শুজা রশীদ : (পর্ব ৪৩)
“ও কি জেলে যাবে?” নীতা ফিসফিসিয়ে বললেন।
“কে জানে?” লাট্টু কাঁধ ঝাঁকালেন। “এই বার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বাসায় বাচ্চারা ছিল। দরজায় ধাক্কা মেরেছে, লাথি মেরেছে। সারা পাড়ার মানুষ দেখেছে, শুনেছে। অনেক সাক্ষী আছে। সরকারী উকিল বলছিল এগ্রেভেটেড এসল্ট।”
“আবুল কি বলল?”
লাট্টু মাথা নাড়লেন। “ও তো ক্রিমিনাল লয়ার না। ও এই কেস নিতে চায় না। কিন্তু কথা দিয়েছে একজন ভালো উকিল খুঁজে দেবে।”
“বিশ্বাস কর ওকে?” নীতা সন্দিহান কন্ঠে বললেন। “মরিয়ম এখন পিন্টুর উপর ভীষণ ক্ষেপে আছে। ও হয়ত পিন্টুর ক্ষতি করবার চেষ্টা করতে পারে।”
“না! মরিয়ম কখন তেমন কিছু করবে না,” লাট্টু প্রতিবাদ করলেন। “তোমার ছেলের সাথে সবসময় অনেক ধৈর্য দেখিয়েছে ও। ও এবার যখন বাসা ছেড়ে চলে গেল ভেবেছিলাম পিন্টু বুঝবে ও কি হারাতে চলেছে। নিজের আচার-আচরণ ঠিক করবে। কিন্তু এখন দেখছি ভালোর চেয়ে খারাপ দিকেই গড়িয়ে নামছে। ঐদিন মরিয়মের উপর ওর অতো ক্ষেপে যাবার কোন দরকার ছিল না। ওর মাথার মধ্যে যে কি চলছে আমি বুঝতে পারছি না।”
নীতা ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন স্বামীর দিকে। “আমার দুই ছেলেকে তুমি কোনদিনই বুঝতে পারোনি। ওরা ভাবপ্রবণ, আবেগের বশে চলে কিন্তু ভেতরে খাঁটি সোনা।” তিনি থামলেন, নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। “মিন্টু চলে গেছে বিশ্বাসই হয় না।” কথা বলতে গিয়ে গলা বুঁজে এলো তার। “ওই ছিল দুজনার মধ্যে ঠান্ডা মাথার। পিন্টুতো বরাবরই একটু মাথা গরম, উলটা পাল্টা কাজ করে কিন্তু ও এখনও আমার কাছে সেই ছোট্ট পিন্টুই। ওকে কিছুতেই জেলে যেতে দিও না। কিছু একটা কর! চল, আমরা রিমার সাথে গিয়ে কথা বলি। ও যদি সরকারী উকিলের সাথে কথা বলে তাহলে হয়ত কেসটা তুলে নিতে পারে, তাই না?”
লাট্টু কাঁধ ঝাঁকালেন। “জানি না, এই দেশে ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম কিভাবে কাজ করে। কিন্তু আমাদের খুব তাড়াতাড়ি একজন উকিল নেয়া দরকার। কিন্তু তুমি চাইলে আমরা গিয়ে রিমার সাথেও দেখা করতে পারি। মিন্টুর ছেলেটাও তো আছে সেখানে। রবিন! ও তো আমাদেরকে চেনেও না।”
নীতা বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে। “সে তো ৃস্বাভাবিক না, তাই না? কথাবার্তা বলতে পারে? মানুষ চিনতে পারে? ও কি জানে দাদা-দাদী কি?”
