শুজা রশীদ : (পর্ব ৩০)
৪২.
দেলোয়ারের কম্পানিতে কাজটা পাবার পর বেশ কিছুদিন রিমার খুব ভালো কাটল। তার জীবনটা হঠাৎ যেন নাটকীয়ভাবে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। ভালো উপার্জন করছিল, নিজের এপার্টমেন্ট ছিল, কিছু সঞ্চয়ও হচ্ছিল। কাজটা করেও আনন্দ পাচ্ছিল। বস হিসাবে দেলোয়ারের তুলনা হয় না। তার উপর ছিল নোমান। তার মত একজন বন্ধু পাওয়া নিঃসন্দেহে ঈর্ষনীয়। যখনই কোন কারনে ওর মন খারাপ হয়েছে, কিংবা অস্থির লেগেছে, মানসিক অবসন্নতায় ভুগেছে, নোমান ছুটে এসেছে এক আনন্দের ফুলকির মত, দূর করে দিয়েছে রিমার সব অবসাদ এবং বিষণ্ণতা, তার ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলেছে হাসির ঝলক।
কাজের পর তার সাথেই অধিকাংশ সময় কাটাত ও। কখন মলে চলে যেত, কখন আবার রেস্টুরেন্টে, কিংবা কোন পার্টিতে- অনেকে তো তাদেরকে কপত-কপতি হিসাবে ভাবতে শুরু করেছিল। মানুষের ধ্যান ধারনা পাল্টানো ওর পক্ষে সম্ভব না হলেও নোমানের আশা-আকাংখ্যাকে যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা করত ও। কিন্তু পরবর্তিতে ও ভেবে দেখেছে সেই সময়ে একটা ক্ষুদ্র পরিসর ছিল যখন নোমানের প্রতি ওর কৃতজ্ঞতাবোধ এতো প্রগাঢ় ছিল যে তখন যদি নোমান একটু জোরের সাথে ওর উপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করত তাহলে ও হয়ত তাতে কোন আপত্তি করত না। কিন্তু নিজের বাবা-মায়ের তীব্র আপত্তির মুখে এক রকম বাধ্য হয়েই নোমানকে সেই সুযোগ হাত ছাড়া করতে হয়। বাবা-মায়ের মনে দুঃখ দিয়ে সে হয়ত তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় শুরু করতে চায় নি। হয়ত ভেবেছিল একদিন তারা নমনীয় হবেন এবং রিমার সাথে তার পরিণয়ে সমর্থন দেবেন।
কিন্তু তার আগেই এমন একটা ঘটনা ঘটল যা রিমার সমগ্র অস্তিত্বকে যেন নাড়িয়ে দিল। খুবই অনাহুতভাবে।
সেই দিনটা রিমার মানশ্চক্ষে এতো পরিষ্কার যে মনে হয় যেন মাত্র গতকালের ঘটনা। দেলোয়ারের অফিস এডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে কয়েক মাস কাজ করেছে। দু’জনার সম্পর্ক অধিকাংশ সময়েই কাজের গন্ডীতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কালে ভদ্রে হয়ত রিমা সুন্দর কোন পোষাক পরলে দেলোয়ার তার প্রশংসা করে। রিমা সহজ মনে তাকে ধন্যবাদ জানায়। ততদিনে ও জেনেছে দেলোয়ারের স্ত্রী একজন সুন্দরী মডেল, বয়েস মাত্র ত্রিশ। তাদের দু’জনার সুখের সংসার। অফিসের দেয়ালে রুপসী স্ত্রীর বিশাল এক ছবি টাঙিয়ে রাখা। সুতরাং এমন ভদ্র, নম্র, স্ত্রী প্রেমিক বসের স্তুতিবাক্য শুনে উদ্বিগ্ন হবার কিছু থাকতে পারে সেটা তার কল্পনাতেও আসত না। যদিও একটা ব্যাপার ও লক্ষ্য করেছিল দেলোয়ার কখনই তার স্ত্রী সম্বন্ধে কোন আলাপ করত না। রিমা সেখানে যতদিন কাজ করেছিল তার মধ্যে তার স্ত্রীও তাকে কখনই অফিসে ফোন করত না। ওর মধ্যে কৌতূহল জাগেনি তা নয় কিন্তু অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখানোর কোন ইচ্ছাও ওর ছিল না।
সে দিন ছিল রিমার বিশতম জন্মদিন। বুধবার। আগের দিন রাতে ওকে ফোন দিয়েছিল নোমান। দুজনে মিলে ঠিক করেছিল ওর জন্মদিনে ভালো কোথাও একসাথে খেয়ে হলে গিয়ে একটা সিনেমা দেখবে। অফিসের পর নোমান এসে ওকে গাড়িতে তুলে নেবে।
