ইউসুফ কামাল : সাত.
’৭৫ এর আগষ্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক চরম অনাকাংখিত অধ্যায়। আগের দিনে আমাদের ডিপার্টমেন্টের চেয়্যারম্যান ড: রওশন আলীর রুমে একটা মিটিং ছিলো। বের হয়ে সাফায়েত ভাই বল্লো, চলো খেয়ে আসি বিদ্যুৎ কে ডাকো। তিনজন মোটর সাইকেল নিয়ে চলে এলাম বলাকার বাংচিন রেষ্টুরেন্টে। মনে আছে তখন বাংচিন এর গেটে একটা বেটে মতো মানুষ দাঁড়িয়ে সবাইকে হাসিমুখে সালাম দিতো। যে যা পারে বখশিস্ দিতো। সবাই তাকে চিনতো।
খেয়ে বেরোতেই দেখি পড়ন্ত বিকেল, আগষ্টের প্রখর গরম গায়ে লাগিয়ে তিনজন চলে এলাম টিএসসি’তে। সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাজ সাজ অবস্থা, পরদিন বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। চ্যান্সেলারকে বরণ করতে সারা ক্যাম্পাস পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে অবস্থা। শেষ মূহূর্তের ফিনিশিং টাচ চলছে। ঘুরে ঘুরে সব দেখছি। টিএসসি’র অডিটোরিয়ামে লাইট-মাইকের পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। কোথাও কোন অসম্পূর্ণতা আছে কিনা সবাই সেই পরীক্ষায় ব্যাস্ত। এখানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন।
রাত ন’টার দিকে দেখলাম শেখ কামাল, ইসমত কাদির গামাসহ কয়েকজন অডিটোরিয়ামের ভিতরে বসে কথাবার্তা বলছে। সার্বিকভাবে নিরাপত্তা জনিত কোনো সমস্যা আছে কিনা এটা নিয়েই আলোচনা চলছিলো।
ডিপার্টমেন্টের নির্বাচন নিয়ে তার সাথে একটা ভূল বোঝাবুঝির পর থেকে তার সাথে আমার একটা মৌখিক পরিচয় হয়ে গিয়েছিলো। দেখা হলেই একটা মৃদু হাসি বিনিময় হতো। কে জানতো এই দেখাই তার সাথে আমার শেষ দেখা হবে।
সাফায়েত চলে গেলো। বল্লো বাসায় যাও সকাল সকাল চলে এসো। সকালেই আসতে হবে ডিপার্টমেন্টে, বিদ্যুৎ কে বল্লাম চলো আমার ওখানে। এত রাতে বাসাবো যাওয়ার দরকার নাই। পপুলারে খেয়ে দুজনে ক্লান্ত শরীরে মনে হয় এগারোটার দিকেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
একটু সকালের দিকেই ঘুম ভেংগে গেল। সকালে রেডিও শোনার অভ্যাস। আমার তিন ব্রান্ডের একটা ফিলিপ্স রেডিও ছিল। সব সময় হাতের কাছেই থাকতো। হাত বাড়িয়ে সুইচ অন করলাম।
কন্ঠস্বরে চমকে উঠলাম, মেজর ডালিম বলছি … লাফ দিয়ে উঠলাম। বিদ্যুৎকে ধাক্কা দিলাম। আচমকা ধাক্কায় সেও হতভম্ব। কি হয়ে গেলো। মহল্লা কেমন যেন নিরব নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে। কেউ রাস্তায় নেই, কোথায় গেলো সবাই। রাস্তায় রিক্সার কোনো টুং টাং শব্দও নাই। কিছুক্ষণ রেডিও ধরে বসে রইলাম। বার বার সেই একই ঘোষণা …
সকাল সাড়ে ন’টার দিকে বাসা থেকে বিদ্যুৎকে নিয়ে বের হলাম। রাস্তায় লোকজন নেই যাও আছে সবাই আতংকগ্রস্ত। পপুলারে এলাম। দুই চারজন লোক নাস্তা করছে। নাস্তা করে ভাবলাম কলাভবনের দিকে যাই দেখি চারিদিকে কি অবস্থা। বদরুন্নেসা গার্লস কলেজ পার হয়ে সোজা দুজন হাঁটা ধরলাম। বদরুন্নেসা কলেজের পাশেই সুলতানা কামালের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী দবিরউদ্দিন সাহেবের সরকারি বাসভবন। কেমন যেন জনমানবশূন্য।
একটু সামনে বুয়েটের মাঠের উল্টো দিকে মেডিকেল কলেজে ঢোকার একটা ছোট্ট পথ, বেশ কিছু লোক ওখান থেকে বেরুচ্ছে আর চাপা স্বরে কি যেন বলছে। কৌতুহল নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম।
ডানদিকে মেডিকেল কলেজের পুরনো মর্গ। রাস্তার দিকে ছোট একটা ভাংগা ভেন্টিল্টর। বাইরে থেকে ৩/৪টা ইট দিয়ে উঁচু করে সিড়ি মত বানিয়ে কেউ হয়তো দেখে গেছে। একটু উঁচু হয়ে ভিতরে তাকাতেই থমকে গেলাম, ১৪/১৫ জন মানুষের মৃতদেহ স্তুপ করে রাখা। কিছু পোষাক পরা পুলিশের মৃত দেহ, কয়েকজনকে চিনলাম না, দুইজন মানুষকে দেখে চমকে উঠলাম।
ক্লীন সেভ গায়ে সাদা শ্যান্ডো গেন্জী নীচে একটা প্লেকার্ড লুংগী পড়া চিৎ হয়ে পড়ে আছেন শেখ মনি আর একটু দূরেই তার সহধর্মিনী শেখ আরজুমান্দ বানু মনির লাশ। আশে পাশে আরো অনেকে, সবাইকে চিনলাম না। বের হয়ে আসলাম। মনটা ভারী হয়ে গেলো। বুঝলাম ৩২ নং এর মৃতদেহগুলো বাদে সবগুলোই এখানে স্তুপ করে রেখে গেছে। একি নৃসংশতায় উন্মত্ত পৃথিবী। এর শেষ কোথায়?
