শুজা রশীদ : (পর্ব ৫৬)
সেই দিন বিকালে কালামকে ফোন দিল মরিয়ম। ঐ ছেলেই তো যত সমস্যার সৃষ্টি করেছে। ফোনে সরসরি সমস্যাটা খুলে বলল। কালাম ভদ্র ছেলে। মরিয়মের যন্ত্রণাটা সে বুঝতে পারল। বিনা বাক্য ব্যায়ে ওর দেয়া দুটি সমাধান সে তৎক্ষনাত মাথা পেতে নিল। প্রথমতঃ দোলনের বাসায় আর কখন সে যাবে না; দ্বিতীয়তঃ তার টিউশনিটা আপাতত স্থগিত রাখতে হবে। মরিয়ম ওকে দোলনের সাথে দেখা করতে বারণ করতে পারত কিন্তু সেটা ওর কাছে মনে হয়েছে অতিরিক্ত হয়ে যায়। দুইজন পরিণত বয়স্ক মানুষ যদি পরস্পরের বন্ধু হতে চায় সেখানে অন্যের মতামতের মূল্য দেবার তাদের কি প্রয়োজন? তেমন একটা অনুরোধ করলে কালামই বা তাকে কি ভাববে? কিন্তু জানে যদি বলত তাহলে কালাম হয়ত তাতেও রাজী হয়ে যেত।

কালাম কথামত কাজ করল। সে পরদিন থেকেই একেবারে উধাও হয়ে গেল। দোলন তাকে সমানে ফোন করে গেল কিন্তু কোন সাড়া পেল না। সে যখন বাচ্চাদের পড়াতেও এলো না দোলন তখন সরাসরি মরিয়মকেই প্রশ্ন করল। মরিয়ম সাধ্যমত চেষ্টা করল অবাক হবার অভিনয় করার। দোলন কি বুঝল কে জানে কিন্তু হঠাৎ করেই কোন এক যাদুর বলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। দোলন বাইরে যাওয়া একেবারেও বন্ধ করে দিল। সবার মুখে হাসি ফুটল। আবুল আবার তার বিছানায় ফিরে যাবার অনুমতি পেল। তার মনে আনন্দ ফিরে এলো। মরিয়ম বাইরে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখালেও ভেতরে ভেতরে ভয়ানক সন্তুষ্ট। কালামকে ফোন করে ব্যাক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানাল। ওকে যা একটা বিপদ থেকে উদ্ধার করল ছেলেটা!

বাসায় শান্তি ফিরে আসতেই মরিয়ম জিনিষপত্র গুছিয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে নিজের বাসায় ফিরে গেল। জানে সেখানে গেলেই হাজারটা সমস্যা ওর উপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে কিন্তু মনে মনে নিজেকে আগেই ল্রস্তুত করেছে। এই পরিবারে পরিবর্তন আসছে এবং তার ফলাফল ভালো ছাড়া মন্দ হবে না।

দুই পুতনি বাসায় ফেরার পর থেকে নীতার শরীরটাও যেন ভালো লাগতে শুরু করল। জলি এবং হ্যাপি তাকে ভালোবাসে এবং তার দেখভাল করে। বাসার মধ্যে ওরা দুইজন ছুটাছুটি করে বেড়াচ্ছে, কখন খিলখিলিয়ে হাসছে, একটু পরেই ঝগড়া ঝাটি করছে, আবার মিলে যাচ্ছে- ওদের উপস্থিতিতে বাড়ীটাতে যেন জীবন ফিরে এসেছে। তার মনটাও ফুরফুরে লাগতে শুরু করেছে।

