শুজা রশীদ : (পূর্ব প্রকাশিতের পর)
৭.
দরজার সামনে যে লোকটি দাঁড়িয়ে তার সুঠাম দেহ এবং পোড়াটে বাদামী বর্ণে তাকে রুক্ষ কিন্তু সুদর্শণ দেখায়। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং পুরুষ্ঠ ঠোঁট তাকে দিয়েছে এক ধরনের কাঠিন্য। আর দু’ দশজন দক্ষিণ এশিয়দের তুলনায় সে কিঞ্চিৎ লম্বা, চুল ছোট করে ছাঁটা, জুলফি নেই বললেই চলে। টাইট জিন্স আর আঁটসাঁট কালো টি-শার্টের নীচ দিয়ে তার ঢেউ খেলানো বাইসেপ এবং দৃঢ় তলপেট উঁকি দিচ্ছে। তার মাথায় গুঁজে রাখা সানগ্লাসটা দেখে খুব মূল্যবান, সমসাময়িক ফ্যাসন সম্মত মনে হয়। রিমা জানে নিজেকে সবার কাছে সফল বলে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য লোকটা কতখানি শ্রম দিয়ে থাকে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, সে না টম ক্রুজ না একশন জ্যাকসন। সে হচ্ছে নিছকই এক ভদ্রবেশী ইতর।
পিন্টু ছোট ছোট কয়েকটা পদক্ষেপ নিয়ে দোকানের ভেতরে প্রবেশ করে, সানগøাসটা হাতে তুলে নিয়ে প্যান্টের পেছনের পকেটে গুঁজে রাখে, সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু শেলফগুলোতে চোখ বোলায়, সাজিয়ে রাখা শাক সব্জীর ঝুড়িগুলো দেখে অবহেলায়, তারপর প্রথমবারের মত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা নীরব, ভাবলেশহীন রিমার দিকে। এই লোকটি একটি উপদ্রব। সে কখন কি ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করবে বলার কোন উপায় নেই। কিন্তু একটা ব্যাপার রিমা বুঝে গেছে, তাকে কাঠিন্য দেখাতে হবে। শীকারী জন্তুর মত পিন্টু প্রতিপক্ষের ভীতি ঝট করে অনুভব করতে পারে এবং তার প্রতিক্রিয়া হয়ে ওঠে ভয়াবহ।
পিন্টু মনে হয় ভেবেছিল তার দর্শণে রিমা ভয় পেয়ে যাবে, কাঁপাকাঁপি শুরু করবে। কিন্তু রিমার শীতল দৃষ্টি আর কঠিন মুখ দেখে তার নিজের আস্থায় মনে হয় কিঞ্চিৎ নাড়া লাগল।
“আমার দিকে এমন আগুণ হয়ে তাকিয়ে আছো কেন? চোখ দিয়ে জ্বালিয়ে দেবে নাকি?” মুখে বাঁকা একটা হাসি ফুটিয়ে বলল পিন্টু।
রিমা কাউন্টারের উপর রাখা তার সেলফোনটা হাতে তুলে নেয়। “আমি ডিটেকটিভ মার্সেলকে কল করছি।”
“কি জন্য?” পিন্টু বাতাসে দুই হাত ঝাঁকিয়ে কন্ঠে বিদ্রুপ নিয়ে বলে। “আমার দোকানে আসাই মানা? কে বলেছে তোমাকে? দেখাও কোথায় লেখা আছে- পিন্টু ঢাকা গ্রোসারীতে আসতে পারবে না! পারবে দেখাতে? পারবে?”
