শুজা রশীদ : (পর্ব ৩৮)
আবুল ডাইনিং টেবিলে বোনের জন্য অপেক্ষা করছিল, হাতে টরন্টো স্টারের সানডে এডিশন। মরিয়মকে আসতে দেখে হাসিমুখে বলল, “শেষ পর্যন্ত এলি? আমার তো ক্ষিধায় নাড়ী ভুঁড়ি হজম হয়ে যাবার জোগাড়। দোলন, আমাদেরকে একটু নাস্তা দেবে?”

মরিয়ম হাসিমুখে বলল, “ভাইয়া, আমার জন্য কেন অপেক্ষা কর? খেয়ে নিলেই পারো।”
“তুই আমার একটা মাত্র বোন,” আবুল হেসে বলে। “একসাথে খেলে ভালো লাগে। আমার পাশে এসে বয়। দোলন এখনই নাস্তা নিয়ে আসবে।”

“আমাকে দেখে কি মহারাণী মনে হয় যে টেবিলে বসে ভাবী খাবার এনে দেবে সেই অপেক্ষায় থাকব?” মরিয়ম ঠাট্টা করে বলে রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে। দোলন ফ্রোজেন পরাটা বের করে ভাজছিল। খিল খিল করে হেসে ওঠে।

“তোমার কথাবার্তা শুনে খুব মজা লাগে মরিয়ম আপু,” ছেলেমানুষী উচ্ছ¡াস নিয়ে বলে। তার বয়েস পঁচিশ হলেও আচার আচরণে সে এখনও অল্পবয়স্ক তরুণীদের মত।
দোলনের সহজ সরল ব্যবহার মরিয়মের খুব পছন্দ। সে নিজে সব সময় বয়েসের তুলনায় বেশী গাম্ভীর্য নিয়ে থেকেছে। বিশেষ করে বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ীতে যাবার পর তার গাম্ভীর্য আরোও অনেক বেড়েছে। সেখানে তার প্রতিটা কথাবার্তা, চলন বলন এমন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হয় যে সে ভয়ে অপ্রয়োজনে কথাবার্তা বলাই ছেড়ে দিয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে দুই জন বয়স্ক মানুষ কি করে তার জীবনে এতো গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। কাছ থেকে না দেখলে বোঝাটা কষ্টকরই। তার শ্বশ্বুর লাট্টু আহমেদ কয়েক বছর আগেও সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ ছিলেন। তার কর্তাগিরি এবং রুক্ষ ব্যবহার সহ্য করা কঠিন ছিল। বয়েস বাড়ার সাথে সাথে, বিশেষ করে রেস্টুরেন্ট থেকে অবসর নেবার পর থেকে, তার ব্যবহার যথেষ্ট নমনীয় হয়ে গেছে। আর শ্বশুড়ি নীতা আহমেদ এক সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির মানুষ। বাইরে থেকে তাকে দেখে মনে হবে খুব নম্র, ভদ্র, ভালোমানুষ। সাধারণত চুপচাপ থাকেন, মাঝে মাঝে কোন কোন বিষয়ে মরিয়মকে সমর্থনও করেন, কিন্তু চোখের আড়ালে গেলেই তার আচরণ হয়ে ওঠে কাল নাগিনীর মত। পান থেকে চুন খসলেও সেটা তিনি লক্ষ্য করেন এবং পিন্টুকে একা পেলে বাড়িয়ে বাড়িয়ে তার কানে লাগান। দাবী করেন পিন্টু যেন মরিয়মের স্খলনের একটা প্রতিকার করে। অবিরত অভিযোগ শুনতে শুনতে ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে যায় পিন্টু, মাঝে মাঝে মরিয়মের উপর রাগ ঝাড়ে। সময়ের সাথে সাথে মরিয়মও শিখে ফেলেছে কিভাবে যথাসম্ভব শান্তি বজায় রেখে তাদের সাথে বসবাস করা যায়। কিন্তু সেই জন্য নিজেকে যথেষ্ট পরিবর্তন করতে হয়েছে। যখন বাবা-মায়ের বাড়িতে আসে তখন সেই কৃত্রিম পরিবর্তনটুকু সে পেছনে ফেলে আসে। এখানে এলে সে অনেক হালকা বোধ করে।
“আমাকে দাও, আমি ভেজে দিচ্ছি,” ও দোলনকে বলল।

“জ্বী না,” দোলন সাথে সাথে নাকচ করে দিল। “টেবিলে গিয়ে চুপচাপ বস। আমি দুই মিনিটের মধ্যে নাস্তা নিয়ে আসছি।” মরিয়ম ইতস্তত করছে দেখে ওকে ঠেলে রান্নাঘর থেকে বের করে ডাইনিং টেবিলে একটা চেয়ারে বসাল। “একদম নড়বে না।”
আবুল হেসে ওঠে। “এই হচ্ছে দোলনের স্পেশিয়াল আতিথেয়তা।”
মরিয়ম মুচকি হাসল। দোলন কখনই তাকে কিছু করতে দেয় না। “বাবা-মা এখনও ওঠেনি?”
“তাদের নাস্তা বিছানায় দেই,” দোলন রান্নাঘর থেকে গলা উঁচিয়ে বলল। “ওনারা বিছানা থেকে উঠতে চান না। সারাদিন ঘরের মধ্যে বসে থাকেন। কোথাও নিতে পারি না।”
আবুল হাসল। “দোলন তাদেরকে মলে নিয়ে যেতে চায় হাঁটানোর জন্য। তারা এই ঠান্ডায় বাসার বাইরে এক পাও দিতে চায় না।”
“ঠান্ডা কোন সমস্যা নয়। ওনারা খুব আইলসা হয়ে গেছেন।” দোলন প্লেটে গরম পরাটা আর সদ্য ভাজা ডিমের অমলেট আনতে আনতে বলল।
“আজ তোর মাস্টার সাহেব আসছে?” আবুল বোনকে জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ,” উত্তরটা এলো দোলনের কাছ থেকে। “বুধবার আর শনিবার সন্ধ্যায় আসে। নাও, ঠান্ডা হবার আগেই খাওয়া শুরু কর।”
“সব দিকে দোলনের লক্ষ্য,” আবুল বোনের প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে গর্ব ভরে বলল। “ছেলেটাকে দেখে তো খুব ভদ্র মনে হয়। শুনলাম কয়েকদিন আগে নাকি রেস্টুরেন্টে জাহানের সাথে মারপিট করেছে।”
“ও রিমাকে সাহায্য করবার চেষ্টা করছিল,” মরিয়ম বলে। “তেমন সিরিয়াস কিছু না।”
“দোলন, তুমিও আমাদের সাথে খেয়ে নিচ্ছ না কেন?” দোলনকে রান্নাঘরে ফিরে যেতে দেখে আবুল পিছু ডাকল।
“পরে খাব,” দোলন সংক্ষেপে বলল।
আবুল কাঁধ ঝাঁকাল। “মরিয়ম, তোর বাসার ঝামেলা না মেটা পর্যন্ত কি করবি বলে ভাবছিস?”
মরিয়ম মাথা নাড়ে। “জানি না।খামাখা রেস্টুরেন্ট সামলিয়ে জীবনটা নষ্ট করেছি। অন্য কোথাও কাজ করলে অভিজ্ঞতা হিসাবে দেখান যেত।”
“এখনও এমন কিছু দেরী হয় নি তোর। তুই এতো স্মার্ট একটা মেয়ে। তোর তো পলিটিকাল ক্যম্পেইনের অভিজ্ঞতা আছে। ২০০৪ সালে ফেডারেল ইলেকশনে লিবারেল ক্যান্ডিডেট টম ওয়াপেলের হয়ে না কাজ করেছিলি?”

“হ্যাঁ, ভলান্টিয়ার হিসাবে,” মরিয়ম বলে। “স্কারবরো সাউথ ওয়েস্ট রাইডিং থেকে দাঁড়িয়েছিলেন। তার আগের বছর কাজ করেছিলাম এন ডী পির ক্যান্ডিডেট বারবারা ওয়ার্নারের সাথে। কিন্তু ঐ বদমাশটাকে বিয়ে করার পর রেস্টুরেন্টে গিয়ে মানুষজনের উপর খবর্দারী করা ছাড়া আরতো কিছুই করি নি। এখন আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।”
“আমি হয়ত তোকে এই ব্যাপারে কিছুটা সাহায্য করতে পারব,” আবুল অর্থপূর্ণ কন্ঠে বলল।
“কিভাবে? খুলে বল,” মরিয়ম বলল।
“আমাদের রাইডীং থেকে এই বছর বাংলাদেশী একটা মেয়ে এন ডী পির ক্যন্ডিডেট হবার চেষ্টা করছে। চাইলে ওর সাথে কাজ করতে পারিস। শুনেছি নমিনেশন পেয়ে যেতে পারে। তুই আগ্রহী হলে আমি আলাপ করে দেখতে পারি। জানি অনেকদিন এইসবের সাথে জড়িত নস কিন্তু না পারার তো কিছু নেই।”
মরিয়ম কাঁধ ঝাঁকাল। “আমার হাতে অনেক সময় এখন। সাহায্য করতে পারলে নিশ্চয় করব।”

“ঠিক আছে। আমি তাহলে আলাপ করি। বিয়ের আগে তুই রাজনীতি নিয়ে এতো বকবক করতিস! বলতিস একদিন নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে যাবি।”
“হ্যাঁ। রাজনীতি ভালো লাগত। কিন্তু চাইলেও ভালো রাজনীতিবিদ হতে পারতাম কিনা সন্দেহ। আমার বৃদ্ধা শ্বাশুড়ীকেই সামাল দিতে পারলাম না। তার কাছে পদে পদে হেরেছি। রাজনীতিবিদ তারই হবার দরকার ছিল।”
আবুল হা হা করে হেসে ওঠে। “তবুও মন্দের ভালো যে এইসব নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে পারিস।”

কালাম যখন মরিয়মের পৈত্রিক বাসার সামনে পার্ক করে, সদর দরজা পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে কলিং বেল বাজাল তখন সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। শীতকাল বিধায় ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে গেছে। এখানকার এই সুদীর্ঘ শীতকালের সবচেয়ে মন্দ দিক হচ্ছে অতিরিক্ত ক্ষুদ্র দিন। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে সন্ধ্যা নেমে আসে। বাইরে দাঁড়িয়েই শুনতে পেল কে দরজা খুলবে তাই নিয়ে জলি আর হ্যাপির মধ্যে ঝগড়া লেগে গেছে। শেষ পর্যন্ত দরজা খুলে যায়, দুই বোন তার দুই হাত ধরে তাকে টেনে বাসার ভেতরে ঢোকাল। কেউ পরাজয় মানতে রাজী নয়। কালাম দরজাটা বন্ধ করে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল। ওদের টিউটরিং সেশন এখানেই চলে।

টেবিলে বসেও দুই বোনে আরেক পশলা ঝগড়া হল কে আগে সারাদিন কি হয়েছে তার ফিরিস্তি দেবে তাই নিয়ে। হ্যাপি তীক্ষ্ণ কন্ঠে চীৎকার শুরু করায় জলিকে বাধ্য হয়ে রণে ভঙ্গ দিতে হল।
মরিয়ম ওদেরকে মিনিট বিশেক সময় দিল সুস্থির হবার। সাধারণত তার মধ্যেই দুই বোনের ঝগড়া-ঝাটি মিটে যায়। জলি অংক ভয় পায়। হ্যাপির বর্ণমালা নিয়ে সমস্যা আছে। কালামের কাছে মাত্র চারদিন পড়ার পরেই দুজনারই বেশ উন্নতি হয়েছে লক্ষ্য করেছে। রেট ধার্য করা হয়েছে ঘন্টায় ত্রিশ ডলার। মরিয়মের খুব একটা সমস্যা হবে না। তার নিজের কিছু জমানো টাকাপয়সা আছে সেখান থেকেই কালামকে দিচ্ছে।
প্রায় দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে বাসা ছেড়ে এসেছে সে। ইতিমধ্যে কয়েকবার ফোনে ওকে পাবার চেষ্টা করেছে পিন্টু। ও ধরে নি। কোন ভয়েস মেইল রাখে নি। লোকটা যদি ভেবে থাকে ফোনে কয়েকটা ভালো ভালো কথা বলে মরিয়মের রাগ ভাঙ্গিয়ে ফেলবে তাহলে সে ভীষণ ভুল করছে।