৮৪

দেশে নীতার প্রচুর ভাইগ্না-ভাগ্নী, ভাতিজা-ভাতিঝি আছে যারা তাকে সম্মান করে, ভালোবাসে। তাদের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে এবং তিনি প্রয়োজনে তাদের কাউকে কাউকে আর্থিকভাবে সাহায্য সযোগীতাও করে থাকেন। তার নিজের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া বেশ কিছু বাড়ী আছে যেগুলো তিনি ভাড়া দেন। সেই ভাড়ার অর্থ দিয়ে তিনি ঐ জাতীয় জনহিতকর কাজকর্ম করেন। যে কারণে তাদের উপর তার বেশ একটা আধিপত্য আছে। তার দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের ছেলে মিনার। লেখাপড়ায় কখনই তেমন ভালো ছিল না। কলেজে উঠে সে আর পড়াশোনা করেনি। নানা ধরনের ব্যবসায়ে ভাগ্য পরিবর্তন করবার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনটাতেই কিছু করতে পারেনি। অবশেষে নীতা তার এক ভাইকে ধরে একটা এন জিও তে তাকে একটা কাজ পাইয়ে দেন। মিনার সেই কাজই করে যাচ্ছে, মোটামুটি ভালোই পায়, বিয়ে করেছে, দুটি বাচ্চাও হয়েছে। দেশে নীতার কোন কাজ করাবার প্রয়োজন হলে কিংবা কোন তথ্যের প্রয়োজন হলে তিবি মিনারের সাথে যোগাযোগ করেন। যৌবনে নানান ঘাটের পানি খেয়ে মিনারের একটা উপকার হয়েছে, সে প্রচুর মানুষজনকে চেনে-জানে। তাদের অনেকেই তাকে যথেষ্ট পছন্দ করে এবং মাঝে সাঝে তাকে সাহায্য সহযোগীতা করে থাকে।

এপ্রিলের এক সকালে, নিজের কামরার বিশাল জানালার সামনে বসে ঘরের দরজা বন্ধ করে রোদ পোহাতে পোহাতে মিনারকে ফোন দিলেন নীতা। তিনি জানেন তাকে অনেক সাবধানে এগুতে হবে। মিনার খুব বেশি উৎসাহী হয়ে উল্টোপাল্টা কিছু একটা করে বসলে সমস্যা।
“শোন বাবা,” তিনি খুব সতর্কভাবে শব্দ চয়ন করলেন, “একটা ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর নিতে হবে তোকেৃকিন্তু খুব বড় একটা শর্ত আছে…”

“নীতা চাচী, কি করতে হবে তাই বল,” মিনার বরাবরের মতই উদ্গ্রীবতা নিয়ে বলে।
“এই ব্যাপারে কাউকে একটা কথাও বলতে পারবি না। বুঝতে পারছিস তো?” নীতা বেশ জোর দিয়ে বললেন। এই ব্যপারাটাকে গোপন রাখাটা খুবই জরুরি।
“কোন চিন্তা কর না নীতা চাচী। আমার মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হবে না।” মিনার প্রতিজ্ঞা করে।
“তোর সাথে ওখানে আর কেউ আছে এখন? থাকলে একটু নিরালা কোথাও যা।”
“এখানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই,” মিনার তাকে নিশ্চিত করে। “কি ব্যাপার বল তো চাচী?”

“শোন, তোকে সব কিছু আমি খুলে বলতে পারব না কিন্তু সংক্ষেপে বললে মিন্টু আমাদের কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে কিছু টাকা পয়সা নষ্ট করেছিল। এই ব্যাপারে কখন কিছু শুনেছিস?”
মিনার কয়েক মুহুর্ত নীরব থাকে। “শুনে থাকতে পারি। মানুষ এইসব নিয়ে কথা বলে। কিন্তু যতদূর জানি সব টাকাই কিছু একটা ব্যবসা করতে গিয়ে পানিতে গেছে।”

“সব না, মিনার। আমাদের ধারনা ও অল্প কিছু টাকা এটা সেটা করতে গিয়ে নষ্ট করেছিল। বাকী টাকাটা কোথাও আছে। আমি চাই তুই বাকী টাকাটার একটা হদিস কর। পারবি? যদি পারিস তাহলে পুরষ্কার পাবি। কিন্তু মনে রাখিস তোর কাজ হচ্ছে একমাত্র খুঁজে বের করা। কিছু করতে পারবি না, কাউকে কিছু বলতে পারবি না। বুঝতে পারছিস?”
“পরিষ্কার! কোন চিন্তা কর না, নীতা চাচী। কত দূর কি বের করতে পারলাম তোমাকে শীঘ্রই জানাব।”

