শুজা রশীদ : (পর্ব ৯)
১২.
এপার্টমেন্ট বিল্ডিঙয়ের প্রবেশমুখ থেকে মিন্টুর পতনের স্থানটা পঞ্চাশ ফুটও হবে না। বিল্ডিঙয়ের ভেতরে বাইরে যাবার সময় সেদিকে না তাকিয়ে একরকম মাথা নীচু করে দ্রæত স্থানটা পেরিয়ে যায় রিমা। কিন্তু দিনকে দিন ব্যাপারটা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। সেই রাতের পর যখন সে সেই ভোতা পতনের শব্দটা শুনেছিল, ছুটে নেমে এসেছিল এবং অবলোকন করেছিল মিন্টুর বিদ্ধস্থ মৃত দেহ ঐ এসফল্টের রাস্তার উপর, তার চূর্ণ মাথার খুলির ফাঁক দিয়ে নামতে দেখেছিল রক্তের ঢল, সে আর ঐ দিকে একবারের জন্যও তাকায়নি। ঐ ঘটনার পর বেশ কিছুদিনের জন্য পুলিশ স্থানটা ঘিরে রেখেছিল টেপ দিয়ে, নানা ধরণের বস্তু সংগ্রহ করেছিল পরীক্ষা নিরীক্ষা করবার জন্য, CSI (Crime Scene Investigator) এসেছিল তাদের অনুসন্ধানমূলক কার্যক্রম করতে, তারপর যখন সবার কাজ কর্ম শেষ হয় তখন সরিয়ে নেয়া হয় টেপটা। এখন সেই স্থান আবার হয়ে গেছে দালানের সামনে উন্মুক্ত এক টুকরো স্থান যেখানে ভাড়াটেরা মাঝে মাঝে ক্ষণস্থায়ীভাবে তাদের গাড়ী পার্ক করে।
সেপ্টেম্বরের এক অপেক্ষাকৃত শীতল সন্ধ্যায় ঢাকা গ্রোসারীতে আটটার দিকে তার কাজ শেষ করে ভিক্টোরিয়া পার্ক এভেনিউ ধরে হেঁটে বাসায় ফিরছিল রিমা। দিন ছোট হয়ে আসছে, ইতিমধ্যেই অন্ধকার হয়ে গেছে। খোলা মাঠের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে সে এখন আর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। খুব বেশি আগের কথা নয় যখন যত্র তত্র চলাফেরা করতে খুব একটা ভয় হত না। ইদানীং সেই সাহস তার হয় না। পরিস্থিতি পালটেছে। বাংলা টাউন থেকে ক্রিসেন্ট টাউনে যাবার ফুটপথটুকু অবশ্য সব সময় আলোকিত থাকে। এই পথটুকু একটু ঘোরা হয় কিন্তু কোন ভয়ের কারণ থাকে না। মিন্টু সবসময় নিরাপত্তা নিয়ে সন্দিহান থাকত, অনুযোগ করত, বিশেষ করে শহরের এই অংশটুকুতে যেখানে অধিকাংশ মানুষই অভিবাসী। তার একটা বদ্ধপরিকর ধারণা ছিল স্থানীয় দূর্বৃত্তরা বিশেষ করে অভিবাসীদের উপর হামলা করে কারণ এই মানুষগুলো স্বাভাবিকভাবেই শান্তিপ্রিয় এবং এই নতুন পরিবেশে এসে কিছুটা ভীতগ্রস্থও। তার ভেতরে কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছিল, কিছু একটা সৃষ্টি করছিল এক ধরনের ঘৃণাবোধ। যে মানুষটা এক সময় তার এই নতুন দেশের জন্য জীবন বিকিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিল, সে কোন এক অজ্ঞাত কারণে সেই দেশের প্রতিই হয়ে উঠছিল ক্রমাগত ক্ষুব্ধ।
তার এপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের কাছাকাছি আসতে চোখ নামিয়ে ফেলে রিমা, আপ্রাণ চেষ্টা করে সেই দূর্ঘটনার স্থানটার দিকে না তাকাতে। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসে কার্ড স্ক্যান করে সদর দরজা ঠেলে ভেতরের প্রশস্ত লবিতে প্রবেশ করে। প্রায় শূন্য লবিতে একটি তরুণ পরিবার তাদের দুটি অল্পবয়স্ক বাচ্চা নিয়ে এলিভেটরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। রিমা ইদানীং মানুষ জন একেবারেই এড়িয়ে চলে, বিশেষ করে পরিচিত মানুষ জন। মিন্টুর আত্মহত্যার খবরটা অতিমাত্রায় প্রচারিত হওয়ায় বৃহত্তর টরন্টোতে বসবাসকারী কিংবা হয়ত সম্পূর্ণ কানাডাতেই এমন কোন বাংলাদেশী পাওয়া যাবে না যে অল্পবিস্তর এক তরুণ বাংলাদেশী পিতার রহস্যময় মৃত্যু এবং তার সুন্দরী, যুবতি স্ত্রীর কুয়াশাময় অতীতের প্রসঙ্গে জানে না।
