শুজা রশীদ : (পর্ব ৬৫)
মরিয়ম দৌড়ে রিমার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। “তুমি ঠিক আছো? আমার হাত ধর। তোমার বাড়ি আর দোকানে আগুন লেগেছে বললে?” মরিয়ম এক হাত বাড়িয়ে রিমাকে ধরে যেন পড়ে না যায়।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ,” রিমা ক্লান্ত গলায় বলে। “ঐ করিয়েছে,” পিন্টুর দিকে আঙ্গুলি দিয়ে দেখায় ও। “রবের যদি কিছু হয় ওকে আমি খুন করব। কসম আল্লাহর!”
পিন্টু এপাশ ওপাশ মাথা দোলাল। “না! না! এই জাতীয় কাজ আমি কখন করব না। আগুন কখন ধরেছিল? কিভাবে?”
লাট্টু কয়েক পা এগিয়ে দ্রুত রিমার কাছাকাছি চলে এলেন। “রবিন ওঈট তে বললে?” তার কন্ঠ ভয়াবহ কোন সম্ভাবনার কথা ভেবে কেঁপে ওঠে।
রিমা মাথা দোলায়। “হ্যাঁ। আমার ছেলেটার অবস্থা খুব খারাপ।”
নীতা লাট্টুর পিছু পিছু উঠোনে চলে এসেছিলেন। দূর থেকে রিমাকে দেখতে পেলেও তার কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলেন না। “পিন্টু! কি হয়েছে রে? এই পিন্টু!” তিনি জোরে জোরে ছেলেকে ডাকলেন।
“মা, কেউ রিমা ভাবীর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। রবিন ICU তে।” পিন্টুর কথা শেষ হবার আগেই টলে পড়ে যাচ্ছিলেন নীতা। পিন্টু দৌড়ে গিয়ে পড়ার আগেই ধরে ফেলল মাকে। লক্ষ্য করল নীতা অজ্ঞান হয়ে গেছেন। লাট্টু স্ত্রীর কাছে দৌড়ে এলেন।
“কি হল? নীতা?”
“অজ্ঞান হয়ে গেছে,” পিন্টু বলল। “ভেতরে নিয়ে শুইয়ে দেই। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে।” মরিয়মের দিকে ফিরে বলল, “মরিয়ম, ভাবীকে বাসার ভেতরে নিয়ে এসো। কেউ পুলিশ কল করতে পারে। অকারণ ঝুট জামেলার কোন দরকার নেই।”
নীতাকে বাসার ভেতরে বয়ে নিয়ে গিয়ে একটা সোফায় শুইয়ে দিল ও। লাট্টু পানি নিয়ে এসে স্ত্রীর চোখে মুখে ছিটিয়ে দিতে থাকলেন।
পিন্টু গাড়িগুলোর চাবি নিয়ে এসে এলার্মগুলো বন্ধ করল। মরিয়ম রিমাকে বাসার মধ্যে নিয়ে এলো। রিমাকে দেখে ভীষণ ক্লান্ত আর অবসন্ন মনে হয়। ধপাস করে একটা চেয়ারে বসল। পিন্টু দ্রুত দরজা লাগিয়ে দিল।
“মা এখন কেমন আছে?” জানতে চাইল।
“জ্ঞান ফিরে আসছে,” লাট্টু বললেন।
পিন্টু রিমার সামনে গিয়ে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসল। “ভাবী, এই ঘটনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। এই ব্যাপারে আমি কিচ্ছু জানি না। আমাকে বিশ্বাস কর। আমি অনেক গাধার মত কাজ করেছি জীবনে কিন্তু এখন অনেক বদলে গেছি।”
“তুমি না করলে কে করল?” রিমা ডুকরে কেঁদে ওঠে। “তুমি ছাড়া আর কে আমার এতো বড় ক্ষতি করতে চাইবে?”
