ডঃ বাহারুল হক : ক্রিসেন্ট টাউন, কানাডার বৃহত্তম নগরী টরন্টোর একটি পরিচিত নেইবারহুড-এর নাম। ড্যানফোর্থ এভিনিউ আর ভিক্টোরিয়া পার্ক এভিনিউ-র পাশে এবং ভিক্টোরিয়া পার্ক সাব-ওয়ে স্টেশনের কোল ঘেষে এই টাউনের অবস্থান। টরন্টো ট্রাঞ্জিট কমিশন সাব-ওয়েকে পূর্ব দিকে ক্যানেডি পর্যন্ত বর্ধিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এমন খবর পাওয়ার পর দুরদর্শী বিষয়-আশয় জ্ঞানী ধন কুবের শিল্পপতি ওয়াল্টার মেসীও সিদ্ধান্ত নিলেন সাব-ওয়ের এডভ্যান্টেজ তিনি নিবেন; তিনি নতুন সাব-ওয়ে স্টেশনের পাশে গড়ে তুলবেন সয়ংসম্পূর্ণ আবাসিক অনু নগর। জমি খুঁজতে লাগলেন। শেষে পেয়ে গেলেন ভিক্টোরিয়া পার্ক সাব-ওয়ে। স্টেশনের পাশে ভিক্টোরিয়া পার্ক এভিনিউ এবং ডজ রোডের সন্নিকটে পছন্দ মত জমি। কিনে ফেললেন ২৪০ একর জমি। সে জমিতে তিনি গড়ে তুললেন ক্রিসেন্ট টাউন, সয়ংসম্পূর্ণ একটা আবাসিক এলাকা। ক্রিসেন্ট টাউন একটি ছাদ যুক্ত ওভার হেড ব্রীজ দ্বারা ভিক্টোরিয়া পার্ক সাব-ওয়ে স্টেশনের সাথে সরাসরি সংযুক্ত। সাব-ওয়ে স্টেশনের কোল ঘেষে অবস্থান হওয়াতে এবং ওভার হেড ব্রীজ দ্বারা সরাসরি সাব-ওয়ে স্টেশনের সাথে সংযুক্তি থাকাতে ক্রিসেন্ট টাউনে বাসার চাহিদা খুব বেশি। বেশ কয়েকটি বহুতল আবাসিক ভবনের অবস্থান এই টাউনের বিশেষত্ব। নগর জীবনের প্রায় সকল চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা আছে বলে ক্রিসেন্ট টাউন জন্মলগ্ন থেকে একটি আদর্শ ও জনপ্রিয় আবাসিক এলাকা। টাউনের দক্ষিণ পাশে আছে। ডেন্টোনিয়া পার্ক নামে সুন্দর এক পার্ক। পার্কের ছয় হেক্টর জমির পুরোটাই ১৯২৬ সনে ধনকুবের শিল্পপতি ওয়াল্টার মেসীর স্ত্রী সুসান ডেন্টন মেসী পার্ক নির্মাণের জন্য টরন্টো সিটি কর্পোরেশনকে দান করেন। সিটি কর্পোরেশন জমি পেয়ে পার্ক নির্মাণ করে আর সুশান ডেন্টনের নামে পার্কটির নাম দেয়া হয় ডেন্টোনিয়া পার্ক। বসার, হেঁটে বেড়াবার ব্যবস্থা ছাড়াও ফুটবল, বাস্কেট বল, টেবিল টেনিস, ক্রিকেট, প্লাশ ইত্যাদি নানারকম খেলার ব্যবস্থা এই পার্কে বিদ্যমান। এই পার্কেই আছে শিশুদের খেলা সহ আরো বিনোদনের জন্য একটি শিশু পার্ক কর্ণার। ডেন্টোনিয়া পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আছে লন টেনিস ক্লাব এবং একটি দৃষ্টিনন্দন বৃহৎ টেনিস কোর্ট। লন টেনিস প্রেমীদের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে এই লন টেনিস কোর্ট। ক্রিসেন্ট টাউন সয়ংসম্পূর্ণ আরো নানা কারণে।
