শুজা রশীদ : (পর্ব ৫৫)
রিমা অর্ধেক্টা রোল খেয়ে বাকিটা মোড়কে মুড়ে কাগজের প্যাকেটে রেখে দিল। “পরে খাব।” ফান্টায় আরেকটা চুমুক দেয়। “আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে তোমার অসুবিধা কোথায়?”
নোমান ওর দিকে তাকিয়ে কেশে গলা পরিষ্কার করল। “সত্যি কথা বলতে কি, ওর সাথে আমার কখন জুটি হবে না। ও আমার গন্তব্য না।”
“গন্তব্য!” রিমা থমকে যায়। “এই তোমার অজুহাত?”
“আমি… আমি কোন অজুহাত খুঁজছি না,” নোমান তোতলায়। “যা সত্য তাই বলছি।”
রিমা অবিশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়ে এবার। “গন্তব্য! হাহ! এটাই তাহলে আমার গন্তব্য! এই ছোট্ট একটা দোকানের মধ্যে সারাদিন একলা বসে বসে মেয়েদের অন্তর্বাস সেলাই করছি। দুইবার বিধবা, একবার ডিভোর্সড।”
নোমান আহত দৃষ্টিতে তাকাল। “রিমা, অকারণে তোমার নিজেকে কেন টানছো এর মধ্যে? আমি শুধু তোমাকে আমার অনুভুতির কথা বলছি।”

“ঠিকই বলেছ। তা তুমি কি চাও আমি আমার বান্ধবীকে এই তথ্যটা জানাই?”
“না,না, তার দরকার নেই,” নোমান দ্রুত বলে। “যদি কখন সেই পর্যায়ে যায় তাহলে আমি নিজেই ওকে সব খুলে বলব। আমি শুধু তোমাকে ব্যপারটা জানাতে চেয়েছিলাম।”
“ঠিক আছে, জানলাম,” রিমা নীরস কন্ঠে বলল। “তবে এমন কিছু কর না যেন ও দুঃখ পায়। ও খুব ভালো একটা মেয়ে।”
“জানি।”
রিমা ঘড়ির দিকে তাকাল। প্রায় আটটা। এখন আর কোন খদ্দের আসবার কোন সম্ভাবনা নেই। আজ একটু আগেই দোকান বন্ধ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। “কোন ডীনার প্ল্যন আছে?”
“নাহ। গত কালকের কিছু উচ্ছিষ্ট আছে ফ্রিজে। সেটা দিয়েই সেরে নেব। দোকান বন্ধ করে দেবে?”
“হ্যাঁ। চাইলে আমাদের সাথে রাতে খেতে পার,” রিমা বলে। “ফায়জা প্যাসতা রেঁধেছে। একটু আগে টেক্সট পাঠিয়েছে আমাকে। কোন চাপ দিচ্ছি না। যদি তুমি চাও।”
নোমান কাঁধ ঝাঁকাল। “সেদিন কাজের পর গিয়েছিলাম। আমাকে পাকোড়া বানিয়ে খাইয়েছে। দারুণ হয়েছিল।”
রিমা চোখ ঘোরাল। “বাহ! তোমার জন্য এখন পাকোড়া ভেজে দিচ্ছে!”