“গিয়ে দেখিই না,” লাট্টু আলতো হেসে বললেন। “আমরা ওকে দীর্ঘদিন ধরে অবজ্ঞা করেছি। ওর তো কোন দোষ নেই।”
নীতা একটু ভাবলেন, তারপর ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন। “আমি চাই না আমার ছেলেটা জেলে যাক। ওটাই আমার প্রধান উদ্দেশ্য।”
“কখন যেতে চাও?” লাট্টু বললেন।
“জানি না,” নীতা বিরক্ত কন্ঠে বললেন। “মহারাণীকে ফোন দাও, দেখ উনি আমদের সাথে দেখা করতে চান কিনা।”
লাট্টু নীরবে হাসলেন। মিন্টুর মৃত্যুর পর থেকে মিন্টুর ছেলেটাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে আছেন তিনি। রবিনের শরীরে মিন্টুর রক্ত বইছে। ছেলেটাকে বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে চান তিনি, তার হৃৎপিন্ডের ধুকধুকানি শুনতে চান, তার গন্ধ নিতে চান, শরীরে হাত বোলাতে চান, তার চুলে বিলি কেটে দিতে চান। মিন্টু আর কখন ফিরে আসবে না কিন্তু সে তাদের জন্য একটা উপহার রেখে গেছে। খুব বেশি দেরী হয়ে যাবার আগেই সেই উপহারটাকে গ্রহণ করাটা তাদের প্রয়োজন।
৬২
শেষবার দেখা হবার পর যখন পুরো একটা দিন চলে গেল কিন্তু রিমা মিলার কাছ থেলে কোন সাড়া-শব্দ পেল না, ও ধরেই নিল পরিস্থিতি আবার খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে। ও বেশ কয়েকবার ফোন দিল কিন্তু প্রতিবারই ভয়েস মেইল পেল।
ওর দিন চলে গেছে বাড়িটা একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে, বাকী বাক্স-পোটরা গুলো খুলে জিনিষ পত্র বের করেছে, সব কিছু ঠিক ঠাক মত কাজ করে কিনা দেখেছে। ওভেনটা পুরানো কিন্তু কাজ করে। ওয়াসার এবং ড্রায়ারও অনেক পুরানো কিন্তু দুটোই এখন ভালোই চলছে। সমস্ত লাইটগুলো এবং ইলেক্ট্রিক আউটলেটগুলোও ঠিক আছে। ফার্নেসটাও চমৎকার কাজ করছে। বাসাটা বেশ ভালোই গরম হয়ে থাকে। বেসমেন্টা অবশ্য বেশ ঠান্ডা থাকে কিন্তু ও শুনেছে সব বাসাতেই নাকি সেই রকমই থাকে। গরম পানি আসতে বেশ সময় লাগে কিন্তু যখন আসে তখন বেশ অনেক্ষণ থাকে। সব মিলিয়ে, প্রয়োজনীয় সব কিছু মোটামুটি কাজ করছে।
সারাদিনে বাসা থেকে বেরিয়ে মিলার সাথে দেখা করতে যাবার সময় হয় নি ওর। সন্ধ্যায়, যখন অন্ধকার হয়ে এলো চারদিকে, ও ফায়জাকে আধা ঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসবে কথা দিয়ে বের হল বাসা থেকে, মিলার এপার্টমেন্টে গেল গাড়ী চালিয়ে, ধামধাম ধাক্কা দিল দরজায়। “মিস মিলা! মিস মিলা!
চার পাঁচবার ধাক্কানোর পর দরজা খুলল মিলা। আগের দিন সন্ধ্যায় তাকে যেমন দেখেছিল আজ তার চেয়েও খারাপ অবস্থা। সারা শরীরে গাঁজার গন্ধ। সারা বসাতেই গাঁজার গন্ধ। “সমস্যা কি তোমার?” রিমা ধমকে ওঠে। “এতবার ফোন করছি ধরছ না কেন? আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে।”
“এসেছো খুব ভালো করেছ,” মিলার কন্ঠ জড়িয়ে এলো। তারপর হঠাৎ ফিক করে হাসল। “চাও টানতে? সাথে বাচ্চারা আছে নাকি?”