বহু তল ভবনের যে কোন বাসিন্দা ঘর থেকে বের হলেই পেয়ে যাবেন দন্ত চিকিৎসকের ক্লিনিক, জেনারেল ফিজিসিয়ানদের ক্লিনিক, ওষুধের দোকান, গ্রোসারি শপ এবং একটি ক্লাব যে ক্লাবে আছে নানা রকম ইনডোর গেমস-এর ব্যবস্থাসহ সুইমিং পুল, জিমনেশিয়াম, ডে কেয়ার সেন্টার, ইত্যাদি। বহুতল ভবনে বসবাসকারিদের জন্য ক্রিসেন্ট টাউন কমপ্লেক্সে আছে একটা বড় খোলা পেটিকো বা পোর্চ বা দেউড়ি যেখানে বসে বসে গল্প করার এবং শিশুদের দৌড়-ঝাপ, ছুটাছুটি করার সুযােগ বিদ্যমান। ক্রিসেন্ট টাউনে আছে শিশুদের জন্য একটা স্কুল- ক্রিসেন্ট টাউন এলিমেন্টারী স্কুল। এই স্কুলের যাত্রা শুরু ১৯৭৩ সনে এবং এটি টরন্টো ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বাের্ডের সাথে কার্যকরী ভাবে সম্বন্ধযুক্ত। এখানে শিশুরা জুনিয়র কিন্ডারগার্টেন থেকে ফিফথ গ্রেড পর্যন্ত পড়তে পারে। কিফার সুদারল্যান্ড (যার প্রকৃত নাম কিফার উইলিয়াম ফ্রেডেরিক ডেম্পসি জর্জ রুফাস সুদারল্যান্ড) একজন বিশ্বখ্যাত কানাডিয়ান তারকা অভিনেতা। হলিউডের বরপুত্র এই অভিনেতা বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন এই শতাব্দির প্রথম এক দশক আমেরিকার বিখ্যাত ফক্স ড্রামা টিভি সিরিজ ২৪ এ অভিনয় করে। কিফার সুদারল্যান্ড তার অসাধারন অভিনয় প্রতিভার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন এই টিভি ড্রামা ২৪ – এ অভিনয় করে। সে জন্য তিনি পেয়েছিলেন এমি এওয়ার্ড, গােল্ডেন গ্লোব এওয়ার্ড সহ নানা রকম প্রেস্টিজিয়াস এওয়ার্ড। কিফার সুদারল্যান্ড গায়ক হিসেবেও কম খ্যাত নন। তাছাড়া ছবির প্রযােজক পরিচালক হিসেবেও তার যথেষ্ট পরিচিতি আছে। উল্লেখ্য, এই জগৎবিখ্যাত অভিনেতার শৈশবের একটা সময় কেটেছে এই ক্রিসেন্ট টাউনে। সে সময় তিনি ছাত্র ছিলেন ক্রিসেন্ট টাউন এলিমেন্টারি স্কুলের। ক্রিসেন্ট টাউন ক্লাবে আছে ওল্ডার এডাল্ট এবং শারীরিকভাবে ডিজএবলদের জন্য স্বতন্ত্র একটি ক্লাবহারমনি হল সেন্টার ফর সিনিয়রস যা শুধু হারমনি হল নামে সবার কাছে পরিচিত। হারমনি হল সেন্টার ফর সিনিয়রস প্রকৃতপক্ষে সাউথ রিভারডেল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারের একটি প্রােগ্রাম। এই প্রােগ্রামের উদ্দেশ্য হলাে এর ওল্ডার এডাল্ট সদস্যা সদস্যদের শারীরিক মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখার সুযােগ বাতলে। দেয়া। সে লক্ষে হারমনি হল পরিচালনা করে নানা রকম কার্যক্রম যেমন, যােগ ব্যায়াম, টাই চি, জেন্ট্যাল ফিটনেস, ওয়াকিং, সােসাল ডাইনিং, সিঙিং সহ বিভিন্ন রকম বিনােদন মূলক কার্যক্রম। মানসিক শারীরিক হেলথ সম্মন্ধে বিস্তারিত জানার বুঝার উদ্দেশ্যে হারমনি হল সারা বছর স্বাস্থ বিষয়ক নানা প্রােগ্রাম করে থাকে। এছাড়া হারমনি হলের কার্য পরিধির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে শিক্ষামুলক কিছু কার্যক্রম যেমন, ভাষা, কম্পিউটার, রান্না শিক্ষা। হাউজিং, ইমিগ্র্যাশন, পেনশন বিষয়েও হারমনি হল সহায়তা প্রদান করে থাকে। বর্তমানে নাজলি সুলতানা আছেন হারমনি হল প্রােগ্রামের প্রধান হিসেবে। নাজলি সুলতানার কর্মদক্ষতা, কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও নিষ্ঠাপরায়নতা, হলের সদস্য সদস্যাদের প্রতি নাজলি সুলতানার ভালােবাসা হারমনি হলকে রেখেছে গতিশীল, প্রানবন্ত, এবং ফলপ্রসু।