“আমার সৌভাগ্য,” নোমান হেসে বলল। “তোমার মেয়েটা ভীষণ ভালো। একদিন খুব বড় কিছু একটা হবে। আমাদের নির্বাচণী অফিসের সবাই ওর প্রশংসা করে। ফোনে মানুষ জনের সাথে এতো সুন্দর করে কথা বলে। আমি শুনে মুগ্ধ হয়ে গেছি।”
“পড়াশুনা বাদ দিয়ে খুব বেশি ঐ সব দিকে মনযোগ দিক সেটা চাই না,” রিমা ক্যাশ বাক্স বন্ধ করতে করতে বলে। দোকান বন্ধ করার আগে সবকিছু গুছিয়ে রেখে যাওয়াটা ওর স্বভাব।
“সেটা হবে না। নিশ্চিত থাক। আমি সারাক্ষণ ওকে সেটা মনে করিয়ে দেই।” নোমান ওকে আশ্বস্ত করে।
“ভালো।”
দোকানের বাইরে বেরিয়ে আসে ওরা। নোমান শাটারটা টেনে নামিয়ে তালা লাগিয়ে দেয়।
“আসছো?” রিমা জিজ্ঞেস করে।
“আজ রাতে না,” নোমান বলে। “বাসায় যাও। বিশ্রাম কর। সারাদিন এখানে ছিলে। নিশ্চয় ক্লান্ত হয়ে আছো। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।”
“কি?” রিমা গাড়ীতে উঠতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়।

“তুমি সময় করে আসো না, আমার সাথে বাইরে ক্যাম্পেইনিং করবে। বাড়ি বাড়ি যাওয়া, মানুষের সাথে কথাবার্তা বলা, মজাই হয়। তোমার ভালো লাগবে।”
রিমা নোমানের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে। বোঝার চেষ্টা করে এই অনুরোধের পেছনে কতখানি ক্যাম্পেইনিং আর কতখানি ব্যাক্তিগত আগ্রহ। “আমার সময় হবে কিনা বলতে পারছি না,” শেষে বলল। নোমানের কাছ থেকে আচমকা এই ধরনের একটা অনুরোধ আসবে সেটা ঠিক আশা করেনি।
“মাঝে মাঝে তোমারও তো একটু ব্রেক দরকার। দোকানের ব্যাস্ততা খুব শীঘ্রই বাড়বে না। সময় লাগবে। বিকালে ঘন্টা দুয়েকের জন্য বের হলে কোন ক্ষতিই হবে না। ভালোই লাগবে। ভেবে দেখ।” নোমানকে দেখে খুব উৎসাহিত মনে হল। তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
“কিন্তু আবহাওয়া তো এখনও অনেক ঠান্ডা! বাইরে গিয়ে ক্যম্পেইনিং করা যাবে?” রিমা দ্বিধা নিয়ে বলে।
“এখনই না, ধর আরোও সপ্তাহ দুই পরে। এপ্রিলের মাঝামাঝি ঠান্ডা অনেক কমে যাবে। কি বল? করবে? তোমার ব্যবসার জন্যও ভালো হবে। অনেক দেশী মানুষ জনের সাথে দেখা হবে। নেটয়ার্কিং হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।”

রিমা হেসে ফেলল। “ঠিক আছে, তাই যদি হয়। কিন্তু ঠান্ডা কমার পর। সর্দি কাশি লাগাতে চাই না।”
“নিশ্চয়!” নোমান বিশাল এক টুকরো হাসি দেয়। তাকে দেখে ভীষণ খুশী মনে হয়।
রিমা গাড়ীতে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে ড্রাইভার সাইডের জানালাটা নামায়। নোমান তখনও দাঁড়িয়ে আছে। ও না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। জানালা নামাতে দেখে এগিয়ে এলো।
“কি?”
“ভাবছিলাম,” রিমা দ্বিধা করে বলে, “মিলা কিছু মনে করবে নাতো?”
নোমান মাথা নাড়ল। “ওসব নিয়ে তুমি ভেব না। নির্বাচন সংক্রান্ত অনেক কাজকর্ম আছে। আমি সময় করে ওর সাথেও কিছুক্ষণ কাজ করব।”
রিমা মাথা দোলাল, তারপর জানালা উঠিয়ে, নোমানকে হাত নেড়ে গাড়ি চালিয়ে দিল। গন্তব্য! নোমানের মুখ থেকে শব্দটা শোনার পর ওর মনে হচ্ছে যেন আবার সেই অতীতে ফিরে গেছে।

