শুজা রশীদ : (পর্ব ১৮)
কিছু একটা ছিল ঐ চিঠির ভাষায়, পরিণত কিন্তু একই সাথে বালসুল্ভ, শব্দ চয়ন এমনই চমৎকার যে অধিকাংশ নারীই বিমুগ্ধ হবে কিন্তু আবার কিঞ্চিৎ বিরক্তিকরও। রিমার আঠারো বছর বয়েসে যত প্রেম পত্র সে পেয়েছিল তার মধ্যে সেই পত্রখানি ছিল নির্দ্বিধায় সেরা। হয়ত পত্র লেখকের বাক্যলাপে লাজুকতার কারণেই তার লেখনী শক্তিতে বিশেষ রকমের নৈপুণ্যতা ছিল।

চিঠিখানা তার ফেলে দেয়া উচিৎ ছিল। নিদেন পক্ষে এমন কোথাও লুকিয়ে রাখা উচিৎ ছিল যেখানে কারো দৃষ্টি পড়বে না। কিন্তু কোন এক আযৌক্তিক কারণে সে খানিকটা অবহেলা ভরে সেটাকে গুঁজে রেখেছিল তার ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে। কাজটা ঠিক হয়নি। লাভলু ওর ব্যাগের মধ্যে টাকার জন্য হাতাচ্ছিল, ওর ভাষ্য অনুযায়ী ঋণ নেয়া, চিঠিটা ওর নজরে পড়ে- নীল কাগজে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা যার শুরু হয়েছিল প্রিয় রিমা দিয়ে।

নিজের সম্বন্ধে লাভলুর অনেক উঁচু ধারণা ছিল, পালের গোদা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাটা সব খানেই তার জন্য জরুরি ছিল। রিমার সাথে সেই চিঠি নিয়ে আলাপ করার কোন প্রয়োজন সে অনুভব করেনি। যেখান থেকে নিয়েছিল সেখানেই চুপি চুপি রেখে দিয়েছিল যেন রিমা বুঝতেও না পারে সে পত্র খানা আদ্যোপান্ত পড়েছে। দিন দুই পরে, বিকালে সামনের বেলকনীতে দাঁড়িয়ে হালকা বাতাসে গোছলের পর যখন চুল শুকাচ্ছিল রিমা, দৃষ্টি সামনের রাস্তার উপর, ওর ধারণাও ছিল না একটু পরেই সেখানে কি ভয়ানক এক ঘটনার সূত্রপাত হবে।

হতে পারে রিমা কিঞ্চিৎ অন্যমনষ্ক ছিল, অথবা হয়ত কিছুটা কৌতূহলও ছিল নোমান কি করে দেখার জন্য। জানত সাধারণত তার নীল গাড়িটা চালিয়ে এমন সময়েই অফিস থেকে ফিরত লোকটা। ঐ অনাকাক্সিক্ষত কৌতূহল থাকাটা তার উচিৎ হয়নি, কিন্তু বয়েস যখন আঠারো, ঐ জাতীয় কৌতূহলকে জয় করাটা কঠিন। কারো প্রগাঢ় প্রেমকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করাটা কষ্টসাধ্য।

নোমান তাদের বিল্ডিঙয়ের সামনে তার গাড়িটা থামিয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে তাকিয়ে ছিল রিমাদের বেলকণির দিকে, খানিকটা অভ্যেস বশতই হবে। বোধহয় আশাও করেনি রিমাকে দেখবে। তাকে দেখেই সে যেন সম্পূর্ণ জমে গেল। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকল। রিমা স্পষ্ট অনুভব করতে পারে লোকটার বুকের মাঝে তোলপাড় তোলা হৃতপিন্ডের কাঁপন। কিন্তু তার নিজের কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। তার কাছে পুরো ব্যাপারটাই ছিল একটা কৌতূহল মাত্র। নিষ্পাপ কৌতূহল।