রিমা একটা ভয়াবহ চাহনি দিল। “না, আমি চাই না। যাও, গিয়ে হাত মুখ ধোও। তুমি আমার সাথে যাচ্ছো। সারা বাসা গুয়ের মত গন্ধ হয়ে আছে। তোমার বাড়িয়ালা জানতে পারলে দেবে লাথি মেরে বের করে।”
মিলা মাথা নাড়ল। “আরে না! তারা স্বামী-স্ত্রীও টানে। খাওনা আমার সাথে একটু। মজাই হবে।”
“মিস মিলা! আমার কিন্তু খুব রাগ হয়ে যাচ্ছে।”
মিলা খিলখিল করে হেসে উঠল। “মা, আমার উপর রাগ কর না। আমি লক্ষী মেয়ে হয়ে থাকব।”
“এটা হাসির কিছু না!” রিমা ছদ্ম রাগে ভ্রূ কুঁচকাল।
পরবর্তি আধা ঘন্টায় নিজেই মিলাকে হাত মুখ ধুইয়ে পরিষ্কার জামা কাপড় পরালো, চুল আঁচড়ে দিল, তারপর একটা জানালা সামান্য খুলে দিয়ে উদড়ের মত গন্ধটাকে যতখানি সম্ভব বের হয়ে যাবার সুযোগ দিয়ে তাকে নিয়ে গাড়িতে চড়ল।
গাড়িতে অল্প সময়টুকোতে মিলা চুপচাপ থাকল। রিমা জানত প্যারিসে যাবে বলে মিলা সপ্তাহ দুই ছুটি নিয়েছিল। সে না চাইলে বেশ কয়েকদিন তাকে কাজে ফিরে যেতে হবে না। ওর ইচ্ছা মিলাকে ওর এবং বাচ্চাদের সাথে নিদেন পক্ষে দিন দুই রাখতে। মিলার মত কঠিন মনের মানুষও যে প্রেম সংক্রান্ত ব্যাপারে কতখানি ভেঙে পড়তে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
মিলাকে এক নজর দেখেই ফায়জা ধরে ফেলল সে নেশার ঘোরে আছে। এটাই রিমার প্রধান ভয় ছিল। ফায়জা ওর দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। রিমা দ্রæত মাথা নাড়ল। না, না, ও টানেনি।
বাসার মধ্যে কোন রকমের ধূমপান চলবে না! ফায়জা নিঃশব্দে মুখ নাড়িয়ে বলল।
রিমা দুই হাত তুলে সারেন্ডার করল। প্রশ্নই আসে না।
সেই রাতে, বাচ্চারা সবাই বিছানায় চলে যাবার পর, রিমার বিছানায় আধা শোয়া হয়ে বসে মিলা তার প্যারিসের গল্প বলতে শুরু করে, অনবরত। সারা রাত ধরে কথা বলে যায়, ডাক্তারের সাথে কোথায় কোথায় গিয়েছিল তার বর্ণনা দেয়, দুজনার মধ্যে যত কথাবার্তা হয়েছে সেগুলো বারবার আওড়ায়, লোকটার বলা ফালতু কৌতুক বলেও খিলখিল করে হাসে। কখন হাসি, কখন কান্নার মাঝে আবার হঠাৎ হঠাৎ একেবারে নীরব হয়ে যায়, যেন চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলে। সেই নাটকীয়তার মধ্যে চুপচাপ বসে থাকে রিমা, মাঝে মাঝে একটু আধটু ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টাও করে। মিলার দুঃখ-কষ্ট ও বুঝতে পারছে না তা নয় কিন্তু ও জানে খুব শীঘ্রই মিলা ঐ মিথ্যাবাদী, ধোঁকাবাজের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসবে এবং তখন নিজের এই করুন প্রতিক্রিয়ার কথা শুনে খুব একচোট হাসবে, লোকটাকে নিয়ে কিছু নোংরা হাসি ঠাট্টা হয়ত করবে।
তবে একটা কথা ও বুঝতে পেরেছে, মিলার জীবনে অনেক প্রেমিক এলেও তাদের সবাই ছিল খুব সাধারণ, বিদ্যায়, কর্মে। এই ডাক্তার এসেছিল ওর জীবনের এক নক্ষত্রের মত। তার জীবনের যাবতীয় সংগ্রাম এবং কাঠিন্য থেকে পরিত্রাণ পেতে চেয়েছিল মিলা, সাধারণের উর্দ্ধে উঠতে চেয়েছিল, সম্মান এবং বিত্তের ছোঁয়া পেতে চেয়েছিল। যতখানি না মানুষটার জন্য তার শোক তার চেয়েও বেশি শোকাতপ্ত সে তার সেই দীর্ঘদিনের স্বপ্নটার এই আচমকা হারিয়ে যাবার ক্ষোভে। কথা বলতে বলতে এক সময় মিলা ঘুমিয়ে পড়ে, ভোরের দিকে। দুপুর পর্যন্ত এক টানা ঘুমায় শিশুর মত। রিমা শোবার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে রাখল, বাচ্চাদেরকে সাবধান করে দিল যেন খুব বেশি শব্দ না করে।
বিকালে, দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে, সামনের বাঁকানো জানালাটার সামনে কোমল, উষ্ণ রোদের মধ্যে মিলাকে নিয়ে দুইটা চেয়ার টেনে বসে রিমা।
“ডাক্তার সাহেব তো জাহান্নামে গেল,” রিমা ঠাট্টা করে বলে, আশা করে মিলা ওর কথার ভেতরের কৌতুকটা ধরতে পারবে, “মিস মিলার পরবর্তি পরিকল্পনা কি?”
