস্থানকালটা ভীষণ প্রাণবন্ত হয়ে উঠে নিমেষেই। : ইটস মাই প্লেজার। সত্যিই কি আমার এমন আসা-যাওয়াটা মন দিয়ে ফিল কর তুমি? : তা আর বলতে। ‘আধার ঘনায়েছে বনে বনে…’। : এটাতো জয়তীর কন্ঠ না! : ঠিকই ধরেছো। : তা’হলে কার? : দেবাংগনা সরকারের কন্ঠে শুনছো, তোমার কাছে কেমন লাগছে? : বেশ ভালোইতো লাগছে।
এতদিনতো জয়তীর কন্ঠেই গানটি শুনে আসছিলাম। কিন্তু দেবাংগনার কন্ঠে এক ভিন্ন আমেজ এনেদিল যেন। : আমিও যখন দেবাংগনার কন্ঠে প্রথম শুনি, অবাক হয়ে শুনছিলাম সে দিন। : নতুন কোন মুভি দেখলে? : হ্যাঁ, আমারতো সময়গুলো এসব দেখে-শুনেই কেটে যায়। কাজ শেষে যতটুকু সময় পাই তা মুভি দেখে, বই পড়ে, গান শুনে কাটাই। আর ছুটির দিনগুলোতে ঘুরে ফিরে নতুন কোন শহর, আমার অদেখা কোন স্থান কাছে কিংবা দূরের। সাথে ছবি তোলা তো থাকছেই। : তোমার সাথে আমারতো এজন্যই এতো মিল, তোমার মতো আমারও গান শুনতে, বই পড়তে, মুভি দেখতে কিংবা একটু বেশি সময় হাতে পেলে বেড়ানো চাই। : এ সপ্তাহে দুটো মুভি দেখে ফেললাম ‘কন্ঠ’ ও ‘কমফোর্ট’। কমফোর্ট ছবিটি দারুণ প্রেমের ছবি, প্রাইজ উইনিং ছিল।

হাসান আজিজুল হকের গল্প সংগ্রহ পড়তে শুরু করেছি শেষ হলে তোমাকে পড়তে দেবো। হাসান আজিজুল হকের প্রথম লেখা পড়ি কলেজে পড়াকালীন সময়ে ‘আত্মজা একটি করবী গাছ’। অদ্ভুত নির্মাণ শৈলী। কথা-মালার বুনন, আবেগ, অনুভূতির অসিম বহিঃপ্রকাশ। প্রায় প্রতিটি ধাপে ধাপে। নিমগ্ন হয়ে এক নিমেষেই পড়ে ফেলার মতো। যেমন খুঁজে পাওয়া যায় আমাদের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তের টানা-পোড়েনের চিত্র তেমনি সহজ-সরল গ্রামীণ কিংবা উপ-শহরে বসবাসরত জনগণের যাপিত জীবনের স্নেহ-ভালোবাসা প্রকাশের এক নিদারুন প্রয়াস। মানবিক ভালোবাসার বিষয়গুলো বার বার ফিরে আসে অজান্তেই তার লেখাসমূহে। ‘আত্মজা একটি করবী গাছ’ গল্পটি পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে আমাকে থমকে যেতে হতো ঘটনা প্রবাহের সু² চিত্রসমূহ অবলোকন করে। লেখকের মমত্ববোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতা সংবেদনশীল লেখনীতের মাধ্যমে সুবিন্যস্ত। : তুমি দেখছি ক্লাশের শিক্ষক সেজে গেলে। : আরে, তাইতো! তোমাকে পড়াচ্ছি নাকি? : তোমার পড়া হলে আমাকে দিও, পড়ে ফেলবো। : মাঝে মাঝে এমন অনেক লেখক খুঁজে পাওয়া যায় অসাধারণ কিছু লেখা নিয়ে আসে পাঠকের জন্য। : খাওয়া শেষ করে কী করা যায়? : নতুন কোন মুভি দেখতে চাও? : না, তোমার তোলা ইদানীংকার ছবি দেখতে চাই। : ঠিক আছে দেখাচ্ছি। : তোমার নৈসর্গিক ছবিগুলো ভারি সুন্দর। : আসলে নদী, পাহাড়, গাছ-গাছালি আর গ্রামীণ ঘর-বাড়িগুলো আমাকে বেশি টানে, চোখে স্নিগ্ধতা এনে দেয়। : ঠিক বলেছো গ্রামীণ দৃশ্যগুলো যেন সুখময় নীড়ের সন্ধান খুঁজে পেতে সাহায্য করে চিরকাল। : তোমার ছবিগুলো দিয়ে টরন্টোতে একটি প্রদর্শনী করতে পার তো! : মাঝে মাঝে ভাবি করবো, কিন্তু ভরসা পাই না। : কেন ‘ভরসা পাই না’ বলছো? : কতটা মানসম্মত, দর্শক টানতে সক্ষম হবে আমি সন্দিহান। : কেউ না আসুক আমিতো আসছি। কেন যে শুধু শধু এতো ভাব। নেক্সট সামারেই হবে, কি বল? প্রয়োজনে তোমাকে সাহায্য করতে আগে-ভাগেই চলে আসবো না হয়। : ঠিক আছে করবো, তোমার ইচ্ছা পূরণে আমি সদা প্রস্তুত। ডেট ঠিক করে তোমাকে জানাবো। হাতে একটু সময় নিয়ে চলে এসো, আমার ভীষণ উপকার হবে। : তা’ আর বলতে, দেখে নিও সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে এসে হাজির।