হঠাৎ একটা মটর সাইকেল ছুটে এলো সংকীর্ণ গলিপথ ধরে, নোমানের ঠিক সামনে এসে আচমকা ব্রেক কষল। সেই প্রবল শব্দে কোন এক যাদুকরী জগত থেকে মুহূর্তের মধ্যে বাস্তবে ফিরে আসে নোমান। মটর সাইকেলের চালকের আসনে লাভলু। সাথে জনা দুই বন্ধু নিয়ে এসেছে, মস্তান হিসাবে তারা সর্বজনবিদিত, রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের ক্ষমতাধরদের সাথে দহরম মহরম। লাভলু ব্যাপারটা সহজেই মিটিয়ে ফেলতে পারত। নোমানকে সহজ ভাষায় জানিয়ে দিতে পারত রিমা তার গার্ল ফ্রেন্ড। তাকে ছেলেমানুষি প্রেম পত্র লিখে কিংবা তার পেছনে ঘুরে সময় নষ্ট করাটা নোমানের জন্য অনুচিত। রিমাকে বিয়ে করবার কোন প্রচেষ্টা তার করা উচিৎ হবে না কারণ তাতে রিমার কোন আগ্রহ নেই। সেই ভদ্রতাসূচক সতর্কতাতেই কাজ হয়ে যেত, নোমান হয়ত আর ভবিষ্যতে কখন রিমার দিকে চোখ তুলে তকাতেও সাহস পেত না। কিন্তু লাভলুর ধরণ ছিল ভিন্ন। সেই খানে, তার গার্ল ফ্রেন্ডের সামনে, পাড়ার যাবতীয় মানুষের সামনে এমন কিছু একটা করবার তার প্রয়োজন ছিল যেন কারোও মনে কোন দ্বিধা দ্ব›দ্ব না থাকে রিমার প্রতি আগ্রহ দেখালে, তার কাছে প্রেম নিবেদন করলে তার পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে। সকল রোমিওদেরকে হঠানোর জন্য কোন একজনকে উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করবার তার দরকার ছিল। রিমা আমার। শুধু আমার।
তারা তিনজন মিলে নোমানকে পেটায়। নিষ্ঠুরভাবে, নির্বিচারে। এক সময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে নোমান, তার রক্তাক্ত শরীর এলিয়ে পড়ে মাটিতে, বুঁজে আসে দৃষ্টি, তার শ্বাস প্রশ্বাস চলছে কিনা বোঝা দুষ্কর হয়ে পড়ে। বেলকনীতে দাঁড়িয়ে গলার সমস্ত শক্তি দিয়ে চীৎকার করে লাভলুকে থামবার জন্য অনুরোধ থেকে শুরু করে অনুনয় বিনয় পর্যন্ত করেছে রিমা, কিন্তু তাতে কোন কর্ণ পাত করেনি লাভলু। সে এসেছিল একটা প্ল্যান নিয়ে, সফল না হওয়া পর্যন্ত সে থামবে না। যেভাবে এসেছিল সেভাবেই মটর সাইকেলে প্রচন্ড আওয়াজ তুলে প্রস্থান করে লাভলু এবং তার বন্ধুরা, যাবার আগে রিমার দিকে তাকিয়ে বীরত্বের গর্বিত হাসি দিয়ে যায়। তারা বিদায় নেবার পর স্থানীয় কিছু তরুণেরা অগ্রণী হয়ে নোমানের খোঁজ নিতে যায়, একজন এম্বুলেন্স ডাকে। তার বাসায় খবর দেয়া হয়।

লাভলু ছিল ওর জানের জান, প্রাণের প্রাণ কিন্তু তারপরও সেই ঘটনার পর বেশ কয়েকটা দিন লাভলুর প্রতি তীক্ষ্ণ একটা ঘৃণাবোধ অনুভব করেছিল রিমা। ধীরে ধীরে সেই অনুভূতিটা উষ্মাতে পরিণত হয়, পরে একবারেই উবে যায়। সে জেনেছিল নোমান ভালো আছে। কিছু হাঁড়গোড় ভেঙ্গেছে কিন্তু বেঁচে যাবে। দীর্ঘস্থায়ী কোন ক্ষত থাকবে না। তারপর কয়েকটা মাস বেলকনীতে গিয়ে আর দাঁড়ায়নি ও। সেই ঘটনার জন্য নিজেকেই দোষারোপ করেছে। চিঠিটা পুড়িয়ে টয়লেটে ছাইগুলো ফেলে ফ্লাশ চেপে চেষ্টা করেছিল সেই পরিচ্ছদটাকে চিরতরে ভুলে যেতে।