“কেউ যে ইচ্ছে করেই করেছে তেমনটা কেন ভাবছ?” পিন্টু জানতে চাইল।
“দুই জায়গাতেই একই রাতে আগুণ লাগার সম্ভাবনা কতটুকু?” রিমা বলল। “যেই করে থাকুক আমাকে বুঝিয়েই করতে চেয়েছিল। সেই জন্যেই একই রাতে দুই খানেই আগুণ ধরিয়েছে। ভেবেছিলাম তুমি করিয়েছ। এতো দিন ধরে যেভাবে আমার পেছনে লেগে ছিলে…”
“ও আর আগের মত নেই,” মরিয়ম বলল। “আমি হলফ করে বলতে পারি এই ব্যাপারে ওর কোন হাত নেই। এইবার বল, রবিন কোন হাসপাতালে?”
“স্কারবোর জেনারেল। স্মোক প্য়জনিং,” রিমা নীচু স্বরে বলল।
“ফায়জা আর জিব্রান?” মরিয়ম উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চায়।
“ওরা ভালো আছে।”
“যাক!” মরিয়ম বলল। “রবিনকে কখন দেখতে যাওয়া যায়?” পিন্টুকে লক্ষ্য করে বলল।
“আমাদেরকে এতো রাতে ভেতরে ঢুকতে দেবে বলে মনে হয় না,” পিন্টু বলল। “কাল সকালেই যেতে হবে।”
নীতার জ্ঞান পুরোপুরি ফিরে এসেছে। “ রবিন! রবিন কেমন আছে?” তিনি কেঁদে উঠলেন। “ও কি এখন ঠিক আছে? কেউ কিছু বলছ না কেন?”
“মা, বেশী চিন্তা কর না। ও ভালো হয়ে যাবে,” পিন্টু বলল।
নীতা নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। “পিন্টু, কে এই কাজ করেছে খুঁজে বের কর। আমি তাকে নিজের হাতে গুলী করব।”
“ঠিক আছে, মা,” পিন্টু বলল। “তুমি এখন বিশ্রাম কর।”
পুলিশের গাড়ীর সাইরেন কানে এলো ওর। “আমি ব্যাপারটা সামলাচ্ছি। বলব রিমা ভাবী আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে। গাড়ীর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিল। দূর্ঘটনা ঘটে গেছে। ওরা কোন সমস্যা করবে বলে মনে হয় না। কিন্তু ভাবীর গাড়ির অবস্থা বেশ খারাপ মনে হল। চালানো যাবে না। আজ রাতে আমাদের এখানেই থেকে যাক। কাল সকালে আমরা সবাই এক সাথে রবিনকে দেখতে যাবো।” শেষাংশটুকু মরিয়মকে লক্ষ্য করে বলা। মরিয়ম মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল।
“রিমা, ফায়জা আর জিব্রান কোথায়?” মরিয়ম জিজ্ঞস করল। “ইনস্যুরেন্স তোমার ক্ষয় ক্ষতির জরিপ না করা পর্যন্ত তোমার থাকার একটা জায়গা লাগবে। ততদিন আমাদের সাথেই থাকো।”
“হ্যাঁ, সেটাই সব দিক দিয়ে ভালো হবে,” পিন্টু সমর্থন জানাল।
“বাচ্চারা নোমানের সাথে,” রিমা সংক্ষেপে বলে। “আমি হোটেলে থাকব। মরিয়ম, তুমি নোমানকে একটা কল করবে? ও এসে আমাকে নিয়ে যাক।”
মরিয়ম মাথা দোলাল। “আচ্ছা, করছি। ওর নাম্বারটা তোমার মনে আছে?”
রিমা মাথা নাড়ল। মনে আছে।
১০১
ওর বাসার কাছেই একটা ডেইজি ইনে ও যখন চেক ইন করল তখন প্রায় ভোর হয়ে গেছে। নোমান ওকে রাতে পিন্টুর বাসা থেকে নিয়ে এসেছিল, তারপর ওরা বাড়ি এবং দোকানটা দেখতে গিয়েছিল। তারপর অফিসার ওমরের সাথে দেখা করতে যায়। ফায়জা এবং জিব্রান গাড়ীতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওদেরকে একাকী কোথাও রাখতে সাহস পায় নি রিমা।
হোটেল রুমে ঢুকে নোমান জিব্রানকে একটা বিছানায় শুইয়ে দিল। ফায়জার ঘুম ভেঙে গেছে। সে ভাইয়ের পাশে বিছানায় বসল। তার ক্লান্ত, উদ্বিগ্ন দৃষ্টি মায়ের মুখে নিবদ্ধ।
“তুমি এখন যাও,” নোমানকে লক্ষ্য কর বলল রিমা। “তোমার বিশ্রাম দরকার।”
“আচ্ছা।” নোমানকে দেখে ব্যাতিব্যাস্ত মনে হল না। যাবার আগে নিশ্চিত হতে চায় রিমার কোথাও কোন আঘাত লেগেছে কিনা। দেখে অবশ্য সুস্থই মনে হচ্ছে। এমার্জেন্সীতে নিয়ে গিয়ে চেক করিয়ে আনতে চেয়েছিল কিন্তু রিমা রাজী হয় নি।
“ঢাকায় তোমার বাসায় ফোন করেছিলাম,” নোমান বলল। “সবাইকে বলেছি তুমি সুযোগ পেলেই তাদেরকে ফোন দেবে। তারা ভীষণ চিন্তায় আছে।”
রিমা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমার ফোনটা কোথায়?”
গাড়ি থেকে রিমার হাত ব্যাগটা সাথে নিয়ে এসেছিল নোমান। তার ভেতরেই পাওয়া গেল ফোনটা। রিমার হাতে ধরিয়ে দিল। “এখন কল করবে?”
রিমা মাথা নাড়ল। হ্যাঁ।
“তাহলে আমি যাই এখন।” ফায়জার দিকে ফিরল নোমান। “প্রিন্সেস, তুমি ঠিক আছো?”
“হ্যাঁ,” ফায়জা ঘুম ঘুম চোখে বলল।
নোমান আলতো করে ওর মাথায় একটা চুমু দিল। “কিছুক্ষণ পরে আমরা সবাই মিলে রবিনকে দেখতে যাবো। আরেকটু ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা কর।”
ফায়জা ফুঁপিয়ে উঠল। “ও কি বাঁচবে?”
“অবশ্যই। অযথা দুশ্চিন্তা কর না।” নোমান দৃঢ় কন্ঠে বলল। যাবার আগে রিমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। মৃদু মাথা নাড়ল রিমা, মুখে কিছু বলল না। বাইরে করিডোরে বেরিয়ে এলো নোমান, দরজাটা লাগিয়ে দিল। নিঃশব্দে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। কি একটা দুঃস্বপ্নময় রাত গেল! প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে আংটিটা খুঁজল, পেল না। তারপর মনে পড়ল রিমা যখন আংটিটা ছূড়ে দিয়েছিল ও সেটা ধরতে পারেনি। এতো ঝুট ঝামেলায় সেটার কথা পুরোপুরি ভুলেই গিয়েছিলে। সেটা খুব সম্ভবত রিমার গাড়ীর মেঝেতে কোথাও পড়ে আছে। রিমার গাড়ী পিন্টুর ড্রাইভওয়েতে। পিন্টু কথা দিয়েছে ঠিকঠাক করিয়ে কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবে। আরেকটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল নোমান। আংটি চুলায় যাক। যার জন্য কিনেছিল সেই যখন ফিরিয়ে দিল তখন ওটা দিয়ে সে আর কি করবে। ওটা তার কাছে এখন সম্পূর্ণ মূল্যহীন।
ঐদিন বিকালে স্কারবরো জেনারেল হাসপাতালের ওঈট ইউনিটে রিমার পরিচিত বেশ কয়েকজন মানুষ জমায়েত হল। রিমা ফায়জা এবং জিব্রানকে নিয়ে বেশ কয়েক ঘন্টা আগেই চলে এসেছিল। ভীষণ ক্লান্ত থাকলেও একেবারেই ঘুমাতে পারে নি ও। ওর বাচ্চা মৃত্যুর সাথে যুঝছে আর ও নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে এই চিন্তা করতেও ওর কষ্ট হচ্ছিল। জিব্রানের ঘুম ভাঙার সাথে সাথে একটা উবার নিয়ে হাসপাতালে চলে এসেছে ও।