যেখানেই সে যায় মানুষের নীরব দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করে যেন তারা তাদের সন্দেহ আর ভিত্তিহীন ধ্যাণ ধারণা দিয়ে তাকে এক বিষাক্ত মাকড়শার জালে পেঁচিয়ে ফেলতে চায়। দোকানে যতক্ষণ থাকে কাজে ব্যাস্ত থাকে। মানুষের অহেতুক কৌতুহল এড়িয়ে যাওয়াটা সহজ হয়। কাজের বাইরে নিজেকে তার নগ্ন মনে হয়, চারদিক থেকে ধেয়ে আসা মানুষের দৃষ্টির সামনে নিজেকে অসহায়, ভঙ্গুর মনে হয়।
রিমা তার মাথায় পড়ে থাকা ওড়নাটা যেটাকে সে খানিকটা হিজাবের মত করে পরে মূলত নিজের পরিচয় গোপন করবার জন্য টেনে মুখের সামনে নিয়ে আসে।
লবিতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা তৎক্ষণাৎ তাকে লক্ষ্য করে। “রিমা ভাবি!” সে উত্তেজিত হয়ে ডেকে ওঠে।
ভাবি ডাক শুনে রিমা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। মিন্টুর বন্ধুরা তাকে ভাবি বলে ডাকে। মিন্টুর অবশ্য খুব বেশি বন্ধুবান্ধব ছিল না, এই দালানে তো নয়ই। তার বন্ধুদের অধিকাংশই বৃহত্তর টরন্টোর বিভিন্ন প্রান্তরে তিন কিংবা চার বেডরুমের বাড়ীর মালিক। এই বহুতল এপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের একটা ছোট এপার্টমেন্টে মিন্টু আটকা পড়ে ছিল। রিমার যে সেজন্যে নিজেকে কখন দোষী মনে হয় নি সেটা সে দাবী করতে পারবে না। তার সাথে বিয়ের পরই মিন্টুকে এক রকম তাদের পারিবারিক ব্যবসা থেকে বের করে দেয়া হয়। খুব ভালো না করলেও তার পরিবারের বেশ কিছু ব্যবসা ছিল। মাত্র মাস খানেকের ব্যবধানে সেগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটু নাজুক অবস্থাতেই পড়ে যায় মিন্টু। তার মায়ের উপর সেই কারণে সে অসম্ভব ক্ষুব্ধ ছিল। রিমাকে তার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করবার জন্য মিন্টুকে কথা শোনাতে কখন ছাড়েন নি তার মা। তিনিই একরকম ত্যাজ্য করে দেন মিন্টুকে।
রিমা মুখ তুকে লোকটাকে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। লিয়াকত। ওদের কয়েক তলা নীচে পরিবার নিয়ে বাস করে সে এবং তার জানা মতে মিন্টুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে একমাত্র সেই আছে এই এলাকায়। কবর দেয়া সংক্রান্ত ব্যাপারে লিয়াকতের সাহায্য না পেলে কি যে হত ভাবতেও পারে না রিমা।
লিয়াকত মানুষটা ছোটখাট, চওড়া, বর্ণ অতিমাত্রায় কৃষ্ণ, গোলাকার মুখে জ্বল জ্বলে এক জোড়া চোখ। দৈহিক এবং মানসিক উভয় দিক থেকেই মিন্টুর একেবারে উল্টো সে, দুজনে কিভাবে এতো ভালো বন্ধু হয়েছিল কে জানে? মিন্টু যখন তাকে রিমার কাছে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় ঐ প্রশ্নটাই প্রথম উদিত হয়েছিল ওর মনে। তার শিশুসুলভ হাসি আর উজ্জ্বল দৃষ্টিতে লিয়াকতকে মনে হয় পাশের বাসার এক ছটছটে ছেলে যে সবাইকে সাহায্য করবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। মিন্টুর