শুজা রশীদ : (পর্ব ২১)
২৯.
সেই কাল রাত্রির কথা ওর মনে পড়ে ঝাপসা ঝাপসা। প্রথমত পেরিয়ে গেছে তেরোটা বছর, দ্বিতীয়ত তখন তার মানসিক অবস্থাও স্বাভাবিক ছিল না, তার চারপাশে যা ঘটছিল তা পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করবার সামর্থ তার ছিল না। পাঁচ তলার চিলেকোঠায় তার প্রেমিককে নিয়ে যে ক্ষুদ্র কিন্তু সুখের ছোট্ট সংসার সে গড়েছিল মাত্র এক মাসের মধ্যেই তা ভেঙে খান খান হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল, লাভলুর মাদকাসক্তির তীব্রতা দেখে রিমার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল। দুই মুখো এক সাপের মত ইউনিভার্র্সিটি প্রাঙ্গণে লাভলু বজায় রাখত এক চমৎকার, উচ্ছল, উজ্জ্বল ব্যাক্তিত্ব কিন্তু সেই প্রাঙ্গণের বাইরে মদ এবং মাদক দ্রব্যের প্রতি তার আসক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সে ছিল অক্ষম।
প্রাথমিকভাবে রিমা ভেবেছিল তার আদর, যত্ন এবং ভালোবাসা দিয়ে সে লাভলুকে পরিবর্তন করে ফেলবে, তার জীবনকে আবার সহজ, স্বাভাবিক করে দেবে। লাভলুর পদস্খলন ঘটছিল খুব দ্রæত, পড়াশোনায় তার মনযোগ একেবারেই ছিল না। সেই গতিতে চললে ভবিষ্যত বলতে আর কিছুই থাকবে না তার। রিমার প্রতি ভালোবাসার অভাব ছিল না লাভলুর, কিন্তু তার জন্য মাদকাসক্তি ছাড়তে সে প্রস্তুত ছিল না। রিমা অনেক চেষ্টা করেছিল, কখন ভালোবেসে, কখন অনুনয়-বিনয় করে, কখন জোরাজুরি করে। কিন্তু কোনভাবেই লাভলুকে মদ এবং ড্রাগস থেকে সরিয়ে আনতে পারেনি। প্রতি রাত্রে তার পাশে যে মানুষটা শুয়ে থাকত সে নেশার ঘোরে এমনই অবসন্ন হয়ে থাকত যে অধিকাংশ সময় না তার সাথে কোন আলাপচারীতা করা যেত, না যেত শারীরিকভাবে ঘনিষ্ট হওয়া। ওর সৌন্দর্য, প্রেম-ভালোবাসা, কাকুতি-মিনতি কোন কিছুই কোন কাজে এলো না। লাভলুর কাছে নেশাই প্রথম। রিমার ঘোর কাটতে খুব বেশি সময় লাগেনি। খুব দ্রুত নিজেকে ওর মনে হতে থাকে অবাঞ্ছিতা, অবহেলিত ও পরাজিতা।
সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি ক্রমশঃ খারাপের দিকেই এগুতে থাকে। ঘর সংসার করার বাড়তি দায়িত্ব যেমন বাজার করা, বিল দেয়া, ঘর গোছানো নিয়ে যেন বিপাকেই পড়ে গেল লাভলু। তার মেজাজ হয়ে উঠল তিরিক্ষি, ব্যবহার উগ্র। ধীরে ধীরে মানসিকভাবে রিমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে সে। লাভলুর বাবা-মা রিমাকে ছেলের বউ হিসাবে কখনই মেনে নেননি, তাদের বাসায় তার যাবার অনুমতি ছিল না। রিমা পরে জেনেছিল তারা লাভলুকে বলেছিলেন রিমার কাছ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ নিলে পারিবারিক সহায় সম্পত্তিতে আবার তার অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হবে। নইলে সে তাদের বিশাল সম্পত্তির কিছুই নাও পেতে পারে। একটা জিনিষ জেনে অবশ্য ওর ভালো লেগেছিল, বাবা-মায়ের সেই প্রস্তাব লাভলু মেনে নেয়নি। বিয়ের আগে সে মোটা অংকের একটা টাকা পেত হাত খরচের জন্য। সেটা বিয়ে সংক্রান্ত কারণে বন্ধ হয়ে যাবার ফলে তার জন্য একটা কাজ নেয়া জরুরি হয়ে পড়ে সংসার চালানোর জন্য। কিন্তু তার এমন কোন দক্ষতা ছিল না যেটা খাটিয়ে সে উপার্জন করতে পারে। তার সেই দিশেহারা পরিস্থিতিতে তার রাজনৈতিক পার্টি তার পাশে এসে দাঁড়ায়। বেশ কয়েকটা মাস পার্টি তাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করে। হয়ত আশা ছিল হয় লাভলু দ্রæত কিছু একটা কাজ খুঁজে নেবে নয়ত তার পরিবারের সাথে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলবে। লাভলু কোনটাই করতে পারে না। যতই দিন যায় সে ততই ক্ষুব্ধ, অস্থির এবং ক্রদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে। দিনকে দিন রিমার উপর তার রাগ এবং ক্ষোভ বাড়তে থাকে। তার জন্যেই তো বেচারীকে হঠাৎ করে এই বিয়ে বিয়ে খেলতে হচ্ছিল, অভিনয় করবার চেষ্টা করতে হচ্ছিল এক দায়িত্ববান পুরুষের। রিমাকে বিশেষ করে শাস্তি দেবার জন্যই মনে হয় সে আরোও বেশি বেশি করে নেশা করতে শুরু করে।
রিমার যাবার কোন জায়গা ছিল না। বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাবার প্রশ্নই ছিল না। তাদের দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। লাভলুকে না ছাড়লে তারাও তাকে গ্রহণ করতে নারাজ। এডভোকেট জয়নাব আলীর কন্যা অন্তঃপ্রাণ হলেও কিছু কিছু ব্যাপারে ছিলেন একরোখা। লাভলুর ব্যাপারে তিনি কোন আপোষ করবেন না বলে পরিষ্কার জানিয়ে গেছেন।
নিজের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে যদি কোন একটা সিদ্ধান্ত রিমা নিয়েই থাকে তাহলে সেই সিদ্ধান্তে অটুট থাকতে হলে কিছু একটা তো তাকে বিসর্জন দিতেই হবে। তার পরিবারকে বিসর্জন দেবার সিদ্ধান্ত রিমাই নিয়েছে।
চিলেকোঠার ঘরে পুলিশ নিয়ে রিমাকে বাসায় ফিরিয়ে নিতে এসে যখন শূণ্য হাতে ফিরে যান জয়নাব, তারপর কন্যার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন তিনি। রিমার একটা আশা ছিল ওর মা হয়ত ওর সাথে যোগাযোগ করবেন। মা করেননি। স্বামীকে তিনি যেমন ভালোবাসতেন তেমনি সম্মান করতেন। স্বামীর কোন সিদ্ধান্তকে অবহেলা করাটা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সেই চিলেকোঠার ঘরে বসবাস করতে করতে নিজের জীবনকে যতখানি সম্ভব স্বভাবিকভাবে পরিচালনা করবার চেষ্টা করে যায় রিমা। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে ততদিনে। কিন্তু দুঃখে, বেদনায় জর্জরিত না হয়ে সেই পরিস্থিতিকে কিভাবে নিজ অনুকুলে ব্যবহার করা যায় সেটাই ছিল তার একমাত্র প্রচেষ্টা। নিয়মিত ক্লাশে যেত, স্থানীয় কয়েকটা বাচ্চাকে পড়াতো, রান্নাবান্না শিখছিল, বাসার যাবতীয় কাজকর্ম করত ব্যাস্ত থাকার জন্য- ঝাড়ু দেয়া, ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া এই জাতীয় কাজ। পড়িয়ে যা উপার্জন করত ঠিকে কাজের মানুষ রাখা সম্ভব ছিল না। প্রতিদিন এক হাতে এতো কাজ করাটা ক্লান্তিকর হয়ে উঠছিল, কিন্তু নিজের সাথে যুঝত ও, নিজেকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করত। পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক, তাকে এগিয়ে যেতেই হবে। সেই মন্ত্রই যেন তার জীবনের একমাত্র পাথেয় হয়ে উঠেছিল।