মানুষের সব ইচ্ছে কি সবসময় পূরণ হয় না? কিছু কিছু ইচ্ছে অধরা থেকে যায় আজীবন, রঙিন ঘুড়ি হয়ে উড়তে থাকে মন আকাশে। : বাহ! তুমিতো কবি হয়ে যাচ্ছ আজকাল, ভালোইতো – আলোক চিত্রি, নবীন কবি কত কি? : ক্যালগেরি আসছো কবে? কতবারইতো বললে ‘রকি মাউন্টেন’ তোমার খুব প্রিয়। চলে আস অনেক ভাল লাগবে, ছবি তোলার বিষয়বস্তু পেয়ে যাবে অনেক। : আসলে অফিসের কাজের চাপটা ঠিক এ সময়গুলোতেই বেড়ে যায়, কোথাও যে দু’দিনের জন্য যাবো তা আর হয়ে উঠে না। এই যে তুমি যেতে বললে, ভীষণ ইচ্ছে জাগলো মনে মনে। কিন্তু, যাওয়া সম্ভব হবে কিনা জানি না। দুঃখটা তখন দ্বিগুণ হয়। : কাল বিকেলের ফ্লাইটে ফিরে যাবো। : তার মানে কি? ‘এসেই বলে যাই…’। এত তারা কিসের পরশু দিনও তো ছুটি।! : জানি আমি। কিন্তু জরুরি একটি কাজে কালই ফিরতে হচ্ছে। : তাহলে দু’দিন পরই না হয় আসতে হাতে সময় নিয়ে। ভেবেছিলাম দু’জনে মিলে ব্লু মাউন্টেনে যাবো উইক এন্ডে।

ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে রাতভর চলবে দু’জনের আড্ডা। : আমার হঠাৎ চলে আসার একটি কারণ ছিল, তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা বলা। : কী কারণ তাহলে এখনই বলতে শুরু করে দাও। : না, এ যাত্রায় হচ্ছে না, বরঞ্চ তুমিই ক্যালগেরি চলে আসো, তখনই না হয় সব বলা যাবে। : হুট করে আসারই বা কী দরকার ছিল, যদি বলতেই না পারবে! : এই যে তোমার সাথে দেখা হলো, রাতভর গল্প, এসব কম কিসের বল? জোনাকি চলে যাবার পর নির্ঘুম রাতের প্রহর গুনেছি। কী এমন কথা ছিল বলা হলো না তার। অতলান্তিক ভাবনার আঁধারে নিমজ্জিত হয়ে যাই নিজের অজান্তেই। ভোরের আলো এসে আমাকে টেনে তোলে অন্ধকারে গভীর গহ্বর থেকে। ঝুল বারান্দায় এক চিলতে সোনালী রোদের মতন প্রতিদিন জোনাকি এসে আবার চলে যায় তার নিয়মেই, তার ইচ্ছায়। সেই রোদের সোনালী আভার কিছুটা উষ্ণতার রেশ থেকে যায় মনের জানালায়।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক, আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা