শুজা রশীদ : (পর্ব ৪০)
বাসা বদল করা যে কি কঠিন কাজ সেটা হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেল রিমা। এই এপার্টমেন্টে ছিল ওর ছয় বছরের সংসার। একটু একটু করে জিনিষপত্র জমে গেছে- অধিকাংশই বাচ্চাদের। তাদের ছোটবেলার জামাকাপড় থেকে শুরু করে যাবতীয় খেলনা, বই-পত্র, ছোটখাট জিনিষপত্র যা ফেলে দিতে পারেনি, ভবিষ্যতের জন্য যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছিল। কোন একদিন বাচ্চারা যখন বড় হয়ে যাবে তখন দেখে খুশী হবে তাদের মা তাদের ছেলেবেলার কত কিছু ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রেখেছে- হাতে আঁকা ছবি, প্রিয় রঙ্গিন পেন্সিল, ছোট্ট সানগ্লাস, এবং এই জাতীয় আরও কত কিছু।
আসবাবপত্র বলতে অবশ্য ওদের তেমন কিছু নেই। খান দুই বিছানা, এক জোড়া সোফা, একটা ছোট ডাইনিং টেবিল, খান ছয়েক চেয়ার, তুলনামূলকভাবে বড় একটা ড্রেসিং টেবিল- প্রথম বিবাহ বার্ষীকিতে মিন্টুর দেয়া উপহার। অন্যন্য বিবাহ বার্ষীকিতে নিশ্চয় ছোটখাট কিছু উপহার সে দিয়ে থাকবে কিন্তু এই একটাই ছিল স্বরণীয়। বেশ কয়েক বছর ব্যবহারের পর এদিক সেদিক কিছু রঙ উঠে গেছে। দুই ছেলে এর উপর উঠে নীচে লাফ দেয়। যে কারণে পায়াগুলোও একটু নড়বড়ে হয়ে গেছে। অধিকাংশ মানুষ নতুন বাসায় যাবার সময় পুরানো আসবাবপত্র সব ফেলে দিয়ে যায়। রিমা ঠিক করেছে ও সব সাথে নিয়েই যাবে। পরে ভালো দাম পেলে অল্প অল্প করে নতুন আসবাবপত্র কিনবে। ড্রেসিং টেবিলটা অবশ্য রেখে দেবে।
ফায়জাকে নিয়ে গ্রোসারী স্টোরে গেল কিছু ব্যবহৃত কার্ডবোর্ড বাক্স জোগাড় করতে। জাফর একজন মুভারের সাথে ওর যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে। শ্রীলংকান ভদ্রলোক, নাম ভিনয়, বহু বছর ধরে করছে। বিশ্বাসযোগ্য। জাফর ওকে বলেছে অনেক মুভাররা নাকি সুযোগ পেলে মানুষকে অকারণে বেশি চার্জ করে, অতিরিক্ত টাকা না পেলে জিনিষপত্র ট্রাক থেকে নামাতে অস্বীকার করে।
ভিনয়ের রেট খুব বেশি নয়, সময় জ্ঞানও চমত্কার- এই পেশায় যা নাকি সচারাচর দেখা যায় না। তাদের সার্ভিস নিয়ে অনেকেই অনেক হুজ্জত পোহায় নানান কারণে। জিনিষপত্র সরানো যে এতো ঝামেলার কাজ রিমার জানা ছিল না। নোমান সাহায্য করতে রাজী হওয়ায় ও মনে মনে পরিত্রাণের নিঃশ্বাস ফেলেছে। ডিসেম্বর মাসে কেউ খুব একটা বাসা বদল করে না বলে উইকেন্ডে ভিনয়ের শিডিউল পেতে কোন অসুবিধা হয়নি। সেটাও একটা স্বস্তির ব্যাপার। অফিস থাকলে নোমানের পক্ষে খুব একটা সময় দেয়া সম্ভব হত না।
রিমা চেয়েছিল এপার্টমেন্ট ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠতে। কিন্তু বললেই তো আর যাওয়া যায় না। প্যাকিং শুরু করতে গিয়ে দেখল তিন-চারদিন কিভাবে পেরিয়ে গেছে টেরও পায়নি।
মিলার কাছ থেকে বেশ কয়েকদিন হল কোন সংবাদ পায়নি। বাড়ি কেনার খবরটা জানিয়ে তাকে টেক্সট করেছিল রিমা। মিলার কাছ থেকে কোন উত্তর আসেনি। মিলা সাধারণত এতো চুপটি মেরে যায় না কিন্তু রিমা ভেবেছে সে হয়ত ডাক্তার সাহেবের সাথে এতো বেড়াচ্ছে যে মেসেজ চেক করারও সময় পাচ্ছে না।
যে দিন ভিনয় জিনিষপত্র সরাতে এলো সেদিন আরেকটা মেসেজ পাঠাল।
নতুন বাড়িতে যাচ্ছি আজকে।
তুমি থাকলে খুব ভালো লাগত।
অন্য পক্ষ থেকে এবারও কোন উত্তর এলো না।
৫৮
