শুজা রশীদ : (পর্ব ২৮)
নীতা লিয়াকতকে দেখে সামান্য মাথা ঝাঁকালেন। “কেমন আছো লিয়াকত? বউ বাচ্চারা কেমন আছে?”
“সবাই ভালো আছে, চাচী,” লিয়াকত বিনীত কন্ঠে বলে। “আপনার শরীর ভালো তো?”
“আছে একরকম,” নীতা সংক্ষেপে বললেন। বোঝা গেল হালকা আলাপে সময় নষ্ট করবার তার কোন আগ্রহ নেই।
“ঘটনা কি? এইরকম হুট করে চলে এলে? আসবার আগে অন্তত একটা ফোন তো করতে পারতে। কারো বাসায় হঠাৎ করে এভাবে এসে হাজির হওয়াটা একেবারেও ঠিক নয়। মাত্র গোছল করতে যাচ্ছিলাম। পরেই করতে হবে। ওকে কেন নিয়ে এসেছ এখানে?”
বিশাল, সাজানো গোছানো কামরাটার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল রিমা। ফুট পাঁচেক দূরত্ব রেখে তার পেছনে দাঁড়িয়ে পিন্টু। রিমা না তাকিয়েও অনুভব করতে পারছে তার কঠিন দৃষ্টি। লম্বা করে একটা শ্বাস নিল সে, গলা যথা সম্ভব কোমল করে বলল, “আম্মা, কেউ আমার বাচ্চাদের ক্ষতি করবার চেষ্টা করছে। আমাদের মধ্যে যাই হয়ে থাক তার রেশ বাচ্চাদের উপর পড়া ঠিক নয়। আপনার কাছে অনুরোধ, ওদেরকে এসবের মধ্যে টানবেন না।”
রিমা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন ওর দিকে, তার মুখ শক্ত, দৃষ্টিতে উষ্মা। “কি বলতে চাইছ তুমি?” ধমকে উঠলেন তিনি।
“অপরিচিত মানুষেরা আমাদেরকে সর্বক্ষণ অনুসরণ করছে। গতকাল তাদের একজন ফায়জার সাথে কথা বলেছে। কেন? কারা ওরা? আমাদেরকে কেন অনুসরণ করছে?” রিমা এক নিশ্বাসে প্রশ্নগুলো করে। তার বুকের মধ্যে ঝড় উঠছে। তার সন্তানেরা যখন জীবনের ঝুঁকির মধ্যে আছে তখন এই মহিলা কিভাবে এমন ভাব করতে পারেন যেন তিনি কিছুই জানেন না?
“পিন্টু!” নীতা ডাকলেন। “কি বলেছে শুনেছিস? তুই কিছু জানিস?”
পিন্টু লিয়েকতের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়ে ঘরের মাঝখানে দাঁড়াল। ফিরল রিমার দিকে। “এইসব কানে নিও না, মা। কল্পনা করছে। জিজ্ঞেস কর পুলিশের কাছে গিয়ে কেন নালিশ করেনি।”
এই প্রশ্নের উত্তর কি দেবে রিমা বুঝতে পারে না। ক্রোধ এবং উদ্বেগের দ্বিবিধ আক্রমণে নিজের মানসিক নিয়ন্ত্রণ হারানোর উপক্রম হয় ওর।
ওকে নীরব দেখে লিয়াকত বলে ওঠে, “একটা পিক আপ ট্রাকে দুই জন কালো লোক রিমাকে সবখানে অনুসরণ করছে। ওর বাচ্চাদের নিরাপত্তা নিয়েই ও বেশী চিন্তা করছে। পিন্টু, তুমি কি কোন সাহায্য করতে পারবে? তুমি তো কত মানুষকে চেন। হয়ত কেউ কিছু বলতে পারবে।”
“কেন আমি তাকে সাহায্য করতে যাব?” পিন্টু উদাস গলায় বলে। “আমাদের জন্য সে কি করছে?”