নীতা ওকে বিশ্বাস করেন। “কি জানলি আমাকে সাথে সাথে জানাবি। আর কাউকে কিছু বলবি না।” ফোন রেখে দিলেন। মিনার কিছু বের করতে পারবে সেই সম্ভাবনা খুব একটা নেই। পিন্টু ইতিমধ্যেই সাধ্যমত চেষ্টা করেছে নানান ভাবে কিন্তু কিছুই বের করতে পারে নি। ও এমনকি ওর পুলিশ বন্ধুদেরকে ব্যবহার করেও বের করার চেষ্টা করেছিল মিন্টু ঢাকায় থাকাকালীন সময়ে কোথায় কোথায় গেছে, কার কার সাথে দেখা করেছে, কিন্তু তারপরও টাকাটার হদিস করতে পারে নি। কিন্তু মিনারের সাথে যোগাযোগ একটা ভিন্ন মাত্রার মানুষদের। তাদেরকে কেউ খুব একটা চেনেজানে না কিন্তু তাদের সমাজের সব ক্ষেত্রেই যোগাযোগ এবং বিচরণ আছে। তাদের কাছে কি ধরনের তথ্য আছে সেটা জানা দুষ্কর। সেই টাকাটা নীতার প্রয়োজন। আপাতত রিমার কাছাকাছি একটা ছোট বাসায় যেতে তার তেমন একটা আপত্তি নেই, ছেলেটাকে অন্তত বেশি দেখা যাবে, কিন্তু সেটা তার দীর্ঘদিনের ঠিকানা তিনি হতে দেবেন না। রিচমন্ড হিলে একটা বিশাল, চোখ ঝলসান বাড়ী কিনে সেখানে তার ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়াটা তার কর্তব্য।

৮৫

একটা পুরানো বাড়ী কেনা যে এতো সমস্যা সেই ব্যাপারে মরিয়মের কোন ধারণাই ছিল না। জাফর যতই তাকে তাদের আকাঙ্ক্ষিত এলাকাগুলোতে মোটামুটি ভালো বাসা দেখাতে থাকে ততই তার আগ্রহ ধীরে ধীরে মলিন হয়ে আসতে থাকে। কিছু কিছু বাসা ওদের প্রয়োজন মেটালেও দৃষ্টি নন্দনীয় নয়। আবার অন্য কিছু বাসা বাইরে থেকে দেখে মন ভরলেও ভেতরের অবস্থা সন্তুষ্টিজনক নয়।

পরিবারের সবার মন রক্ষা করবার জন্য ও তিন ধাপের একটা প্ল্যান বানিয়েছে। পিন্টু এবং ও প্রথম দেখে বাসাগুলো, তারপর যায় লাট্টু এবং দুই মেয়ে, সবার শেষে নীতা। গত দুই সপ্তাহে বেশ কিছু বাসা দেখার পর নীতার সামনে খান তিনেক বাড়ী পরিবেশন করা হয়েছিল কিন্তু কোনটাই তার পছন্দ হয়নি।

মরিয়ম একটু হতাশা বোধ করছে। যত দ্রুত ব্যাপারটা হবে বলে আশা করছিল ও, বাস্তবে ততখানিই শ্লথ ঘটছে সব কিছু। ওরা যে সমস্ত বাসা পছন্দ করছে নীতা যদি তার সব গুলো এক বাক্যে নাকচ করে দেন তাহলে খুব শীঘ্রই বাড়ী পাল্টাবার কোন সম্ভাবনা আর নেই। মায়ের অনুমতি ছাড়া পিন্টু কোনভাবেই এগুবে না। মায়ের প্রতি তার ভালোবাসা এবং সম্মানকে মরিয়ম প্রশংসার নজরে দেখে কিন্তু তার ভয় হচ্ছে এইভাবে চলতে থাকলে তাদের সমস্ত পরিকল্পনা মাঠেই মারা যাবে।

তাদের মিনি ম্যানশন বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ভেতরের পেইন্টিং এবং ইন্টেরির ডিজাইন সমাপ্ত হয়েছে। মরিয়ম বাইরের আঙ্গিনাগুলো একটু পরিষ্কার করতে চায় বাজারে ছাড়ার আগে। এপ্রিলের শুরুতে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করায় সমস্ত বরফ গলে গেছে। পিন্টু কয়েকজনকে ভাড়া করেছে। তারা এসে বাড়ীর চারদিকটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে দেবে। বাড়ীটা ভালো মূল্যে বিক্রি হওয়াটা দরকার। ওরা চায় বাজারে ছাড়া মাত্রই যেন একটা হৈ চৈ পড়ে যায়।