ক্রিসেন্ট টাউন ক্লাবে প্রবেশ করে রিসেপশন ডেস্ক অতিক্রম করার আগে দাঁড়ালে চোখে পড়বে হাতের বাঁ পাশে একটা ছােট কক্ষে একটা অফিস। সে অফিসে বসেন “দি নেইবারহুড অর্গানাইজেশন’- এর । সেটেলমেন্ট কাউন্সেলর নিভাঁজ ব্যক্তিত্বসম্পন্না ভদ্র মহিলা ইয়াসমিন আশরাফ। অফিস কক্ষটি ছােট হলেও তার কার্যপরিধি অনেক বড়। নানারকম কার্যের সাথে তিনি ব্যাপক ভাবে সম্পৃক্ত। নানা রকম কাজ নিয়ে তিনি প্রতিদিন ব্যস্ত সময় কাটান। বিভিন্ন দেশ থেকে কানাডায় নবাগতদের নানামুখি সমস্যা সমাধানে সহায়তা প্রদান করাই তার অন্যতম প্রধান কাজ। আমি নিজেও ক্রিসেন্ট টাউনে উঠে প্রথমে গিয়েছি তার কাছে। তার নথিভুক্ত সেবাগ্রহনকারীদের তালিকায় আমার নামও অন্তর্ভুক্ত আছে। তাকে সেই যে সেদিন আপা ডেকেছি আজও আমি আপা বলেই সম্বােধন করি। আপা সহায়তা প্রদান করেন সিটিজেনশিপ, সােসাল ইস্যুরেন্স, হেলথ কার্ড, চাইল্ড ট্যাক্স বেনিফিট, অন্টারিও ওয়ার্কস, ইত্যাদির জন্য আবেদন করতে। তিনি পি-আর কার্ড নবায়নেও সহায়তা করে থাকেন। আপা ‘অন্টারিও ডিজএবিলিটি সাপাের্ট প্রােগ্রাম’ বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহায়তা প্রদান করেন। তিনি এডুকেশন ডকুমেন্টসও প্রত্যায়ন করে থাকেন। সমস্যা হলেই সবাই ছুটে যান তার অফিসে। আপনজনদের দেশে ফেলে রেখে আসা কানাডায় নবাগতদের যারাই তার কাছে যান সবাইকে আপা হাসি মুখে হৃষ্ট চিত্তে তার মেধা, দক্ষতা, আন্তরিকতা দিয়ে আপন জনের মত সেবা প্রদান করে থাকেন। কত জনের কত কথা কত কাহিনি আপা শােনেন! আপা কিছুই ভুলেন না। ভুলেননা বলেই বাসায় অবসরে বসে সেসব নিয়ে আপা মাঝে মাঝে লেখেন ছােট গল্প। ঝর ঝরে শব্দে বাক্যে রচিত সে সব ছােট গল্প ছাপা হয় পাঠক নন্দিত পত্রিকা বাংলা কাগজ’-এ। ফলে তিনি অন্য কাউন্সেলরদের থেকে আলাদা। তার আছে কাউন্সেলর হিসেবে কর্মসত্তার পাশাপাশি ছােট গল্প লেখিকা হিসেবে একটা লেখিকা সত্তা। দুটোতেই তিনি অনবদ্য। ক্রিসেন্ট টাউনে বসবাস করে বিভিন্ন দেশের ইমিগ্র্যান্ট। তম্মধ্যে বাংলাদেশী ইমিগ্র্যান্টরা সংখ্যায় অনেক। বাংলাদেশীদের পাশাপাশি আছে প্রচুর ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানী, নেপালি এবং শ্রীলংকান ইমিগ্র্যান্ট। আরাে বাস করে আফ্রিকান বিশেষ করে ইথিওপিয়া, সােমালিয়া, নাইজেরিয়া, কেনিয়া , উগান্ডা থেকে আগত ইমিগ্র্যান্টবৃন্দ। ইদানিং থাকতে শুরু করেছে মধ্যপ্রাচ্য,বিশেষ করে সিরিয়ান এবং মেডিটেরানিয়ান অঞ্চলের দেশ তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, মিশর, মরক্কো প্রভৃতি দেশের ইমিগ্র্যান্টবৃন্দ। কবে কখন কোন বাংলাদেশীর পা প্রথম পড়েছিল এই ক্রিসেন্ট টাউনে তা আমি জানি না। তবে এখন দেখি নতুন আসা বাংলাদেশীদের। যারা