“তুই চিনিস ঐ লোক দুটাকে?” নীতা ভ্রূ কুঁচকে জানতে চান।
“না, মা!” পিন্টু নীচু গলায় বলে। “কিন্তু খুঁজে বের করতে পারব নিশ্চয়। একটু উৎসাহ দরকার।”
“আমি জানি তুমিই করাচ্ছ এটা,” রিমা ফুঁসে ওঠে। “মিন্টু চলে যাবার পর থেকে আমার পেছনে লেগে আছো তুমি। ইন্সুরেন্সের টাকাটার জন্য, তাই না? তোমার ভাইয়ের প্রতি তোমার কোন ভালোবাসা নেই। তোমাদের কারো কখন ছিল না। একটা জিনিষ জেনে রাখো। আমার কাছে একটা কানা কড়িও নেই। ইনস্যুরেন্স থেকে আমাকে একটা টাকাও দেবে কিনা আমি জানি না। ঐ টাকা আমি চাইও না। তুমি আমাদেরকে আর জ্বালিও না। যদি পুলিশের কাছেই যেতে হয় যাবো। ঐ লোক দুইটার ছবি তুলেছি আমি। ঐ ছবি পেলে পুলিশ ওদেরকে ঠিকই খুঁজে বের করে ফেলবে।”
“আমি আর আমার ভাই সম্বন্ধে তুমি কিছুই জানো না,” পিন্টু অগ্নি দৃষ্টি হেনে বলে। তার কাছে এটা একটা স্পর্শকাতর ব্যাপার। “আমরা ছিলাম বন্ধুর মত। তুমি এসে সব নষ্ট করে দিয়েছিলে। তুমি আমাদের সংসারটাকে ধ্বংস করেছ।”
“আমি তাকে ভালবাসতাম! আমার সাথে সে সুখী ছিল। সেই কারণে তোমরা তাকে এই পরিবার থেকে বের করে দিয়েছিলে। আমাকে দোষ দিও না। নিজেকে দোষ দাও। লোভ করে, অপচয় করে কত টাকা পয়সা নষ্ট করেছ তুমি হিসাব আছে?” রিমা মুখের লাগাম খুলে দেয়। অনেক সহ্য করেছে। তার কিছুটা ফিরিয়ে দেবার এটাই মোক্ষম সুযোগ।
পিন্টু প্রত্যুত্তর দেবার আগেই নীতা তিক্ত কন্ঠে বললেন, “তুমি আমার ছেলেকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলে। আমরা তাকে বাংলাদেশের এক মন্ত্রীর মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে বিয়ে করল তোমাকে – দুই বাচ্চার মা। নিজের বাবা-মায়ের সাথেই যার কোন যোগাযোগ নেই। ছিঃ ছিঃ। ওকে বের করব না কেন? তোমার কোন ধারনা আছে মানুষ আমাদেরকে নিয়ে কত হেসেছে?” হতাশ ভঙ্গিতে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লেন তিনি। “তুমি কোন দিন বুঝবে না সেই যন্ত্রণা। তোমার অতীত আমরা জানি। তুমি হচ্ছ একটা বারবনিতা। দুদিন পর পর নতুন পুরুষ ধর। বেরিয়ে যাও আমার বাসা থেকে। তোমার বাচ্চাদের নিয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। ফালতু দোষারোপ করবে না। মানহানির মামলা করে দেব।”
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে তাড়তাড়ি হাল ধরল লিয়াকত। “চাচী, মিন্টুর ছেলে তো ওর কাছে, তাই না? তারও তো ক্ষতি হতে পারে। যেই এই কাজটা করাচ্ছে তার কোন বদ মতলব থাকতে পারে।”
নীতা নিদারুণ বিরক্তি দেখিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। “ঐ হাবা-গোবাটার জন্য আমাদের কারো প্রাণ পুড়ছে না।” বিড় বিড় করে বল্লেন তিনি। “ঐ মেয়ের পুরানো পাপের জন্যই ঐ রকম একটা বাচ্চা হয়েছে। আমার ছেলের সেখানে কোন ভুমিকা ছিল না।”
“হাবা-গোবা?” রিমা ক্ষেপে যায়। “নিজের পোতাকে কেউ এইভাবে সম্বোধন করে? সেই কারণেই কি আপনি কখন ওকে দেখতে আসেননি? ওর সঙ্গ পাবার যোগ্য আপনারা না। এখানে আসাই ভুল হয়েছিল আমার। ভেবেছিলাম একজন মা হিসাবে আপনার মনে দয়া হবে। হাবা-গোবা! চলেন, লিয়াকত ভাই। আমি পুলিশের কাছেই যাবো।”