এক শনিবারে দুই মেয়েকে নিয়ে রিমাদের এলাকায় বাড়ি দেখতে এসে আগাম খবর না দিয়েই চলে এলো মরিয়ম। সৌভাগ্যবশত রিমাদেরকে বাসায় পাওয়া গেল। মরিয়ম এবং ওর দুই মেয়েকে দেখে খুব অবাক হল রিমা। এইভাবে হঠাৎ চলে আসবার জন্য ক্ষমা চাইল মরিয়ম। ফায়জা জলি এবং হ্যাপিকে নিয়ে ভেতরে উধাও হয়ে গেল। মরিয়মকে নিয়ে লিভিংরুমে বসল রিমা।
“এদিকেই এসেছিলাম। ভাবলাম তোমার নতুন শীপমেন্টটা একটু দেখে যাই।” মরিয়ম ব্যাখ্যা করে।
“সেগুলো তো দোকানে,” রিমা সতর্ক ভঙ্গিতে বলে। মরিয়মকে ও পছন্দ করে কিন্তু তার এই আচমকা আবির্ভাবের পেছনে কাপড়ের কোন যোগাযোগ আছে বলে ওর মনে হচ্ছে না। “কাল এক সময় এসো দোকানে। আমার ভাই খুব ভালো কিছু জিনিষ পাঠিয়েছে।”
মরিয়ম নিঃশব্দে মাথা নাড়ে।

“এদিকে এলে যে হঠাৎ?” রিমা জিজ্ঞেস করে। আহমেদ পরিবারের ডাউনসাইজের কথা তার কানেও এসেছে। এই শহরে খবর বাতাসে ওড়ে।
“বাড়ি দেখতে এসেছিলাম,” মরিয়ম হালকা কন্ঠে বলে। “আমাদের বাড়ীটা বেঁচে দিয়ে তোমার কাছাকাছি কোথাও আসবার প্ল্যান করছি আমরা। খুব শীঘ্রই আমরা তোমাদের প্রতিবেশী হয়ে যেতে পারি।”
“ভালোই হবে!” তার ভেতরের ভীতিবোধটাকে গোপন করে বলে রিমা। “জানি আম্মা রবিনকে আরোও বেশী দেখতে চান। এটা বোধহয় তারই ইচ্ছা, তাই না?”
“এই শর্তেই তিনি রাজী হয়েছেন। ঐ বাড়ীটা বিক্রি করবার ব্যাপারা তার খুব একটা আগ্রহ ছিল না।”
“রাজী যে হয়েছেন তাতেই আমি আশ্চর্য হচ্ছি!” রিমা বলে।
“এ ছাড়া আমাদের খুব একটা উপায় নেই,” মরিয়ম এক মুহুর্ত নীরব থেকে বলে। “কার কাছ থেকে শুনেছ? আমরা এখনও কাউকে কিছু বলিনি এই ব্যাপারে।”
রিমা এক মুহুর্ত দ্বিধা করল। ও কালামের কাছ থেকে শুনেছে। কালাম শুনেছে দোলনের কাছ থেকে। “না মানে, আন্দাজ করলাম আরকি…”

মরিয়ম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। রিমা কার কাছ থেকে শুনে থাকতে পারে সেটা আন্দাজ করাটা খুব কঠিন কাজ নয়। “কালামের যা ঘটেছে সেই জন্য আমি খুবই দুঃখিত। সব কিছু এতো হঠাৎ করে খারাপের দিকে মোড় নিল যে আমার আর কোন উপায় ছিল না।”
“কালাম তোমাকে ভীষণ সম্মান করে,” রিমা বলে। “দোলনকে নিয়ে যা সব হয়েছে সেই জন্য বেচারা খুব অপরাধবোধে ভুগছে।”
মরিয়ম কাঁধ ঝাঁকায়। “ও অন্যায় কিছু করেনি। আমার বাব-মা পুরানো দিনের মানুষ। কালাম আর দোলনের বন্ধুত্ব বুঝবার সামর্থ্য তাদের নেই। আমার ভাইকে নিয়ে তেমন কোন সমস্যা ছিল না। যাই হোক, সব কিছু এখন ভালোই আছে।”