টেবিলে শান্তি ফিরে আসতে কালামের সাথে কথা বলতে এলো মরিয়ম। দোলনকে ওদের সাথে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হল। কালাম একটা সেল ফোন হাতে নিয়ে দ্রæত বোতাম টেপাটেপি করছে।
দোলন মরিয়মকে দেখে লাজুক মুখে হাসল, “এই ফোনটা গত মাসে নিয়েছি। এখনও সব ঠিক মত সেট করতে পারি নি। তাই কালাম আমাকে দেখিয়ে দিচ্ছে।”
কালাম দোলনের হাতে ফোনটা ফিরিয়ে দিল। “সব ঠিক করে দিয়েছি। অন্য কোন সমস্যা হলে আমাকে টেক্সট করবেন।”
“পরে একদিন আমাকে দেখিয়ে দিও কিভাবে করলে,” দোলন তাড়াতাড়ি টেবিল ছাড়ল। “আমি চা নাস্তা নিয়ে আসি। মরিয়ম আপু, তোমাকে চা দেব?”
“দাও, দোলন।” মরিয়মে টেবিলে একটা চেয়ার নিয়ে বসল। “কালাম, সব ঠিক ঠাক আছে তো?”
কালাম বিশাল এক টুকরো হাসি দেয়। “সব ঠিক আছে, আপু।”
“পাঁজরের কি অবস্থা?”

কালাম ফিক করে হেসে ফেলে। “ভালো হয়ে যাচ্ছে। তবে মাঝে মাঝে একটু ব্যাথা করে। গাধাটা এতো জোরে মেরেছে!”
“আমাদের মহাবীর!” দোলন রান্নাঘর থেকে ফোঁড়ন কাটল।
কালাম হেসে ফেলল।
“রিমা কেমন আছে?” মরিয়ম জানতে চায়।
“অনেক ঝামেলার মধ্যে আছে,” কালাম বলে।
মরিয়ম তার হাতে একটা খাম তুলে দিল। “তোমার এই মাসের টাকাটা।”
কালাম খামটা খোলে না। লজ্জিত মুখে দ্রæত পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে। দোলন এক প্লেট ভর্তি কুকি নিয়ে ফিরে এসেছে। “মরিয়ম আপু, তোমার চাটা কি এখানে এনে দেব?”
মরিয়ম মাথা নাড়ল। “না। বাবা-মায়ের সাথে বসে খাব।”
দুই মেয়ে টিউটরিংয়ের সময় মায়ের উপস্থিতি একেবারেই পছন্দ করে না। বাবা-মা মাগরেবের নামাজ পড়ে টেলিভিশন দেখছিলেন। আবুল তাদের কামরায় একটা টেলিভিশন লাগিয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যায় নামাজ পড়ে তারা চা খেতে পছন্দ করেন। মরিয়ম চা নিয়ে তাদের সাথে বসে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। এই সময়টা দুই মেয়ের কাছে ছোটখাট একটা উৎসবের মত। মা যত দূরে থাকে তাদের আনন্দ ততই বেশী হয়।

৫৫
দেখা করা যাবে? কিছু কথা ছিল। মরিয়ম।
মরিয়মের টেক্সটা পেয়ে একটু অবাকই হয়েছে রিমা। জানত মরিয়মের দাম্পত্য সমস্যা হচ্ছে। সেই সব বিষয় নিয়েই কি আলাপ করতে চায়? বার দুয়েক টেক্সট চালাচালি করার পর কেনেডি আর এলসমেয়ারের ইন্টারসেকশনে অবস্থিত টিম হর্টনসে দু’ জনে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সোমবার সন্ধ্যা। রিমা ঢাকা গ্রোসারীতে কাজ সেরে মরিয়মের সাথে দেখা করতে গেল। মরিয়ম দুই জনের জন্য কফির অর্ডার দিয়ে এক কোনে নিরালা একটা টেবিল দেখে বসল।
“পিন্টু যা করেছে সেই জন্য আমি ব্যাক্তিগতভাবে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি,” মরিয়ম বলে। “আমি এইসব ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। আমাকে কখন কিছু বলে না।”
“জানি,” রিমা তাকে আশ্বস্ত করে। “মিন্টুও শেষের দিকে ঐ রকম হয়ে গিয়েছিল।”
রিমা ধারনা করেছে মরিয়মের এই সাক্ষাতের পেছনে নিশ্চয় অন্য কোন কারণ আছে। কিছু একটা নিশ্চয় ওকে বলতে চায় সে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বাচ্চাদের নিয়ে আলাপ হয় কিছুক্ষণ। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে রিমা।

“তোমার একটা ব্যাপার জানা দরকার,” মরিয়ম এক পর্যায়ে কন্ঠস্বর নীচু করে বলে।
রিমা এই মুহুর্তটার জনই অপেক্ষা করছিল।
“এটা জেনে আইনগতভাবে কোন লাভ হবে কিনা বলতে পারব না কিন্তু তারপরও আমি চাই তুমি এটা জান,” মরিয়ম বলে। “তোমার হয়ত শুনে ভালো লাগবে।”
“কি ব্যাপার বলতো?” রিমা একটু ঝুঁকে বসে আগ্রহ দেখায়।
“যে রাতে মিন্টু ভাই মারা যান ঐ রাতে উনি পিন্টুর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন,” মরিয়ম নীচু স্বরে বলে। “অনেক রাতে এসেছিলেন। মাঝরাতের পরেই হবে। আমি বাচ্চাদের নিয়ে ততক্ষণে বিছানায় চলে গেছি। বাচ্চারা অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল, আমি জেগে ছিলাম। ড্রাইভয়েতে একটা গাড়ী ঢোকার শব্দ পাই। মাঝে মাঝে পিন্টুর কাছে অনেক রাতে মানুষ জন আসে। নীচ তলায় একটা সাইড ডোর দিয়ে ঢোকে তারা। পিন্টু তাদেরকে নিয়ে বেসমেন্টে চলে যায়।”

“মিন্টুই যে এসেছিল কি করে জানলে?” রিমা জিজ্ঞেস করে।
“গলা শুনেছিলাম। দুই ভাইই চীৎকার করছিল। কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল দুজনাই মাতাল। আমি ভয় পাচ্ছিলাম মেয়েরা এতো শব্দে উঠে না যায়। আমি কামরা থেকে বের হয়ে দেখি আমার শ্বশুর আর শ্বাশুড়ী করিডোরে দাঁড়িয়ে। আমাকে বললেন কোন হস্তক্ষেপ না করতে। আমি আবার শুতে চলে যাই। পিন্টু রাতে শুতেই আসে নি। মাঝে মাঝে অবশ্য ও বেসমেন্টে ঘুমায় – মাতাল হয়ে থাকলে কিংবা ড্রাগস নিলে। চায় না মেয়েরা জানুক।”
“কি নিয়ে কথা বলছিল ওরা? কিছু শুনতে পেয়েছিলে?” রিমা কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়। সেই রাতে মিন্টু ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিল সেটা ওর জানা ছিল না। ওর ধারনা ছিল মিন্টুর সাথে তার পরিবারের কোন যোগাযোগ ছিল না। দেখা যাচ্ছে সেটা সম্পূর্ণ সত্য নয়।

“শুনতে পাবো না কেন? ওরা গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করছিল। পিন্টুই বেশী। আর সমানে গালাগালি করছিল। মিন্টু ভাইকে চোর, মিথ্যেবাদী বলে গাল দিচ্ছিল। বলছিল উনি যা করেছেন সেই জন্য তাকে খুন করলেও ওর রাগ মিটবে না। পিন্টু সবসময়ই উল্টো পাল্টা কথাবার্তা বলে। কিন্তু মিন্টু ভাইয়ের সাথে আগে কখন এইভাবে কথাবার্তা বলতে দেখিনি।” মরিয়ম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। “আমার তখনই কেমন একটা খারাপ অনুভূতি হচ্ছিল। কিন্তু মিন্টু ভাইয়ের এইরকম একটা পরিণতি হবে একবারও বুঝতে পারিনি। কিছু একটা করা উচিৎ ছিল আমার।”
রিমা আলতো করে মরিয়মের হাত ছোঁয়। “তুমি এই ব্যাপারে কিছুই করতে পারতে না। খামাখা এইসব ভেবে কষ্ট পেও না। আমি নিজেকে দোষারোপ করা অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছি।”
মরিয়ম মাথা নাড়ল। “আমার খুব অবাক লাগে। মিন্টু ভাই সবসময় এতো বড় বড় স্বপ্ন দেখত। তার জন্য এইভাবে চলে যাওয়াৃ”