একটা ভারী আসবাব নাড়াতে হবে, লিয়াকত হাজির। পায়খানা আটকে গেছে, চিন্তার কোন কারণ নেই। লিয়াকত প্লাঞ্জার হাতে হাজির। গাড়ি নিয়ে সমস্যা? লিয়াকত তার টুল বক্স নিয়ে উপস্থিত। বাজার নেই? কিসের চিন্তা? লিয়াকত দোকানেই যাচ্ছিল। বন্ধুর জন্য কিছু জিনিষপত্র কিনে আনবে এটা কেন সমস্যা হবে? চাইলেও তাকে অপছন্দ করা দুষ্কর। প্রয়োজনের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু।
নিজের ছোট মেয়েটাকে ঘাড়ে বসিয়ে দুই হাতে তার দুটি হাত শক্ত করে ধরে ছিল লিয়াকত। মেয়েটা বাবার কাঁধে বসে এপাশ ওপাশ দুলছে। রিমার ভয়ই লাগে। পড়ে টড়ে না যায়। মেয়েটা বাবাকে শক্ত করে ধরে থাকে, পড়ে যাবার ভয় থাকলেও দুলিনিটা সে উপভোগ করে, ভীত দৃষ্টিতে রিমার দিকে তাকিয়ে খিল খিল করে হেসে ওঠে।
“ভাবি, সব ঠিক ঠাক আছে তো?” লিয়াকত উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করে। “বেশ কয়েক দিন হল আপনার কোন খোঁজ খবর নিতে পারি নি। মন্ট্রিয়ল যেতে হয়েছিল। কোন সমস্যা নেই তো? বাচ্চারা কামন আছে? আপনাকে দেখে একটু ফ্যাঁকাসে মনে হচ্ছে। পিন্টু কি আবার সমস্যা করছে?”
রিমা এক হাত তুলে তাকে থামাল। মিন্টু ঠাট্টা করে বলত দশ কথার লিয়াকত। সে কখন একটা প্রশ্ন করে উত্তরের অপেক্ষায় থাকতে পারে না। উত্তরদাতার যদি উত্তর দিতে বিলম্ব হয় তাহলে সে নিজেই সাধারণত নিজের প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করে। তাদের বন্ধু বান্ধবদের মাঝে এটা ছিল একটা হাসির ব্যাপার। মিন্টুর সাথে বন্ধুত্ব সেই বাল্যকাল থাকে। পুরানো ঢাকার কোন এক স্কুলে দুজনে এক সাথে পড়েছিল, তারপর জীবনের পথে দুজনে দুদিকে চলে গেলেও টরন্টোতে এসে যখন আবার দেখা হয় তাদের বন্ধুত্বে নতুন জোয়ার আসে।
লিয়াকতের স্ত্রী মোনা চুপচাপ ধরনের মানুষ, ধার্মিক, হিজাবটা মাথার চারদিকে সবসময় শক্ত করে পেঁচানো থাকে, মুখ ছাড়া তার শরীরের আর কোন অংশ সে অনাবৃত রাখে না। কথা বার্তা সে কখনই তেমন একটা বলে না। বেশ কয়েক বছরের পরিচয় থাকলেও এখনও তার সাথে অধিকাংশ সময়েই আলাপ ভদ্রতাসূচক হাসি আর হাতের ইশারাতেই সাধারণত সীমাবদ্ধ থাকে। লিয়াকতের ঝাঁক বেঁধে আসা প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার আগে মোনাকে হাত দেখাল রীমা। মোনাও হাত নাড়ল। রিমা এবার দ্রুত লিয়াকতের দিকে ফিরল, নইলে সে আবার আরেক ঝাঁক প্রশ্ন ছুড়ে দেবে।
“কিচ্ছু ভাববেন না, লিয়াকত ভাই। সব ঠিক আছে। বাচ্চারাও ভালো,” সংক্ষেপে বলে সে।
একটা এলিভেটর এসেছে, মোনা দরজাটা ধরে আছে, তার স্বামীকে ডাকছে। লিয়াকত দ্রুত তার দিকে দৃকপাত করে আবার রিমার দিকে তাকাল। তার মুখে পরিষ্কার দুঃশ্চিন্তার ছাপ। “ভাবি, দোকানে হেঁটে যাতায়াত করাটা আপনার উচিৎ না।” এলিভেটরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে সে। বেশীক্ষণ ধরে রাখার জন্য এলিভেটরের এলার্ম বেজে উঠেছে। “নিরাপদ না। গাড়িটা চালাচ্ছেন না কেন?”
গাড়ি! মিন্টুর গাড়ি। আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং লটে তাদের জন্য বরাদ্দ পার্কিং স্পটে পার্ক করা আছে সেটা। কিন্তু তাতে রিমার কি সুবিধা?
