অনলাইন ডেস্ক : অনেকেই ঘনঘন কোভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষা করছেন। উপসর্গ নেই বা সামান্য হাঁচি বা গলা ব্যথা হলেই একাধিকবার করোনা পরীক্ষা করছেন। সামান্য জ্বর হলেই অনেকে ছুটছেন নমুনা নিয়ে। এদের কারণে করোনা আক্রান্তদের পরীক্ষার সুযোগ নষ্ট হচ্ছে। অতি উৎসাহীদের ঘনঘন পরীক্ষায় সংকট দেখা দিয়েছে কিটের।

ল্যাবরেটরিতে নমুনার স্তূপ তৈরি হচ্ছে। পরীক্ষার জন্য ল্যাবে নমুনার সিরিয়াল সাজাতে হচ্ছে। ফলে রিপোর্ট পেতে সময় লাগছে অনেক বেশি। এতে করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। অন্যদিকে রিপোর্টের অভাবে হাসপাতালে ভর্তি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের কাজে যোগদানসহ নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

এসব কারণে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অতি উৎসাহী হয়ে অহেতুক টেস্ট না করানোর জন্য জনগণের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। তারা বলেন, লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিলে অথবা দেখা না দিলেও সন্দেহ থাকলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। তাদের মতামত নিয়ে প্রয়োজন হলে নমুনা পরীক্ষা করান।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, সামান্য জ্বর-হাঁচি-কাশি বা গলা ব্যথা নিয়ে যারা অপ্রয়োজনে নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন তাদের অধিকাংশের রিপোর্ট আসছে নেগেটিভ। একবার নেগেটিভ রিপোর্ট আসার পরও অনেকের মন প্রশান্ত হতে চায় না। সন্দেহ থেকেই যায়। রিপোর্ট সঠিক কিনা তা নিয়ে তৈরি হয় সংশয়ের।

এ অবস্থায় অনেকেই পৃথক একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে নমুনা দিয়ে আসেন। সাধারণত নমুনা সংগ্রহের পর পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে পজিটিভ রিপোর্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা ওই ব্যক্তিকে জানিয়ে দেয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু নেগেটিভ রিপোর্ট এলে তা যাচাই-বাছাই শেষে সরবরাহ করতে বেশ কয়েকদিন সময় চলে যায়। এতে তৈরি হয় রিপোর্ট জ্যাম।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, একজন গুরুতর অসুস্থ বা কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তি দিনের পর দিন ঘুরেও পরীক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তি তার বাসার চাকরবাকরসহ সবাইকে কোভিড পরীক্ষা করাচ্ছেন। এভাবে চলছে দিনের পর দিন। সরকারের সময় ও অর্থ নষ্ট করছেন তারা।

অনুসন্ধানে এমনও তথ্য পাওয়া গেছে, একই ব্যক্তি পরপর দু’বার এমনকি তিনবারও কোভিড পরীক্ষা করিয়েছেন। ফলাফল নেগেটিভ। কেন তিনি এমনটি করলেন এর কোনো সদুত্তর নেই। এই তালিকার একজন রোগী নাম গোপন করে বলেন, নেগেটিভ রিপোর্ট হাতে থাকলে মনে জোর পাই। সাধারণ কোনো অসুখ নিয়ে কোনো হাসপাতালে গেলে নেগেটিভ রিপোর্ট থাকলে চিকিৎসা পেতে সুবিধা হয়। আর রিপোর্ট না থাকলে হাসপাতালগুলো সন্দেহের চোখে দেখে। আমাদের কি করার আছে বলেন।

সুস্থ মানুষের জন্য কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা দরকার কিনা বা কোন পদ্ধতিতে একজন সুস্থ মানুষ দফায় দফায় নমুনা দেয়ার সুযোগ পায়- এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, এখন একজন ব্যক্তির একাধিক ফোন নম্বর থাকে। তারা আবার একাধিক নম্বর ব্যবহার করেন।

নেগেটিভ রিপোর্ট আসার পরও পুনরায় নমুনা দিতে পারেন। কারণ ফোন নম্বরটাই আমাদের কাছে আইডি। এমনও দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি প্রথমে ঢাকায় পরীক্ষা করেছেন। আবার একই নম্বর ব্যবহার করে ঢাকার বাইরে গিয়েও করেছেন। তবে ইদানীং এই প্রবণতা কিছুটা কমে আসছে বলে জানান তিনি।