“তুমি ঠিক জানো? কালাম তো বলল দোলনের সাথে নাকি ওর স্বামীর সারাক্ষণ ঝগড়াঝাটি হচ্ছে। শেষ কবে তোমার ভাইয়ের সাথে কথা বলেছ?”
মরিয়মের টনক নড়ে। সত্য হচ্ছে বাবা-মায়ের বাড়ি থেকে চলে আসার পর ও দোলন সংক্রান্ত বিষয়ে ঐ বাসার কারোর সাথেই আলাপ করেনি। ওর মা নালিশ করবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ও খুব একটা কানে নেয় নি। নিজদের বৈষয়িক ব্যাপার নিয়ে ও হাবুডুবু খাচ্ছে। অন্য কোন দিকে মনযোগ দেবার সময় নেই।
মরিয়ম অস্বস্তি বোধ করে। রিমা মনে মনে বুঝতে পারে কালাম-দোলনের বন্ধুত্বের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেবার জন্যই মরিয়মের এই আচমকা আগমন। ও মরিয়মকে দোষ দেয় না। কিন্তু কালাম ইদানীং ঐ সব ব্যপারে রিমার সাথে খুব একটা আলাপ করে না। ভেতরে ভেতরে কিছু হচ্ছে কিনা কে জানে?

৮৬
এপ্রিলের মাঝামাঝি তাপমাত্রা হঠাৎ করেই বেশ উঠে এলো এবং মনে হল অবশেষে শীতের মহা প্রতাপ শিথিল হয়ে আসছে। পাখীরা সব হঠাৎ করেই দৃশ্যমান হয়ে উঠল, এদিকে সেদিকে বাসন্তি ফুল ফুটতে শুরু করল, আঙিনায় ঘাসের ডগায় নতুন জীবনের ছোঁয়া লাগল, আর সবার উপরে সূর্য যেন আবার তার উজ্জ্বলতা এবং উষ্ণতা নিয়ে বিকশিত হয়ে উঠল। সব মিলিয়ে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব প্রকৃতিতে।
আবহাওয়ার এই পরিবর্তন রিমার মনেও হয়ত কিছু একটা প্রভাব ফেলে থাকবে। এক রবিবারে নোমানের জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করে ডলির জন্য ক্যাম্পেইনিং করতে রাজী হয়ে গেল। সেন্ট ক্লেয়ারে আয়েশার ক্যাম্পেইন সেন্টারে নোমানের সাথে দেখা করল সে। মিলাও সেখানে ছিল। ওকে দেখেই ছুটে এলো। “রিমা! নোমান বলল তুমি নাকি আমাদের সাথে যাবে আজকে?”

“যদি তোমাদের কোন অসুবিধা না হয়,” রিমা লাজুক মুখে বলে।
“অসুবিধা? কি বল? এতো আমাদের সৌভাগ্য!” মিলা খুশীতে গদ্গদ হয়ে বলে। “চল, নোমান। যাওয়া যাক।”
দোরে দোরে গিয়ে ক্যাম্পেইন করবার অভিজ্ঞতা খুব ঘটনাবহুল হল। ওর নিজের দোকানের জন্য ফ্লায়ার দেয়ার অভ্যাস ইতিমধ্যে রিমার আছে কিন্তু সে কারো কলিং বেল বাজিয়ে কথাবার্তা বলার চেষ্টা কখন করেনি।
ওরা একটাই গাড়ি নিল। রাস্তার পাশে পার্ক করে নেমে মানুষজনের সাথে আলাপ করল। অনেকেই বাইরে তাদের প্রাঙ্গণে কাজ কর্ম করছে বসন্তের উষ্ণ দিনে। তাদের কারো কারো সাথে কথা বলেছে। আবার কারো কারো দরজায় গিয়ে কলিং বেল টিপেছে। উদ্দ্যেশ্য তাদের ক্যন্ডীডেটের পরিচয় দেয়া, তার এজেন্ডা ব্যাখ্যা করা ইত্যাদি। কিছু বাড়ীওয়ালারা ওদের সাথে আলাপ করবার কোন আগ্রহ দেখাল না। তারা এন ডি পি তে ভোট দিতে আগ্রহী নয়। কেউ কেউ ইতিমধ্যেই অন্য পার্টীর প্রার্থীকে সমর্থন করছে। কিন্তু অনেকেই আবার ডলি এবং তার ক্যাম্পেইন সম্বন্ধে জানতে আগ্রহ দেখাল। কেউ কেউ তাদের প্রাঙ্গণে ডলির নর্বাচনী সাইন পোতারও অনুমতি দিল। মিলার কাছে ডলির সমর্থকদের একটা লিস্ট ছিল। ওর প্রাথমিক উদ্দ্যেশ্য ছিল তাদের সাথে আগে আলাপ করা। ভোটাররা তাদের প্রার্থীর কাছ থেকে আগ্রহ দেখতে চায় নইলে অনেক সময় অবহেলিত মনে করে এবং অন্য কাউকে ভোট দিয়ে দেয়।