“আপনি তো জানেনই আমি গাড়ি চালাতে পারি না,” সে বলে, কিছুটা তিক্ততা নিয়ে। এতো বছর এখানে আছে, অন্তত গাড়ি চালানোটা শিখতে পারত। অনেক বার চেয়েছে কিন্তু হয়ে ওঠে নি। তাদের মাত্র একটা গাড়ি ছিল, মিন্টুই সারাক্ষণ চালাত। রিমার ড্রাইভিং শিখবার প্রয়োজন কিংবা সময় ছিল না।
“একজন মহিলা ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টরের সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব,” লিয়াকত এলিভেটরের ভেতর থেকে চীৎকার করে বলে, মোনা হাত সরিয়ে ফেলায় দরজা বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। “এক মাসের মধ্যেই আপনি ড্রাইভ করবেন। পরে ফোন দেব।”
এলিভেটরের দরজা বন্ধ হয়ে যাবার ঠিক আগের মুহুর্তে পা বাড়িয়ে সেটাকে ঠেকিয়ে দিল লিয়াকত। “আপনিওতো বাসায় যাচ্ছেন। আসেন!” লিয়াকত জোর করে।
রিমা আপত্তি না করে ভেতরে ঢোকে। তারা পনের তলায় নেমে গেল। নামার আগে মহিলা ইন্সট্রাক্টর সম্বন্ধে সমানে বকবক করল লিয়াকত। তার নাম আসমা আলী। স্কারবোরতে তার স্বামীর সাথে জোট পাকিয়ে একটা ড্রাইভিং স্কুল চালান তিনি। লিয়াকত নিশ্চিত করল মহিলা যে শুধু একজন অসম্ভব ভালো মানুষ তাইই নয়, সে গাড়ী চালানো শেখাতেও অতুলনীয়। রিমাকে রাতারাতি গাড়ী চালান শিখিয়ে দেবেন।
১৩.
ঐ দিন রাতে, খাবার দাবারের পর্ব চোকার পর রিমা সিদ্ধান্ত নিল সে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং লটে গিয়ে গাড়ীটা দেখে আসবে। ফায়জা তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। এই রকম একটা ব্যাস্ত দালানেও রাতের বেলা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং লট প্রায় শূন্যই থাকে। নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হওয়াটা অযৌক্তিক নয়। গার্ড আছে কিন্তু তারপরও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। রিমা যে সেটা ভাবে নি তা নয়। ইদানীং গ্যাং সংক্রান্ত সমস্যা বেড়েছে এই এলাকায়, চুরি ডাকাতিও বেড়েছে।
“তুই আয় না আমার সাথে,” রিমা আবদার করে।
“এই দুই পঙ্গপালকে বাসায় একলা রেখে?” ফায়জা অবিশ্বাস নিয়ে বলে। “বাসায় আগুন-টাগুন লাগিয়ে দিতে পারে।”
সত্য। দুজনকে একাকী রেখে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না আবার সাথে নিয়ে গেলেও সমস্যা হতে পারে যদি রবিন হঠাত ঘাবড়ে গিয়ে চীৎকার চেঁচামেচি শুরু করে।
একটু ভাবনা চিন্তা করে বেসবল ব্যাটটা সাথে নিল, যতখানি না নিরাপত্তার জন্য তার চেয়ে বেশী একটু সাহস পাবার জন্য। ফায়জাকে দরজা বন্ধ করতে বলে এলিভেটর নিয়ে একেবারে নীচ তলায় নেমে এলো।
স্বল্পালোকিত করিডোর পেরিয়ে একটা ভারী দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। টেনে দরজাটা খুলে উঁকি দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং লটে নজর বোলাল। এই পার্কিং লট সমস্ত দালানগুলোর সাথে যুক্ত। সারি সারি পিলার ধরে রেখেছে উপরের ওজন। ভেতরে মোটামুটি আলোকিত। দূরে কয়েকটি গাড়ীকে চলতে দেখল কিন্তু সে যেদিকে আছে সেদিকে সব চুপচাপ, নিথর।
একটা গভীর শ্বাস নিয়ে রিমা, বেসবল ব্যাটটাকে শক্ত করে ধরে পা বাড়ায়।