“যা ইচ্ছা কর,” নীতা বিতৃষ্ণ কন্ঠে বললেন। “আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি ভুলে যেও না। সেই বিসর্জনের জন্য আমাদেরও কিছু পাওনা আছে। হয়ত তুমিই তাকে মেরেছ। কে জানে? ইন্সুরেন্সের টাকা তুমি চাও না!” তার কন্ঠে ব্যাঙ্গ। “কি রে আমার ফেরেশতা!” হঠাৎ করে কাশতে শুরু করলেন তিনি, এক হাতে বুক চেপে ধরলেন।
পিন্টূ দৌড়ে গেল মায়ের কাছে। “মা, কি হল? জোরে জোরে শ্বাস নাও।”
“ঠিক আছি আমি,” নীতা কাশি থামানোর চেষ্টা করতে করতে বললেন।
“তোমার পাফারটা কোথায়?” চারদিকে তাকিয়ে খুঁজল পিন্টু। বিছানার পাশের সাইড টেবিলের উপর পেল। তার হাত থেকে একরকম ছিনিয়ে নিয়ে দ্রæত কয়েকটা টান দিলেন নীতা। রিমাকে লক্ষ্য করে হাত ঝাঁকালেন। “ওদের চলে যেতে বল।”
পিন্টু নিঃশব্দে আঙ্গুল দিয়ে সদর দরজার দিক নির্দেষ করল। রিমা এক মুহুর্তের জন্য ইতস্তত করে। আলাপ যে এই পথে গড়াবে সেটা ও চিন্তাও করেনি। নীতার কথা শুনে মনে হয়েছে লোক দুজনার ব্যাপারে তার কোন ধারণাই নেই। যদি থেকে থাকে থলে বুঝতে হবে তার অভিনয়ে ব্যুৎপত্তি আছে। পিন্টুও খুব এটা মুখ খোলেনি। তাকে সরাসরি প্রশ্ন করে কোন লাভ নেই। কখন স্বীকার করবে না। ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করে ও।
“চাচী ঠিক আছেন তো?” লিয়াকত পিন্টুকে লক্ষ্য করে বলে।
“হ্যাঁ। বেশী রেগে গেলেই এমন হয়।” পিন্টু বলে। লিয়াকত রিমার পিছু পিছু যাচ্ছিল পেছন থেক ডাকল পিন্টু।
“লিয়াকত ভাই! আমি খোঁজ খবর নেব। খামাখা পুলিশের কাছে যাবার কোন দরকার নেই। এই সব ঝুট ঝানেলা মা নিতে পারবে না।”
লিয়াকত নীরবে মাথা নেড়ে দ্রুত হেঁটে রিমার পাশে চলে এলো। সে কিছু বলার আগেই রিমা বলল, “শুনেছি। হাবা-গোবা! তার নিজের পোতা! বিশ্বাস করতে পারেন?”
লিয়াকত কিছু বলে না। নীতা চাচী কখনই মানবিক কারণে খুব একটা পরিচিত ছিলেন না। তিনি বরাবরই একটু উগ্র, রগচটা ছিলেন, মানুষের মন বিষিয়ে দিতে তার চেয়ে দক্ষ কম মানুষই ছিল।
৪০.
মিডল্যান্ড এভ ধরে ড্রাইভ করে ফেরার পথে রিমার শিড়দাঁড়া বেয়ে একটা সিরসিরে অনুভূতি হয়। ও গিয়েছিল শান্তি চুক্তি করতে, ফিরেছে যুদ্ধ বাঁধিয়ে। পিন্টুর কথার কোন দাম নেই। রিমার এইভাবে যাওয়াটা তার কাছে মনে হতে পারে রিমার পরাজয়। তার কৌশল কাজে দিয়েছে। সে হয়ত এবার আরোও তোড় জোড় করে নামতে পারে রিমাকে তটস্থ করে দেবার জন্য। হ্যাঁ, পুলিশের কাছে রিমা যেতে পারে। কিন্তু গিয়ে বলবেটা কি? ঐ লোক দুজন যে তাকেই ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করছে তার কি প্রমাণ তার কাছে আছে? মার্সেলকে ফোন দিয়ে পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে তার সাহায্য চাইতে পারে কিন্তু সে হয়ত ভেবে বসতে পারে রিমার এখন মাথার দোষ দেখা দিয়েছে। সব খানে বিপদ দেখছে।
“যা ভেবেছিলাম তেমনটা হল না,” রিমা হতাশ কন্ঠে বলে।
লিয়াকত কোমল দৃষ্টিতে দেখল রিমাকে। ওর মনের মধ্যে কি চলছে বুঝতে অসুবিধা হয় না। “যতখানি খারাপ মনে হচ্ছে ততখানি খারাপ হয়ত হয়নি। পিন্টু গাধা না। এই কথাটা সবসময় মনে রেখ। কম বয়েসে কিছু ভুল করেছে কিন্তু ভুল করতে করতে অনেক কিছু শিখেওছে। ওকে যদি আমি এতটুকুও চিনে থাকি, এটা বন্ধ হয়ে যাবে।”
“লিয়াকত ভাই, আপনি তো দেখেছেনই মিন্টু চলে যাবার পর ও কিরকম আচরণ করেছে। আপনার এখনও মনে হচ্ছে আপনি ওকে চেনেন?”
“ওর ঐ সময়কার অতি নাটকীয় কাজকর্ম আমার কাছে কি মনে হয় জান? কৌশল। একটা সময় ছিল ওকে ছোট ভাইয়ের মত ভালবাসতাম। আমার সাথে কেমন ব্যাবহার করল দেখলে? কে কি ভাবল সেসব নিয়ে ভাবে না ও। ওর মাথায় শুধু টাকা পয়সা আর সাফল্যের চিন্তা ঘোরে। আর সত্যি কথা বলতে কি, কোন দিকেই ও সফল হতে পারছে না। যে কারণে এখন মরীয়া হয়ে গেছে। যেখানেই টাকার গন্ধ পাচ্ছে সেখানেই পাগলা কুত্তার মত ছুটে যাচ্ছে।”
রিমা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। “ও যে এতো কিছু করছে সেসব কি শুধু ইন্সুরেন্সের টাকাটার জন্যই? মিন্টুর যে লাইফ ইনস্যুরেন্স ছিল সেটা ও জানল কি করে? আমি তো জানতাম না। যদি মিন্টু আমাকে কখন বলেও থাকে আমার একেবারেই মনে নেই।”
লিয়াকত মাথা দোলায়। “মিন্টুকে ওদের পারিবারিক ব্যবসা থেকে বের করে দিলেও ভাইয়ের সাথে ওর কিছু যোগাযোগ ছিল। বোঝোই তো ভাই ভাই। পিন্টু যখন ছোট ছিল তখন মিন্টুই ওকে সব ধরনের বিপদ থেকে আগলিয়ে রেখেছিল। ও নিজেই হয়ত পিন্টুকে বলেছিল।”
“কিন্তু আমাকে কেন উত্যক্ত করছিল?” রিমা কৌতূহলী কন্ঠে জানতে চায়। “আমাকে খুনী প্রমাণ করবার জন্য এতো মরীয়া কেন হয়ে উঠেছিল?”
“আমার জনা দুই উকিল বন্ধু আছে। ওদের সাথে এটা নিয়ে আলাপ করেছিলাম। ওরা আমাকে যা বলল, যদি কোনভাবে আপনাকে মিন্টুর মৃত্যুর দায়ে ফাঁসানো যায় তাহলে ঐ টাকার কিছুই আপনি পাবেন না। ওটা চলে যাবে রবিনের কাছে, যে হচ্ছে সেকন্ডারী বেনেফিসিয়ারী। আমি জানি কারণ মিন্টুই আমাকে বলেছিল। রবিন হচ্ছে পিন্টুর ভাইপো। আপনি যদি শেষ পর্যন্ত জেলে যান তাহলে রবিনের দায়িত্ব গিয়ে পড়বে ওদের কাছে।”
“গাছে কাঠাল গোঁপে তেলের মত অবস্থা!” রিমা অবিশ্বাস নিয়ে বলে।
“ঠিক, কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কি? এর চেয়েও অবিশ্বাষ্য কাজকর্ম করতে শুনেছি মানুষকে। লোভী মানুষের দ্বারা সবই সম্ভব।”
রিমা সেন্ট ক্লেয়ার এভিনিউতে ডানে ঘুরল। “ওরা বরাবরই আমাকে এতো অপছন্দ করে! সেই প্রথম থেকেই। কারণটা কখনই ঠিক ধরতে পারিনি। ভেবেছিলাম হয়ত আমি ডিভোর্সি, দুইটা বাচ্চা আছে, সেজন্য ভড়কে গেছে সবাই। কিন্তু সত্যটা আজকে প্রকাশ পেল। মন্ত্রীর মেয়ে! তাদের বিশাল প্ল্যান আমি একেবারে মাঠে মেরে দিয়েছি। রক্ষা করেছে আল্লাহ। মন্ত্রীর সেই হতভাগা মেয়েটার জীবন বেঁচেছে! বিষের আখড়া!
পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে যায় লিয়াকতের। বহু বছর আগে কোন এক অজপাড়াগাঁ থেকে ঢাকা এসেছিল যুবক লিয়াকত, তার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল প্রাণে ভরপুর আরেক যুবকের যার নাম ছিল মিন্টু। খুব শীঘ্রই মিন্টুর বাড়ি হয়ে উঠেছিল সেই গেঁয়ো যুবকের বাড়ী, মিন্টুর পরিবার হয়ে উঠেছিল তার পরিবার। কত রাত সেই বাসায় ঘুমিয়েছে সে, যখনই গেছে একসাথে কত বেলা খেয়েছে, যখনই অর্থের প্রয়োজন হয়েছে কর্জ পেয়েছে যা তাকে কখন শোধ করতে হয়নি। নীতা তখনও ভীষণ বদমেজাজী ছিলেন কিন্তু তারপরও তাকে স্নেহ করে নিজের বাসায় যাতায়াতের অধিকার দিয়েছিলেন। সেই সব দিন ও কখনই ভুলতে পারবে না। যতদিন বেঁচে আছে ততদিন সেই কারণে সে তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।
রিমা তার নীরবতটুকু লক্ষ্য করল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে মনে হল গভীর কোন চিন্তায় ডুবে গেছে লিয়াকত। “লিয়াকত ভাই, কিছু ভাবছেন? আপনাকে অকারণে এই সবের মধ্যে টেনে আনলাম। মিন্টু একমাত্র আপনাকেই বিশ্বাস করত।”
“ভাবি, এসব নিয়ে আপনি একেবারেই ভাববেন না,” লিয়াকত শান্ত কন্ঠে বলে। “আমার ক্ষমতায় যতখানি কুলায় আমি আপনাকে সাহায্য করব।”
সামনের সিগনালটা লাল হয়ে গেছে। রিমা ব্রেক কষে গাড়ী থামাল। প্রাক দুপুরের কিঞ্চিৎ হালকা ট্রাফিক। ও কৌতূহলী দৃষ্টিতে চারদিকে নজর বোলাল, সেই পিক আপ ট্রাকটা কোথাও আছে কিনা দেখল। নজরে পড়ল না। আল্লাই জানে কোথায় লুকিয়ে আছে।
“লিয়াকত ভাই, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?” একটু দ্বিধা নিয়ে জানতে চায়।
“করেন ভাবি।”
“মিন্টুকে পারিবারিক ব্যাবসা থেক হঠাৎ বের করে দেবার কি কারণ ছিল?”
“আসমা আপা বোধহয় আপনাকে কিছু একটা বলেছে,” লিয়াকত বলে। “উনি আমাকেও একই কথা বলেছিলেন। সত্যি কথা হচ্ছে আমি এই ব্যাপারে খুব একটা কিছু জানি না। কানাডা আসার পর চেষ্টা করেছি ওদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে। মিন্টু এখানেও আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল কিন্তু ওর পরিবারের অন্যদের সাথে আমার খুব একটা দেখা সাক্ষ্যাৎ ছিল না।”
“মিন্টু কি সত্যি সত্যিই ওর পারিবারিক সম্পত্তি চুরি করেছিল? মিন্টু তো সেই রকম মানুষ ছিল না।”
লিয়াকত কাঁধ ঝাঁকাল। “কিছু একটা করেছিল। ঢাকায় অন্যদের কাছ থেকেও আমি শুনেছি। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে মিন্টু আমাকে কখন কিছু বলে নি। কিন্তু ভাবি, সত্যি কথা হচ্ছে , ওদের অনেক আত্মীয় স্বজন। ওদের সহায় সম্পত্তির কিছু কিছু অংশ অন্যন্যদের সাথে যৌথভাবে রেজিস্ট্রি করা। মিন্টু আদতেই অন্যায় কিছু করেছে কি করেনি সেটা আন্দাজে বলাটা অসম্ভব। এই জাতীয় কথায় কান দেবেন না। মিন্টু আর নেই যে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারবে।”
“জানি,” রিমা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। হঠাৎ ওর মনে হয় একটু প্রাণ খুলে কাঁদে। মিন্টুর জন্য কয়েক বিন্দু অশ্রু ঝরায়। কেন এভাবে ও চলে গেল? জীবনের কত কিছু করার বাকী ছিল। নিজেকে কেন শক্ত করে যুঁঝে গেল না? কি এমন যন্ত্রণা ছিল তার মনে যা সে এমনকি রিমাকেও বলতে পারে নি?
