অনলাইন ডেস্ক : প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি কিছুটা কমেছে গত দু’দিনে। তবে বন্যাদুর্গতদের কষ্ট একটুও কমেনি। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও উত্তরাঞ্চলে বানভাসিদের হাহাকার বেড়ে চলেছে। দুর্গম অঞ্চলে সরকারি ত্রাণ পৌঁছায়নি। ফলে অনেকের দিন কাটছে অনাহারে। উজানের পানি আরেক দফা বৃদ্ধির পূর্বাভাসের মধ্যে আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তায় কাটছে উত্তরাঞ্চলের মানুষের দিন। দারিদ্র্যপীড়িত এই অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও বিপর্যস্ত হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে, মধ্যাঞ্চলে বন্যার পানি অব্যাহতভাবে বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চল থেকে পানি এখনই সরে যাওয়ার আভাস মিলছে না। এসব জেলায় পরিস্থিতি উন্নতির খবর দিতে পারেনি বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জের জন্য একটু আশা দেখিয়েছে সংস্থাটি।
তবে দুর্গত এলাকাগুলোয় প্রায় ২৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে থাকার তথ্য দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। গত শনিবার ১৮টি জেলার ৯০টি উপজেলার ৫২৩ ইউনিয়নে পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ ৫১ হাজার ৮৪। ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ২৫ লাখ মানুষ। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে জরুরি ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৪১টি পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ৫৯টি পয়েন্টে কমেছে। শনিবার ১২টি জেলার ২২ পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছিল। অবশ্য প্রায় সব নদ-নদীর পানি নিম্নগামী।
এদিকে নদ-নদীর পানি কিছুটা কমলেও উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে দেখা দিয়েছে ব্যাপক নদীভাঙন। ভাঙনের তীব্রতায় চোখের সামনে মাথাগোঁজার ঠাঁই হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন নদীতীরের মানুষ। এতে দিশেহারা বানভাসি মানুষ।
প্রতিনিধিদের পাঠানে খবর-
মানিকগঞ্জ : পদ্মা-যমুনায় পানি বৃদ্ধির হার কমলেও জেলার চারটি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। পদ্মার পানি হরিরামপুর উপজেলার চত্বরে ঢুকে পড়েছে। পানির তোড়ে মানিকগঞ্জ-হরিরামপুর সড়কের কয়েকটি স্থানে সড়ক ভেঙে যাওয়ায় হরিরামপুরের সঙ্গে সড়কপথে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া শিবালয়, হরিরামপুর ও দৌলতপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ২০ হাজার মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, যমুনা নদীর পানি আরিচা পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মার পানিও বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে।
হরিরামপুর উপজেলা চেয়ারম্যান দেওয়ান সাইদুর রহমান জানান, উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের সবক’টিতে পানি ঢুকে পড়েছে। অধিকাংশ পরিবারই পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জেলা প্রশাসক এস এম ফেরদৌস জানান, পদ্মা ও যমুনায় পানি বাড়ায় চারটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
গাইবান্ধা ও ফুলছড়ি : গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর পানি শনিবারও বিপদসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। করতোয়া নদী তীরবর্তী এলাকা পলাশবাড়ি ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এদিকে দীর্ঘদিন পানিবন্দি থাকায় শুকনো খাবার, গবাদি পশুর খাদ্য সংকট, জ্বালানি, পয়ঃনিস্কাশন ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে বন্যা কবলিত এলাকার পরিবারগুলো দুর্ভোগ বাড়ছে। অন্যদিকে ফুলছড়ি উপজেলায় বন্যার পানি কিছুটা কমলেও বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ কমেনি।
নওগাঁ : নওগাঁয় ছোট যমুনা ও আত্রাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে হু হু করে পানি প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। এতে আত্রাই ও মান্দা উপজেলার আরও তিনটি ইউনিয়নের অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ পর্যন্ত ওই তিন উপজেলার শতাধিক গ্রাম এখন পানির নিচে।
