ফরিদ আহমেদ : সিনেমার শুটিং চলছিলো সাত নম্বর ফ্লোরে। ট্রেনের একটা ডামি তৈরি করা হয়েছে। একটা কামরায় শুধু নায়ক য়ার নায়িকা উপস্থিত। এমন নির্জন কামরা দু’জনের প্রেম করার কথা। তবে, প্রেম নয়, তীব্র ঝগড়া শুরু হয় তাদের মধ্যে। নায়ক প্রেম করতেই গিয়েছিলো। নায়িকাকে টেনে বুকের মধ্যে এনেছিলো। সমস্যাটা বাঁধে সেখানেই। নায়কের কাপড়ে মেয়েলি সেন্টের গন্ধ পায় নায়িকা। অন্য রমণী গমনের সন্দেহে মৌখিক আক্রমণ শুরু করে সে। নায়কও পাল্টা জবাব দেয় তাকে সন্দেহবাতিক বলে। তুমুল বাদানুবাদ চলতে থাকে দু’জনের মাঝে। নায়িকা অবনির কড়া কড়া কটুবাক্য সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে গিয়ে নায়ক সাদমান চৌধুরী মেজাজ হারিয়ে ফেলে। গায়ে হাত তুলতে যায় সে অবনির। অবনিও কম যায় না। তেজ তারও আছে। এর পাল্টা হিসাবে সে নায়কের গায়ে হাত তোলে। নায়ক এবার প্রচণ্ড রেগে গিয়ে পিস্তল বের করে তার মাথায় ধরে। বাড়াবাড়ি করলে মেরে ফেলবে বলে ঠাণ্ডা গলায় হুমকি দেয় সে। এই পর্যায়ে গিয়ে নায়িকার চুপ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু, আগেই বলেছি নায়িকা অবনিরও তেজ কম না। হুট করে নায়কের হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নিয়ে উল্টো নায়কের বুকে চেপে ধরে সে। চেপে ধরেই ক্ষান্ত হয় না। আচমকাই ট্রিগার টিপে দেয় সে। নায়কের বুকে রক্তের লাল দাগ দেখা যায়। বুক চেপে ধরে নায়ক ধীরে ধীরে পড়ে যায় ট্রেনের মেঝেতে।

এই পর্যায়ে গিয়ে পরিচালকের কাট শব্দ শোনা যায়। এই দৃশ্যের শুটিং শেষ। দুর্দান্ত একটা অভিনয় করেছে, এটা ভেবে গর্বিত নায়িকা নেমে যায় শুটিং এর জন্য বানানো ডামি ট্রেন থেকে। সবাই তালি দিয়ে তাকে অভিনন্দিত করতে থাকে। চারিপাশ থেকে কলাকুশলীদের প্রশংসা বাক্য ভেসে আসতে থাকে।

একটা সিনেমার শুটিং এ এটা একটা স্বাভাবিক দৃশ্য। দৃশ্য ভালো হলে সবাই হর্ষধ্বণি দেয়, তালি দেয়, উৎসাহব্যাঞ্জক কথাবার্তা বলে। এগুলো শিল্পীদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করে। এখানেই তাই হচ্ছিলো। স্বাভাবিক সব কর্মকাণ্ড চলছিলো দৃশ্যটার টেক হবার পরে। তবে, এই স্বাভাবিক দৃশ্যটা আর আর স্বাভাবিক থাকে না। খুব দ্রুতই আবিষ্কৃত হয় যে নায়ক আসলে সত্যি সত্যিই নায়িকার গুলিতে মারা গিয়েছে। সেটের সবাই আতংকিত হয়ে পড়ে এই অদ্ভুত ঘটনায়।

এই রকম একটা দারুণ সূচনা দিয়ে শুরু হয়েছে রায়হান রাফির চলচ্চিত্র ‘৭ নাম্বার ফ্লোর’। এফডিসির সাত নম্বর ফ্লোরে একটা চলচ্চিত্রের শুটিংকে ঘিরে সাজানো হয়েছে এর চিত্রনাট্য। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সিনেমার ক্ষেত্রে এটা একটা ব্যতিক্রমী গল্প।

সিনেমার শুটিং এর সময়ে যে সমস্ত অস্ত্র ব্যবহার করা হয়, সেগুলো সব খেলনা অস্ত্র হয়ে থাকে। নায়িকা অবনি যে পিস্তল দিয়ে নায়ককে গুলি করেছে, সেটাতে গুলি থাকার কথা না। অথচ সেই পিস্তল দিয়েই গুলি বের হয়েছে এবং একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মারা গিয়েছে। এর মানে হচ্ছে কেউ একজন খেলনা পিস্তলকে সরিয়ে আসল পিস্তল রেখে দিয়েছে। কেউ একজন চেয়েছে নায়ক সাদমান চৌধুরী খুন হোক।