মিলা আহত ভঙ্গিতে হাসল। “এটা ভুলতে আমার কিছু সময় লাগবে। নিজের উপরেই ভীষণ ক্ষেপে আছি। কি করে বুঝতে পারলাম না? হারামীটা আমাকে এমন করে বোকা বানাল!”
মিলা এক হাত বাতাসে অবজ্ঞা ভরে ঝাড়ল। “আরে, ভুলে যাও তো ওকে। ওর চেয়ে অনেক ভালো কেউ তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। ওর জন্য নিজের জীবনটা নষ্ট কর না।”
মিলা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। “জানো, আমাকে কোন বিষয়টা সবচেয়ে বেশি আঘাত দিয়েছে? লোকটা চাচ্ছিল আমি সম্পর্কটা চালিয়ে যাই, সব জানার পরও। তোমার জন্য এটা কেন সমস্য হবে? আমাকে বলেছে। কতখানি বমায়েশ হলে একজন মানুষ এই ধরনের একটা প্রশ্ন করতে পারে চিন্তা করতে পারো? আমাকে দেখে কি সেই ধরনের মেয়ে মনে হয় যে কারো রক্ষিতা হবে?”
রিমার ফোন বাজছে। লাট্টু। ফোনটা নেবার আগে মিলার কাছ থেকে একটু দূরে সরে এলো ও।
“হ্যাঁ, আব্বা?” রিমা শীতল গলায় বলে।
“ঐ দিনের ঘটনার জন্য আমি সত্যিই খুব দুঃখিত,” লাট্টুর কন্ঠে অনুতাপ। “পিন্টুর যে কি হয়েছে আমি ধরতে পারছি না। কিন্তু ওর কর্মের শাস্তি ওকেই পেতে হবে। তোমরা সবাই ঠিক আছো তো?”
“হ্যাঁ, আব্বা। আমরা সবাই ভালোই আছি। বাচ্চারা একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল কিন্তু এখন ঠিক আছে।”
“আচ্ছা, আমি আর নীতা অল্প একটু সময়ের জন্য যদি আসি তোমাদের কি খুব অসুবিধা হবে? আমাদের খুব ভালো লাগত।” লাট্টু বিনীত কন্ঠে বললেন।
রিমা বেশ অবাক হল। নীতা ওর বাড়িতে আসবে এটা ও কখন কল্পনাও করেনি। এই আগমনের পেছনের মূল উদ্দেশ্যটা কি বোঝার চেষ্টা করল। মাথার মধ্যে চিন্তার ঝড় চলছে ওর। ঠিক সেই সময় বুদ্ধিটা এলো। এই সু্যােগে রবিনের সাথে তার দাদা-দাদীর পরিচয়টা হয়ে যেতে পারে।
“নিশ্চয় আব্বা। কখন আসবেন আপনারা?”
লাট্টু বিকালেই আসবার আগ্রহ দেখালেন। নীতার আজ নাকি শরীরটা অনেক ভালো লাগছে। কোন কোন দিন তার আর্থাইটিস খুব খারাপ থাকে, বিছানা ছেড়েই উঠতে পারেন না।
রিমা তাকে বাড়ির ঠিকানা আর আসার পথটা যতখানি পারে বলে দিল।
হাতে ঘন্টা দুই সময় আছে ওর। বাসাটাকে গুছিয়ে একটু গ্রহণযোগ্য করতে আপ্রাণ চেষ্টা করল। নীতা এই প্রথমবারের মত তার বাসায় আসবেন। তাকে খারাপ কিছু বলার কোন সুযোগ রিমা দিতে চায় না। বাচ্চাদেরকে তদের সেরা কাপড় পরাল, চুল আঁচড়ে দিল, দাঁত ব্রাশ করাল। ওদেরকে দেখে যেন মনে হয় ছবির বাচ্চাদের মত, বিশেষ করে রবিনকে। তার ছোট নীল স্যুট-প্যান্টে তাকে দেখাচ্ছে একটা ক্ষুদে ভদ্রলোকের মত- দেখলেই যে কারো হৃদয় মাখনের মত গলে যাবে।
ওর বাড়াবাড়ি দেখে ফায়জা চোখ উল্টাল। হচ্ছে টা কি!
৬৩
রিমা যা ভেবেছিল তার কিছু আগেই চলে এলেন তারা। ডোরবেল বাজার সাথে সাথেই দরজা খুলে দিল ও, ওর আগ্রহ উদ্দীপনায় যে কোন ঘাটতি নেই সেটা বোঝানোর জন্য। নীতাকে দেখে মনে হল একটু ভয়ে ভয়ে আছেন, হয়ত ভেবেছেন রিমা খুব ভাব দেখাবে। এই সুযোগে তাকে খুব অপমান করবে।
“আসেন আম্মা,” রিমা খুব শ্রদ্ধা ভরে তাকে ভেতরে আসার জন্য আহ্বান করে। তারপর লাট্টুর দিকে ফিরে বলে, “আব্বা, আসেন।”
নীতা খুব সাবধানে পা বাড়িয়ে ভেতরে ঢুকলেন, সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন, অবশেষে তার দৃষ্টি আটকাল সুবেশী তিন ছেলেমেয়ের উপর। নীল স্যুট পরে সবার সামনে যে ছোট ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে সে-ই নিশ্চয় রবিন। ছেলেটা অবশ্য তাদের দিকে তাকিয়ে নেই। সে তার বড় ভাইয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে আছে, তার শরীরে মাথা দিয়ে খেলাচ্ছলে ক্রমাগত ধাক্কা দিচ্ছে। ছেলেটার মাথা ভর্তি সিল্কি কালো চুল আর বড় বড় বাদামী চোখ তাকে মিন্টু যখন ঐ রকম ছোট ছিল সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দিল। ছবিতে বেশ কিছুদিন আগে ছেলেটাকে একবার দুইবার দেখেছিলেন তিনি, কিন্তু চেহারাটা তার মনেও ছিল না।
ফায়জা এবং জিব্রান তাদেরকে সালাম দিল। নীতা হালকা করে মাথা নাড়লেন। লাট্টু সালামের উত্তর দিলেন। রিমা ছোট হলওয়ে দিয়ে তাদেরকে লিভিং রুমে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসতে দিল। লাট্টু রবিনের সাথে আলাপ করার চেষ্টা করলেন কিন্তু সেই প্রচেষ্টা খুব একটা সফল হল না। রবিন তার দিকে ফিরেও তাকাল না। ফায়জা লক্ষ্য করল লাট্টু খুব অস্বঃস্তি বোধ করছেন।
“অচেনা মানুষ দেখলে ও খুব ভয় পায়,” ও ব্যাখ্যা করে। “তাদের দিকে সরাসরি তাকায় না। ভেতরে ভেতরে কোন এক ধরনের দুশ্চিন্তা কাজ করে বোধহয়।”
লাট্টু বোদ্ধার মত মাথা দোলান। “নিশ্চয়! আমরা তো ওকে এর আগে কখন দেখতে আসি নি। আমাদেরকে চিনবে কি করে? তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছ, মামনি। কত বয়েস হল তোমার?”
“তের,” ফায়জা বলে, তার দৃষ্টি চলে যায় নীতার দিকে। নীতার চোখ রবিনের উপর আবদ্ধ। এইমাত্র ভাইয়ের পিছু নিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেছে রবিন। মনে মনে একটু অবাক হল। যার জন্য তারা কখন কোন আগ্রহ দেখান নি হঠাৎ তার জন্য তাদের এতো আগ্রহের কারণ কি?
“ও কি কথা বলতে পারে?” নীতা দ্বিধান্বিত কন্ঠে জানতে চাইলেন।
“হ্যাঁ, পারে,” ফায়জ সতর্ক কন্ঠে বলে। তাদেরকে ও খুব একটা বেশী আশান্বিত করতে চায় না। “কিন্তু মাত্র অল্প কিছু শব্দ জানে আর শুধু যাদেরকে খুব ভালোবাসে তাদের সাথেই কথা বলে। জিব্রানের সাথে অনেক কথা বলে। মাঝে মাঝে হয়ত মায়ের সাথেও বলে। আমাকে খুব একটা পছন্দ করে না। আমি খুব বকা দেই তো।”
নীতা ওর দিকে আলতো এক টুকরো হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন। তাকে মনে মনে স্বীকার করতেই হল এমন সুন্দর মেয়ে তিনি খুব কম দেখেছেন, আর তার আত্মবিশ্বাসও চোখে পড়ার মত, মানুষের চোখে চোখ রেখে বিনীত ভাবে কথা বলার ভঙ্গীটা চমৎকার। মেয়েটার সম্বন্ধে কত কথা শুনেছেন তিনি কিন্তু ওর মায়ের প্রতি তার ক্ষোভের কারণে তাকেও খানিকটা হলেও অপছন্দ করতেন। নিজেকে তার এই মুহুর্তে সেই জন্য অপরাধীই মনে হয়।