ওখান থেকে বের হয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম সোজা। শহীদ মিনার ডানে রেখে সোজা কলাভবনের দিকে। দুজনের কারো মুখেই কথা নেই। কি বলবো। নির্জন প্রায় রাস্তা। বামে জগন্নাথ হলের মাঠ পেরিয়ে এগোলাম।
একটু সামনেই বামে শামসুন্নাহার হল। দোতলা তিন তলার বারান্দায় কৌতুহলী ছাত্রীরা দাঁড়িয়ে আছে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে। বিদ্যুৎ এর ধাক্কায় ওর দিকে তাকালাম, বল্লো কে যেন আমাদেরকে ডাকছে তিন তলা থেকে হাত ইশারায়। আমাদের কেই ডাকছে বুঝলাম। এগিয়ে গেলাম গেটের কাছে।
দ্রæতপায়ে তিনতলা থেকে নেমে এসেছে বুবুনি, আমাদের সহপাঠী রাজবাড়ীর। সম্ভবত সোশাল সায়েন্সে পড়ে। মেধাবী ছাত্রী। চোখেমুখে আতংক। কুশল বিনিময়। সাবধানে থাকতে বল্লাম। বল্লো বাড়ির কারো সাথে দেখা হলে যেন বলে দিই, ভালো আছে।
ভাবলাম শাহবাগের দিকে যাওয়া যায় কিনা। ডান দিকে তাকালাম টিএসসি’র দিকে। পথে ভীত সন্ত্রস্ত দু’একজন মানুষ। যাও আছে তারাও দ্রæত পায়ে যার যার গন্তব্যের পানে।
ভাবলাম একটু পরেই যেখানে আনন্দ উৎসবে ভরপুর থাকার কথা সে খানে এখন খা খা শূন্যতা। সাজানো গেট, ফেস্টুন ব্যানারগুলো কেমন নিস্প্রাণ, নির্জীব মনে হচ্ছে। যেন মহাশক্তিধর কোনো টর্ণেডোর আঘাত ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে গেছে মানব সভ্যতার সুন্দর সাজানো পৃথিবীটাকে। এ ভয়ংকর জিঘাংসা কি কোনো দিনই শেষ হবে না। ডান হাতটা ধরে কে যেন টান দিলো, দেখি বিদ্যুৎ থামতে বলছে আস্তে করে। ভয়ে কথা বলতে পারছে না। সামনের দিকে দেখতে ইশারা করলো। দেখি ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরির গেটে একটা ট্যাংক দাঁড়িয়ে নীচে তিনজন কালো পোশাক পরা সৈন্য। ইশারায় আমাদেরকে সামনে যেতে নিষেধ করছে। দাঁড়িয়ে পড়লাম। শাহবাগের দিকের রাস্তাটা ফাঁকা।
কাল রাতে বিদ্যুৎ বাসায় ফেরেনি, তারপর এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে – ওঁকে বল্লাম তুমি আজকে বাসায় যাও।
কোন রিক্সা নাই রাস্তায় ও হাঁটা ধরলো বাসাবোর বাসার উদ্দেশ্যে। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে ও আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। আমি উল্টো পথে হাঁটা ধরলাম বাসার দিকে। রাস্তায় কোনো মানুষ নাই, মানুষ নিশ্চুপ, মানুষ হতভম্ব।
আজ শুক্রবার।
(চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, আমেরিকা