এগারো মাস পরে এলো সেই অভিশপ্ত দিন। ভীষণ বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন। সকালে ঘুম থেকে উঠতে মন চাইছিল না রিমার। আগের রাতে বেশ কিছু ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল, একটু কড়াই। কটা খেয়েছিল খেয়ালও ছিল না। দুইটা, তিনটা কিংবা বেশিও হতে পারে। বেশ কিছুদিন ধরে রাতে ঘুমাতে সমস্যা হচ্ছিল ওর। বেশ কয়েকটা ক্লাশ ছিল কিন্তু বাসা থেকে বের হতেই ইচ্ছে হচ্ছিল না। বিশেষ করে এমন বৃষ্টি ভেজা দিনে কে বাইরে যেতে চায়? কিন্তু উপায়ও ছিল না। একসময় বিছানা ছাড়তেই হয়। সকাল প্রায় দশটা বেজে গেছে অথচ লাভলু তখনও বাসায় ফেরেনি। সারা রাত বাইরে কাটিয়েছে। ওকে একটা ফোন কিংবা টেক্সট করে কিছু জানায়ওনি। কোথায় ছিল জানার কোন উপায় ছিল না রিমার। গত কয়েকটা মাস ধরে এভাবেই চলছে। রিমা ফোন করলে ফোন ধরবেও না। একবার ওর বন্ধুরা ওকে ধরে বাসায় দিয়ে গিয়েছিল। নেশা করে কোন পার্টিতে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল। তার মুখ ফ্যাঁকাসে হয়ে গিয়েছিল, মুখের কোণে ছিল গ্যাঁজা, দৃষ্টি নিথর। রিমা ভেবেছিল হয়ত মরেই গেছে। ওর হার্ট এটাক হবার জোগাড় হয়েছিল।
নিজের সাথে যুঝে বিছানা থেকে ওঠে রিমা। কাঠের দরজাটা খুলে ছাদে পা রাখে। চারদিকে তাকিয়ে লাভলুকে খোঁজে। হয়ত অনেক রাত করে ফিরেছে। রিমাকে আর ঘুম থেকে ডেকে তোলেনি। ছাদেই কোথাও শুয়ে থেকেছে। সিঁড়িঘরের ভেতরে একটা আরম কেদারা রাখা থাকে। মাঝে মাঝে লাভলু সেখানে শরীর এলিয়ে বসে থাকত। আগের রাতে ভীষণ বাতাসে চেয়ারটা উড়ে ছাদের আরেক কোণে কাত হয়ে পড়ে ছিল, খানিকটা লাভলুর মত, পরাজিত। মাত্র এগারো মাসেই নিঃশেষ হয়ে গেছে যেন ছেলেটা। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয় রিমার, কিন্তু সেটাই ছিল কঠিন বাস্তব।
আবার বাসার ভেতরে ঢুকে পড়ে রিমা। দরজাটা বন্ধ করে বিছানায় ফিরে যায়। এরপর ওর যখন ঘুম ভাঙল ওর মনে হল কেউ বা কারা যেন ওর দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে, উঁচু গলায় ওর নাম ধরে ডাকছে। হতবিহবল এবং কিঞ্চিৎ দিশেহারা, কোন রকমে বিছানা থেকে নিজেকে টেনে তুলে হোঁচট খেতে খেতে দরজায় পৌঁছে ছিটকিনিটা নামিয়ে দরজা খুলে দেয় সে। তখনও সমানে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। এক পশলা ঠান্ডা পানির ঝাপটা আর ঝড়ো বাতাস এসে আছড়ে পড়ে ওর শরীরে, চোখে মুখে, চমকে উঠে খানিকটা ধাতস্থ হয় ও। তার দরজার সামনে কম করে হলেও জনা পাঁচেক মানুষের একটা জটলা- বাড়িওয়ালা, তার স্ত্রী, তাদের এক ছেলে আরে জনা দুই-তিন ভাড়াটিয়া, খোলা ছাদের নীচে দাঁড়িয়ে সবাই বৃষ্টিতে ভিজে ছপছপে হয়ে গেছে। চিলেকোঠার ঘরটা ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে, সিঁড়িঘর আর তার মাঝে প্রায় ফুট ত্রিশেকের খোলা ছাদ।
সবাই একজোটে তাকে লক্ষ্য করেই চীৎকার করে চলেছিল। তাদের কথাবার্তার কিছুই বুঝতে পারেনি রিমা, তার মনে হয়েছিল যেন এক বিকটকায় শব্দের যন্ত্র উগড়ে দিচ্ছিল অবোধ্য শব্দের জঞ্জাল। কয়েকটা মুহূর্তের হতবিহবলতার পর যখন সেই গোলমেলে আওয়াজের ভীড় খানিকটা কমে এলো তখন ধীরে ধীরে তাদের কথার অর্থ তার কাছে পরিষ্কার হতে থাকে। বাড়িওয়ালার স্ত্রী, মাঝবয়েসী ভদ্র স্বভাবের মহিলা, তার একটা হাত ধরে একঝটকা টানে উন্মুক্ত ছাদে নিয়ে আসে, মুষল ধারে ঝরে পড়া বৃষ্টি উপেক্ষা করে এগিয়ে যায় সিঁড়িঘরের দিকে। ভেড়ানো দরজাটাকে হ্যাঁচকা টানে বাইরের দিকে সরিয়ে দিতেই সামনের কংক্রিটের পাটাতনে একটা লোককে চিত শুয়ে থাকতে দেখে রিমা। সেই ক্ষুদ্র চত্তরে কম করে হলেও ডজন খানেক মানুষ- নারী, পুরুষ, শিশুরা – জড় হয়ে গভীর মনযোগ দিয়ে সেই লোকটার দিকেই তাকিয়ে ছিল। তার আবির্ভাবে সেই ক্ষুদ্র জনতা আচমকা নিঃশব্দ হয়ে পড়ে, নীরবে তাকেই পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। তাদের দৃষ্টিতে এমন কিছু একটা ছিল যে তৎক্ষণাৎ রিমার মনের মধ্যে একটা খটকা লাগে। একটু ভালো করে তাকাতেই কারণটা পরিষ্কার হয়। লোকটা আর কেউ নয়, তার লাভলু। আরোও দু পা এগিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে লক্ষ্য করে লাভলুর মুখ কাগজের মত সাদা, নিথর দৃষ্টি ছাদের দিকে মেলে ধরা। তার মুখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে নামছে ফেনা, গন্ডের উপর গ্যাজার ভেজা রেখা। শরীরের পাশে তার নির্জীব দুটি হাত অলস ভঙ্গিতে রাখা। তার ডান হাতের পাশে একটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ রাখা। কি ঘটেছে বুঝতে খুব একটা বিলম্ব হয়নি ওর।
হায়রে লাভলু!
ওর মাথায় ঐ শব্দ দুটোই সবার আগে এলো। রিমার কি কোন দোষ ছিল? যেভাবে নেশার সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিল, এই দুঃখজনক পরিণতির জন্য ছেলেটা নিজেই কি নিজের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল না? রিমা কি কোনভাবে লাভলুর সেই দুঃখজনক পরিণতিকে দ্রæততর করেছে? সবার কৌতূহলী দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে ছিল ওর উপর, যেন সবাই আশা করে ছিল সে চীৎকার করে কেঁদে উঠবে স্বামীর মৃত্যুতে, কেঁদে ভাসিয়ে দেবে গণ্ডদেশ, কিন্তু বাস্তবে জমে গিয়েছিল রিমা। কোন কথা নয়, আশ্রæ বিসর্জন নয়, সে ধপ করে বসে পড়েছিল সেই শীতল মেঝেতে, দৃষ্টি আঁঠার মত সেঁটে ছিল মৃতের মুখের উপর।
আমার হতভাগা লাভলু!
পরবর্তি কয়েকটা দিন গিয়েছিল এক আধা স্বপ্ন আধা জাগরণের মধ্যে- বাস্তব এবং অবাস্তবের মধ্যে। তার চোখের সামনে দিয়ে এক চলন্ত ট্রেনের মত, একটা চলচিত্রের মত ঘটে চলেছিল নানা ঘটনা, শুধু একটাই সমস্যা ছিল- সেই চলচিত্রের সে ছিল অনিচ্ছুক মূল চরিত্র। বিস্ময়, হতবিহবলতা এবং আতঙ্কের ভেতর দিয়ে ছুটছিল সে। যেন ঠিক বুঝতে পারছিল না তার চারপাশে কি ঘটছে। পুলিশ কেন বার বার তাকেই লাভলুর মৃত্যুর জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করছে? লাভলুর বাবা-মা, প্রিয়জনেরা কেন তাকে লাভলুর খুনী বলছে? কেন সারা শহরের মানুষ হঠাৎ লাভলুর অকাল মৃত্যুতে তার ভূমিকা নিয়ে আলাপে মেতে উঠেছে?
সেই তরুণের মৃত্যুর জন্য সে কি কোনভাবে দায়ী ছিল? হয়ত ছিল। ছিল না? ওকে এক আচমকা দায়িত্ববোধের মধ্যে টেনে না আনলে হয়ত এতো দ্রæত তার অবক্ষয় হত না। কিন্তু সেই অপরাধবোধ এবং অন্য সবাই তাকে যেভাবে দোষারোপ করছিল তার মধ্যে কোন যুক্তি সংগত কারণ ছিল না। পরে জেনেছে সেই রাতে লাভলু বাসায় ফিরেছিল আরোও ড্রাগস নিয়ে যাবার জন্য। ওর নাকি চিলেকোঠার ঘরে কোন এক বাক্সের মধ্যে আরোও কিছু লুকানো ছিল। রিমা নিশ্চয় দরজা খুলে দিয়েছিল। কিন্তু তারপর কি হয়েছিল? রিমা কি ওকে ড্রাগস বের করতে দেখেনি? তারপর লাভলু কি করেছিল? রিমা কি রাগ করে তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল? ছেলেটার জন্য ওর মনে কি কোন দরদ কিংবা ভালোবাসা ছিল না? নাকি এটাই সে চেয়েছিল? লাভলু দ্রুত চরম অবক্ষয়ের দিকে ছুটছিল। তার হাত থেকে রিমা মুক্তি চেয়েছিল, চায়নি?