“আমিও নিজেকে ঐ প্রশ্নই সবসময় করি,” রিমা বলে। “কি করে ঐ পর্যায়ে গেল? আমি বুঝতে পারলাম না কেন? নাকি বুঝতে চাই নি। হয়ত দেখেও না দেখার ভান করেছি। কিন্তু অনেক ভেবেও তেমন কোন অবধারিত আলামত দেখেছি বলে মনে করতে পারি না।”
কিছুক্ষণ নীরবে কফি খায় দু’ জন।
“আসলে হয়েছিল কি দুজনার মাঝে?” রিমা জানতে চায়। “তুমি কিছু জান? আমি নানা মানুষের মুখে টুকরো টুকরো কথা শুনি। কোনটা বিশ্বাস করব আর কোনটা করব না বুঝতে পারি না।”
“আমাকেতো ওরা সরাসরি কিছু বলতে চায় না এসব নিয়ে কিন্তু একবার পিন্টুর মায়ের মুখে খানিকটা আড়ি পেতে শুনেছিলাম,” মরিয়ম দ্বিধা করে বলে। “দেশে তাদের কিছু প্রিমিয়াম জমি ছিল। সেইগুলো নিয়েই সমস্যা। আমার শ্বশুর বহু আগে কিনেছিলেন। মূল্য বেড়ে আকাশচুম্বী হয়েছিল। ঐ জমিগুলো বিক্রী করে এখানে টাকাটা আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিন্টু ভাই নাকি কাউকে কিছু না বলে জমিগুলো বিক্রী করে দিয়েছিলেন। দেশে নাকি কি একটা ব্যবসা শুরু করবার চেষ্টা করেছিলেন। সেটা হয় নি। টাকা সব লোকসান হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ সেটা বিশ্বাস করে না। তাদের ধারণা মিন্টু ভাই টাকাটা কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন।”
“আমিও সেই রকমই শুনেছি,” রিমা বলে। “কত টাকা হবে সব মিলিয়ে?”
“দুই তিন মিলিয়ন ডলার হবে,” মরিয়ম বলে।
“এতো টাকা!” রিমা অবাক হয়ে যায়।
“তাই তো শুনেছিলাম। ওদের সম্ভবত ধারনা মিন্টু ভাই টাকাটা নিয়ে কি করেছে তুমি সেটা জান। খুব সম্ভবত সেই কারণেই পিন্টু তোমার পেছনে লেগে আছে, শুধু ইনসিওরেন্সের টাকার ভাগ বসানোর জন্য না।”

“পিন্টুর সত্যিই ধারনা আমি সেই টাকা সম্বন্ধে কিছু জানি?” রিমা অবিশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়ে। “কয়েক বছর আগে কয়েক মাসের জন্য বার দুই দেশে গিয়েছিল মিন্টু। কিন্তু কেন গিয়েছিল, কি হয়েছিল সে সম্বন্ধে কিছুই বলে নি আমাকে।”
“পিন্টুও একই রকম। টকা পয়সার ব্যাপারে আমার সাথে কখন কোন আলাপই করে না।”
“ও কি টাকাটা ট্রেস করবার চেষ্টা করেছিল?” রিমা জানতে চায়।
“নিশ্চয় করেছে,” মরিয়ম বলে। “দেশে ওর অনেক বন্ধু বান্ধব আছে।”
রিমা লাজুক গলায় জানতে চাইল, “ওরা কি সত্যি সত্যিই অনেক আর্থিক সমস্যার মধ্যে আছে? রেস্টুরেনটা কি খুব একটা ভালো চলছে না?”
মরিয়ম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। “ওদেরকে সাহায্য করবার কথা চিন্তাও কর না। দুই ভাইয়েরই দৃষ্টি ছিল অনেক উপরে। পিন্টু অনেক টাকা পয়সা লোন নিয়েছে, বাসার ইকুইটি তুলে নিয়ে নানা জায়গায় খাটিয়েছে। অধিকাংশ প্রজেকটেই মার খেয়েছে। রেস্টুরেন্ট নিয়ে কোন সমস্যা নেই। এটা হচ্ছে লোভ। তোমার নিজের ভালো দেখাটা তোমার কর্তব্য। ওদের কথা তোমার চিন্তা করতে হবে না।”
বিদায় নেবার আগে রিমা মরিয়মকে আলিঙ্গন করে। এই মেয়েটিও তর মতই ভুক্তভোগী।