৮২

পরের শনিবারে দোকান থেকে রাত আট্টার একটু পরে বাসায় ফিরে সবার জন্য রাঁধলো রিমা। ইদানীং এতো ব্যাস্ত থাকে যে রান্নাবান্না খুব একটা করাই হয় না। ফায়জার উপরেই বেশী নির্ভর করে। ওর নিজের অধিকাংশ সময় কাটে হয় দোকানের ভেতরে নয়ত ইন্টারনেটে ওর পণ্য দ্রব্যের বিজ্ঞাপনে।
ঢাকা থেকে সেলিম এবং সোনিয়া পোশাকের প্রথম লোডটা শিপ করেছে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই চলে আসা উচিৎ। অধিকাংশ মানুষ জন যারা ওর দোকানে এসেছিল তারা ওর নতুন পোশাক দেখতে আগ্রহ দেখিয়েছে। রিমা ওর দোকানে যারা আসে তাদের সবার জন্য একটা ইমেইল এবং ফোন লিস্ট তৈরী করছে।পরবর্তিতে একটা ওয়েব সাইট বানাতে হবে। ওয়েব সাইট কিভাবে বানাতে হবে সেই ব্যাপারে ওর বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই কিন্তু ভাবছে কালাম ওকে নিশ্চয় সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু ইদানীং ছেলেটা ওর কাজকর্ম, ক্যাম্পেইন আর পড়াশুনা নিয়ে এতো ব্যাস্ত আছে যে রিমা আর তাকে অহেতুক জ্বালাতে চায় নি। ওয়েব সাইট কয় দিন পরে হলেও কোন সমস্যা নেই।

মিলা সন্ধ্যায় হঠাৎ এসে হাজির। আগে থেকে কিছু জানায়নি। সবার সাথে রাতে খেল। খাবার পর রিমা দু’জনার জন্য দুই কাপ চা বানাল। ওরা লিভিং রুমে পাশাপাশি বসল, মন খুলে গাল গল্প করবে।
“বলতো আজকে আমার দোকানে কে এসেছিল?” রিমা চায়ের কাঁপে লম্বা একটু চুমুক দিয়ে বলে।
“নোমান নয়তো!” মিলা কৌতূহলী কন্ঠে বলে।
“না, না। মাঝে মাঝে আসে অবশ্য, সাধারণত সন্ধ্যার দিকে।”
“আমাকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্যাম্পেইনিং করতে সাহায্য করছে,” মিলা বলে। “করতে চায় না। একটু আইলসা। আমাকে সারাক্ষণ ঠেলতে হয়। আগেও কি এই রকমই ছিল নাকি? যখন আরোও বয়েস কম ছিল?”
রিমা মৃদু হাসে। “তুমি হচ্ছ একটা এনার্জির সুপারনোভা। ও তোমার মত না। বেচারীর উপর একটু দয়া মায়া দেখিও। যাই হোক, আজ এসেছিল ডিটেকটিভ মার্সেল!”
“কি? সে এখনও তোমার পেছনে লেগে আছে? কেন?” মিলা ভ্রূ কুঁচকে জানতে চায়।
“জানি না। এমনিতে মানুষ হিসাবে তো ভালোই মনে হয়। হয়ত দেখা করতে এসেছিল। যাইহোক, আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম। ওর বউয়ের জন্য একটা শাল কিনল।”
“ভালো। তোমার ব্যবসা হয়েছে। কি বলল?”
রিমা কাঁধ ঝাঁকাল। “তেমন কিছু না। বাচ্চাদের কথা জিজ্ঞেস করল। শ্বশুর শ্বাশুড়ির কথা জিজ্ঞেস করল। পিন্টুর কথাও। বললাম সবাই ভালো আছে। কিছু পোশাক আষাক দেখে শেষে শালটা বাছাই করল। ওর বউ নাকি ইন্ডিয়ান শাল পছন্দ করে। তারপর চলে গেল।”
মিলা মুখ বাঁকাল। “এইসব পুলিশকে কক্ষন বিশ্বাস করা যায় না। তোমার বাসায় এসেছিল। দোকানে গেছে। মতলাব কি? তার কি আর কোন কাজ কর্ম নেই?”