মরিয়ম একটু চিন্তায় পড়ে গেছে। ওর শ্বশুর মশাই যেদিন ওর সাথে দেখা করতে এলেন সেদিনই ওর মনে হয়েছে ওর এই গৃহত্যাগ যতখানি ক্ষণস্থায়ী হবে বলে ভেবেছিল ততখানি হবার কোন সম্ভাবনা নেই। পিন্টু যদি ভেবে থাকে বাবাকে পাঠিয়ে এই সমস্যাস সমাধান করে ফেলা যাবে তাহলে সে এই সমস্যার প্রকৃত রূপই এখনও ধরতেই পারেনি। যার একটাই অর্থ। মরিয়মকে বাবার বাড়িতে বেশ কিছুদিন গ্যাঁট মেরে বসে থাকার পরিকল্পনা করতে হবে। একটা কাজও নিয়ে নেবে কিনা ভাবছে। দোকান- পাটে কাজ করবার কোন আগ্রহ ওর নেই। ক্যাম্পাইনিংগ করতে আপত্তি নেই। ঐ লাইনে কাজ করতে ওর আগ্রহ হয়। পুরানো কিছু বন্ধুবান্ধবকে ফোন করেছে কিন্তু তেমন কোন সুযোগ আসেনি এখনও। ভাবছে বড় ভাইকে বলবে বাংলাদেশী বংশদ্ভুত যে মেয়েটা এন ডী পি র ক্যান্ডিডেট হিসাবে তাদের ওয়ার্ড থেকে দাঁড়িয়েছে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে।
তিন দিন পরে এক সন্ধ্যায় লাট্টু আবার এসে হাজির হলেন। মরিয়ম বিছানায় আধশোয়া হয়ে তার সেল ফোনে ইউটিউবের একটা ভিডিও দেখছিল। দোলন হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলো। “ওনারা এসেছেন!”
“কারা?” মরিয়ম অবাক হয়ে জানতে চায়। এই শহরে কেউ আগে থেকে খবর না দিয়ে কারো বসায় আসে না।
দোলন চোখ ওলটাল। “আর কারা? তোমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ী! সবাই এসেছেন। পিন্টু ভাই বাইরে গাড়ি পার্ক করছেন। যলদি ওঠ। একটা ভালো শাড়ি পরে নাও।”
মরিয়ম মুখ বাঁকাল। “তারা এসেছেন বাচ্চাদের দেখতে। তুমি ওদেরকে ভালো পোশাক-আষাক পরাও।”
দোলন হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নাড়ল। “আচ্ছা যাই, তাই করি।”
পোশাক পাল্টানোর প্রস্তাবে দুই মেয়েই ভয়ানক আপত্তি করল। জোরাজুরি করার সময় দোলনের নেই। দরজায় ইতিমধ্যেই বেল বাজছে। সে বিড়বিড়িয়ে বলল, “না, তোমাদের পোশাক ভালোই আছে। এতেই হবে।” তারপর ছুটল দরজা খুলতে।
মরিয়ম ভাবেনি লাট্টু সত্যি সত্যিই নীতাকে নিয়ে এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবেন বাচ্চাদের দেখার জন্য। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনল দোলন দরজা খুলে লাট্টু এবং নীতাকে লিভিংরুমে নিয়ে বসাল। তার দুই মেয়ে দাদু এবং দাদীর সাথে কথা বলছে। তারা নিশ্চয় ভালো কোন উপহার নিয়ে এসেছেন। হ্যাপি খুশীতে চীত্কার দিয়ে উঠল।
বিছানা ছাড়ল ও। হাতমুখ ধুয়ে শাড়িটা পাল্টাল, একটু মেকআপও নিল। পিন্টু যদি সত্যি সত্যিই এসে থাকে তাহলে ধরতে হবে এটাই তার প্রথম সত্যিকারের প্রচেষ্টা মিল মহব্বত করার। তাকে একটু উত্সাহ দেবার মধ্যে মন্দ কিছু নেই।
ও লিভিংরুমে প্রবেশ করতে ওর দিকে তাকিয়ে একটা শীতল হাসি দিলেন নীতা। লাট্টু সাধ্যমত চেষ্টা করলেন এই সাক্ষাতে কিছু প্রাণ আনতে। “তুমি বলেছিলে আমরা আসতে পারি, তাই চলে এলাম,” একগাল হাসি নিয়ে বললেন।
পিন্টু এখনও ভেতরে আসেনি। কি করছে বাইরে এতক্ষণ? মনে মনে একটু অবাক হল মরিয়ম।
“আপনাদেরকে দেখে খুব ভালো লাগছে!” মরিয়ম বলল। “আজ রাতে আমাদের সাথে খেয়ে যাবেন।”
“না, না!” নীতা আপত্তি করলেন। “বেশীক্ষণ থাকব না আমরা। মেয়ে দুইটাকে দেখতে এসেছি। আশা করি হঠাত এভাবে এসে কোন ঝামেলা করিনি।”
“কি বলছেন খালাম্মা!” দোলন ভয়ানক প্রতিবাদ করে উঠল। “আপনারা এসেছেন তাতে আমরা যে কি খুশী হয়েছি সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু পিন্টু ভাই কোথায় গেল?”