মার্সেলের ফোন নাম্বার রিমার স্পিড ডায়ালে। লোকটার ফোন বাজছে। মানিক দোকানের অন্য পাশে ছিল। পিন্টুর কন্ঠ নিশ্চয় তার কানে গেছে কারণ সে তাড়াহুড়া করে কাউন্টারের কাছে চলে এলো। পিন্টুকে এই এলাকায় কেউই খুব একটা পছন্দ করে না, সম্পূর্ণ বাংলাদেশী কমুউনিটিতেই তার জনপ্রিয়তা খুব স্বল্পই। তার উগ্র ব্যবহার, নিয়ন্ত্রণহীন ক্রোধ এবং বড় ছোট নির্বিশেষে সকলকে তুচ্ছ করবার বাতিক তাকে করে তুলেছে অধিকাংশের কাছেই বর্জনীয়।
নিজের দোকানে তার উপরস্থিতি মানিকের কাম্য নয়। রিমার সাথে লোকটা যা যা করেছে তার পরে তো নয়ই। দেশী বিদেশী সব কাগজেই সেই সব তথ্য বিস্তারিত মুদ্রিত হয়েছে, এই এলাকায় সবাই জানে তার বিরুদ্ধে আদালত একটা রেস্ট্রেইনিং অর্ডার জারি করেছে, রিমা এবং তার বাচ্চাদের এক শ’ ফুটের মধ্যে তার যাওয়া মানা।
“পিন্টু! খবর কি ভায়া?” মানিক মুখে এক টুকরা হাসি ঝুলিয়ে বলে।
“আরে, মানিক ভাই!” পিন্টু সোৎসাহে বলে। “এই রকম একজন মহিলাকে আপনি এখনও কাজে রেখেছেন কেন? আপনার দোকানের একটা খ্যাতি আছে, যাকে তাকে এখানে কাজ করতে দেয়াটা আপনার উচিৎ না। ওকে বিদায় করে দেন। ওর জন্য আপনার অনেক ফালতু ঝামেলা হবে।”
“ভায়া, মাথাটা একটু ঠান্ডা রাখো,” মানিক শান্ত থাকবার চেষ্টা করে। এই ব্যাটা আগেও পুলিশি সমস্যায় পড়েছে। এখন এতো ভদ্র ভাবে কথা বললেও হঠাৎ যে তেড়ে উঠে অসম্মানজনক কথা বর্তা বলতে শুরু করবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
রিমা ত্রস্থ ভঙ্গিতে অপেক্ষা করছিল কখন ডিটেকটিভ ফোন ধরবে। বার পাঁচেক রিং হবার পর ভয়েস মেইলে চলে গেল। এই ধরনের পরিস্থিতিতে ভয়েস মেইল রাখার কোন যৌক্তিকতা আছে কিনা বুঝতে পারছে না। পিন্টূ কি মতলব নিয়ে এসেছে কে জানে। শুধুমাত্র ওকে একটু জ্বালাতে এসেছে নাকি কোন খারাপ উদ্দেশ্য আছে? পিন্টুকে বোঝা দুষ্কর।
পিন্টুর নজর মানিকের উপর থেকে রিমার ফোনের উপর ছিটকে পড়ল। ডিটেকটিভের ভয়েস মেইলের স্বাগত বার্তা শুনে থাকবে সে। দ্রুত এক পা এগিয়ে এক হাতের ঝটকায় রিমার হাত থেকে ফোনটাকে মেঝেতে ফেলে দিল সে। “কাকে কল করছ? তোমার ধারণা আমি যদি সত্যি সত্যিই তোমার ক্ষতি করতে চাই ঐ শালা ডিটেকটিভ তোমাকে বাঁচাতে পারবে?” রাগে কাঠের কাউন্টারের উপর ধাম করে একটা কিল বসায়, থরথর করে কেঁপে ওঠে সেটা। রিমা এক লাফে পিছিয়ে যায়, একেবারে কাউন্টারের পেছনের দেয়ালে সেঁটে থাকে। “মানিক ভাই! ওকে চলে যেতে বলেন। প্লিজ!”
মানিক সাবধানে পিন্টুর দিকে এক পা এগোয়। কাউন্টারটা ভাংলে কয়েক শ’ ডলার গচ্চা। পিন্টুর কাছ থেকে কিছু পাবার কোন সম্ভাবনা নেই। “পিন্টু! প্লিজ যাও! আর পুলিশী ঝামেলায় জড়ানো তোমার ঠিক না। আমি তোমার বড় ভাইয়ের মত। আমার কথা একটু শোন!”
পিন্টু কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজের চোখ বন্ধ করে, তাকে দেখে মনে হয় সে বাস্তবিকই নিজেকে শান্ত করবার চেষ্টা করছে। তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আলগা হয়, উত্তেজিত মাংপেশীগুলো শিথিল হয়। “সরি মানিক ভাই, ঝামেলা করতে আসি নি। ওর সাথে আমার কথা বলা দরকার। কিন্তু সে কোন কথা বলতেই রাজী না।” তারপর রিমার দিকে ফিরল। “চল, কোথাও গিয়ে ভদ্রভাবে দুইটা কথা বলি। আমাদের মধ্যে যে সমস্যা আছে আমি সেটা মিটিয়ে ফেলতে চাই। যাবে? প্লিজ?”