রিমা আবার কাঁধ ঝাঁকাল। “বাদ দাও। ক্যাম্পেইনিং ছাড়া তোমার জীবনে আর কি ঘটছে বল।”
“ঘটনা একটা ঘটেছে, তোমাকে এখনও বলা হয় নি,” মিলা রাগী গলায় বলল। “ঐ শয়তানটা কয়েক দিন আগে আমাকে ফোন করেছিল। কাঁদছিল…”
“কোন শয়তানটা? বউ-বাচ্চায়ালা ডাকতারটা?” রিমা থ হয়ে যায়।
“আর কে! আমি কথা বলতে চাই নি কিন্তু ব্যাটা খান দশেক মেসেজ রেখেছে। সুতরাং শেষে ধরলাম। খুব কাঁদল, হাত পায়ে ধরল ওকে ক্ষমা করে দেবার জন্যৃওর কাছে ফিরে যেতে বলে… যা হাসি পাচ্ছিল না!”
“কোন সাহসে তোমাকে ফিরে যেতে বলে সে?” রিমা হতভম্ব হয়ে বলে। “ওর বউয়ের কি হবে? কোন ধরনের মানুষ এইটা?”
মিলা মুখ বাঁকিয়ে হাসল। “আরে, ওর বউ জেনে গেছে যে আমাকে নিয়ে প্যারিস গিয়েছিল। তারপর ফুটে গেছে। হারামী শালা এখন একা একা চোখের জল ফেলছে।”
রিমা তীক্ষ্ণ নজরে বান্ধবীকে দেখল। “মিস মিলা! তুমি ওর কাছে ফিরে তো যাচ্ছ না?”
“আরে না। আমাকে কি মনে কর তুমি? আমার কি কোন আত্মসম্মান নেই?”
রিমা দাঁত বের করে হাসল। “তা ভাবি নি। তুমি কি বললে ওকে?”
“বললাম গোল্লায় যা!”

রিমা হাতের কাপ উপরে তুলল। “চিয়ার্স! মনে রেখ, ঐ ব্যাটা তোমাকে সমানে কল করতে থাকবে। ওর ফোন ধরবে না। ওর মেসেজ শুনবে না।”
“আমি ওকে এর মধ্যেই বøক করে দিয়েছি। ধোঁকাবাজরা কখন শোধরায় না।”
“দারুণ বলেছ। কখন ভুলে যেও না কথাটা।“ রিমা কৌতুক মেশান কন্ঠে বলে। মিলা এই একই রুটিনের ভেতর দিয়ে এর আগেও গেছে। সাধারণত প্রথমে কিছুদিন দূরে দূরে থাকলেও শেষতক ঠিকই ধরা দেয়।
মিলা মাথা দোলাল। “এইবার না। তা ছাড়া আমার মনে হয় আরোও ভালো কাউকে পেয়েছি। মানে, এখনও কিছু হয় নি কিন্তু হতে পারে। আমার চেয়ে বয়েসে একটু বড় কিন্তু ওল্ড ইজ গোল্ড।”
রিমা একটা গভীর শ্বাস নেয়। নিশ্চয় নোমান। দুর্ভাগ্যবশত তাকে দেখে একেবারেই আগ্রহী মনে হয়নি। মিলা মানসিকভাবে খুব বেশি আশা না করলেই হয়। “কে সেই ভাগ্যবান?”
“আমার মনে হয় তুমি ইতিমধ্যেই একটা ধারনা করেছ। কিন্তু আমি এখনই কোন কিছু বলতে চাই না। তবে একটা ব্যাপারে প্রতিজ্ঞা করছি, কিছু হলে তোমাকেই সবার আগে বলব।”
রিমা দূর্বলভাবে হাসে। “আমার তো এখনই জানতে ইচ্ছে করছে। আমি যদি কোন ভাবে সাহায্য করতে পারি আমাকে জানিও।”