স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে আগ্রহ দেখাল দেশী মানুষেরাই। বিশেষ করে যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে। এতে অবশ্য আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এখানে এখনও অধিকাংশ মাইনরিটি গোত্রই রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের পদ চিহ্ন আঁকতে উদগ্রীব। তাদের পথ চলা মাত্র শুরু।
“আমাদের এখনও অনেক কাজ বাকী,” মিলা হাঁটতে হাঁটতে বলে। “আমাদের দেশীয় মানুষদের অনেকেই লিবারেলদের দীর্ঘদিনের সমর্থক। তারা হঠাৎ করে অন্য একটা পার্টীর প্রার্থীকে ভোট দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ নাও করতে পারে। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদেরকে বোঝান যে ডলি যে পার্টিরই প্রার্থী হোক না কেন সবার আগে সে বাংলাদেশের মেয়ে। পার্লামেন্টে তার উপস্থিতি আমাদের সবার জন্য সম্মান বয়ে আনবে।”
“এই মুহুর্তে লিবারেল পার্টীর নেতা ক্যথলিনের সমর্থন এতো কম যে পি সি এবং এন ডি পি পার্টির প্রার্থীদের এবার বেশ ভালো সুযোগ আছে নির্বাচিত হবার,” নোমান বলল। “আমাদের কাজ হচ্ছে ভোটারদের কাছে ডলির নাম পৌঁছে দেয়া।”
“তাতে কি কাজ হবে?” নির্বাচন সংক্রান্ত ব্যাপারে রিমার জ্ঞান খুবই কম। কখন খুব একটা আগ্রহও দেখায়নি।

“হতে পারে,” নোমান বলল। “কুইবেকে ২০১১ ফেডারেল ইলেকশনে লিবারেল পার্টিকে শাস্তি দেবার জন্য সেখানকার ভোটাররা অল্প বয়স্ক, অনভিজ্ঞ এন ডি পি ক্যন্ডীডেটদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিল। ভোটারদেরকে রাগিয়ে কখন কোন লাভ হয় না।”
“আমরা জিতবই,” মিলা নাটকীয় ভাবে চীৎকার করে ঘোষণা দিল। আশেপাশের মানুষজন ফিরে তাকাচ্ছে।
রিমা হেসে ফেলল। “তোমার নাটক না করলে চলে না, না?”
“খুব ভালো লাগছে আজকে!” মিলা বলল। “বিশেষ করে এই রকম একজন সুদর্শন, আকর্ষনীয় লোক যখন আমার পাশে আছে। ঠিক বলেছি না, ডার্লিং?”
নোমানের পাঁজরে কনুই দিয়ে জোরে সোরে একটা গুতা দিল সে। নোমান নীরবে হাসল।
“ব্যাস, এইটুকুই?” মিলা ছদ্ম রাগ নিয়ে বলল কিন্তু পরক্ষণেই খিল খিল হাসিতে ফেটে পড়ল।

নোমানের সাথে মিলার আচরণ দেখেই রিমা বুঝল নোমানের প্রতি কতখানি ভালোবাসা তার ভেতরে জন্মে থাকতে পারে। সে যেভাবে কথা বলছে, হাসছে, ঠাট্টা করছে, সব কিছুই প্রমাণ করছে সেটা। নোমানকে দেখেও মনে হয় সে মিলার এই হাসিখুশি ছেলেমানুষি পছন্দই করছে, যদিও খানিকটা সহিষ্ণু ভঙ্গিতে, গা ছাড়া ভাব নিয়ে। সপ্তাহ দুই আগে শেষবার এই বিষয়ে যখন রিমা এবং তার মধ্যে আলাপ হয়েছিল তাপর কি মিলার সাথে তার সম্পর্কের কোন পরিবর্তন হয়েছে? রিমা ঠিক ধরতে পারে না। এর মাঝে নোমানের সাথে ওর দেখা হয় নি তা নয়, কিন্তু মিলাকে নিয়ে কোন আলাপ হয়নি।
সেই দিন বিদায় নেবার আগে নোমান এবং মিলার কাছে প্রতিজ্ঞা করতে হল জুনের ৭ তারিখে ভোট না হওয়া পর্যন্ত রিমা অন্তত পক্ষে সপ্তাহে একবার ওদের সাথে নির্বাচন সংক্রান্ত কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করবে।