লাভলুর জন্য দরজা খুলবার কথা ওর মনে পড়ে না। সেই রাতে লাভলুর বাসায় ফেরার কথাও ওর একেবারেই মনে পড়ে না। এমনটা কি হতে পারে বেশ কয়েকটা ঘুমের ওষুধ খাওয়ায় ওর ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিভ্রম হয়েছিল ওর? কিন্তু একটা ব্যাপারে ওর মনে কোন সন্দেহ ছিল না লাভলু যদি বাসায় ফিরে থাকত, তাহলে সে কখন আরও ড্রাগস নিয়ে তাকে চলে যেতে দিত না। জীবন গেলেও না। ওর ধারণা লাভলু সিঁড়িঘর পর্যন্ত এসেছিল বাসায় ঢুকে ড্রাগস নেবার জন্যই, কিন্তু সেখানে এসে ভেবেছিল আরেকটা শট নিয়ে তারপর বাসায় যাবে কারণ জানত রিমা তাকে হয়ত আর বের হতে দেবে না। মেঝেতে বসে নিজের শরীরে আরেক ডোজ হেরোইন প্রবিষ্ট করে, ওভারডোজ হয়ে যায়। পরবর্তি কয়েকটা মুহূর্ত যে আনন্দময় অনুভূতি তার হয়েছিল সেটা তার শ্বাস প্রশ্বাস এবং সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের উপরেও প্রভাব ফেলে। তার শ্বাস প্রশ্বাস ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে এবং এক সময় সে যখন সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে তখন একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। বেদনাহীন এক মৃত্যু হয় তার। পরবর্তিতে তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে পড়াশুনা করে জেনেছে রিমা। লাভলুর মৃত্যুতে ওর কোন হাতই ছিল না। বারবার সেই কথাই সে সবাইকে বলতে থাকে- পুলিশকে, লাভলুর আত্মীয়স্বজনদেরকে, সাংবাদিকদেরকে এবং বস্তুত যার সাথেই তার কথা হত তাকেই।
অবশেষে সেই যন্ত্রণাময় সময়েরও ইতি হয়। লাভলুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে উন্মত্ততার সৃষ্টি হয়েছিল সেটা ধীরে ধীরে চাঁপা পড়ে যায়। তার শেষকৃত্যে যেতে চেয়েছিল কিন্তু সাহস করে নি। হঠাৎ সারা শহরের মানুষের কাছে সে হয়ে উঠেছিল চিলেকোঠার ডাইনী। সবচেয়ে দুঃখজনক ছিল, লাভলু চলে যাবার পর ঐ চিলেকোঠার ঘর আকড়ে পড়ে থাকার তার কোন কারণ ছিল না কিন্তু অন্য কোথাও যাবারও স্থান ছিল না। অন্তরের গভীরে ওর একটা আশা ছিল ওর বাবা-মা ওকে হয়ত সেই দুর্বিপাক থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবেন। সারা দেশের মানুষ যা নিয়ে মেতে ছিল তারা সেই খবর পাবেন না তা হতেই পারে না। খবরের কাগজে, টেলিভিশনে, রেডিওতে কোথায় না তার কাহিনীর আদ্যোপান্ত অনুক্ষন প্রচারিত হচ্ছিল? তারা আসেননি। ও বুঝেছিল সেটা ছিল বাবার সিদ্ধান্ত। তিনি তাকে শাস্তি দিচ্ছিলেন তার অবাধ্যতার জন্য, তার দৃঢ়তার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। বিদ্ধস্ত হয়ে পড়লেও বাবার কাছে এই যুদ্ধে হারতে চায়নি রিমা। নিজেকে তার কাছে প্রমাণ করবার এই সুযোগ সে হাত ছাড়া করতে চায়নি। সেই অসাহয়ত্বের মধ্যেও আত্মসম্মানবোধ ওকে তাড়িত করছিল। তারপর, খুব আকস্মিকভাবে একজন এলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে, যার মুখ সে জীবনে আর কখন দেখতে চায়নি, তার জীবনের যাবতীয় সমস্যার জন্য যাকে সে অনুক্ষন মনে মনে দোষারোপ করত, সেই মহান নোমান!