মিলা লাজুক ভঙ্গীতে মাথা নাড়ল। “আমার মনে হয় সব ঠিকঠাক মতই হবে। তোমাকে জ্বালাতে হবে না। মিস মিলা এইবার আর কোন ভজঘট করবে না।”
“না করলেই ভালো!” রিমা নরম গলায় বলে। মিলা একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পেত রিমার মুখে মেঘের ঘনঘটা। একটু হিংসে বোধ করলেও রিমার মন বেশি খারাপ হচ্ছে এই ভেবে যে মিলা নিজের অজান্তেই নোমানকে নিয়ে একটা মিথ্যে স্বপ্ন দেখছে। (বাকি অংশ ৩২-এর পাতায় ধ)

৮৩
মরিয়ম ভেবেছিল সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ও বাসায় ফিরে যাবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাবে কি না, যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। ওর পৈত্রিক বাসায় বিশেষ একটা সমস্যা বেশ বিপদজনক সীমানায় পাড়ি জমিয়েছে। দোলন দিনকে দিন আরোও বহির্গামী হয়ে উঠেছে এবং কালাম, লরা ও তাদের গ্রুপের আরোও কয়েক জনের সাথে সঙ্গী হয়ে ডলির ক্যাম্পেইনেও ভলান্টিয়ার হিসাবে নাম লিখিয়েছে। প্রায় প্রতিদিন দুপুরের দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় সে আর আসে অন্ধকার হবার পর।

এটা নিয়ে দুশ্চিতা করবার কোন কারণ আছে বলে মরিয়মের মনে হয় নি কিন্তু ওর বাবা-মা তা মানতে রাজী নন। তারা আবুলের কাছে সর্বক্ষণ নালিশ করছেন, দাবী করছেন দোলন এইভাবে যখন তখন বাইরে যাওয়া বন্ধ করুক। তাদের ভয় ক্যাম্পেইনের নামে সে আরোও কি কি করছে একমাত্র আল্লাহ খোদাই জানেন।
প্রথম দিকে আবুল এইসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় নি, বিশেষ করে সে যখন মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে যে দোলন অন্য কারো সাথা পরকীয়া করছে না। তার কিছু অল্প বয়স্ক বন্ধু হয়েছে। সে তাদের সাথে কিছু সময় কাটাচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রæত খারাপের দিকে মোড় নিল যখন বাবা-মায়ের ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে একদিন স্ত্রীর সাথে মাঝামাঝি কোন একটা সমঝোতায় আসা যায় কিনা সেটা নিয়ে আলাপ করতে গেল। ভেবেছিল দোলনের সাথে আলাপ করে এমন কিছু একটা করবে যাতে বাব-মাও শান্ত হন আবার দোলনের আনন্দও খর্ব না হয়।

কিন্তু দোলন ব্যাপারটা ভালো ভাবে নিল না। সে ধরে নিল তার স্বাধীণতা হরণ করবার চেষ্টা চলছে। তার প্রতিক্রিয়া হল প্রয়োজনের চেয়ে অনেক চড়া। তাদের চীৎকার চেঁচামেচিতে প্রতিবেশীরাও চমকে উঠে থাকবে। দোলন কিংবা আবুলের কন্ঠ এতো উঁচুতে উঠতে পারে সেটা হয়ত তাদের কেউ কখন চিন্তাও করে নি। বিশেষ করে আবুলের। সবাই কম বেশী জানে স্ত্রীকে সে কত উঁচু নজরে দেখে। সেই ঘটনার পর থেকে বাসার সবার সাথে বাক্যালাপ বন্ধ করেছে দোলন। আবুলের রাত কাটছে লিভিংরুমে। মরিয়ম তার সাথে আলাপ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু শুধু নীরবতাই পেয়েছে।
দিন দুয়েক একরকম নিজের কামরায় স্বেচ্ছাবন্দী থাকার পর দোলন যখন সেজে গুঁজে বাইরে গেল তখন বাসার মধ্যে জরুরী মিটিং বসল। মরিয়ম, ওর বাবা-মা এবং আবুল, যাকে অফিস থেকে তলব করে আনা হয়।
বেগম ভীষণ তেঁতে আছেন মরিয়মের উপর। “এটা তোর দোষ,” তিনি মরিয়মের দিকে আঙ্গুল নির্দেষ করে ঘোষনা দিলেন। “এই বাড়ীতে ঐ ছেলেটাকে তুইই এনেছিস। আরেকটু হলে নিজের সংসারটাতো ভেঙ্গেছিলিই, এখন ভাইয়ের সংসারটা ভাঙ্গার চেষ্টা করছিস। তোর লজ্জা হওয়া উচিৎ।”

মরিয়ম বাকহারা হয়ে যায়। একজন ভদ্র স্বভাবের একটা ছেলেকে বাচ্চাদের শিক্ষক হিসাবে নিয়োজিত করেছিল ও। এটাতে দোষের কি হল? দোলন যদি তার সাথে বন্ধুত্ব করে সেই জন্য মরিয়ম কেন দোষী হবে? কিন্তু মুখে কিছু বলল না। সেদিনের ঝগড়ার পর থেকে আবুল ভীষণ মন খারাপ করে আছে, ঘুম-টূম একেবারেও হচ্ছে বলে মনে হয় না। মাকে রাগাতে ওর কোন সমস্যা নেই কিন্তু ভাইকে রাগাতে চায় না। বোনের জন্য জান দিতে পারে আবুল।
“আমাকে কি করতে বল?” সে অসহায়ভাবে বলে। “আমি ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি। ও আমার সাথেও কথা বলছে না।”
বেগম ওকে আরোও কিছুক্ষণ বকাবকি করলেন। হাজী নীরবে বসে থাকলেন। তাদের বিবাহিত জীবনে তার স্ত্রীই কথাবার্তা যা বলার বলেছে। আবুলকে দেখে মনে হল সে সর্বস্ব হারিয়েছে।
“ভাইয়া, তুমি আমাকে কি করতে বল?” শেষে আবুলকেই জিজ্ঞেস করল মরিয়ম। ওর কাছে তার মতামতের দামই সবচেয়ে বেশী।
আবুল মাথা নাড়ে। কি করতে হবে সেও জানে না। “আমি তো ওর চলাফেরা বন্ধ করতে চাই নি,” বিড়বিড়িয়ে বলল। “আমি শুধু বলেছিলাম এতো দীর্ঘক্ষণ বাইরে না থাকলেই ভালো। আর প্রত্যেকদিন যাবারওতো দরকার নেই। ভুল কিছু বলেছিলাম? আমি তো ঐ রকম স্বামী না যারা স্ত্রীদেরকে নিয়ন্ত্রন করতে চায়।”

বেগম মরিয়মের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন। “আগে মেয়েটা বাইরে কখন যেতই না। এই বাসাই ছিল ওর জীবন। ঐ ছেলেটার সাথে পরিচয় হবার পর থেকেই ওর ভাব সাব পালটে গেছে। মরিয়ম, তুই ফিরে যাবার আগে এই সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যাবি।”
আবুল আপত্তি জানাল। “মা, মরিয়ম তো অন্যায় কিছু করে নি। আমি আবার দোলনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করব।”
“না, তুমি না,” বেগম ধমকে ওঠেন। “আবার তোমরা ঝগড়া কর আমি সেটা চাই না। প্রতিবেশীরা সবাই কি মনে করবে? মরিয়মকেই এই সমস্যার সমাধান বের করতে হবে।”
মরিয়ম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়ে। কিভাবে কি করবে জানে না কিন্তু এই ক্ষণে মায়ের প্রস্তাবে সম্মত না হয়ে আর কোন উপায়ও নেই।”