সৌভাগ্যবশত দরজার মুখ থেকে তাদের পার্কিং স্পটটা খুব দূরে না। ডানে দুই সারি গিয়ে দশটা গাড়ি পেরুতেই দেখল ঘন নীল রঙের ঝটঠটা, হোন্ডা ঈজ-ঠ। কয়েক বছর ধরে এটাকে উপার্জনের জন্য ব্যবহার করছিল মিন্টু। ফলে গাড়িটার মাইলেজ আকাশচুম্বী কিন্তু গাড়িটা দেখতে এখনও নতুনের মত আর চলেও খুব ভালো।
রিমা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। মিন্টুকে যারা চিনত তারা যদি শুনত সে উবার কিংবা লিফটের জন্য গাড়ি চালাচ্ছে, কখন বিশ্বাস করতে পারত না। তার দৃষ্টি ছিল সবসময় অনেক উঁচুতে। রিমা মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবত কেন মানুষটা তার পারিবারিক রেস্টুরেন্ট ব্যবসা থেকে সরে এসে গাড়ি চালিয়ে সংসার চালাচ্ছিল? বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে তার মা প্রচন্ড ক্ষেপে ছিল কিন্তু সে কি কোনভাবে একটা মিটমাট করতে পারত না? অনেকবার তাকে জিজ্ঞেস করবে ভেবেছিল কিন্তু তার প্রতি মিন্টুর পরিবারের যে ঘৃণাবোধ ছিল সেটা মনে হতেই তাদেরকে নিয়ে কোন আলাপ করতেই তার মন চাইত না।
সেই প্রায় নিস্তব্ধ পার্কিং লটের মাঝে দাঁড়িয়ে, চকচকে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সম্পূর্ণ পরিস্থিতিটাকে অদ্ভুত মনে হয় রিমার কাছে। এই হতভাগা গাড়িটা জানেও না তার মালিক আর নেই। গাড়ির যত্ন নিত মিন্টু। রিমার সাথে যখন প্রথম পরিচয় হয় সে তখন একটা মার্সিডিজ চালাত। কিন্তু সেটার বয়েস হয়েছিল এবং যেকোন ধরনের সমস্যা হলেই সারাতে একগাদা টাকা গুনতে হত, বিরক্ত হয়ে সেটাকে বেঁচে দিয়ে এই গাড়িটা কিনেছিল। রবিন পেটে আসার ঠিক পরে। ছেলেটার সাথে সাথে মিন্টুর জীবনেও বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছিল। তার পেটের মাঝে বেড়ে উঠতে থকা সন্তানের কথা তুললেই লোকটার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। নতুন সন্তানের জন্য কাউকে এইভাবে আনন্দিত হতে রিমা দেখেনি আগে। তার আগের দুই প্রেগনেন্সির কোনটাতেই এর সিকি ভাগও উপলব্ধি করেনি। কিন্তু সে ছিল এক ভিন্ন সময়, তার জীবনের এক ভিন্ন অধ্যায়। সেই সব কথা সে স্মরণ করতে চায় না।
গাড়িটার চকচকে শরীরে হাত বোলায় রিমা, যেন মিন্টুর উপস্থিতি সে অনুভব করে। মৃত্যুর আগে দিনের অধিকাংশ সময় এর ভেতরেই কাটাত মানুষটা। দরজা খুলে ভেতরে উঠল সে, বসল ড্রাইভারের সিটে। বুক ভরে টানল লেবু- গন্ধয়ালা এয়ার ফ্রেসনার। রিমার সবচেয়ে প্রিয় গন্ধ। জানত মিন্টু। নিজের ভালোবাসা বোঝানোর জন্য তার অদ্ভুত কিছু প্রথা ছিল। মুখে কখন প্রকাশ করত না।
রিমা স্টীয়ারিং হুইলটা ধরে ড্রাইভিং করবার অভিনয় করে। তার ঠোঁটের ফাঁকে বালিকা সুলভ একটা হাসি লটকে থাকে। ব্যাস্ত রাস্তা দিয়ে সে নিজেকে ড্রাইভ করে যেতে দেখে, আরোও শত শত গাড়ির মাঝে। গাড়ি চালান তাকে শিখতেই হবে, নিজেকে বলে সে। আজ রাতেই আসমা আলীকে ফোন দেবে। অকারণে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে চায় না আর। এবার বুনো ষাড়ের শিং চেপে ধরে তাকে বশ্যতা মানাতে বদ্ধপরিকর সে।
“পারব আমি,” সে স্বগতোক্তি করে। “সবাই পারলে আমিও পারব।” তারপর সে কল্পনায় ছুটিয়ে দেয় গাড়ি টরন্টোর রাস্তায়, কল্পিত গাড়ির ভীড় এড়ানোর জন্য তীব্রভাবে হর্ণ বাজায় কিংবা অমনযোগী সাইক্লিস্ট অথবা পথচারীকে তারস্বরে গালমন্দ করে, ঠিক যেভাবে মিন্টু গাড়ি চলাত। তারপর একসময় সে হঠাত ভেঙে পড়ে বুক ভাঙ্গা কান্নায়।