“জানেন লিয়াকত ভাই, সব কিছু ভালোই যাচ্ছিল। তারপর হঠাৎ করেই সব কিছু কেমন যেন খারাপের দিকে গড়াতে থাকল। মিন্টু কেমন চুপচাপ হয়ে গেল, মনমরা হয়ে থাকত। মদ খাবার পরিমাণ বেড়ে গেল। ড্রাগসও করত – গাঞ্জা, হেরোইন, এই রকম আরোও হাবি জাবি কত কিছু। দেখছিলাম কিন্তু কিছু করতে পারছিলাম না। যখনই জানতে চেয়েছি ক্ষেপে গেছে আমার উপর। ভাবতাম হয়ত আমার জন্য ওর পরিবারের কাছ থেকে ওকে দূরে সরে যেতে হয়েছে সেই জন্য হয়ত রাগ। কিন্তু এখন মনে হয় নিশ্চয় অন্য কিছুও ছিল।”
লিয়াকতের দৃষ্টি রাস্তায় নিবদ্ধ ছিল। “ভাবি আমাকে বার্চমাউন্ট রোডের কাছে কোথাও নামিয়ে দিন। আমি সেখান থেকে হেঁটে কাজে চলে যাব।”
“আমি আপনাকে একেবারে আপনার কাজের জায়গায় নামিয়ে দিয়ে যাই,” রিমা জোর করে।
“এইখানে একটা এপার্টমেন্ট দেখব,” লিয়াকত লাজুক কণ্ঠে বলে। “আমার বউ ক্রিসেন্ট টাউনে আর থাকতে চায় না। কয় দিন ধরেই খুব চাপাচাপি করছে অন্য কোথাও বাসা নেবার জন্য।”
“তাই!” রিমা অবাক হলেও কারণটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রিয় বন্ধুর অযাচিত মৃত্যুতে লিয়াকতও নিশ্চয় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। বাইরে থেকে দেখে বোঝা না গেলেও স্ত্রীর কাছে লুকাতে পারে না। রাস্তার পাশে একটা স্ট্রিপ মলে গাড়ী ঢোকাল ও, পার্কিং লটে গাড়ী থামাল। লিয়াকত গাড়ী থেমে নেমে ঘুরে ড্রাইভার সাইডে এসে ওকে জানালা নামানোর জন্য ইংগিত করল। রিমা জানালা নামাল।
“ভাবি, একটা কথা আপনাকে বলতে চাই,” লিয়াকত গম্ভীর মুখে বলে। “এখানকার এই জীবন মিন্টু কখন চায় নি। ও চেয়েছিল দেশে গিয়ে বড় কিছু হবে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কেউ। ভীষণ বড় বড় স্বপ্ন দেখত। আমাকে বলেছিল ফিরে গিয়ে গচ ইলেকশনে দাঁড়াবে, পার্লামেন্টে যাবে, একদিন মন্ত্রী হবে, তারপর হয়ত আরোও বড় কিছু। ওর স্বপ্ন পূরণ করবার জন্য হয়ত অন্যায় কিছু করে থাকতে পারে। কিন্তু তারপরও ওর স্বপ্ন যখন সফল হবার কোন সম্ভাবনা দেখে নি তখন ও হতাশ হয়ে পড়েছিল। ধীরে ধীরে সেই হতাশা থেকে আসে ডিপ্রেশন। আমি চেষ্টা করেছিলাম ওকে নানা ভাবে বোঝাতে। কিন্তু কোন কাজ হয় নি। আপনাকে এইসব বলার কারণ একটাই, নিজেকে কখন কোন কারণে ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করবেন না। আপনার কোন দোষ ছিল না।”
লিয়াকত বিদায় জানিয়ে চলে গেল। তাহলে মিন্টু নিজের ব্যার্থতাকে গ্রহণ করতে পারে নি বলেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল? হ্যাঁ, এই সমাধান রিমার কাছে গ্রহণ যোগ্য। সামনে এগিয়ে যাবার জন্য একটা গ্রহণযোগ্য উত্তরের ওর প্রয়োজন আছে।
– টরন্টো, কানাডা