সকাল থেকেই অগুণিত মানুষের কাছ থেকে সমবেদনা পেয়েছে। বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত মানুষেরা ওকে নানা ভাবে সাহায্য করবার প্রস্তাব দিয়েছে। কেউ তাদের বাসায় থাকার জন্য জোরাজুরি করেছে, কেউ খাবার দিয়ে যেতে চেয়েছে, কেউ প্রয়োজন হলে টাকা পয়সা দিয়েও সাহায্য করতে চেয়েছে। ও সবাইকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছে কিন্তু কারো কাছ থেকে কিছু নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অনেকেই রবিনকে দেখার জন্য হাসপাতালে আসতে চেয়েছিল, তাদেরকে আসতে মানা করেছে। অকারণে ভীড় হয়ে যাবে, বাস্তবিক অর্থে কোন লাভই হবে না।
নিজের মধ্যে আচমকা যে দৃঢ়তা অনুভব করছে দেখে নিজেই বেশ আশ্চর্য হয়েছে রিমা। প্রথমে মনে হয়েছিল ওর সারা পৃথিবী যেন ধ্বসে গেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আবার নতুন করে সব গড়বার মত মনবল ওর এখনও আছে। যত পরিশ্রমই করতে হয় ও করবে কিন্তু কোন অবাস্থাতেই পরাজয় মানবে না।
মরিয়ম বাসার সবাইকে নিয়ে এসেছে। তার উপস্থিতি রিমাকে মনবল দেয়। মানিক এবং শেফালীও এসেছে। তারা তাদের একটা ভাড়া বাসা যতদিন ইচ্ছা বিনা ভাড়ায় রিমাকে থাকতে দিতে চেয়েছে। এসেছে রিমার এপার্টমেন্টের পরিচিত কিছু মানুষ। আসমা তার স্বামীকে নিয়ে এসেছে। লিয়াকত বউ বাচ্চা নিয়ে এসেছে। এমনকি রিমার কিছু কাস্টোমারও যাদের সাথে ওর বেশ সখ্যতা হয়েছে তারাও এসেছে।
অবশেষে এলো মিলা, তার ডাক্তার বন্ধুকে নিয়ে। সকালে রিমাকে ফোন করে ওর মোটেলেই আসতে চেয়েছিল কিন্তু রিমা মানা করেছিল। বলেছিল সরাসরি হাসপাতালে চলে আসতে। মিলা ভীড় ঠেলে ওর কাছে এসে ওকে শক্ত করে আলিঙ্গন করল। দুজনাই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদল। এক পর্যায়ে চোখের পানি মুছে মিলা বলল, “দেখো, সব আবার আগের মত হয়ে যাবে। রবিন একদম ভালো হয়ে যাবে।”
তার পর এলো ডিটেকটিভ মার্সেল তার স্ত্রীকে নিয়ে। তাকে বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দিতে চেয়েছিল রিমা কিন্তু তার স্ত্রী যেমন নম্র তেমনি মিষ্টভাষী। মহিলা তার মন জয় করে নিল খুব সহজেই। তার মুখের দিকে চেয়েই মার্সেলকে মন্দ কিছু বলা থেকে বিরত থাকল রিমা। চলে যাবার আগে রিমাকে এক পাশে সরিয়ে নিয়ে মার্সেল বলল,”জানি তুমি অনেক ক্ষেপে আছো কিন্তু এটাই আমার কাজ।”
“এই পৃথিবীতে যে একজন মানুষকে আমি বিনা বাক্য ব্যায়ে বিশ্বাস করতাম তুমি তাকেই আমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিলে,” রিমা রাগী গলায় বলে। “এটা তোমার করা উচিৎ হয় নি। তুমি একটা কালসাপ। তোমাকে বিশ্বাস করাই আমার ভুল হয়েছিল।”
মার্সেল কাঁধ ঝাঁকাল। “একটা কথা বলি, শুনে তোমার মন ভালো হয়ে যেতে পারে। নোমান আমাকে কিছুই বলে নি। একটা শব্দও না। আমি ওকে নানাভাবে অনেক চাপ দিয়েছিলাম, বলেছিলাম পুলিশকে সাহায্য করা ওর সামাজিক দায়িত্ব। সেই কারণেই ও রাজী হয়েছিল। বলেছিলাম তুমি যদি অপরাধী না হও তাহলে তোমার লুকানোর কিছুই থাকবে না। সেই ক্ষেত্রে নোমান তোমার মুখ থেকে এমন কিছুই জানতে পারবে না যা তোমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে। ওকে কথা দিয়েছিলাম ও যদি আমার কথা মত কাজ করে তাহলে তোমাকে আমার সন্দেহের লিস্ট থেকে চিরতরে মুছে ফেলব। বেচারা তোমাকে সাহায্য করবারই চেষ্টা করছিল। তাকে শাস্তি দেবার আগে সব কিছু চিন্তা করে দেখ।”
“আমি তাকে কোন শাস্তি দিচ্ছি না,” রিমা ভ্রূ কুঁচকে বলল। “কেন, সে কি তোমাকে কিছু বলেছে?”
“আরে না, আমাকে কিছুই বলেনি।” মার্সেলের স্ত্রী তাকে লক্ষ্য করে হাত নাড়ছিল। মার্সেল বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলে দ্রুত স্ত্রীর দিকে চলে গেল। ইতিমধ্যেই নোমানের যথেষ্ট ক্ষতি সে করেছে। কিছু বলে পরিস্থিতি আরোও মন্দ করে দিতে চায় না।
রিমা চারদিকে চোখ বোলাল। খেয়াল করল নোমান একটা দেয়ালের পেছনে দ্রæত লুকিয়ে পড়বার চেষ্টা করছে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আপন মনে মাথা নাড়ল। কে ভেবেছিল এই রকম কিছু একটা হবে? তারপর মনে পড়ল আংটিটার কথা। সেটা কোথায়? গাড়ীতে নোমানের দিকে ছুড়ে দিয়েছিল। ও কি ধরতে পেরেছিল? বেচারী নিশ্চয় অনেক টাকা খরচ করেছে ওটার পেছনে। হারিয়ে গিয়ে থাকলে রিমা খুব লজ্জায় পড়ে যাবে। সুযোগ মত নোমানকে জিজ্ঞেস করবে, মনে মনে স্থির করল ও।
১০২
কয়েক ঘন্টা পরে জনৈক ফায়ার মার্শালের সাথে দেখা করতে হল রিমাকে। ওর বাড়ি এবং দোকান পোড়ার দুটি কেসই একজনের হাতে গেছে। ভদ্রলোক মধ্যবয়েসী, কৃষ্ণাঙ্গ, তীক্ষ্ণ চোখ, সন্দিহান দৃষ্টি। বোঝাই যায় নিজের কাজ সে খুব গুরুত্বের সাথে নেয়। তার কথাবার্তা কাটা কাটা, প্রচুর নোট নেয় এবং একেবারেই হাসে না। তার নাম ডেমিয়েন জনসন। লোকটাকে রিমার পছন্দ হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে সৎ, চরিত্রবান। ও চেয়েছিল এমন কাউকেই ওর কেসগুলো দেয়া হোক। ওর লুকানোর কিছুই নেই। এই ভদ্রলোকের রিপোর্টে পরিষ্কার করে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন যে যা ঘটেছে তাতে রিমার কোন হাত নেই। ইন্সিউরেন্স কম্পানি যেন কোন সুযোগ না পায় ওর ক্লেইম ডিনাই করার। ওর যে ধরনের কভারেজ আছে তাতে অর্থনৈতিকভাবে খুব একটা লোকসান ওকে দিতে হবে না। রব যদি মৃত্যু মুখে না থাকত তাহলে ও হয়ত এই ব্যাপারটাকে তেমন পাত্তাই দিত না। এই জাতীয় ঘটনা ঘটেই থাকে। ওর জীবনে নতুন কিছু নয়।
ডেমিয়েন ওকে অনেক প্রশ্ন করল। রিমার মোটেলে ওর সাথে দেখা করতে এসেছিল সে। রিমা ফায়জা আর জিব্রানকে নোমানের সাথে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তিন জনে কোথাও থেকে ঘুরে আসুক। মুভি-টুভি দেখলে দেখতে পারে। ওরা দুই ভাইবোন হাসপাতাল থেকে আসতেই চায় নি। ওদের হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল ওরা যদি রবিনের দিকে দীর্ঘক্ষন তাকিয়ে থাকে তাহলে হয়ত রবিন ভালো হয়ে যাবে। রিমা তাদেরকে এক রকম জোর করেই মোটেলে নিয়ে এসেছিল। ওরা দুইজন অসুস্থ হয়ে পড়লে খুব বিপদে পড়ে যাবে ও। মিলা ওদেরকে তার ডাউন টাউনের কন্ডোতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু ওরা যেতে চায় নি। নোমানের সাথেই তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। রিমা অকারণে তাতে বাগড়া দিতে চায়নি। জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করবার আগে ওকে কিছু তথ্য জানাল ডেমিয়েন। “আমি দুই জায়গাতে সশরীরে গিয়েছিলাম। বুঝতে বেশী সময় লাগে নি যে দুটোই কোন মানুষের কাজ। কেউ গ্যাসোলিন ঢেলে ম্যাচ জ্বালিয়ে দিয়েছে। তুমি দেখতে গিয়েছিলে?”