“নিশ্চয় বিড়ি ফুঁকছে,” নীতা বিরক্ত কন্ঠে বললেন। “ওকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমাদের সাথে বস। রাতে আমরা খাচ্ছি না। আমি বাসার বাইরে খেতে পারি না। আবুল কোথায়?”
দোলনের মনটা খারাপ হল। নিজের অতিথি আপ্যায়ন নিয়ে তার বিশেষ রকমের অহমিকা আছে। আজ মনে হচ্ছে নিজেকে প্রমাণ করবার একটা মোক্ষম সুযোগ হাত ছাড়া হতে চলেছে।
“ওর একটা এপয়েন্টমেন্ট আছে রাতে,” দোলন বলে। “নটার মধ্যে চলে আসবে। আমি ওকে না হয় এখনই একটা ফোন করছি। এপয়েন্টমেন্টটা ক্যান্সেল করে বাসায় চলে আসুক।”
“কোন দরকার নেই,” নীতা দৃঢ় স্বরে বললেন। “আমরা খুব বেশীক্ষণ থাকব না। আমার শরীরটা খুব ভালো যাচ্ছে না। বাসায় ফিরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে হবে।”
“আচ্ছা, আমি গিয়ে পিন্টু ভাইকে নিয়ে আসি,” দোলন স্লিপার পরে বাইরের উঠোনে চলে গেল। দেখল পিন্টু সব দরজা-জানালা বন্ধ করে গাড়ির মধ্যে বসে আছে। সে কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করল। পিন্টু নীরবে হাত নাড়ল কিন্তু ভেতরে আসতে রাজী হল না। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে ভেতরে ফিরে এলো দোলন। “ভেতরে আসতে চান না,” খুব মন খারাপ করে ঘোষণা দিল সে।
লাট্টু মনে হল একটু লজ্জিত বোধ করলেন। “বেশি ঘাড় ত্যাড়া!”
“রেগে আছে!” নীতা বিড়বিড়িয়ে বললেন। “ঐ বজ্জাত ছেলেটা কেন মেয়েদেরকে পড়াচ্ছে? ওরতো জেলে থাকা উচিত। মরিয়ম, তোমার উচিত ছিল পিন্টুকে আগে জিজ্ঞেস করা। সে বাবা। ওরও তো একটা অধিকার আছে।”
মরিয়ম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। ভাবতেও অবাক লাগে হঠাত করে কালাম কেমন গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাক্তিত্তে¡ পরিণত হয়েছে। এক মুহুর্তের জন্যে ওর মনে হয়েছিল পিন্টু হয়ত ওর সাথে মিল করতেই এসেছে। কিন্তু এই কথা শোনার পর আর খুব একটা নিশ্চিত হতে পারছে না।
“মাস্টার সাহেব কিন্তু খুব ব্রিলিয়ান্ট!” দোলন কালামের পক্ষ নিয়ে বলল। “জলি আর হ্যাপি দুজনাই ওকে ভীষণ পছন্দ করে। স্কুলেও দু’জনাই খুব ভালো করছে। ও কত সুন্দর করে যে সবকিছু বোঝায় দেখলে আপনারা মুগ্ধ হয়ে যাবেন। তাই না?” সে ছাত্রীদের দিকে তাকাল সমর্থনের আশায়।
জলি এবং হ্যাপি বুঝতে পেরেছে তাদের প্রিয় টিউটরকে নিয়ে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। দু’জনে দ্বিদ্ধান্বিত ভঙ্গিতে আলতো করে মাথা দুলিয়ে মায়ের দিকে তাকাল।
“তুমি কি জান ঐ ছেলে আমাদের একজন কর্মীকে প্রায় খুন করতে বসেছিল?” নীতা তিক্ত কন্ঠে বললেন। “ওর কপাল ভালো যে আমরা ওর বিরুদ্ধে মামলা করি নি। ওর মত একটা বিপজ্জনক মানুষের বাচ্চাদের আশেপাশেই থাকা উচিত নয়। পিন্টু যে রেগে আছে সেই জন্য আমি ওকে দোষ দিতে পারি না।”
দোলন নীতার কথাবার্তা শুনে একটু ঘাবড়ে গেল। দিশেহারা ভঙ্গিতে মরিয়মের দিকে তাকাল। ওর মনে হল আবুল এখন বাসায় থাকলেই ভালো হত। পরিস্থিতিটা কেমন করে যেন হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। “আচ্ছা, আমি আপনাদের জন্য চা নাস্তা নিয়ে আসি। আপনারা চা খাবেন না কফি খাবেন?”