২৬.
নোমানকে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছিল। সপ্তাহ দুয়েক পরে একটু ভালো বোধ করতে শুরু করার পর তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়। ইতিমধ্যে রিমার জীবন আকাশ পাতাল হয়ে গেছে। বাস্তবিক অর্থেই। পরবর্তিতে ও অনুধাবণ করেছিল সেই একটা ঘটনাই কিভাবে তার সমগ্র জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। লাভলুর এক ভয়াবহ ভুলের মাশুল তাকেই দিতে হয়েছে। সে ঘটনার পর রিমা যতই চেষ্টা করুক নিজেকে আড়াল করতে তার বাবা মা স্পষ্টভাবেই বুঝে ফেলেছিলেন সম্পূর্ণ ব্যাপারাটার পেছনে রিমার একটা গুরূত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল। রিমার সৌন্দর্যে পাগল হয়ে তরুণের দল ঝাঁকে ঝাঁকে যে এই দালানের আশে পাশে ঘুর ঘুর করত এটা এই পাড়ায় কারোরই জানতে বাকি ছিল না। তাদের অধিকাংশই একটা ভদ্রতাসূচক গন্ডী পার হবার সাহস কখনই পায়নি, নিদেন পক্ষে লাভলুর পক্ষ থেকে এমন ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হবার মত তো নয়ই। লাভলুকে ওর বাবা-মা বেশ কয়েকবার দেখেছেন, যেহেতু সে মাঝে মাঝে রিমাকে বাসা থেকে নিয়ে যেত আবার কখন বাসায় পৌঁছে দিয়ে যেত। তারা কখন কিছু জিজ্ঞেস করলে রিমা দৃঢ় কন্ঠে জানাত সে একজন ভালো বন্ধু, তার বেশি কিছু নয়। তারা সম্ভবত তাকে বিশ্বাস করতেন, কিংবা হয়ত ভেবেছিলেন আরোও কিছু দিন যাক, তার পর দেখা যাবে কি হয়।

একটা ব্যাপার রিমা পরিষ্কার জানত, তার বাবা-মা খুব একটা রক্ষণশীল না হলেও লাভলুকে তারা কখনই মেনে নেবেন না। লাভলুর মত ছেলেকে জামাই করবার জন্য কোন মেয়ের বাবা-মাই খুব উৎসাহিত বোধ করবে না। সে ছিল উড়নচণ্ডী ধরনের, রাগী স্বভাবের, চারদিকে ঝামেলা পাকিয়ে বেড়াত, মিশত যাদের সাথে তাদের অধিকাংশরই অপরাধচক্রের সাথে যোগাযোগ ছিল, তার নিজেরও জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল আর্মস ক্যাডার হবার। তার অন্যান্য বদ অভ্যাসও ছিল। রিমার কাছে কখন সরাসরি স্বীকার না করলেও রিমা জানত সে মাঝে মাঝে মদ খেত এবং হয়ত ড্রাগসও নিত। রিমাদের পরিবারে কেউ মদ্য পান করত না। ওর বাবা এই ব্যাপারে খুব কঠিন না হলেও মা সহ্যই করতে পারতেন না।
নোমানের কথা ছিল ভিন্ন। তার বিয়ের প্রস্তাবে ওর বাবা-মা সম্মত হলে আশ্চর্য হবার কিছু থাকত না।

সেই ঘটনার পর, রিমা যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল তার বাবা-মায়ের কাছে লাভলুর ভ‚মিকাটাকে ছোট করে দেখানোর কিংবা একেবারেই গোপন করার। ছোট ভাইটাকে এক বাক্স দামী চকলেটও কিনে দিয়েছিল বাবা-মা কিছু জিজ্ঞেস করলে মুখ বন্ধ রাখার জন্য। কিন্তু এই সব ক্ষেত্রে সত্য গোপন করা খুবই দুষ্কর। ওর বাবার পরিচিত মানুষের সংখ্যা ছিল অগণিত। আর ওর মায়ের ছিল এক পাল সখী, আশেপাশের বাসাগুলোর কাজের মেয়েরা, যাদের সাথে বসে বসে সারাদিন টেলিভিশনে নাটক দেখতেন। তারাই তাকে পাড়ার কোথায় কি হচ্ছে তার সবিস্তারে বর্ণনা দিত। পরদিন দুপুরের মধ্যেই ঘটনার আদ্যপান্ত তাদের জানতে বাকী থাকল না।