রিমা মেঝে থেকে নিজের ফোনটা তুলল। চেক করল। না, কাজ করছে। কেস ছিল বলে বেঁচে গেছে। লাইনটা কেটে গেছে। সে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ল। “তোমার সাথে আমার কথা বলার কিছু নেই।”
পিন্টু কাউন্টারের উপর দুই হাত রেখে তার মুখের সামনে নিজের মুখ নিয়ে এলো। “তাই? কিচ্ছু বলার নেই?” কন্ঠে ঘৃণা নিয়ে বলে সে। “ভেবেছ আমাকে বোকা বানাতে পারবে? তুমি আমার ভাইকে খুন করেছ। আমার একমাত্র ভাই ছিল সে। প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত আমি থামব না। মনে রেখ!” কাউন্টারের উপর জোরে থাপ্পড় মারে সে।
রিমা পিছিয়ে গিয়ে আবার দেয়ালের সাথে সেঁটে যায়। এক মুহুর্তের জন্য ভেবেছিল পিন্টু হয়ত তাকে আঘাত করতে যাচ্ছে, কিন্তু লোকটা যখন রাগ দেখিয়ে দপ দপ করে হেঁটে দোকান থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সে।
মানিক পিন্টুর পিছু নেয়, প্রধানত যাবার পথে কাঁচের দরজাটার কোন ক্ষতি না করে সেটা নিশ্চিত করবার জন্যেই। ভাগ্যবশত তেমন কিছু করল না পিন্টু। এমন চালু একটা দোকান চালানো সহজ কথা নয়। প্রচুর খরচ আছে। ক্ষয় ক্ষতি সামাল না দিলে ব্যবসা লাটে উঠবে। পিন্টু যতক্ষণ না দোকানের পাশেই পার্ক করা তার গাড়ীতে উঠে রাস্তায় নামল সে বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকল।
“দিনকে দিন মাথায় মনে হয় আরও বেশি গোলমাল দেখা দিচ্ছে,” ভেতরে ঢুকে রিমাকে লক্ষ্য করে বলে মানিক।
রিমা নীরবে আবার ডিটেকটিভ মার্সেলকে কল করল। সে তাকে বলেছে এই ধরনের কোন ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে তাকে জানাতে। দেরী করলে মনে হতে পারে রিমা খুব একটা ভয় পায় নি। পিন্টু কোর্টে গিয়ে জাজকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে এই সবই একান্তই পারিবারিক ব্যাপার এবং এর মধ্যে তার কোন খারাপ অভিসন্ধি নেই। সুতরাং রেস্ট্রেইনিং অর্ডারটা তুলে নেয়া উচিৎ। সৌভাগ্যবশত জাজ রিমার পক্ষ নেন। তার চোখের সামনেই রিমাকে লক্ষ্য করে পিন্টুর গালি গালাজ করাটা তিনি খুব ভালো নজরে দেখেননি। গর্দভটা তার সামনেই রিমার ক্ষতি করবার হুমকিও দিয়েছিল। জেলে যে যায় নি তার কপাল ভালো বলতে হবে। একমাত্র ভাইকে হারিয়ে বেচারা দুঃখে বেদনায় জর্জরিত হয়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে এই অজুহাতে তাকে এবারের মত রেহাই দিয়েছেন জাজ।
৮.
ডিটেকটিভ মার্সেল রাসেলের নাম শুনলেই ধরে নেয়া যায় যে সে ফ্রেঞ্চ কানাডিয়ান। বাল্যকাল এবং তারুণ্যের অধিকাংশ সময় কেটেছে মন্ট্রিয়লের নিকটবর্তি এক ছোট শহরে, পরে টরন্টো এসে যোগ দেয় পুলিশে। তার রয়েছে সুন্দরী স্ত্রী এবং তিনটি চমৎকার সন্তানÑ দুটি ছেলে যাচ্ছে হাইস্কুলে, মেয়েটা মাত্র টিন এজার হয়েছে এবং খুব ঝামেলা করছে সব কিছু নিয়ে। রিমার কাছে মেয়ের কথা বলতে গিয়ে অবশ্য তাকে খুব একটা উদ্বিগ্ন মনে হল না। বোঝাই যায় মেয়ে অন্ত প্রাণ তার। ছেলে দুটির মধ্যে একজন আইস হকি খেলে, অন্যজন আমেরিকান ফুটবল। দু’জনাই ভালো খেলছে এবং সব কিছু যদি পরিকল্পনা মাফিক হয় তাহলে হয়ত প্রফেশনাল লীগেও খেলতে পারে। ঐ দুটি খেলার কোনটি সম্বন্ধেই রিমার কোন জ্ঞান নেই। তার পছন্দ সকার আর ক্রিকেট।
জুলাইয়ের ৫ তারিখের পর রিমার সাথে কম করে হলেও কয়েক ডজন বার দেখা করেছে সে। দীর্ঘদেহী, ছয় ফুট দুই তিন ইঞ্চি তো হবেই, হালকা পাতলা গড়ন, মাথায় পাতলা হয়ে আসা স্বরণালী চুল, সাধারণত দাঁড়ি মোচ চাঁছাই থাকে, একটু সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটে, শরীরের মাঝখানে কিঞ্চিৎ বক্রতা তৈরি করে, প্রতি পদক্ষেপের সাথে সাথে তার উর্ধাংগ দোলে। তার বিনীত মুখে এক জোড়া বন্ধুত্বপূর্ণ চোখ, হাসি হাসি। তাকে পছন্দ না করাটা কঠিন। তার আচরণ কথা বার্তা এমন যে প্রথম পরিচয়েই তাকে রিমার পছন্দ হয়েছিল। ওর বিশেষ করে ভালো লেগেছিল লোকটার আন্তরিক ভাবটুকু, এমনকি যখন সে অবাঞ্ছনীয় প্রশ্ন করছে, খুব ব্যাক্তিগত প্রসঙ্গে কথা বলছে, তখনও তার কন্ঠে থাকে এক সহানুভূতির পরত।
মার্সেল মসল্লাভারী খাবার পছন্দ করে, বিশেষ করে দেশী সমুসা, সিঙ্গাড়া, পেঁয়াজু, ডাল পুরি জাতীয় তেলে ভাজা মুখরোচক খাবার।
রিমার সাথে যখনই কথা বলতে এসেছে তাকে নিয়ে গেছে ড্যানফোর্থের কোন না কোন একটা বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে। রিমাই তাকে বাংলাদেশী খাবারের সাথে পরিচিত করেছে, খানিকটা বহুল পরিচিত ভারতীয় খাবারে মত কিন্তু কিছু পরিষ্কার পার্থক্য আছে। রিমা তাকে একবার জোর করেছিল মাছ ভাত খাবার জন্য। সে খেয়েছিল। মাছের তরকারীটাতে অল্প একটু ঝাল ছিল, কিন্তু সেইটুকুও তার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশী। সে পুরো একটা জগ ভর্তি ঠান্ডা পানি খেয়েছিল। খুব হেসেছিল রিমা। মার্সেল মানুষটা মজার। ঝালে জর্জরিত মুখ এবং রক্তিম জিভ যেটা দেখে মনে হচ্ছিল মৌমাছি হুল ফুটিয়েছে, গøাশ থেকে ঢক ঢক করে পানি খেতে খেতে সেও তার হাসিতে যোগ দিয়েছিল।
মার্সেল সশরীরে আসবে আশা করে নি রিমা। কিন্তু তার ভয়েস মেইলে পিন্টু শব্দটা শুনে নিশ্চয় সে তার গুরুত্বটা অনুধাবন করেছে। ঢাকা গ্রোসারির দুই দোকান ওপাশে ছোট্ট একটা বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট আছে – সুস্বাদু। মার্সেল এসেছিল ঠিক দুপর বারোটায়, মানিকের সাথে সংক্ষপে আলাপ সেরে রিমার কর্ম বিরতির ব্যবস্থা করে তাকে নিয়ে আসে সুস্বাদুতে, একটা কোনার টেবিলে জাঁকিয়ে বসে তার প্রিয় ভাজাভুজির অর্ডার দেয়। খেতে খেতে কথা বলে সে, মূলত তার টীনএজ মেয়ে আর তার যাবতীয় উদ্ভট কর্মকান্ড নিয়ে, মুখে ঝুলে থাকে এক সহিষ্ণু হাসি। রিমা নীরবে তার কথা শোনে, এমনকি কষ্ট করে হাসেও, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে পিন্টুকে নিয়ে কথা বলতে উদগ্রীব হয়ে থাকে। পিন্টুর কিছু একটা হওয়া উচিৎ। এভাবে কোর্ট অর্ডার তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে তার কাজের জায়গায় চলে এসে তাকে ভয় দেখাতে পারে না সে। কোর্ট অর্ডারের তাহলে দাম কি? পুলিশই বা কি করতে আছে?
খেতে খেতে হাত উঁচিয়ে দু’জনার জন্য দুই কাপ দুধ চায়ের অর্ডার দিল মার্সেল। চা চলে এলো ঝট করে। নিজের কাপে একটা চুমুক দিয়ে রিমার দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে শান্ত গলায় বলল, “পিন্টুর সাথে আমার কথা হয়েছে। ভেব না। আর কোন ঝামেলা করবে না। ভয় পাবার কিছু নেই। ঠিক আছে, রিমা?”
রিমার বুকের মধ্যে আলোড়ন ওঠে। তার ভাবতে ইচ্ছে হয় এই লোকটা বুঝতে পারছে কি ধরনের জঘন্য সময়ের ভেতর দিয়ে চলেছে সে। মাত্র দুই মাসে তার পুরো জগত মুখ থুবড়ে পড়েছে। পিন্টু পরিস্থিতি অসম্ভব রকম অসহনীয় করে তুলেছে। তার ক্রমাগত আক্রমনে নিজেকে দূর্বল, অসহায় মনে হয় রিমার।
“তোমার কিছু একটা করা উচিৎ,” রিমা জোর দিয়ে বলে। “ওর যা ইচ্ছা ও তাই করছে। ওর কিছু একটা শাস্তি হওয়া উচিৎ।”
মার্সেল তার বাহুতে আলতো করে চাপড় দেয়। “তোমার এখানে আসার পথে ওর রেস্টুরেন্টে থেমেছিলাম। অনেক রাগ করেছি। ভয়ও দেখিয়েছি। এই এলাকায় টহল দেয় এমন কয়েকজন পুলিশ অফিসারকে আমি ভালোমত চিনি। তাদের সবাইকে আমি তোমার কথা বলে রেখেছি। বেশী চিন্তা কর না। আর কোন ঝামেলা হবে না। চা খাও। চাটা দারুণ!”
পিন্টুর সাথে মার্সেলের কি আলাপ হয়েছে রিমা জানে না কিন্তু সে তেমন আস্থা পায় না। প্রতিবার একই কথাই বলে মার্সেল। কয়েকটা দিন একটু শান্তিতে কাটে তারপর পিন্টু আবার যেইকে সেই। তার নিজেকে ক্ষুদ্র, ভঙ্গুর মনে হয়। চাইলে মার্সেল আরোও কিছু করতে পারত, পারত না? কোর্ট অর্ডার ভাঙ্গার জন্য পিন্টুকে কি এরেস্ট করা উচিৎ ছিল না?
মার্সেল মনে হয় তার মনের কথা বুঝতে পারে। সে আরোও একটু ঝুঁকে এসে প্রায় ফিসফিসয়ে বলে, “একটা কথা তোমাকে বলি, মানুষ যখন বেপরোয়া হয়ে ওঠে তারা জঘন্য কাজ কর্ম করতে পারে। আমি যদি ওকে এখন এরেস্ট করি ও বেইল নিয়ে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত আবার তোমার পেছনে এসে পড়বে। এই জাতীয় ঘটনা সবসময় দেখছি। কিছু কিছু মানুষ রাগের মাথায় অমানুষিক কাজকর্ম করতে পারে। পিন্টু কি ধরনের মানুষ আমি জানি না কিন্তু সেই ধরনের কোন ঝুঁকি আমি নিতে চাই না। কি বলছি বুঝতে পারছ?”
রিমা মাথা নাড়ে। যা হয়েছে তার চেয়ে খারাপ আর কি হতে পারে? “কিন্তুৃকিন্তুৃও তো যা ইচ্ছা তাই করছে। করছে না?”