“আমি একটু কফি খাব,” লাট্টু দ্রুত বললেন। বোঝা গেল পরিবেশটাকে একটু হালকা করতে চাইছেন তিনি।
“আমরা এখনই উঠব,” নীতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলেন।
“এখনই?” লাট্টু একটু ভয়ে ভয়ে বললেন। তাকে দেখে মনে হল তিনি একজন পরাজিত মানুষ। পারিবারিক সমস্যা মিটিয়ে ফেলার তার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ মাঠে মারা যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে কি করা যায় তিনি নিশ্চিত হতে পারছেন না।
“আরেকটু বসেন, আম্মা,” মরিয়ম বিনীত কন্ঠে বলল। “বাচ্চাদের সাথে আরেকটু সময় কাটান। ওরা আপনাদেরকে খুব মিস করে।”
নীতা মনে হল প্রস্তাবটা নিয়ে একটু ভাবলেন। “আমার হাঁটুতে খুব ব্যাথা হচ্ছে। হেঁটে গাড়ি পর্যন্ত যেতে হলে আমাকে আরেকটু বিশ্রাম নিতেই হবে।”
“আমি বরফ নিয়ে আসি?” দোলন দ্রুত বলল।
“না, না, লাগবে না,” নীতা তাকে থামিয়ে দিলেন। “আমার আর্থ্রাইটিস আছে। হাঁটলে বেশি খারাপ হয়।”
মরিয়ম মনে মনে কৃতজ্ঞ অনুভব করে। নীতা বুদ্ধিমতী মহিলা। দোলন এবং মেয়েদের সামনে নিজেকে ক্ষুদ্র করতে চাননি তিনি।
পরিবেশটা যখন একটু সহনীয় হয়ে আসছে ঠিক তখনই আবার সব তছনছ হয়ে গেল। পিন্টু যে কখন দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা কেউই খেয়াল করেনি।
“মরিয়ম! বাইরে আসো। কথা আছে।” সে দরজার বাইরে থেকেই জোর গলায় ডাকল।
পিন্টুর এই জাতীয় ব্যবহার মরিয়ম আশা করেনি কিন্তু এতো বছর সংসার করার পর তার কাছ থেকে কোন কিছুই ওকে আর বিস্মিত করে না। সে দরজার কাছে গিয়ে বলল, “ভেতরে আসছো না কেন?”
পিন্টু অন্য দিকে তাকিয়ে হাতের ঈশারায় ওকে বাইরে আসতে বলল, কোন জবাব দিল না। মরিয়ম ক্ষনিকের জন্য লোকটাকে পরখ করল। রেগে আছে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু মাতাল হয়ে নেই। অসম্ভব গম্ভীর মুখ, কঠিন দৃষ্টি, খাঁড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গী এবং আড়ষ্ট কাঁধ দেখেই যা বোঝার বুঝে নিল ও। সে আজ এখানে ওকে বাসায় ফিরিয়ে নিতে আসেনি। এসেছে মনের রাগ ঝাড়তে। আজকের এই নাটকের প্রধান চরিত্র হচ্ছে কালাম।
উঠোনে বের হয়ে দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিল মরিয়ম। যা বলতে চায় বলে বুকের বোঝাটা হালকা করুক লোকটা।
“তুমি কি করছ এসব?” পিন্টু খেঁকিয়ে উঠল। “দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে! বাবা-মা র বয়েস হয়েছে। তাদের দেখা শোনা করার জন্য কাউকে তো দরকার। আমি এখন সারাদিন রেস্টুরেন্টে থাকি। তাদের দেখভাল করা আমার পক্ষে একেবারেই সম্ভব হচ্ছে না। এইসব ফাজলামী বন্ধ করে বাসায় ফিরে আসো।”
মরিয়মের মনটা বিষাদে ভরে গেল। বাসায় ফিরে যাবার যেটুকু আশা ছিল সেটাও গেল। “আর কিছু বলবে?” ও শান্ত গলায় বলে।
“ঐ হারামীটা আমার মেয়েদেরকে কেন পড়াচ্ছে?” পিন্টু চীত্কার করে উঠল। “ও হচ্ছে রিমার চর। এই সামান্য ব্যাপারটা তোমার মাথায় ঢোকে না?”
“সে রিমার চর নয়,” মরিয়ম বোঝানোর চেষ্টা করে। “রিমা ওকে কিছুই করতে বলে নি। জাহানের সাথে লড়াই করেছে কারণ তুমি জাহানকে এমন কিছু একটা করতে বলেছ যেটা তোমার বলাটা একেবারেই ঠিক হয় নি। নিজের ভুল স্বীকার করার সময় এসেছে তোমার।”
“ভুল? কিসের ভুল?” পিন্টুর মুখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে। “তুমি এখন তার পক্ষ নিচ্ছ? আমার ভাইটা মরেছে ওর জন্য। আমি অন্যায় কিছুই করি নি। বুঝেছ?” পিন্টু ইঁটের দেয়ালে ধড়াম করে একটা ঘুষি বসাল। “সবকিছুতে সব সময় আমার দোষ!” গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচাচ্ছে সে। “বাসায় চলে আসো, ঠিক আছে? আর ঐ হারামীটা যেন আমার মেয়েদেরকে আর না পড়ায়। মনে থাকে যেন।”
মরিয়ম লক্ষ্য করল বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী কৌতূহলী দৃষ্টিতে এদিকেই তাকিয়ে আছে। এই শহরে গৃহকোন্দল সংক্রান্ত সহিংসতা প্রচুর হয়ে থাকে। সবাই চোখ কান খোলা রাখে। প্রয়োজন মনে করলে পুলিশে খবর দেয়। পিন্টুর ব্যবহার ওকে একটু চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে।
“আমার মনে হয় তোমার এখন চলে যাওয়াই ভালো,” মরিয়ম শান্ত কন্ঠে বলে।
লাট্টু মনে হয় বুঝতে পেরেছেন পিন্টু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি দরজার বাইরে মুখ বাড়িয়ে বললেন, “পিন্টু, আমরা এখন যাবো। তোর মায়ের বিশ্রাম দরকার।”
“এর মধ্যেই?” পিন্টু মুখ কুঁচকাল। “মাত্রতো এলাম। মেয়ে দুইটার সাথেইতো এখনও দেখা হল না।”
“দেখা কর, তারপর যাই,” লাট্টু গম্ভীর মুখে বললেন। “আর দেয়ালে ঘুষি মারছিস কেন?”
“ঘুষি মারলাম কখন? একটু ছুঁয়েছি মাত্র।” পিন্টু বিরক্ত গলায় বলল। “আচ্ছা ঠিক আছে, চলেন যাই। মাকে বের হতে বলেন।” মরিয়মের দিকে আরেকটা অগ্নি দৃষ্টি হেনে ধুপ ধাপ করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গাড়ীর মধ্যে গিয়ে ঢুকল, সশব্দে গাড়ীর দরজা বন্ধ করল।
“ভেব না, সব ঠিক হয়ে যাবে,” লাট্টু মরিয়মকে বললেন। “তুমি ভেতরে আসো। অনেক ঠান্ডা বাইরে।”
মরিয়ম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ভেতরে ঢুকল। নীতা ভেতরে বসেই ওদের আলাপের শেষাংশ শুনেছেন। তিনি আসন ছেড়ে উঠে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। “চল যাই। আরেক দিন আসব।”
মরিয়ম মেয়েদের দিকে তাকাল। “তোমাদের বাবা গাড়ীতে বসে আছে। যাও, দেখা করে আসো।” তারা দু জনাই নীরবে মাথা নাড়ল। বাবা রেগে আছে, এই অবস্থায় তার সাথে দেখা করবার কোন আগ্রহ তাদের কারোরই নেই।