জয়নাবের খ্যাতি ছিল উকিল হিসাবে। তার জেরার সামনে তুখোড় সাক্ষীও নাস্তানাবুদ হত। মেয়ের মুখ থেকে লাভলু সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য বের করতে তার সাকুল্যে বিশ মিনিট লাগল। স্বামীর পাশে বসে তার মা রাফিয়া, যোগ্য উকিলের যোগ্য স্ত্রী, অগ্নি দৃষ্টিতে তাকে ভস্ম করবার চেষ্টা করতে থাকেন জেরার সময়। রিমা তার সাধ্যমত চেষ্টা করেছিল লাভলু সম্বন্ধে দু চারটে ভালো কথা বলতে, তার কিছু কিছু ভালো দিক তুলে ধরতে, কিন্তু নোমানের মত ভদ্র, বিনীত, চরিত্রবান একটা ছেলেকে সে যেভাবে গরু পেটা করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে তারপর বাবা-মাকে সেই সবের কিছুই বিশ্বাস করান যায়নি। দু’জনে সেই বৈঠকেই দ্রæত সিদ্ধান্ত নিয়ে রিমাকে জানিয়ে দিলেন লাভলুর সাথে কোন সম্পর্ক রাখা যাবে না। কোন যোগাযোগ থাকতে পারবে না। যদি তারা জানতে পারেন রিমা তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচারণ করেছে তাহলে তার ফল হবে বিরুপ, তাকে তারা ইউনিভার্সিটি পরিবর্তন করতেও বাধ্য করতে পারে।

তখনও লাভলুর উপর ভয়ানক ক্ষেপেছিল ও, কিন্তু বাবা-মায়ের এই রায় শুনে তার মেজাজটা একেবারেই চড়ে গেল। লাভলুর সাথে তার সম্পর্ক থাকবে কি থাকবে না সেটা তার একান্তই ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তার বয়েস আঠারো, সুতরাং সে একজন পরিণত বয়স্ক মানুষ এবং এই জাতীয় ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার সম্পূর্ণ অধিকার তার আছে। তার বাবা-মা তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেও এই ব্যাপারে তাদের মতকে তার উপর চাপিয়ে দেবার কোন অধিকার তাদের নেই। তার প্রেম সংক্রান্ত ব্যাপার সে কিভাবে চালনা করবে সেই নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র তার একারই থাকা উচিৎ। যদি তার জীবন থেকে কাউকে চলে যেতেই হয় সেটা তার বাবা-মাকেই হতে হবে, কারণ তাদের জবরদস্তিমূলক আচরণ রিমা কোন অবস্থাতেই সহ্য করবে না।

পরবর্তি দুই সপ্তাহ খুব চুপচাপ কাটালো ও, মাথার মধ্যে নানা ধরনের পরিকল্পনা চলছে, কিভাবে কি করবে তার নীল নক্সা আঁকার চেষ্টা করছে। নিজেও জানত না কোন ব্যাপারে একবার মনস্থির করে ফেললে কতখানি দৃঢ় সংকল্প হতে পারে ও।

দৃঢ় সংকল্প কিন্তু উজবুক নয়। লাভলুর সাথে যদি পালিয়েই যাবে বলে স্থির করে থাকে তাহলে লাভলুকেও কিছু দায়িত্ব নেবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রিমার বিয়ের প্রস্তাবে সে সাগ্রহে সম্মত হয়েছে, তার বাবা-মায়ের মত থাকুক আর না থাকুক। নিজেদের একটা ছোট ঘর বাঁধার ব্যাপারটা তার খুব মনে ধরেছে। রিমার মনে তার ব্যাপারে কোন দ্বিধা দ্ব›দ্ব ছিল না তা নয়। লেখাপড়ায় লাভলুর একেবারেই মনযোগ ছিল না, ক্লাশে প্রায়ই দেরী করে আসত। মাঝে মাঝে আবার মনে হত মাতাল হয়ে এসেছে। কখন কখন বেশ কিছুদিন হয়ে যেত রিমার সাথে কোন যোগাযোগ করত না। ড্রাগস নেবার সম্ভাবনাটাও খুব একটা ভালো লাগত না। জিজ্ঞেস করলে বলত কালে ভদ্রে নেয়। কিন্তু সব মিলিয়ে লাভলুর প্রতি তার নিজের যে তীব্র ভালোবাসা এবং যৌন আকর্ষণ ছিল, সেই তুলনায় লাভলুর মন্দ দিকগুলোকে সে উপেক্ষা করবারই সিদ্ধান্ত নেয়।