শেরপুর : পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে যাওয়ায় শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শেরপুর সদর উপজেলার চরপক্ষীমারী ইউনিয়নের কুলুরচর বেপারীপাড়া, খাসপাড়া টাকীমারী, বাঘলদি, ডাকপাড়া, চুনিয়ারচরসহ ১২ গ্রাম, চরমোচারিয়া ইউনিয়নের হরিণধরা, চরভাবনা, মুন্সীরচর, নলবাইদ, ধাতিয়াপাড়াসহ ওই ইউনিয়নের ৯০ ভাগ, কামারেরচর ইউনিয়নের ৬ ও ৭নং চর, চরসাহাব্দী, বাঘেরচরসহ ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। কুলুরচর বেপারীপাড়া গ্রামে পানি ওঠায় ওই গ্রামের শতাধিক পরিবার পার্শ্ববর্তী জামালপুর শহর রক্ষা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। শনিবার দুপুরে হুইপ আতিউর রহমান আতিক বন্যাকবলিত বেপারীপাড়ায় যান। এ সময় তিনি তিন শতাধিক মানুষের হাতে খাবার তুলে দেন। গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) :গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া পয়েন্টে পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এরই মধ্যে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে গোয়ালন্দ উপজেলার দেবোগ্রাম ও দৌলতদিয়া ইউনিয়নের হাজার হাজার পরিবার। সরেজমিনে উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ছত্তার মেম্বারপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এই গ্রামের দুই শতাধিক পরিবারের প্রতিটি বাড়িই বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, গোয়ালন্দ উপজেলা এক হাজার ৫০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
সারিয়াকান্দি (বগুড়া) : সারিয়াকান্দিতে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। অন্যদিকে বাঙালী নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি উঠতে শুরু করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গতকাল শনিবার ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ১৩ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ১১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে যমুনার চরাঞ্চলে নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে একের পর এক গ্রাম, জনপদ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। উপজেলার চালুয়াবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শওকত আলী জানান, তার ইউনিয়নের ১০ গ্রামে যমুনার ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে।
নেত্রকোনা : নেত্রকোনার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, বারহাট্টা, খালিয়াজুরী, পূর্বধলা, মদনসহ বিভিন্ন উপজেলায় ১৮ দিন ধরে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ওই সব উপজেলার গ্রামীণ সড়ক পানিতে ডুবে গেছে। চারপাশে পানি থাকায় মানুষ বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না।
মাদারগঞ্জ (জামালপুর) : মাদারগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সড়কে পানি ওঠায় বন্ধ হয়ে গেছে মাদারগঞ্জ-তেঘড়িয়া, নব্বইচর-মাদারগঞ্জ সড়ক, কড়ুইচুড়া, আদারভিটা সড়কে যান চলাচল। এদিকে মাদারগঞ্জ উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে এ পর্যন্ত মারা গেছেন চারজন। এ ছাড়া বন্যার পানিতে বিদ্যুতের তারের স্পর্শে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি কমলেও ফের বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে পাউবোর। গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ সেন্টিমিটার কমে শনিবার জুলাই দুপুর ১২টায় সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার এবং কাজিপুরে ১০৩ সেন্টিমিটার ওপরে রয়েছে। পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী একেএম রফিকুল ইসলাম জানান, যমুনায় সামনের ক’দিন পানি কমার সম্ভাবনা থাকলেও ঈদের আগে তৃতীয় দফা ফের বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে, শুক্রবার সদর উপজেলার সয়দাবাদ, কালিয়া হরিপুর, খোকশাবাড়ি ও কাওয়াখোলা ইউনিয়নে ত্রাণ বিতরণ করেন সিরাজগঞ্জ-২ আসনের এমপি প্রফেসর ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না।
শিবচর (মাদারীপুর) : পদ্মায় পানি বৃদ্ধির ফলে শিবচরের কাঁঠালবাড়ী ফেরি ও লঞ্চ ঘাট তলিয়ে গেছে। পদ্মায় স্রোতের তীব্রতা থাকায় শুক্রবার থেকে বন্ধ রয়েছে ফেরি চলাচল। পানি বৃদ্ধির ফলে তলিয়ে গেছে ফেরিঘাটের পন্টুন ও ফেরিতে গাড়ি ওঠার পথ। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এদিকে পদ্মায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় উপজেলার সাত ইউনিয়নে নদীভাঙনের ব্যাপকতা বেড়েছে।
বেতাগী (বরগুনা) : বেতাগী উপজেলা বিষখালী নদীর ভাঙনে দিশেহারা নদীর তীরের মানুষ। বেতাগী সদর ইউপির সাবেক সদস্য আব্দুস সোবাহান জানান, বিষখালী নদীর ভাঙনে ঝোপখালী, উত্তর বেতাগী, ঝিলবুনিয়া, কেওড়াবুনিয়া, মোকামিয়া, কালিকাবাড়ি, বদনীখালী, কাইয়ালঘাটা, আলিয়াবাদ এলাকা বিলীনের উপক্রম হয়েছে।
বাঞ্ছারামপুর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) : বাঞ্ছারামপুরের ‘ভুলতা-আড়াইহাজার-বাঞ্ছারামপুর সড়কের কড়িকান্দি-বিশনন্দি ফেরিঘাটের বাঞ্ছারামপুর অংশের কড়িকান্দি ফেড়িঘাটের সংযোগ সড়ক বর্ষার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে ফেরি পারাপার হচ্ছে যানবাহন ও যাত্রীরা। পাঁচ দিন ধরে চলছে এ অবস্থা।
সড়ক ও জনপথের নারায়ণগঞ্জ বিভাগীয় অফিসের উপসহকারী প্রকৌশলী কাফি হোসেন জানান, ক্রেন চালক গত শুক্রবার ছুটিতে যাওয়ায় কাজ শুরু করতে পারিনি। রোববার কাজ করতে পারব বলে আশা করছি।