রিমা মাথা নাড়ে। হ্যাঁ। বাড়িটা অনেক খানি পুড়ে গেছে, বিশেষ করে যে দিকটা দিয়ে বেসমেন্ট এপার্টমেন্টে ঢুকতে হয় সেই দিকের দেয়ালটা পুরোই পুড়ে গেছে। ঐ দিকেই হয়ত আগুণটা ধরান হয়েছিল। বেডরুমগুলো না পুড়লেও লিভিংরুমের অনেকখানি দগ্ধ হয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো যে ফায়ার ট্রাক ঝট করে চলে এসেছিল, আগুন বেশি ছড়ানোর আগেই নিভিয়ে ফেলা গিয়েছিল। দোকানের ক্ষতির পরিমান বেশ কম। এক দিকের দেয়াল আর শো রুমের খানিকটা অংশ পুড়ে গেছে। ওর মালামালের অল্প কিছু ক্ষতি হয়েছে কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ অধিকাংশই রক্ষা পেয়েছে। দুই স্থানেই পুলিশের হলুদ টেপ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ভেতরে যেতে পারে নি। ডেমিয়েন ওকে জানাল দুই এক দিনের মধ্যেই রিমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে ও। স্থানগুলো নিরাপদ কিনা সেটা আগে নিশ্চিত করাটা প্রয়োজন।
“পরিস্থিতি আরোও অনেক খারাপ হতে পারত, তাই না?” ডেমিয়েন বলল।
“হ্যাঁ, তা পারত,” রিমা স্বীকার করে। “আমার বাচ্চারা ঘুমাচ্ছিল বাসায়। ওরা যে বেঁচে গেছে তাতেই আমি খুশী। বড় দুই জনের কিছু হয়নি কিন্তু ছোটজনের স্মোক ইনহাইলেশন হয়েছে। সে হাসপাতালে। অবস্থা বেশি ভালো নয়।” “হ্যাঁ শুনেছি। আমার সহানুভূতি তোমার জন্য। কামনা করছি সে দ্রæত ভালো হয়ে যাক।” ডেমিয়েনের মুখভাব বদলে গম্ভীর হয়ে যায়। হাতের মোটা নোটবুকটা খুলল, একটা কলম বের করল পকেট থেকে।
“মিসেস আহমেদ, তোমার কি কাউকে সন্দেহ হয়? প্রশ্নটা সরাসরি করছি, উত্তরটা কোন রাখঢাক না করেই দাও। যাদেরকে সন্দেহ হয় সবার নাম বল। যে বা যারা এটা করেছে তাদেরকে এখনই ধরাটা দরকার। যদি ধরা না পড়ে তাহলে তারা যে আবার একই কাজ করবে না তার কি নিশ্চয়তা? সুতরাং, আমার কাছে কোন কিছু লুকিও না। তোমার এবং তোমার পরিবারের ভালোর জন্যেই বলছি।”