টরন্টোতে কোন আত্মিয়-স্বজনদের বাসায় উঠবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন বা উঠার তেমন কোন সুযােগ নাই তাদের অনেকের থাকার জন্য স্থান হিসেবে প্রথম পছন্দ ক্রিসেন্ট টাউন। ফলে ক্রিসেন্ট টাউনে দেখা মেলে বাংলাদেশী প্রফেসর, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, ঠিকাদার, ব্যাংকার, এরকম নানা পেশার মানুষের। ক্রিসেন্ট টাউনের প্রতি বাংলাদেশীদের এই টানের পেছনে আরও কারণ আছে। ক্রিসেন্ট টাউনের দক্ষিণ পাশে যে ডেন্টোনিয়া পার্ক আছে তার পুর্ব পাশ দিয়ে ক্রিসেন্ট টাউন থেকে সােজা দক্ষিণ দিকে একটা রাস্তা চলে গেছে। সে রাস্তা গিয়ে মিশেছে ড্যানফোর্থ রােডের সাথে। ক্রিসেন্ট টাউন থেকে এই পথ ধরে হাঁটলে। ড্যানফোর্থ রােডে পৌঁছতে সময় লাগবে ৫ থেকে ৭ মিনিট। সেখানে গিয়ে হাতের ডানে বাঁয়ে তাকালে দেখা যাবে বাংলা সাইন বাের্ড, বাঙালীদের দোকানপাট আর বাঙালী। আছে সেখানে বাঙালীদের গ্রোসারি, হােটেল-রেষ্টুরেন্ট, শাড়ী-কাপড়ের, ওষুধের , ফার্নিচারের দোকান। আছে বাঙালীদের সেলুন, ব্যবসা বানিজ্যের ছােট বড় অফিস। এ সমস্ত গ্রোসারিতে পাওয়া যায় ঢাকার গ্রোসারিতে যা যা পাওয়া যায় তার সবই। এখানে আছে ‘বাংলা কাগজ সহ আরও কয়েকটি পত্রিকার প্রধান ব্যুরাে। ড্যানফোর্থ এভিনিউর এই বাঙালী অধ্যুষিত এলাকায় আছে দুইটি মসজিদ। মসজিদ দুইটির একটির অবস্থান মােটামুটি আরেকটির কাছেই। একটি ড্যানফোর্থ এভিনিউ আর ভিক্টোরিয়া পার্ক এভিনিউর ইন্টারসেকশনের পুর্ব পাশে অন্যটির অবস্থান পশ্চিম পাশে। পুর্ব দিকের বাইতুল আমান মসজিদ পার হয়ে আরাে এক কিলােমিটার পুর্ব দিকে গেলে পাওয়া যাবে আরেকটি মসজিদ- বাইতুল মােকাররম মসজিদ। এটি অপর দুটি মসজিদ থেকে আলাদা। এটি আগে ছিল একটি গির্জা- খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়। গির্জা কর্তৃপক্ষ এটি মুসলিমদের কাছে। বিক্রি করে দেয়। মুসলিম অর্গানাইজেশন গির্জাটি ক্রয় করে এবং গির্জাটিকে মসজিদে রুপান্তরিত করে। বাইতুল মােকাররম মসজিদটি খুব সুন্দর। বাংলাদেশীদের মধ্যে যারা ভাবপ্রবন মনের মানুষ তারা ড্যানফোর্থ এভিনিউর এই অংশে এসে হেঁটে একটা অব্যক্ত আনন্দ অনুভব করেন এই ভেবে যে তারা ঢাকায় আছেন, দেশ ছেড়ে আসেন নি। বাংলাদেশী ইমিগ্র্যান্টদের মধ্যে যারা প্রথমে এসে ক্রিসেন্ট টাউনে উঠেন অন্য সকল ইমিগ্র্যান্টদের মত তারাও এসে নেমে পড়েন কাজের সন্ধানে। কাজের সংস্থান যদি দুরে কোথাও হয়ে যায়। বা তারা যদি কোথাও একটা বাসস্থান ক্রয় করতে পারেন বা যখন দেখেন দুরে স্কুল হওয়ার কারণে সন্তানদের স্কুলিং-এ অসুবিধা হচ্ছে (উল্লেখ্য, ক্রিসেন্ট টাউন স্কুলে এডুক্যাশনের সুযােগ ফিফথ গ্রেড পর্যন্ত) তাহলে তারা ক্রিসেন্ট টাউন ছেড়ে চলে যান। ফলে দেখা যায় ক্রিসেন্ট টাউনে চলছে সারা বছর গ্রহনবর্জন, ভাঙ্গা-গড়া, আর আসা-যাওয়ার একটা খেলা।