মার্সেল সহিষ্ণুভাবে হাসে। “বিশ্বাস কর, পরিস্থিতি এর চেয়ে অনেক গুণ খারাপ হতে পারে। নিজের চোখে দেখেছি। পাত্তা দিও না ওকে। রাতের বেলা কে যেন দরজায় টোকা দিচ্ছিল, বন্ধ হয়েছে?
“কাল রাতে হয়েছে আবার,” রিমা ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে। “আমার মেয়ে আমাকে ডেকে তোলে। খুব ভয় পেয়েছে। ওটা কি পিন্টু করছে? আর কে করবে? এমন নোংরা মানসিকতা আর কার হতে পারে?”
মার্সেলকে চিন্তিত দেখাল। “মনে হয় না। অত রাতে এজিনকোর্ট থেকে ক্রিসেন্ট টাউনে ড্রাইভ করে যাওয়াৃবিল্ডিংয়ের ভেতরেই বা ঢুকবে কি করে?”
“ওর কোন বন্ধু হয়ত থাকে আমাদের বিল্ডিংয়ে,” রিমা বলে।
মার্সেল মাথা দোলাল। “সম্ভব। দরজায় টোকা দিয়ে ভয় দেখানোর জন্য এতো খাটুনী করবে ও? আমি দেখব কি করা যায়। দরজা ভেতর থেকে ভালো করে বন্ধ করে রেখ। ঠিক আছে?”
রিমা মাথা দোলায়। এই লোকটার কাছ থেকে হয়ত একটু বেশীই আশা করছে সে। মাত্র মাসখানেক আগে স্বামী হত্যার অভিযোগে সে রিমাকেই প্রায় জেলে ঢুকিয়ে ছেড়েছিল। যখন বুঝতে পেরেছে যে রিমাও এই সমগ্র ঘটনায় একজন ভুক্তভোগী মাত্র, তার আচরণ সম্পূর্ণ পালটে গেছে। এখন মনে হয় সে আন্তরিকভাবেই রিমাকে নানাভাবে সাহায্য করতে চায়।
মার্সেল ওকে ঢাকা গ্রোসারী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বিদায় নেবার আগে হাত মেলাল।
মানিক ওকে দেখে দরজার সামনে এগিয়ে এলো। “সব ঠিকঠাক আছে?”
“হ্যাঁ,” রিমা সংক্ষেপে বলে। “বলল পিন্টুর সাথে কথা বলেছে।”
“পিন্টু বেশী আওয়াজ করে,” মানিক বলে, একরকম অবজ্ঞা ভরে। কিন্তু তার কন্ঠের উদ্বেগটুকু ধরতে রিমার কষ্ট হয় না। লোকটার প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতা অনুভব করে সে। অন্য কোন দোকানের মালিক হলে হয়ত ফালতু ঝুট ঝামেলা হবে সেই ভয়ে তাকে কাজ থেকে অব্যহতি দিত। মানিক তাকে সমর্থন করছে, এই বিপদের মধ্যে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শেফালী চেষ্টা করেছিল তার স্বামীর মত পাল্টাতে কিন্তু এই ব্যাপারে মানিক নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থেকেছে। এটা নিয়ে কিছুদিন ধরে স্বামী স্ত্রীতে ঝামেলাও চলছে। নিজের স্বামীর চরিত্র নিয়ে শেফালীর সন্দেহ চিরায়ত। রিমা এমনও শুনেছে সে নাকি মানিকের কাছে সরাসরি জানতে চেয়েছে রিমার প্রতি তার কোন দূর্বলতা আছে কিনা। মানিক স্বভাবমত হেসে উঠেছে। তাতে শেফালীর সন্দেহ আরোও বদ্ধমূল হয়েছে। রিমা নিজেকে এই সমস্ত উটকো সমস্যা থেকে যতখানি সম্ভব দূরে রাখে। এখন ওর যে নাজুক অবস্থা, মানিকের এখানে যতদিন সম্ভব কাজ করে যাওয়াটা ওর জন্য জরুরী। যাতায়াতে সুবিধা, কাজের সময়টাও যথেষ্ট শিথিল। মনে মনে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা তৈরী করছে ও, কিন্তু সে সব রাতারাতি হবে না।