মিথ্যা পিস্তল বদলে সেখানে সত্য পিস্তল কে রাখলো, এই রহস্যকে উন্মোচনের প্রক্রিয়া দিয়ে রায়হান রাফি দর্শককে নিয়ে যান তাঁর সিনেমার মাঝে। রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয় একজন আনপ্রেডিক্টেবল মেজাজের পুলিশ অফিসারের। মেজাজে তিনি আনপ্রেডিক্টেবল, তবে কাজে একেবারে পাকা। অসম্ভব বুদ্ধিমান একজন মানুষ তিনি। অপ্রচলিত ধারায় রহস্যের সমাধান করেন তিনি। তাঁর আনপ্রেডিক্টেবল আচরণের কারণে তিনি কখন কী করবেন, কখন কাকে ধরে মার লাগাবেন, কোন সময়ে একেবারে কাদার মতো নরম হয়ে থাকবেন, সেটা বোঝা মুশকিল। এর উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, অসম্ভব সুন্দরী নায়িকা অবনির গালে ঠাস করে চড় লাগিয়ে দিয়ে পরের মুহূর্তেই তিনি তাঁকে মিষ্টি সুরে বলতে পারেন, ‘আপনিতো অসম্ভব সুন্দরী, আমি আপনার ফ্যান।’

তো, এই পুলিশ অফিসারের মাধ্যমেই রহসের পর্দা সরতে থাকে। পর্দাতো সরা না, প্রতি ক্ষণে ক্ষণে গল্পে জন্ম নিতে থাকে নতুন নতুন মোচড়ের। এর সাথে দৃশ্যপটে আসতে শুরু করে নায়ক নায়িকার অতীত জীবন। এদের অতীতের সাথে সাথে যোগ দেয় ওই সিনেমার দ্বিতীয় নায়িকা পাখি এবং একজন প্রচুর পয়সাওয়ালা মাস্তান ধরনের মাতাল প্রযোজকের। এই প্রযোজক তার নিজের কাজ করানোর জন্য অস্ত্রের ব্যবহার করতেও দ্বিধাবোধ করে না । সিনেমা জগতের অনেক মানুষের অন্ধকার অতীত, লোভ, লালসা, ধোঁকাবাজি, উপরের ওঠার অদম্য আগ্রহ, এবং সেটা করার জন্য যে কোনো ধরনের আপোষ কিংবা ষড়যন্ত্র করা, এর সবকিছু একীভূত হয়ে এক বিন্দুতে এসে মিলে যায় রায়হান রাফির চলচ্চিত্রে।
‘৭ নাম্বার ফ্লোর’ সিনেমার মাধ্যমে অনেকদিন পর একটা গতিশীল এবং আকর্ষণীয় থ্রিলার দেখা হলো আমার। এই সিনেমাটার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর চিত্রনাট্যের গতি। প্রথম দৃশ্য থেকেই এটা আপনাকে আগ্রহী এবং কৌতূহলী করে তুলবে চলচ্চিত্রটা দেখার জন্য। সেই আগ্রহ থেকে আপনি মুক্তি পাবেন না সিনেমা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। আপনার কৌতূহলেরও পূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটবে না শেষ দৃশ্যের আগ পর্যন্ত। এটাই ছবির প্রাণ।

এর সাথে রয়েছে চলচ্চিত্রের পাত্র-পাত্রীদের দুর্দান্ত অভিনয়। নতুন অভিনেতা রাজ মানিয়া সাবলীল অভিনয় করেছেন।

তমা মির্জা এবং সুমন আনোয়ারও দারুণ ছিলেন নিজ নিজ চরিত্রে। পুলিশ অফিসারের চরিত্রে এসে অনেকদিন পরে শাহরিয়ার নাজিম জয়ও চমৎকার করেছেন। জয়কে অনেক দিন পরে চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে দেখলাম। তবে, এরা কেউ নয়, এই ছবিতে সেরা অভিনয়টা করেছেন নায়িকা অবনির চরিত্রে শবনম বুবলি। এটা আমার দেখা বুবলির দ্বিতীয় কাজ। এর আগে ‘টান’ ছবিটা দেখেছিলাম। সেই ছবিতে নায়ক সিয়ামের বিপরীতে নায়িকা হয়েছিলেন তিনি। একজন সংগ্রামী নারীর চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন সেখানে তিনি। মজার বিষয় হচ্ছে, সেই চরিত্রটার নামও ছিলো অবনি। এই দু’টো চলচ্চিত্রে বুবলির অভিনয় দেখে ‘৭ নাম্বার ফ্লোর’ সিনেমার পুলিশ অফিসারের মতো আমিও তাঁর ফ্যান হয়ে গিয়েছি। তাঁর শুধু সৌন্দর্যই নেই, একই সাথে দারুণ বুদ্ধিমত্তাও রয়েছে।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে হঠাৎ করেই দখিনা হাওয়া বইছে। চমৎকার, চমৎকার সব চলচ্চিত্র এবং ওয়েব সিরিজ তৈরি হচ্ছে। আমরা এক সময় চলচ্চিত্র জগত নিয়ে হতাশই হয়ে গিয়েছিলাম। সেই হতাশার মেঘ এখন কেটে যাওয়া শুরু হয়েছে। কিছু তরুণ পরিচালকের হাত ধরে সাবালক হবার পথে যাত্রা শুরু করেছে বাংলা চলচ্চিত্র। নিত্যই তাঁরা নতুন ধরনের গল্প নিয়ে আসছেন। অভিনব সব চলচ্চিত্র তৈরি করছেন। এইসব চলচ্চিত্রের শুধু গল্পই নতুন নয়, একই সাথে কারিগরি দিক থেকেও উন্নত হচ্ছে। আগেকার সেই পানসে একঘেঁয়েমির যুগের অবসান হতে চলেছে।

শুরু হয়েছে নতুন এক সম্ভাবনার। ‘৭ নাম্বার ফ্লোর’ তারই একটা ধারাবাহিকতা মাত্র।