অফিসে খুব ব্যাস্ততা ছিল সারা দিন। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল দেলোয়ারের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর সাথে। শ্বাস নেবার সময় ছিল না। পুরো সময়টা রিমাও তার সাথেই ছিল। মিটিংয়ের নোট নেয়া থেকে শুরু করে অতিথিদেরকে আপ্যায়ন করা সবই তাকে করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সেই উন্মাদনা যখন শেষ হল তখন শেষ বিকেল। অধিকাংশ কর্মীরাই কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে গেছে। নোমান কিছুক্ষণ পরপরই ওকে ফোন দিয়ে যাচ্ছিল। ও সংক্ষেপে জানিয়েছে : ব্যাস্ত। পরে।
রিমা তড়িঘড়ি করে মিটিঙ সংক্রান্ত কাগজপত্র জায়গামত গুছিয়ে রাখছিল। যত দ্রæত সম্ভব বেরিয়ে যেতে চায়। নোমান এতো কিছু প্ল্যান করে রেখেছে। হয়ত আজ শেষ পর্যন্ত সাহস করে তার মনের কথাটা রিমাকে বলবে। রিমা সেই জন্য নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করেছিল। এতো দ্বিধাদ্বন্দ্বের কি আছে? নোমানের সাথে এক ছাদের নীচে জীবন নিতান্ত মন্দ হবে না।
দেলোয়ার ওকে নিজের অফিসে ডেকে পাঠাল। ও ভেতরে ঢুকতেই ড্রয়ার থেকে একটা বিশাল উপহারের বাক্স তার হাতে ধরিয়ে দিল। “হ্যাপি বার্থডে! আমার পক্ষ থেকে সামান্য একটা উপহার। আশা করি তোমার পছন্দ হবে।”
রিমা হকচকিয়ে যায়। “স্যার, আপনি কি করে জানলেন?”
“তোমার বায়োডাটা তো আমার কাছে আছে, নাকি?” দেলোয়ার হেসে বলে। “খোল না প্লিজ! তোমার পছন্দ হয় কিনা খুব জানতে ইচ্ছা করছে। দরকার হলে বদলে নেয়া যাবে।”
“কি এটা?” রিমা খুব সাবধানে মোড়ক খোলে। ভেতরে একটা জুয়েলারি বক্স। বাক্সটা খুলে সে অবাকই হল। একটা হীরার হার। অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে সে। আলংকারের সাথে তার সম্যক পরিচয় আছে। ততক্ষনাৎ বুঝেছিল সেটা খুবই মূল্যবান। তাকে দেখে নিশ্চয় বিভ্রান্ত এবং অনিশ্চিত মনে হয়েছিল কারণ দেলোয়ার দ্রুত পায়ে তার কাছে এসে দাঁড়ায়। “তোমার পছন্দ হয়নি?” শুষ্ক গলায় জানতে চায় সে। “দেখে মনে হয়েছিল তোমাকে খুব মানাবে এটাতে। কিন্তু চিন্তার কোন কারণ নেই। এটা বদলে তুমি যা চাও সেটাই আমি কিনে দেব।”
“না! না! ব্যাপারটা তা নয়,” রিমা আরক্তিম হয়ে বলে। “এতো অনেক দামী উপহার। এটাতো আমি গ্রহণ করতে পারব না।”
দেলোয়ার আরেক পা এগিয়ে এসে ওর কাঁধে আলতো করে একটা হাত রাখে। “আজ তোমার জন্মদিন। ভেবেছিলাম তুমি অনেক খুশী হবে। যদি না নাও তাহলে আমার ভীষণ খারাপ লাগবে। তুমি আমার অফিসে কাজ শুরু করবার পর থেকে আমার ব্যবসা খুবই ভালো যাচ্ছে। বেশ কয়েকটা বিরাট বড় বড় কন্ট্রাক্ট পেয়েছি, মানুষ জন আমার সাথে ব্যবসা করবার জন্য মুখিয়ে আছে। আমাদের ইলেক্ট্রনিক্স বিক্রি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। সেই তুলনায় এই উপহার তো তুচ্ছ! তোমাকে নিতেই হবে। না বললে আমি শুনব না।”
রিমা অসহায় ভঙ্গীতে হেসেছিল। জানত এতো দামী উপহার নেয়াটা উচিৎ হবে না। ওর উপস্থিতিতে দেলোয়ারের ব্যবসায়ে কোন উন্নতি হবার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু লোকটা এমন অনুনয় করে বলল যে সে না করতে পারে নি। যদি ব্যাপারটা সেখানেই মিটে যেত তাহলেও হত। ও তখনই নোমানকে ফোন করে দিত এসে ওকে তুলে নেবার জন্য। কিন্তু দেলোয়ার অন্য প্ল্যান করে রেখেছিল। তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে আজ সন্ধ্যায় আরেক জন খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তির সাথে তার একটা মিটিং আছে যেখানে রিমার থাকাটা খুবই জরুরী। ছোট মিটিং। শেষ হলে দুজনে মিলে এক সাথে ডিনার করবে। রিমা যখন সাহস করে নোমানের সাথে তার আগে থেকে করা পরিকল্পনার কথা বলল তখন দেলোয়ার তার সামনেই নোমানকে ফোন করে প্ল্যানটা নাকচ করে দিল।
ঘন্টা খানেক পরে তারা দুজন যখন একটা নামী রেস্টুরেন্টে গিয়ে হাজির হল রিমা ততক্ষনাৎ বুঝে ফেলল মিটীং-ফিটিং কিছু নেই। শুধু ওরা দু’ জনাই। সেখানকার আবহাওয়া এবং খাবারে কোন তুলনা হয় না। এমন চমৎকার খাবার রিমা জীবনে কখন খায় নি। খাবার পরে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল দেলোয়ার, নাচার আহ্বান। রিমা লাজুক মুখে জানায় সে নাচতে পারে না। কিন্তু তাতে পিছিয়ে যাবার পাত্র দেলোয়ার নয়। এক রকম জোর করেই তাকে টেনে ড্যান্স ফ্লোরে নিয়ে যায় দেলোয়ার, ভুল ভালের মধ্য দিয়েই তাকে নিয়ে নাচতে থাকে। যতখানি খারাপ লাগবে ভেবেছিল রিমার ততখানি খারাপ লাগে নি। দেলোয়ার দেখতে সুদর্শণ, ব্যবহারে ভদ্র, বহুল পরিচিত, অনেক মহিলাকেই দেখল তার সাথে ঢলাঢলি করতে উদ্গ্রীব।
ফেরার পথে, রিমাকে নিজের গাড়ী করে তার বাসায় নামিয়ে দেবার সময় দেলোয়ার আচমকা একটা গোপন তোথ্য ফাঁস করে। “প্রায় মাস ছয়েক হল আমার স্ত্রীর সাথে আমার সেপারেশন হয়ে গেছে। আমাদের ডীভোর্স অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ফাইনালাইজ হয়ে যাবে।”
রিমার বুঝতে বাকী থাকে না ঘটনাপ্রবাহ আচমকা কোন দিকে মোড় নিয়েছে। এই পরিণতিকে ও গ্রহণ করবে নাকি দৌড়ে পালিয়ে যাবে ভেবে পায় না ও। ওকে হেঁটে ওর এপার্টমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেবার আগে যখন হঠাৎ ওর গালে গুড নাইট কিস খেল দেলোয়ার তখন জমে যায় রিমা। পরে, সেই রাতে, নিজের এপার্টমেন্টে একাকী বসে যখন গভীর চিন্তায় মগ্ন হয় রিমা, মনে মনে অস্বীকার করতে পারে না সব মিলিয়ে সন্ধ্যাটা চমৎকারই কেটেছিল।
এর পর প্লাবনের মত যা ধেয়ে এলো রিমার দিকে তাকে প্রতিরোধ করবার মত কোন যুতসই প্রতিরোধ ওর ছিল না। অসহায়ের মত প্রকট অনুরাগ আর বিলাসী উপহারের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় সে দেখেনি। নোমানের বুঝতে বাকী থাকেনি ঘটনা কোন দিকে এগুচ্ছে। ব্যাথাতুর মনে সে নিজেকে রিমার জীবন থেকে একেবারেই গুটিয়ে নেয়। রিমা তার বেদনা বুঝতে পারলেও তার করণীয় কিছুই ছিল না। নোমান নিজেকে দেলোয়ারের প্রতিদ্ব›দ্বী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবার কোন চেষ্টাই করেনি। সমরে নামার আগেই পরাজয় মেনে চুপিসাড়ে সে সরে পড়েছিল।
নিজেকে অসহায় মনে হয়েছিল রিমার। নোমান চলে যাবার পর দেলোয়ারের অক্টোপাসের মত বাহুর আগ্রাসী শক্তিতে সমর্পন করা ছাড়া আর কোন উপায় দেখেনি সে। পালানোর কোন উপায় ছিল না, তাকে ফিরিয়ে দেবারও সুযোগ ছিল না। বড় জোর মাস দুয়েক চলে সেই রকম। তার পর আসে বিশাল এক হীরার আংটি এবং তার সামনে হাটুর উপর উপবিষ্ট দেলোয়ার ‘আমায় বিয়ে করবে, প্লিজ?’
না বলার সুযোগ ছিল না। পরের মাসেই ভীষণ ঢাক ঢোল পিটিয়ে তাদের বিয়ে হল। মাত্র বিশ বছর বয়েসে রিমা হয়ে গেল কোটিপতি ব্যবসায়ীর দ্বিতীয় স্ত্রী এবং তার বিশাল সহায় সম্পত্তির উত্তরসূরি। রিমার কাছে তার কোন কিছুই বাস্তব মনে হয় নি। নোমান স্বল্প সময়ের জন্য তার বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছিল, তাকে কংগ্রাচুলেট করে কোন এক ফাঁকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। ওর বাবা-মাকেও দাওয়াত দেয়া হয়েছিল, তারা আসেননি। ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করেছিল রিমা, জেনেছিল ওর বাবা ভীষণ ক্ষেপে ছিলেন। দেলোয়ারের প্রচুর দেনা ছিল বিভিন্ন ব্যাংকে। অনেকেই তাকে ধোঁকাবাজ বলে অভিহিত করত, বলত সে ব্যঙ্কের ম্যনাজমেন্টকে ঘুষ দিয়ে শত শত কোটি টাকার ঋণের ব্যবস্থা করত, যার অধিকাংশই কখন পরিশোধ করত না। ওর বাবার নজরে দেলোয়ার ছিল একটা চোর-বাটপার বৈ আর কিছুই নয়।
৪৩.
বিয়ের পর ওর জীবন হয়ে উঠেছিল ভালোবাসার আতিশয্য আর নিদারুণ অবহেলার এক জগাখিচুড়ি। দেলোয়ার ধুমকেতুর মত দেখা দিয়ে আবার উধাও হয়ে যেত। রিমাকে তার কাজটা ছেড়ে দিত হয়। সেটা করবার তার আর কোন প্রয়োজন ছিল না। তাছাড়া দেলোয়ারও চায়নি। গুলশানের এক বিশাল রাজপ্রাসাদের মত বাসায় এসে ওঠে ও। চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা বাড়ীর প্রবেশমুখে বিশাল গেট, পরিপাটি করে সাজানো বাগান, ওর নিজের গাড়ী, ড্রাইভার, আধা ডজন কাজের মানুষ, গেটে সর্বক্ষণ প্রহরী। কত মেয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দেয় এই ধরনের বিলাসীতার স্বপ্ন দেখে।
সমস্যা হল সেখানে মাস দুয়েক থাকার পরও রিমা বুঝতে পারছিল না ওর মনের অনুভূতি। বিয়ের পর দেলোয়ারের সার্বক্ষনিক সঙ্গী থেকে সে হয়ে উঠেছে এক নিঃসঙ্গ স্ত্রী যার একমাত্র কাজ হচ্ছে তার চারদিকের বিলাসীতায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয়া, ধনবান স্বামীর যোগ্য স্ত্রী হিসাবে নিজেকে সর্বক্ষণ সুন্দর এবং আকর্ষণীয় করে রাখা। দেলোয়ারে কাছে সে হয়ে উঠেছিল তার সামাজিক উত্থানের এক চিহ্ন। সে গর্বিত কন্ঠে সবাইকে বলে বেড়াত তার নতুন স্ত্রী পূর্বের মডেল স্ত্রীর চেয়েও তরুণী এবং সুন্দরী। শুনলেই শরীর গুলিয়ে উঠত রিমার। নিজেকে মনে হত পরিত্যাক্ত, নিঃসঙ্গ এক নারী যে সর্বক্ষণ পরিবৃত হয়ে থাকত দরিদ্র কর্মচারীদের দ্বারা, তাকে খুশী করাই যাদের ছিল একমাত্র কাজ। সেই জীবনে সে হয়ে উঠেছিল দুখী, ব্যাথাতুর।