কিভাবে জানতে পারেন এক ব্যক্তি নেগেটিভ রিপোর্ট আসার পর আবারও পরীক্ষা করালেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা মোবাইল নম্বর (আইডি) পর্যবেক্ষণ করে জানতে পারছি। তবে চাপ কমানোর জন্য এখন সরকার ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। তিনি জানান, একজন রোগীর জন্য পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়াটা জরুরি। তাই দ্রুত তাকে সেই রিপোর্টটি দেয়া হয়। যাতে তিনি চিকিৎসা শুরু করতে পারেন।

আইইডিসিআর’র পরামর্শক প্রফেসর ডা. মো. মুসতাক আহমেদ বলেন, অপ্রয়োজনে কোভিড পরীক্ষার চাপ সামাল দিতে একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হবে। দেখা যাচ্ছে প্রভাবশালীরা ৪০-৫০ জনের একটা লিস্ট স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের হাতে ধরিয়ে দেন। এরপর চাপও দেন সবার পরীক্ষার রিপোর্ট পৌঁছে দিতে।

এটা বন্ধ করতে হবে। ওই প্রভাবশালী ব্যক্তি যখন আক্রান্ত হবেন, তখন কিন্তু তিনি পরীক্ষার সুযোগটা নাও পেতে পারেন। ফলে তাকে হুঁশ আনতে হবে। অন্য আক্রান্ত রোগীদের প্রতি সদয় হতে হবে। এতে একদিকে যেমন চাপ কমবে, অন্যদিকে প্রকৃত রোগীরা সেবাটা নিশ্চিতভাবে পাবেন।

পরীক্ষা করতে গিয়ে মানুষ কিভাবে হয়রানির শিকার হন- জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. নাজমুল করিম মানিক বলেন, যার করোনা টেস্ট দরকার নেই তিনি করতে গেলে জ্যাম তৈরি হয়। অন্যরা হয়রানিতে পড়েন। আমরাও চাই হয়রানিমুক্তভাবে প্রকৃত আক্রান্ত ব্যক্তি যেন নমুনা পরীক্ষার সুযোগ পান। আমাদের হাসপাতালে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে পরীক্ষা করানো হয়। সকালে নমুনা নেয়ার পর সন্ধ্যায় রিপোর্ট দেয়া সম্ভব। দেয়াও হয়। এই সুবিধা অন্য প্রতিষ্ঠানে নেই। তবে এই সুযোগটা হল প্রকৃত আক্রান্ত রোগীদের বেলায়।

তিনি জানান, ২৮ জুন স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে এক প্রজ্ঞাপনে আমাদের জানানো হয়েছে, নেগেটিভ দেখার জন্য দ্বিতীয়বার টেস্টের প্রয়োজন নেই। সবাইকে এই গাইডলাইন অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।

অপর এক চিকিৎসক জানান, একজন ব্যক্তির পজিটিভ হওয়ার পর ১৪ দিন অতিক্রান্ত হলে আর পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। তিনি আরও ১৪ দিন বাসায় থেকে গাইডলাইন অনুযায়ী চলবেন। সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করবেন। নেগেটিভ রিপোর্ট আসার পরও কেন দু’বার অনেকে পরীক্ষা করে- এমন প্রশ্নে ওই চিকিৎসক নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, বেসরকারি ব্যাংকসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বলে নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে আসো। বাধ্য হয়ে তারা পুনরায় পরীক্ষা করে রিপোর্ট হাতে নিয়ে কাজে যোগ দেন।

এসব কারণে সত্যিকার অর্থে যাদের পরীক্ষা করানো দরকার তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। কারণ দেশে এ ধরনের পরীক্ষার সামগ্রী কিটের অপ্রতুলতা রয়েছে। সেই সঙ্গে ল্যাবও খুব বেশি নেই। আবার সব প্রতিষ্ঠানে পিসিআর মেশিনে পরীক্ষার সুযোগ নেই। এই বাস্তবতায় সবার উচিত গুরুতর আক্রান্ত ব্যক্তিকে সহায়তা করা।