অনলাইন ডেস্ক : করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে দেশে প্রতিদিন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর থেকে কাজ হারানো মানুষ গ্রামের দিকে ছুটছে। প্রবাসী যাঁরা দেশে ফিরে এসেছেন, তাঁরাও এখন বেকার। করোনা মোকাবেলায় এক লাখ তিন হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হলেও ব্যাংকগুলোর অনীহায় টাকা ছাড় নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা। দিন যত যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাপ তত বাড়ছে।
এমন বাস্তবতায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে রাস্তা প্রশস্তকরণ, সেতু ও কালভার্ট তৈরি, রাস্তার পাশে গাছ লাগানো কর্মসূচির বিভাগভিত্তিক আটটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। আটটি বিভাগের জন্য তিন হাজার কোটি টাকা করে এসব প্রকল্পে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এসব প্রকল্প অনুমোদন নিয়ে দোলাচল তৈরি হয়েছে।
কমিশনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার এ সময় তাঁদের মনোযোগ স্বাস্থ্য খাতের দিকে। সরকারের অগ্রাধিকারও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের দিকে। করোনার কারণে সরকারের রাজস্ব আদায় আগের মতো নেই। রাজস্ব আদায়ের হার কমে যাওয়ায় তাঁদের চিন্তা হলো পুরনো প্রকল্পের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া। অর্থাৎ নতুন প্রকল্প না নিয়ে যেসব প্রকল্পের কাজ চলমান, সেসব প্রকল্প দ্রুত শেষ করা। কারণ, নতুন প্রকল্প নিলেই সেখানে টাকা বরাদ্দ দিতে হবে।
জানা গেছে, প্রকল্পগুলো অনুমোদনের জন্য প্রায় তিন মাস আগে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এসব প্রকল্প দ্রুত অনুমোদনের জন্য কমিশনকে অনুরোধ করেছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার ৫০ লাখ প্রান্তিক মানুষকে আড়াই হাজার টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর বাইরে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় কিছু টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু এ টাকা দিয়ে কর্মসংস্থান হবে না। গ্রামের মানুষের কিছুদিনের চলার পথ হবে মাত্র। দীর্ঘমেয়াদি কোনো ব্যবস্থা হবে না। করোনা বাংলাদেশ থেকে কবে বিদায় নেবে তা কেউ বলতে পারে না। সে কারণে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থানের জন্য এসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর আওতায় কাজ পাবে নারী-পুরুষ সবাই। তাঁরা বলছেন, অনুমোদন দিলে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এসব প্রকল্পের কাজ চলবে।
স্থানীয় সরকার সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘করোনার প্রভাবে অনেকে চাকরি হারিয়েছে। অনেকে গ্রামে চলে গেছে। করোনার প্রভাব মোকাবেলায় গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে আমরা বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছি। প্রকল্পগুলো অনুমোদন পেলে সেখানে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের টাকার কোনো সমস্যা হবে না। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাসহ (জাইকা) বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা আমাদের ঋণ দিচ্ছে।’
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পাঠানো প্রকল্পগুলো নিয়ে বৈঠক করেছে কমিশন। কিন্তু এখনো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাঠানো হয়নি।
জানা গেছে, গত ৬ জুলাই চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) প্রথম একনেক সভায় যে ৯টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তার পাঁচটি ছিল পুরনো। আর চারটি নতুন প্রকল্প।
অবশ্য কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারপ্রধান যদি মনে করেন গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে কর্মসংস্থান তৈরির জন্য প্রকল্পগুলো অনুমোদন দেওয়া দরকার, পরিকল্পনা কমিশন সেই অনুযায়ী কাজ করবে।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের (পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ) সচিব জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, ‘কভিড-১৯ মোকাবেলায় আমাদের মূল মনোযোগ এখন স্বাস্থ্য খাত ঘিরে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, সবাই যেভাবে গ্রামমুখী হচ্ছে, সেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাও জরুরি। কারণ, ত্রাণ দিয়ে বেশি দিন চলা যায় না। কেন্দ্র থেকে গ্রামে টাকার প্রবাহ বাড়াতে হলে এ ধরনের গ্রামীণ সড়ক প্রশস্তকরণ, উন্নয়নসংক্রান্ত প্রকল্প জরুরি। তা ছাড়া এসব প্রকল্পের কাজ হলে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাও সহজ হবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সামনে বিষয়টি তুলে ধরব।’
রাস্তা প্রশস্ত করা হবে নতুন নকশা অনুযায়ী : স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, আটটি বিভাগে যেসব গ্রামীণ সড়ক প্রশস্ত করা হবে সেটা নতুন নকশা অনুযায়ী করা হবে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এত দিন গ্রাম পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১০ ফুট চওড়া রাস্তা নির্মাণ করতে পারত। ইউনিয়ন পর্যায়ে পারত ১২ ফুট চওড়া। আর উপজেলা পর্যায়ে সড়কগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল ১৮ ফুট চওড়ার মধ্যে। নতুন অনুমোদিত নকশায় গ্রাম পর্যায়ে এখন সড়ক হবে সর্বনিম্ন ১২ ফুট চওড়া। যানবাহনের সংখ্যা ও চাপের ওপর নির্ভর করে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে সড়ক হবে ১৮, ২০, ২২, ২৪ ও ৩৬ ফুট চওড়া। অর্থাৎ চার লেন পর্যন্ত সড়কও করতে পারবে এলজিইডি, যেটা এখন শুধু সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর করতে পারে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এক কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করতে গেলে অন্তত ৪০ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়। তা ছাড়া রাস্তার দুই ধারে গাছ লাগাতে নারীদের ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়। গ্রামীণ রাস্তাঘাট নির্মাণ হলে বালু, রড, সিমেন্টের প্রয়োজন হয়। বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এতে টাকার হাতবদল হয়। অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়। এলজিইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী মীর তানভীর হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে দ্রুত নগরায়ণ ঘটছে। অনেক গ্রাম ও ইউনিয়নে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। গ্রামে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে। কিন্তু গ্রামীণ রাস্তাগুলো ১০ ফুটেই রয়ে গেছে। সে কারণে নকশা পরিবর্তন করে গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে সড়ক প্রশস্ত করা হচ্ছে।