নোমান হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার দুই দিন পর ছোট একটা ব্যাগে সামান্য কিছু জিনিষপত্র গুছিয়ে নিয়ে, ক্লাশের বই পত্র যা ছিল সব সাথে করে ইউনিভার্সিটিতে যায় রিমা এবং লাভলুর সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলে। বিয়ের রেজিসট্রেশন হবার পর তাকে নিয়ে এক বন্ধুর চিলেকোঠার ঘরে এসে ওঠে লাভলু। বাসাটা সে এক বন্ধুর কাছ থেকে কিছুদিনের জন্য ধার নেয়। ওর বন্ধুরা সবাই টাকা পয়সা তুলে ওদের কিছু আসবাবপত্র এবং হাঁড়িপাতিল কিনে দেয়। একজন কোথা থেকে একটা খাট এবং বিছানা এনে দেয়। সেই হল রিমার প্রথম সংসার। বাবা-মায়ের ভালোবাসার ঘর ছেড়ে নিজের প্রথম ঘর। বাবা-মাকে ছোট একটা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে বিয়ের খবরটা জানিয়েছিল। কোথায় আছে জানায়নি, ভেবেছিল তারা আগ্রহ দেখালে তখন বলবে। নিজের বাবা-মাকে তার সেই ক্ষুদ্র সংসারে আমন্ত্রণ জানানোর চেয়ে আনন্দকর আর কিছু হতে পারত না।

ঠিক যেভাবে ভেবেছিল ঘটনা সেভাবে ঘটে নি। তার বাবা এক দিনের মধ্যেই তার অবস্থান বের করে ফেলেন এবং এক গাড়ী ভর্তি পুলিশ নিয়ে এসে সিঁড়ি ভেঙে পাঁচ তলার চিলেকোঠায় এসে হাজির হন। রিমা বাসায় থাকবে তারা জানতেন। রিমাকে ইউনিভার্সিটি থেকে অনুসরণ করে এসেছিলেন। মাত্র গোছল সেরেছিল রিমা, দরজায় ধাক্কা শুনে ভেবেছিল হয়ত লাভলু ফিরে এসেছে।

দরজা খুলে বাবাকে এক ডজন পুলিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্তম্ভিত এবং বিস্মিত হয়েছিল। কিন্তু মন্দের ভালো যে তার বাবা উকিল বিধায় আইনের প্রতি তার অসম্ভব শ্রদ্ধাবোধ ছিল। বিয়ের সার্টিফিকেট দেখার পর মেয়েকে জোর করে নিয়ে যাবার ইচ্ছা তার নিমেষেই নির্বাপিত হয়ে যায়। কিন্তু রিমার কাছে কাকুতি করলেন বাসায় ফেরার জন্য, লাভলু ব্যাতিরেকে। বিয়েটা কোন একটা আইনগত সমস্যা তুলে ভেঙে দেয়া যাবে বলে প্রতিশ্রæতি দেন। প্রায় ঘন্টা খানেক চেষ্টা করবার পরও যখন রিমার মত পালটানো গেল না, তখন সঙ্গী পুলিশ অফিসারদের নিয়ে প্রত্যাগমন করেন তিনি, চিরতরে।
যদি রিমা কখন বাড়ী ফিরতে চায় তাহলে তাকে নিঃশর্তে ফিরতে হবে।

চলে যাবার আগে সেটা ছিল তার শেষ কথা। রিমাও রাগের মাথায় চীৎকার করে বলেছিল সেই দিন কখন আসবে না। যদি কোন ভাবে মাস দুই ভবিষ্যতে চলে যেতে পারত তাহলে হয়ত পরিস্থিতি ভিন্ন হত। ধীরে ধীরে হলেও এক সময় আর ওর জানতে বাকী থাকল না মাদক দ্রব্যের প্রতি লাভলুর প্রবল অনুরক্তি, বিশেষ করে হেরোইন। পরবর্তিতে অনেক ভেবেও বুঝতে পারে নি কিভাবে লাভলুর সেই দিকটা সে একেবারেই লক্ষ্য করে নি। বছর খানেকের পরিচয়ে নিশ্চয় যথেষ্ট প্রমাণ ছিল। হতে পারে আনুরাগ, অনুরক্তি এবং দৈহিক আকর্ষণের ঘোরে অনেক কিছুই সে উপেক্ষা করেছে।