নোমান ফিরে গিয়েছিল তার নিজস্ব জগতে। রিমার সাথে কোন যোগাযোগ সে রাখে নি। সে ছিল তার একমাত্র বন্ধু। তাকে হারিয়ে রিমার সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেবার আর কেউ ছিল না। ওর পরিবারের কেউ তার প্রতি কোন আগ্রহ দেখায় নি। তারা জানত ও কোথায় বাস করত, কেমন ভাবে বাস করত। রিমার হাতে ছিল অফুরন্ত সময়। একবার, ভয়ে ভয়ে ও তাদের সাথে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করেছিল। ফলাফল ভালো হয় নি। ওর বাবা ফোন ধরে কয়েকবার হ্যালো বলেছিলেন, যখন কেউ অন্য পাশ থেকে কথা বলে ওঠে নি, তখন তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলেনঃ
রিমা, যদি তুমি হও, আমাদেরকে বিরক্ত কর না। ঐ চোরের সাথে আমি কখন কোন সম্পর্ক করব না।
রিমার কন্ঠ ব্যাথায় বুঁজে এসেছিল। সে কোন কথা বলতে পারে নি।
ওর এই সৌভাগ্য কিংবা দূর্ভাগ্যের জন্য কাকে দায়ী করবে বুঝতে পারত না। ওর দিন কেটে যেত একটা ম্যনেকুইনের মত যে একভাবে তাকিয়ে থাকে কোন এক দিকে যতক্ষণ না কেউ এসে তার দিক পরিবর্তন করে দেয়। ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে পড়াশুনা শেষ করতে চেয়েছিল কিন্তু দেলোয়ার বাঁধ সাধল। রিমার নিরাপত্তার অজুহাত দিত। বিদেশে গিয়ে পড়তে চেয়েছিল। দেলোয়ার বলেছিল ভেবে দেখবে। তার অল্প কিছুদিন বাদেই অন্তঃস্বত্বা হয়ে পড়ে ও। ফলে অন্য সব পরিকল্পনা ভুলে যেতে হয়। দেলোয়ারের কোন সন্তান ছিল না। একটি সন্তানের জন্য সে উদগ্রীব ছিল। প্রেগনেনসির প্রাথমিক পর্বে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়। দুই জন নার্সকে নিয়ে আসা হল রিমার সার্বক্ষনিক দেখভালের জন্য। আগে যদি সে ছিল এক ম্যনেকুইন, এবার সে হয়ে ওঠে এক হাজতি।
ঢাকায় দেলোয়ারের প্রচুর আত্মীয় স্বজনেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তারা দল বেঁধে আসতে থাকে রিমাকে দেখার জন্য, সাথে নিয়ে আসে বাক্স বাক্স উপহার। তাদের মধুর মধুর কথা শুনে বিরক্ত হত রিমা। তাদের অধিকাংশকেই সে চিনত না। তাদের সাথে ওর কোন যোগাযোগ ছিলনা। তারা আসত ভীড় করে তারপর হঠাৎ উধাও হয়ে যেত, রিমা নিমজ্জিত হয়ে যেত আবার নিঃসঙ্গতায়। একাধিক ডাক্তার বাসায় আসত তাকে দেখবার জন্য। নার্স দুজন হিসাব রাখছিল তার দৈনন্দিন খাবারের, মল-মুত্রের, এমন কি কয়বার খেতে গিয়ে ওয়াক করে উঠেছে তারও।
ওর প্রেগন্যানসির প্রথম দিকে দেলোয়ার ভীষণ আগ্রহ দেখিয়েছিল। কাজ থেকে একটু পর পরই ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নিত, প্রায় প্রতিদিনই দেখতে আসত, নানা ধরনের উপহারের ছড়াছড়ি তো ছিলই। কিন্তু ধীরে ধীরে তার আগ্রহে ভাঁটা পড়তে থাকে। তার ফোনের সংখ্যা কমে আসতে থাকে, উপহারের হার ক্রমশ নেমে যেতে থাকে, কালে ভদ্রে ওকে দেখতে আসত। ওর উদরে শিশুটা যতই বেড়ে উঠছিল ততই ওর শারীরিক সমস্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছিল। সেই সময় স্বামীর সঙ্গ সে কামনা করত কিন্তু দেলোয়ারের সাথে তার দূরত্ব ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছিল।